ছপ্পর সিং তার ইয়াব্বড় গোঁফে তা দিতে দিতে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিল, তারপর তড়াক করে উঠে পড়ল। এরপর ছপ্পর সিং বলল, ” মহান্তজী একটা আস্ত শয়তান। আমি নাকি ওর কাছে দীক্ষা নিয়েছি ! আমি নাকি বিবাগি হয়ে গিয়েছি ! অনেক বড় বড় কথা বলে বেড়ায় ব্যাটা, আজ আবার আমার ক্ষতি চেয়ে তন্ত্র মন্ত্র করছে ! ওর ব্যাবস্থা আমি করব। তুই বস আমি আসছি। “
ছপ্পর সিং যে কোথায় গেল তা খোচরটি জানে। তাই সে আর কথা বাড়াল না। মিনিট পাঁচেক পরেই পেট হাল্কা করে ছপ্পর সিং এল। খোচর বলল,” বটেশ্বর ওঝাকে ডেকেছে ওরা। বটেশ্বর বলেছে, এই বিধি সম্পূর্ণ হলেই ডাকু ছপ্পর সিং ফিনিশ ।”
ছপ্পর সিং এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। সন্মন্ধে বটেশ্বর তার ভাইরাভাই। বটেশ্বর যতবারই ছপ্পর সিংয়ের বাড়িতে আসত ততবারই ছপ্পরের নামে শ্যালিকার কানে বিষ ঢালত। আর পরিণামে ছপ্পরের দাম্পত্য কলহ চরমে উঠত। ছপ্পর সিং তাই বটেশ্বরকে দু’চোখে দেখতে পারত না। আজ খোচরের মুখে বটেশ্বরের কীর্তিকলাপ শুনে ছপ্পর সিং হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ” বটেশ্বরের মুণ্ডু নেব আমি। আমার সঙ্গে শত্রুতা ! এর দাম দিতে হবে ওকে।”
ছপ্পর সিং দলবল নিয়ে তৈরি হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করতে হবে। বটেশ্বর আর মহান্তজীকে ছাড়া যাবে না। রাঁধুনিরা রান্না বসিয়ে দিল। সকাল সকাল খেয়েদেয়ে তৈরি থাকতে হবে। মোটা মোটা লাল চালের ভাতের সঙ্গে আলুসেদ্ধ আর ভাতের মাড়। ছপ্পর সিং বন্দুকের নল পরিস্কার করতে বসল। দলের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। ছকুয়া গান ধরল। সবাই সঙ্গত দিল তাতে।
বহুতদিন বাদ সাজন আইলবা রে
পেড় পর মিঠিয়া আমিয়া পক গেইলবা রে।
সাজনবা হামার পকাই রোটি গোল গোল
খনকি চুড়িয়া উনকি, পল্লু দে দোল দোল,
মাইকে সে আয়ি লেকে চুড়িয়া রে।।
ছপ্পর সিং আর থাকতে পারল না। সেও গান ধরল,
কুন পাড়ার ছুঁড়ি রে তুর খুঁপায় গুঁজা ফুল
বুকে আমার মেরে দিলি ভালবাসার শূল,
ঠুঁটে রে তুর ঠুঁটপালিশ গালে রে তুর লালি
তুকে দেখে মনে পড়ে আমার ছুটু শালী।
শালী আমার ভরযুবতী উকুন বাছে বসে,
বিহানবেলা কেটে গেল সেই শালীর আশে।
মুড়ির সাথে আলুভাজা আর সাথে পেঁয়াজ কাঁচা
মু’য়ের গন্ধে রয় না শালী, বেথাই আমার বাঁচা।
শালীর বাড়ি মল্লারপুর ট্রেনে বাসে ভিড়
হেঁটে হেঁটে চলে যাব আমি মারাং বীর হে
আমি মারাং বীর।।
– – ৬–
অলীকপুরে টেনশনের শেষ নেই। রজত রায় পায়চারি করছেন ।চোখে মুখে তার টেনশনের ছাপ স্পষ্ট। পায়চারি করছেন আর বিড়বিড় করছেন, ” ছেলেটাকে হাতিডোবায় কি কুক্ষণেই না পাঠালাম ! ওর মাকে এবার আমি কি জবাব দেব ! হে ভগবান, আমার মাথায় আর কিছু আসছে না।”
হরি ডাক্তার এখন সুস্থ্য। তিনি বললেন, ” তুমি চিন্তা কোরো না বাবা রজত, তোমার ছেলেকে ছাড়িয়ে আনবার দায়িত্ব গোটা অলীকপুরের। মাথা ঠান্ডা করো। কিছু একটা উপাই বেরোবই। “
-” না ডাক্তারবাবু, শান্ত হতে পারছি কই ! আপনার বৌমাকে আমি কি জবাব দেব বলুন তো। “
-” আমি সব বুঝতে পারছি। বৌমার সঙ্গে আমি কথা বলব।”
রজত রায়ের সঙ্গে যখন হরি ডাক্তারের কথোপকথন চলছে তখনই দৌড়তে দৌড়তে হাজির হল চাকলাদার। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি বললেন,” খবর আছে, একটা খারাপ খবর আছে। “
রজত রায় আর হরি ডাক্তার একসঙ্গে বলে উঠলেন,” কি খবর… “
চাকলাদার বললেন,” আমার কাজের মেয়েটার স্বামী ছপ্পর সিংয়ের ডাকাতদলে রান্না করে। কাজের মেয়েটাই আমার বৌকে বলেছে, ছপ্পর সিং হাতিডোবায় আক্রমণ করবে। পাক্কা খবর।”
হরি ডাক্তার একটু হতাশ হয়ে বললেন,” এতে খারাপ কি ? হাতিডোবা আমাদের শত্রু। ওদেরকে শিক্ষা দেওয়া দরকার।”
চাকলাদার বলল,” এতো সহজ নয় ডাক্তারবাবু, সাহেবকে ওরা তন্ত্রমতে বলি দেবে। “
রজত রায় শোনামাত্র অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হরি ডাক্তার বললেন,” উকিলকে জাগাও। আজই আমরা হাতিডোবা আক্রমণ করব। আমি ষণ্ডাগুণ্ডা দেখে লোক বেছে রাখছি। এতবড় সাহস হাতিডোবার ! “
হরি ডাক্তার চলে যান। চাকলাদার রজত রায়ের চোখে মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন। সারা গ্রাম সাহেবকে বাঁচানোর জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠে।
এদিকে হাতিডোবায় সাহেবের দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছে তিন্নির উপর। তিন্নি একটু বেশিই যত্ন রাখছে। আজকের অলীকপুর অভিযানে সাহেবকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে মহান্তজী আর কর্ণেলের মধ্যে একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেছে। অবশেষে ঠিক হয়েছে সাহেবও সঙ্গে যাবে। হাতিডোবার দাবিদাওয়া মেনে নিলে সাহেবকে অলীকপুরের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
…. চলবে