বাবার সাথে বাজার করতে যেতে বেশ ভালো লাগতো। তবে ব্যাপারটা ছিল খুবই কষ্টকর। বাবার বাজার করার একটা নেশা ছিল। কোন্ জিনিসটা ভালো কোনটা ভালো নয়, কোন সবজি ভালো কী না কিভাবে বুঝতে হয়, তিনি খুব ভালো বুঝতেন। আমাদের শেখাবার চেষ্টাও যথেষ্টই করেছিলেন। কিন্তু আজও আমরা কোন ভাইবোনই সেটা শিখে উঠতে পারিনি। হয়তো সেভাবে শেখার চেষ্টাও করিনি, বা শেখার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করিনি।
প্রচন্ড অর্থকষ্টে আমাদের দিন কাটতো। তবে ওই অর্থাভাবের জন্য আমাদের আহারটা প্রায়শঃই বেশ রাজকীয় হতো। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, ঘটনাটা সত্যি। মাসের প্রথম সপ্তাহের পর থেকেই টাকা পয়সার অভাব দেখা দিত। তার অনেক কারণও ছিল, সে কথা এখন থাক, পরে সুযোগ হলে বলা যাবে। আর এই অর্থাভাবের সময়েই আমাদের অতিপ্রিয় খাসির মাংস ভাত খাবার দিন আসতো। বাজারে একটা মাংসের দোকান ছিল। দোকানের মালিক অতন্ত চতুর ও পাকা ব্যবসাদার ছিল। সে বাবাকে মাষ্টারবাবু বলতো এবং বাবাকে জোর করে মাংস চাপাতো। এক কিলোগ্রাম মাংস চাইলে, সে দেড়-দুই কিলোগ্রামের কম কিছুতেই দিত না। এইভাবে মাস শেষ হলে, তার প্রাপ্য মেটাতেই আবার অর্থাভাব, ফলে আবার খাসির মাংস ভাত।
একটা দিনের কথা বেশ মনে পড়ে। বাবার সাথে বাজারে গিয়ে, মাংস কিনে মহানন্দে ফেরার পথে একটা মিষ্টির দোকান থেকে এক ভাঁড় টক দই কিনে ফিরছি। আমার হাতে দই এর ভাঁড়। বাবার হাতে বাজারের ব্যাগ। রেল লাইনের পাশ দিয়ে আমরা বাসায় ফিরছি। হঠাৎ কিছু বোঝার আগেই আমার হাতের দই এর ভাঁড়, ছিটকে গিয়ে পাশের জঙ্গলে পড়লো। হতভম্ব ভাব কাটলে বুঝতে পারলাম, একটা চিল ছোঁ মেরে আমার হাতের দই এর ভাঁড় নেবার চেষ্টা করেছিল।
বাবা ছিলেন খুব খাদ্য রসিক। মা সারাদিন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মোচা, ডুমুর জাতীয় ঝামেলার পদ প্রায়ই করতে হতো। বাবা নিজে অবশ্য মা’কে অনেক সাহায্য করতেন। অদ্ভুত অদ্ভুত সব রান্নার প্রক্রিয়া তাঁর মাথায় আসতো। নিজেও মাঝে মধ্যে এক আধটা পদ রান্না করতেন। তবে অধিকাংশ সময়েই তাঁর সাহায্য, মা’র খাটুনি বৃদ্ধি ও ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়াতো। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে।
নারকেল কোড়া দিয়ে নারকেল নাড়ু করলে ছিবড়ে থেকে যায়, ফলে খেতে তত ভালো লাগে না। তাই নারকেল কুড়িয়ে, শিলে বেটে তবে নারকেল নাড়ু হবে। আর এই গোটা অধ্যায়টা তিনি নিজেই সামলাতেন। মা’র কষ্ট লাঘব করতে, সমস্ত কাজ নিজেই করতেন। কিন্তু তারপর শিল পরিস্কার, রান্নাঘর পরিস্কার, হাজারো বাসন পরিস্কার, মায় কড়াইয়ের পিছনের কালি পরিস্কার পর্যন্ত, মা’কে অন্যান্য কাজের শেষে করতে হতো।