– কেমন আছো ?
– চিনতে পারোনি নিশ্চই !
– আরে না চেনারই কথা, তোমার জীবনে খুব একটা বিশেষ ভুমিকা তো ছিলনা আমার। কোন এক বসন্তে এসেছিলাম। তারপর পাতাবাহার এর সব রঙিন পাতাগুলো এক এক করে বিবর্ণ হতে লাগলো আর ঝরে পড়তে লাগলো। মিলিয়ে গেল শেষে। জল দেওয়াও হয়নি আর , শুকনো খটখটে একটা দন্ডের মতো বিশ্রী চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে থাকা একটা গাছ, কারো চোখেও পড়েনা সেরকম ভাবে।
আলগোছেই কথাগুলো বলে চলেছে অর্নিবান। স্টেশনে এতো লোকজন, কুলি হকার থেকে সাধারণ মানুষ সবাই ঘুব ব্যাস্ত , থমকে গেছে শুধু অনি।
সামনের ইউক্যালিপটাস গাছগুলোকে আজ অনেক ছোট্ট লাগছে, এতো চিৎকার চেচামেচি সব কেমন যেন কানে আসছে না, বধির লাগছে নিজেকে। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
পাশের সমস্ত কিছুই খুব দ্রুত গতিতে ধাবমান। বড্ড বেশি আবেগঘন লাগছে নিজেকে। অর্নিবান এমনিতেই খুব বেশি ইমোশনাল, একটুতেই চোখ দিয়ে জল চলে আসে, তারপর এরকম একটা পরিস্থিতি।
হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ আর কাঁধে শান্তিনিকেতনী একটা ব্যাগ। চোখের চশমার ফ্রেমটাও একই রকম আছে তিয়াসের । কিচ্ছু পরিবর্তন হয়নি এই ৯ বছরে।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে যেমনটি দেখেছিলাম ঠিক সেরকমই আছো। বয়সটাও একটু ও বাড়েনি মনেহচ্ছে। কারন তখনও কার্টুন দেখতে আর এখনো দেখো, ব্যাগের মধ্যে কার্টুনের ছবিগুলো তার ই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
– যাইহোক , তোমায় খুব মিষ্টি লাগছে তিয়াস। এখোনো তুমি অনন্যা।
– এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না। এখনো কি ফ্লার্টিং করবে নাকি ! তিয়াস একটু হাসি দিয়ে কথাটা বললো অর্নিবানকে ।
– এ’মা আমি একদম ইয়ার্কি করছিনা। বিস্বাস করো আই এ্যম সো সিরিয়াস।
– তুমি অনেকটাই চেঞ্জ হয়ে গেছো অনি। তখনকার সেই প্রেমিক প্রেমিক লুকটা আর নেই। অনেকবেশি ম্যাচিওর লাগছে তোমায়। গাল ঢেকেছে কাঙ্খিত চাপ দাড়ি। সার্ট এর কালার গুলো অনেক হালকা। এবং অবশ্যই অনেকটাই মোটা হয়ে গেছো।
– ভাবতে অবাক লাগছে না তিয়াস আজ প্রায় নয় বছর পর আমাদের দেখা। ভেবেছিলাম পৃথিবী যখন গোলাকার তখন এই পৃথিবীর আনাচে কানাচে কোথাও না কোথাও ঠিক দেখা হয়ে যাবে আমাদের। তবে এতোটা তাড়াতাড়ি কোথাও সেটা ভাবিনি।
মাথায় সিঁদুর, হাতে শাঁখা সাথে কয়েকটি বাচ্চা, আর কোনো কাকু মার্কা টিপিক্যাল হাসব্যান্ড ঠিক এরকম ভাবেই দেখা হবে কোনো ব্যাস্ত স্টেশনে। দূর থেকে দেখবো আর চলে যাব, এমনটা ছিল ভাবনায়।
এতো সুন্দর এতো চার্মিং লুকে অবিবাহিত অবস্তায় যে তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে এটা কাঙ্খিত ছিল না।
– অনেক গুছিয়ে, কাব্য করে কথা বলতে শিখেছো অনি। তোমাকে আমার বড্ডো অচেনা লাগছে। কলেজের সেই চুপচাপ একা একপাশে বসে থাকা অর্নিবান এর সাথে এই অর্নিবান এর কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না আমি।
কি’করে এতোটা পরিবর্তন হলো তোমার ?
– তিয়াস, সূর্য ওঠার আর অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীতে দিন রাত্রির পরিবর্তন হয়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির অবয়ব পরিবর্তন হয়, আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিবর্তন হবে এটাই কি স্বাভাবিক নয় !!
– আবার সেই কাব্য করা বলা। উফফ্ । যাইহোক, বুঝলাম ম্যাচুওর হয়েছো অনেকটাই। শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে মানিয়েছে তোমাকে।
তা এখোনো বিয়ে-থা করোনি কেন!
– তোমার জন্যেই তো অপেক্ষা করে আছি। একগাল হেসে উত্তর দিল অনি।
– এই সবসময় ইয়ার্কি করোনা প্লিজ। ভালো লাগেনা আমার।
– আমি একটু ও ইয়ার্কি করছিনা তিয়াস।
তুমি রাজি থাকলে তোমাকে বিয়ে করতে আমার কোনো অসুবিধে নেই।
লজ্জায় তিয়াসের মুখখানা যেন আরও লাল হয়ে উঠল। মুখ নিচুকরে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াস।
অদ্ভুত এক খুশিতে মনটা ভরে গেল অনির। সেই কলেজের প্রথম দিন থেকে যাকে ওর ভালোলাগে, যার জন্য এতোটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে। প্রেম হয়েও যেন হয়নি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে তখন জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে নিজের প্রেমকে। আর সেই তিয়াস কেই আজ এতো বছর পর ফিরে পেয়েছে, আবার তাকেই জীবন সঙ্গী করে জীবনপথ পাড়ি দেওয়ার কথা বলতে চলেছে। তাহলে কী ইশ্বর সত্যি সত্যি আমার অন্তরাত্মার কথা শুনেছেন !!
তিয়াসের থেকে উত্তর যাই আসুক না কেন , আমি জানাতে তো পেরেছি, এটাই বা কম কিসের।
ক্রমশ সন্ধ্যে নেমে এসেছে..
দিনের শেষ আভা তিয়াসের চুলে এসে পড়েছে, মনে হচ্ছে যেন গত কোন শতাব্দীর হারিয়ে যাওয়া কোনো এক মাধবীলতা তার প্রেমিক এর জন্য এখানে অপেক্ষা করছে।
আকাশটাও গাঢ় একখানা হলুদ রঙের শাড়ি পরে নবদম্পতির জন্য সুন্দর একটি বাসর রচনা করেছে। ইউক্যালিপটাস গাছের পাখিদের কলতান যেন এক সুমিষ্ট সঙ্গীত পরিবেশন করে চলেছে সেই বাসরে।
গ্ৰাম্য স্টেশন, ধীরে ধীরে একদম ফাঁকা হয়ে আসছে। আলোগুলো এক এক করে জ্বলে উঠছে…
অর্নিবান এর বুকে মাথা রেখে তিয়াসের তার ভাবী জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল ক্রমশ। অর্নিবান এর দুচোখে তখন আনন্দের অশ্রু …..