পেটানো চেহারা। লোহার মতো শক্ত। ৪২ ইঞি ছাতি।২৬ ইঞি কোমর। চওড়া কাঁধ। ছ ফুট লম্বা। বয়স আশির ওপর। পরনে ধূতি পাঞাবি। মন্দিরের প্রথম সিঁড়িকে প্রনাম করে মন্দিরের ওপর চাতালে এলেন জীবনলাল। ডানদিকে দেওয়ালে মাথা ঠুকলেন কালীর কাছে। বাঁ দিকে জোর হাত রাধাকৃঞ যুগল মূর্তিতে। এরপর সোজা শিবঘর। সেখানে মাথা রাখলেন শিব লিংঙের ওপর। ঘন্টা বাজালেন।বেরিয়ে এসে বাঘের চামড়ার আসনে বসলেন। পদ্মাসনে। এক সময় ব্যায়াম যোগা করতেন। হনুমান চল্লিশা পড়লেন। মন্দির সংলগ্ন স্কুল। বিশ্বনাথ বিদ্যা মন্দির। মাঝখানে কলাপসিবেল গেট। এখন টিফিন চলছে। বাচ্চরা হৈচৈ করছে। তিনি একটু ধমক দিলেন। বাচ্চারা কিছু সময় শান্ত থাকলো। তারপর আবার হৈচৈ। তিনি এবার ডাক দিলেন – – – যোগেন।
ডাক তো নয়। ইন্দিরের বজ্রধবনি।যোগেন বের হবে হেড স্যার বললেন–যোগেন তুমি কার কাছে কাজ করো?
–স্কুলে।
–ফাইলটা বের করেছো?
–পাচ্ছি না। দেখছি।
-আগে ফাইল তারপর জীবনলাল।
–আমার কাছে আগে জীবনলাল। উনি এখানে আমাকে চাকরি দিয়েছেন। তখন স্কুল সরকার অনুমোদন দেয়।নি। আজ আমি সরকারি চাকরি করি।
–কি ব্যাপার?
-এই স্কুল উনি প্রতিষটা করেছেন।
আর কথা না বাড়িয়ে জীবনলারের জন্য দ্রুত চা আর বিস্কুট নিয়ে আসে যোগেন।
চা খেতে খেতে জীবনলাল বলেন–ছেলে এখন কেমন আছে? জ্বর কমেছে?
–হ্যাঁ ।
–মেয়ে কোন ক্লাস?
–এইট।
–মেয়ে বড় হচ্ছে। সাবধানে রাখবি। চারপাশে অনেক রাখস।
চা পর্ব শেষ।
###
যোগেন দোতলার সিঁড়িতে বসে বিড়ি টানছে। কানে আসছে বেহালার সুর। কেন যে মানুষটা এই একটা সুরই বাজিয়ে যায়, কে জানে। বুকের ভিতরটা শূন্য করে দেয়। সংগে আরো একজন ছিল। বিরজুলাল।দুজনে এক সুর তুলতো। যোগেন এই সুরের কিছু বোঝে না। সে তখন টিফিনের নাম করে বেরিয়ে যেত। যেদিন পারত না সেদিন ঐ জোরা সুর তার বুক ভেঙে দিতো। বিরজুলাল মারা গেছে। শ্মশানে যান নি জীবনলাল। সেদিনও বেহালাতে বিদায়ের সুর। যোগেন নতুন করে বিড়ি ধরায়। কি মানুষ ছিলেন জীবনলাল, কি মানুষ হয়ে গেলেন।
ছিলেন পঞ পান্ডব। জীবনলাল,
শান্তীলাল, মদন লাল, গোরাচাদ, বীরেশ ধর।
এরা খাল ধারে চলে যেত। ওপারে রেল ইয়াড। পর পর মাল গাড়ি। তার তালা ভেঙে মাল লুঠ করতো। এভাবে সকলে বেশ সম্পদ করে ও লাইন ছেড়ে দিল। বাড়ি আর কারখানা করেছেন জীবনলাল। এই অঞ্চলে তখন পঞ পান্ডবদের দৌরাত্ম্য। বেশ বড় করে কালী পূজো হতো। কাঙালি ভোজন, গরীরদের বস্ত দান, জলসা হতো। পাঁচ দিনের ঠাসা অনুষ্ঠান। যোগেন এসব শুনেছে। এখন সারাদিন মন্দির নিয়ে পড়ে থাকেন জীবনলাল। রাতে আর দুপুরে খেতে যান। স্ত্রী আছেন। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছেন। এক ছেলে কারখানা দেখে। তার কাছে এখন ঘর বাড়ি মন্দির।
–যোগেন।আবার ডাক পড়ে। যোগেন ছুটে আসে।
–বিল বইটা নে। সামনে শিব রাতি। তাড়াতাড়ি চাদা তুলে আনবি।
যোগেন জানে এই 25 পাতার বিল বই থেকে তিরিশ হাজার আসবে। জীবনলালের শিব পূজো।এখানের সব ব্যবসায়ী জানে। শিব রাতে এই মন্দিরে সব চেয়ে ভিড় হয় বেশি। তখন মানিকতলা থানা থেকে দুজন কনস্টেবল আসে। ভিড় সামাল দিতে। মন্দির তখন ফুলে আলোতে ঝলমল করে। জীবনলাল বসে দেখে আর আত্ম সুখ অনুভব করেন। জীবনলাল পুলিশের রাইফেল ছিনতাই করেছিল। করেছিল ডাকাতি। মন্দ জায়গায় গেছেন। কিন্তু মন্দির প্রতিষ্ঠা করার পর ঐ জীবন ত্যাগ করেছন। তিনি যোগেনকে বলেন–নারী তোমাকে মুক্ত দিতে পারবে না। দিতে পারবে না সুখ। তবু মানুষ কেন যে তার পিছনে ছোটে কে জানে? জীবনে যদি তুই সুখ আনন্দ চিরকালের জন্য পেতে চাস তবে তোকে ঈশ্বরের কাছে ফেলে দিতে হবে নিজকে।
শীতাংশু ঐপথ দিয়ে যাচ্ছিল। জীবনলাল ডাকলেন। সাইকেল থামলো। – – এদিকে তো আসিস না আর। তা ভালো আছিস তো?
–হ্যাঁ ।
–শোন সামনের মাসে কাঙালি ভোজন আছে। তূই 30 কে জি চাল দিবি।
–আচ্ছা ।দেব।শীতাংশুর পৈতিক বাড়ি মন্দিরের পাশে। তার বাবা যখন এই বাড়িটা কেনে তখন জীবনলাল টাকা চেয়েছিল। বাবা খুব বড় একটা ঘন্টা দিয়েছিল। এখনও সেই ঘন্টা ঝুলছে। একটি মেয়ে শিব পূজো দিয়ে সেই ঘন্টা বাজাছেএখন। আকাশে বাতাসে তার শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে। শীতাংশুর মনে হলো, এটা ঘন্টা ধ্বনি নয়। এই ধ্বনি জীবনের ধ্বনি। এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাত্রার ধ্বনি।