কু ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক। জংশন স্টেশন থেকে বেরিয়ে শহরের ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে একটি ধাতব সরীসৃপ। স্টেশন চত্বর জুড়ে বসেছে বিকিকিনির পসরা । জনারণ্য। দূর থেকে সেই মায়াবী যন্ত্রদানবের হাতছানি শুনছে ছোট্ট ঝুমুর। রেল লাইনের ধার ঘেঁষে দাদুর হাত ধরে এগিয়ে চলেছে সে লাল- নীল- সবুজের হাটে। পথে যেতে যেতে জমে উঠেছে দাদু- নাতনির গল্পের ডালি। কখনো তার নিজের স্কুলের কথা কখনো বা তার বড় হওয়ার সময় পর্বের খুঁটিনাটি। দাদুর সব কথায় মন নেই তার, সে বরং চোখ ভিড়িয়েছে চলমান ঝাঁকামুটে, ধোঁয়া ওঠা কচুরি, সিম- পালঙের জমাটবাঁধা সবুজ আর হাড়- চুড়ি-মালার ঠিকরানো দ্যুতিতে।
কৈ গো আমাদের ছোট্ট মামনিটা কৈ?- তাকে খুঁজতে হইচই বাধিয়েছে বাড়িজুড়ে মামা- মাসির দল। ছোট্ট ঝুমুর তখন পুতুলের আসর জমিয়েছে বৈঠকখানা ঘরে। সঙ্গে জুটিয়েছে পাশের বাড়ি থেকে আসা অনু-রুনু- বুবুদের। ঘরের মধ্যে থাকা রেডিওটা একটানা বেজে চলেছে। মামার বাড়ি আসলে দিনের মধ্যে অনেকটা সময় সে এই ঘরটায় কাটায়। কখনো গান শোনে, পুতুল সাজায় কখনো বা দেওয়াল জুড়ে টাঙানো ছবিগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এ ঘরের দক্ষিণের দেয়াল জুড়ে রয়েছে একটি মানচিত্র, কবিগুরুর একটি ছবি ও কৃষ্ণ-অর্জুনের ছবি আঁকা গীতার সারাংশ। তার দিম্মা তাকে ওই ছবিটা দেখিয়ে মহাভারতের গল্পকথা শুনিয়েছে খানিক। সময় পেলেই সে আপন মনে গান গায় আর এ ঘর থেকে ও ঘর জুড়ে কি সব বিড়বিড় করে বেড়ায়! রাঙা দাদু বলে সে হলো প্রজাপতি সারা বাড়ি জুড়ে শুধু আলো ছড়ায়…।
রেলক্রসিং এ আটকে পড়া বোলেরো গাড়িতে বসে অনিতা সোম যেন মানসচক্ষে দেখছিলেন এই দৃশ্যগুলি। আজ বছর ২৫ পর এ শহরে পা রেখেছেন তিনি। দক্ষিণের একটি শহরে তিনি প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন একটি ওয়ার্কশপ পরিচালনায়। কিছুদিন থেকেই নিজের জন্ম ভিটেটা দেখবার বড় সাধ জেগেছিল তার। কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে তাই পাড়ি জমিয়েছিলেন একশ কিলোমিটারেরও বেশী দূরের এই মফঃস্বল শহরে। বংশের প্রথম সন্তান হিসাবে মামার বাড়িতেই জন্মেছিলেন কিনা! এখন স্বপ্নের এত কাছে এসে স্মৃতিগুলো যেন হামলে পড়ছে তার মস্তিষ্কের চোরাকুঠুরিতে। কতক্ষণে ছোঁবে সে স্বপ্নকে! আর কতক্ষণ! ভাবনার ঘোর কাটলো যখন হুইসাল দিতে দিতে চলে গেল ডাউন কাটোয়া লোকালটা। উঠল রেলগেট। চলতে শুরু করলো জনস্রোত।
২২-১০-২০২২। স্বনন্দিনী
Swanandini