সুভাষখুঁড়ো একগাছা দড়ি এনে সাহেবকে চণ্ডিমণ্ডপের থামের সাথে বেঁধে ফেললেন। সাহেব কাঁদতে কাঁদতে বাবার মুখে শোনা চাকলাদার আর হরি ডাক্তারের সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলল।
সবকিছু শুনে রসিকদাদু বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললেন,” কেস তো সিরিয়াস ! কিন্তু পঞ্চানন ডাক্তার তো যাবে না।সেবার পদা নাপিতের উরুস্তম্ভ হল, হরি ডাক্তারকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম, অলীকপুরের লোক আসতে দেয়নি।”
মহান্তজী বললেন, ” নৈব নৈব চ। অলীকপুরের কাউকে সাহায্য করা যাবে না। আর তোমরা সে চেষ্টা করলে আমি অনশনে বসব।”
মহান্তজীর দিকে সকলে সভয়ে তাকাল। কারণ এর আগেও অনেক আলতু ফালতু কারনে মহান্তজী অনশনে বসেছেন, আর প্রতিবারই কোনো না কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। এই তো আগের বছর রাসপূর্ণিমার সময় মহাপ্রসাদে লুচি না ভাত কি হবে তা নিয়ে বিবাদ বাধল। মহান্তজী ভাতের পক্ষে আর রসিকদাদু লুচির পক্ষে। শেষে জনসমর্থন না পেয়ে মহান্তজী অনশনে বসলেন। অবশেষে গ্রামের সবাই মহান্তজীর কথা মেনে নিতে বাধ্য হল। রান্নার ঠাকুর ইতিমধ্যেই ময়দা মেখে ফেলেছে। ফলে কেজি চল্লিশেক ময়দার লেই গরু-ছাগলের পেটে গেল।
রসিকদাদু বললেন, ” তোমরা শান্ত হও। মাথা খারাপ করো না। শত্রুতা দু’গাঁয়ের মধ্যে, কিন্তু তাবলে বিবেক মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে নয়। অলীকপুরের লোককে আমরা দেখিয়ে দেবো যে মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে আমরা ওদের থেকে অনেক উঁচুতে।”
আজ আর মহান্তজীর অনশনের ধমকি কোনো কাজে দিল না। উপস্থিত সবাই রসিকদাদুর কথা মেনে নিলো। একজন গেল পঞ্চানন ডাক্তারকে ডাকতে।
সুভাষখুঁড়ো বললেন,” আমার একটা প্রস্তাব আছে। “
সবাই সমস্বরে বলল,” বলুন.. “
সুভাষখুঁড়ো বললেন,” দেখো, বিপদের দিনে আমরা পাশে দাঁড়াবো ঠিক আছে কিন্তু শত্রুকে বিশ্বাস নয়। ছেলেটাকে আমাদের হেফাজতে রাখা হোক। ডাক্তারবাবু যাবেন অলীকপুর আর তার জমানত থাকবে ছেলেটা। এবার বলো তোমরা রাজি কি না। “
সকলে জানাল তারা রাজি। বিশেষত হরিদাস মহান্ত খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন,” আমার আশ্রমেই থাক ছেলেটা। আমি কথা দিচ্ছি কোনো অযত্ন হবে না। “
মহান্তজীর এই প্রস্তাবের পিছনে একটা গূঢ় কারণ ছিল। অনেকদিন হয়ে গেল মহান্তজীর পূর্বাশ্রমের পত্নী মায়ার কোনো খবর তিনি পান নি। হাজার বৈরাগ্য হোক পুরানো প্রেমের আগুন ( দাম্পত্যে কি প্রেম কি অপ্রেম বলা শক্ত ) এখনো নিভে যায় নি। সাহেবকে আশ্রমে রেখে মায়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নেবেন।
এসব কথাবার্তা যখন চলছে ঠিক সেসময় পঞ্চানন ডাক্তার এসে হাজির। তাকে সমস্ত বৃত্তান্ত বলা হলে তিনি বললেন, ” ডাক্তারি যখন জানি তখন যাওয়াটা কর্তব্য। তাছাড়া অলীকপুরের লোকদেরও জানানো উচিত যে হাতিডোবাকে ছাড়া অলীকপুর অচল।”
পঞ্চানন ডাক্তাররের কথায় সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। পঞ্চানন ডাক্তারর ব্যাগপত্র নিয়ে অলীকপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সাথে গেলেন রসিকদাদু।
রাস্তায় যেতে যেতে দুজনে অলীকপুরের সাম্প্রতিক ঘটনা বিষয়ে অনেক আলোচনা হল। দুজনে ধীর পায়ে এগিয়ে চলতে লাগলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা জগদীশ দারোগার জিপ দেখতে পেলেন। রসিকদাদু ঘুমন্ত ড্রাইভারকে লাঠি দিয়ে এক খোঁচা মেরে বললেন, “ডিউটিতে মে ফাঁকি দেতা হে !”
ড্রাইভার খোঁচা খেয়ে মিটমিট করে তাকিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
রসিকদাদু আর পঞ্চানন ডাক্তার আবার হাঁটতে লাগলেন। রাতের পথ, আর দুজনেই বয়স্ক তাই একটু ধীরে পথ চলছেন দুজনে। একটা কালপেঁচা কর্কশকণ্ঠে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে গেল। রাস্তার দু’পাশ থেকে অজস্র ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেঁসে আসছে। কতগুলো মেঠো ইঁদুর চিঁচিঁ শব্দ করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রচণ্ড হাওয়ায় গা শিরশির করছে। রসিকদাদু চাদরটা গায়ে ভালোকরে জড়িয়ে নিলেন। পঞ্চানন ডাক্তার বললেন, ” বুঝলেন রসিকবাবু, ডাক্তারি করা যার তার কর্ম নয়, রীতিমতো এলেম লাগে। ওই হরি ডাক্তার আমার নামে আকথা কুকথা বলে বেড়ায়, আর কপাল দেখুন আজ সেই হরে গাঁটকাটাই আমার খপ্পরে !” এই বলে পঞ্চানন ডাক্তার একচোট হেঁসে নিলেন ।
ক্যানেলের ব্রিজের কিছুটা আগে রসিকদাদু কিসে যেন একটা হোঁচট খেলেন। ” ওরে মা গো ! বাবা গো ! আমি একেবারে খুন হয়ে গেলাম রে ! ” এই বলে রসিকদাদু মাটিতে পড়ে গেলেন।
পঞ্চানন ডাক্তার টর্চের আলো ফেলে দেখলেন রসিকদাদু একটা মাঝারি মাপের ইঁটের টুকরোতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছেন। তিনি রসিকদাদুর হাত ধরে টেনে তুললেন। রসিকদাদু উঠেই আবার গুঁড়ি হয়ে পাটকেলটা তুলে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিলেন। বললেন,” কি, ঠিক করলাম কিনা বলুন ! কে কখন রাস্তা পার হতে গিয়ে হোঁচট খায়, তাই ফেলে দিলাম।”
পঞ্চানন ডাক্তার মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন। কিন্তু সবার ধাতে সৎকর্ম সয় না। রসিকদাদুরও কপালে পরোপকার সইল না। ঝোপে প্রাতকৃত্য সেরে জগদীশ দারোগা পুকুরে শৌচে গিয়েছিলেন। শৌচ সেরে যেই উঠতে যাবেন অমনি কোথা হতে একটা পাটকেল এসে লাগল কপালে। জগদীশ দারোগা ঝপ করে জলে পড়ে গেলেন। কোনোক্রমে উঠেই যেদিক হতে পাটকেলটা এসেছে সেদিকে দৌড় লাগালেন।
রাস্তার উপরে উঠে জগদীশ দারোগা দেখলেন দু’জন লোক খোশগল্প করতে করতে যাচ্ছে। জগদীশ দারোগা বুঝে গেলেন যে এরাই সেই আততায়ী । রিভলভারটা উঁচিয়ে ধরে দুজনের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
” হ্যাণ্ডস্ আপ ! নড়েছ কি মরেছ। ধাঁই ধাঁই করে গুলি চলবে। বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবারে ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ।”
রাস্তার মাঝখানে পঞ্চানন ডাক্তার আর রসিকদাদু দুই হাত তুলে গৌর নিতাই হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। রসিকদাদুর হাত হতে লাঠি খসে পড়ে রাস্তায়। রসিকদাদু কাতর কণ্ঠে বললেন,” হেই ডাকাত বাবা, আমরা ঘুঘু নই। আমাদের মেরো না। “
জগদীশ দারোগা রিভলভার নাচাতে নাচাতে বললেন,” কি.. কি বললি ব্যাটা আমি ডাকাত। চল একবার থানায় তোকে বোঝাবো ডাকাত কাকে বলে।”
পঞ্চানন ডাক্তার রসিকদাদুর গা-ঘেঁষে দাঁড়ান। তিনি ভয়ে ভয়ে মিনমিন করে বলেন, ” অন্ধকারে কিচ্ছু ঠাওর হচ্ছে না বাবা। আমরা দুজনেই সিনিয়ার সিটিজেন, আমাদের মেরো না।”
জগদীশ দারোগা এবার আরো রেগে গেলেন। তিনি বললেন,” সিনিয়ার সিটিজেন হও আর জুনিয়ার সিটিজেন হও কাউকে ছাড়ব না। দু-দুবার আমার মাথায় ঢিল মারা হয়েছে, আমি শোধ তুলবই।”
রসিকদাদু সাহসে ভর করে বললেন,” দুবার নয়, একবার আমি ঢিল ছুঁড়েছি।.. তাও ভুল করে। মাফ করে দাও বাবা।”
দু’পক্ষের বাগবিতন্ডা যখন চলছে তখনই একটা তীব্র আলো এসে জগদীশ দারোগার মুখের উপর এসে পড়ল। তীব্র আলোতে রসিকদাদু আর পঞ্চানন ডাক্তার দেখলেন সামনেই দাঁড়িয়ে রিভলভার হাতে জগদীশ দারোগা। তীব্র আলোর ঝলসানি কাটিয়ে উঠতেই জগদীশ দারোগা দেখলেন তার রথ সামনে দাঁড়িয়ে। জিপ হতে ড্রাইভার নেমে এসে বলল, “গাড়িটা হঠাৎ করে স্টার্ট হয়ে গেল দারোগাবাবু।”
.. চলবে