অবিনাশ ঘোষ রজত রায়ের কথায় সন্মত হলেন না। তিনি মাথা নেড়ে বললেন , ” আমার দৃঢ় বিশ্বাস এটা আলঝাইমারের পূর্বলক্ষণ। আমার মাসতুতো দাদার শালার ভাইরাভাইয়ের মেয়ের কাকার শ্বশুরের হয়েছিল এ রোগ। প্রথম প্রথম পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে শিঁস দিতেন , তারপর পাড়ার মেয়েরা দিল রামঠ্যাঙানি, – যেটুকু স্মৃতি বাকি ছিল তাও গেল। তখন পাড়ার বাড়ি বাড়ি হেঁসেল খুলে খাবার খেয়ে আসতেন। সেবার হল কি… “
অবিনাশের অনন্ত কাহিনী রজত রায়ের হুঙ্কারে থেমে গেল ।
রজত রায় বললেন ,” থামুন তো মশাই ! আপনার ওই সন্মন্ধের বহর শুনেই আমার স্মৃতিও লোপ পাবার জোগাড় হয়েছে। এসব আপনার মতো রেলের টিটির কর্ম নয়। হরি ডাক্তারকে ডাকতে হবে। ওরে কে আছিস…
একজন যা তো বাবা হরি ডাক্তারকে ডেকে আন। বলবি উকিলবাবু ডেকছেন, খুব এমারজেন্সি।”
এক অত্যুৎসাহী যুবক দৌড়ে গেল হরি ডাক্তারকে ডাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হরি ডাক্তার এসে হাজির হলেন। তিনি এমনিতে হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করেন, তবে প্রয়োজনে অ্যালোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, সিদ্ধাইয়েও তার দখল যথেষ্ট। তিনি এও দাবি করেন যে আগমবাগীশ শ্রী শ্রী ১০৮ অঘোরানন্দের তত্ত্বাবধানে তিনি তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন।
এহেন হরি ডাক্তার এসেই রজত রায়ের মুখে থার্মোমিটার গুঁজে দিলেন। এরপর তার নজর গেল চাকলাদারের দিকে। তিনি চাকলাদারের দিকে তাকিয়েই একচোট হেঁসে উঠলেন, ” ওহে চঞ্চল, ওভাবে সাধনা হয় না। সাধনার জন্য চাই ভালো গুরু, যেমন আমার গুরু আগমবাগীশ শ্রী শ্রী ১০৮ অঘোরানন্দজী মহারাজ।” এই বলে তিনি দুই কানে হাত দিলেন।
রজত রায় মুখে থার্মোমিটার নিয়ে উঁ উঁ শব্দে কিছু বলতে চাইলেন, হরি ডাক্তার সে আবেদনে কর্ণপাত করলেন না। শুধু বললেন,” পাঁচ মিনিট। ” এ ঘটনায় উপস্থিত অন্যরা এতই হতচকিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা ডাক্তারের ভুল ধরিয়ে দেবার চেষ্টাও করলো না।
পাঁচ মিনিট পর থার্মোমিটার বের করে নিয়ে আঁতকে উঠলেন, ” ও মাই গড ! এ তো অনেক জ্বর। পুকুরে স্নান করেছিলে ?”
রজত রায় কিছু বলার আগেই হরি ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে দিলেন রজত রায়ের হাতে। ইঞ্জেকশনের ব্যাথায় কাতর হয়ে নার্ভাস রজত রায় বললেন, ” হ্যাঁ, সপ্তাহখানেক আগে। আপনার বৌমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম, রাস্তায় কোন শালা ইয়ে করে রেখে দিয়েছে ! পড়বি তো পড় ওই ইয়েতেই পা পড়ল। আপনার বৌমা স্নান না করে ঘরে ঢুকতে দিল না। “
হরি ডাক্তার বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললেন,”হুঁ.., এবার সামলাও ঠ্যালা। ওষুধ আমি দিচ্ছি, সাতদিন শুধু বার্লি নো অ্যানি খাবার। “
আসলে হয়েছিল কি এখানে আসার আগে হরি ডাক্তার গিয়েছিলেন এক জ্বরের রুগি দেখতে। জ্বর মাপার পর থার্মোমিটারে রিডিং থেকেই গিয়েছে। আর সেই রিডিংই রজত রায়ের জ্বরের প্রধান কারন। রজত রায়ের চিকিৎসা করার পর ব্যাগ গোটাতে গোটাতে বললেন,” তা চঞ্চল, কি সাধনা করছো তুমি ?”
চঞ্চল চাকলাদার হুশহাস শব্দ করে কিছু বোঝাতে চাইল, কিন্তু হরি ডাক্তার তো দুরস্ত কেউই কিছু বুঝতে পারল না। এতক্ষণে রজত রায় কঁকিয়ে উঠলেন ।
” আচ্ছা বেয়ারা ডাক্তার মশাই আপনি ! আমি ডেকে পাঠিয়েছি বলেই আমার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করতে হবে ! ওই দেখুন চাকলাদারের অবস্থা। সাধন ভজন নয়, ঠিকঠাক চিকিৎসা না হলে সাধনোচিত ধামে চলে যাবে চাকলাদার।”
এবার মুখ খুললেন অবিনাশ ঘোষ , ” আলঝাইমার হয়েছে মশাই, এ রোগ আমার মাসতুতো দাদার শালার… “
রজত রায় মাঝ পথে বাধ দিয়ে বললেন ,” ছাড়ুন আপনার মাসতুতো দাদার শালা, ডাক্তার কি মুখ দেখতে এনেছি ! ডাক্তারবাবু, দেখুন একটু ভালোকরে ব্যাটা হনুমান গেল কি রইল। “
হরি ডাক্তার রোগীর কাছে গিয়ে ভালোকরে পর্যবেক্ষণ করলেন। রোগী প্রথমে নার্ভস দেখাতে চাইল না, কিন্তু হরি ডাক্তার জেদী মানুষ তিনি জোর করে চাকলাদারের কব্জিটা টেনে নিয়ে নার্ভস পরীক্ষা করলেন।
এরপর হরি ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বললেন,” না, নার্ভস খুব চঞ্চল। বড় কোন রোগ না হয়ে যায় না।”
অবিনাশ ঘোষ জিজ্ঞাসা করলেন , “ডাক্তারবাবু, কি রোগ কিছু বুঝতে পারলেন !”
হরি ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলেন, “সে জেনে তুমি কি করবে বাপু।”
নাছোরবান্দা অবিনাশ ঘোষ বললেন , “তাও বলুন শুনি।”
হরি ডাক্তার স্টেথস্কোপটি কান থেকে নামিয়ে বললেন,” সিটিস্কপ। “
রজত রায় বললেন ,” আরেকবার ভালোকরে দেখুন ডাক্তারবাবু। “
হরি ডাক্তার স্টেথস্কোপটি আবার কানে পরে নিয়ে চাকলাদারের কাছে গেলেন। ভালোকরে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন চাকলাদারকে। চোখের পাতা আঙুল দিয়ে প্রসারিত করে পরীক্ষা করলেন। রোগীকে জিভ দেখাতে বললেও রোগী তা শুনল না।
হরি ডাক্তার যেই না স্টেথস্কোপটি চাকলাদারের বুকের উপর রেখেছেন অমনি একটা হাতখানেক লম্বা সাপ চাকলাদারের জামার ভেতর থেকে বেরিয়ে ভায়া স্টেথস্কোপ হরি ডাক্তারের পাঞ্জাবির ভেতরে ঢুকে গেল। চাকলাদার এক ছুটে আটচালা থেকে নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর হরি ডাক্তার চাকলাদারের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শি শি করতে লাগলেন।
উপস্থিত সবাই দেখেশুনে হকচকিয়ে গেল। হরি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ ঘোষ বললেন , ” ডাক্তারবাবু ! বলি ও ডাক্তারবাবু ! আছেন না টেঁশে গেলেন ?”
হরি ডাক্তার চিঁ চিঁ করে কি বললেন বোঝা গেল না। অবিনাশ ঘোষ হরি ডাক্তারের কাছে গেলেও খুব কাছে গেলেন না। তার ভয় হল যে চাকলাদারের থেকে হরি ডাক্তারের রোগসংক্রমণ হয়েছে, যদি তারও কিছু হয়ে যায় !
রজত রায় বললেন ,” একবার হাতিডোবার পঞ্চানন বটব্যালকে ডাকলে হয়। শুনেছি সে একদম ধন্বন্তরি।”
অবিনাশ ঘোষ বললেন , “কিন্তু উকিলবাবু, পঞ্চানন ডাক্তার কি আসবে ? আপনি তো জানেনই হাতিডোবার লোকেরা আমাদের অলীকপুরের লোকেদের খুব একটা সহ্য করতে পারে না। তারপরেও আপনি আশা রাখেন ?”
রজত রায় বললেন ,” তোমরা ডাক্তারবাবুর দিকে নজর রাখ, আমি আসছি। ” এই বলে কালবিলম্ব না করে রজত রায় বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
… চলবে