——হ্যালো!
——কী স্যার! বলুন !
——খুব গোপন একটি কথা। শোনো। এবছর তোমাকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। জানো তো কত লাখ ?
——আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, স্পষ্ট করে বলুন।
——এই সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার। বর্তমানে কত লাখ জানো ? না, থাক্, জানতে হবে না । শুধু একটা শর্ত আছে তোমার সঙ্গে।
——কী শর্ত স্যার ?
——পুরস্কারের টাকাটা তোমাকে সিকি ভাগ দেওয়া হবে। বাকিটা আমাদের কমিটির।
——তাতে আমার লাভ ?
——লাভ তো বিশাল। তোমার নাম খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ বের হবে। রাতারাতি তুমি বিখ্যাত হয়ে যাবে। হু হু করে তোমার বই বিক্রি হবে। বই বিক্রির যে রয়্যালিটি পাবে তা তো পুরস্কারের টাকার কয়ক গুণ। জানো ?
——আমি তো আনন্দে শিউরে উঠছি।
——হ্যাঁ, কেউকে প্রকাশ কোরো না। প্রেমিকাদেরও না।
——ঠিক আছে, কথা রইলো। শুভ রাত্রি ।
কবির রাত্রি “শুভ” হয়ে গেল। কথা কটি শুনিয়ে দিলেন বন্ধুবর। যথারীতি পুরস্কার পেলেন। সিকিভাগ টাকাও পেলেন। পুরস্কৃত বইটির বহু সংস্করণ হল। সবাই পড়ে দেখল, না! একখানা বই লিখেছে বটে !
আমার পঁচাত্তর বছরের মাস্টার মশাই বইটি পড়ে বললেন, ছিঃ! শুধু রগরগে যৌন সুড়সুড়ি। এ বই পুরস্কার পায় কী করে ?
আমাকে নিয়ে একটা পত্রিকার সংখ্যা করো। দীর্ঘদিন থেকে লিখছি। তোমাদের পত্রিকার বেশ নামডাক আছে। হ্যাঁ, আমি খরচ বাবদ ২৫ হাজার টাকা দেবো। পত্রিকা বিক্রি করেও তোমরা অনেকটা তুলে নিতে পারবে।
আমাকে কবি বলে মনে করো না তোমরা ? আজ অবধি আমাকে নিয়ে একটাও কিছু লেখোনি। তোমাদের এত লেখা প্রকাশ করলাম! এ টুকু আশা করতে পারি না?
হ্যালো, এই সংখ্যা “স্ট্রিটে” তোমার কবিতা থাকছে। একটা কাজ কোরো, আমার এই মোবাইল নম্বরে ২৫০ টাকা রিচার্জ করে দিও। কথাটি কেউকে বোলো না কিন্তু।
কবি! আমি খুব বিপদে পড়েছি, হাজার খানেক টাকা আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দিও। খুব তাড়াতাড়ি। কলকাতায় থাকি। বুঝতেই পারছ শরীরটা ভালো নেই। পত্রিকা করাও বেশ ঝক্কি।
——আমি “আয়ুদ” পত্রিকায় কি লেখা পাঠাতে পারি ?
——অবশ্যই পাঠাবেন । আমরা তো লেখা চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছি।
লেখা পাঠানোর দুই মাস পর…..
——হ্যালো, আপনার প্রবন্ধটি মনোনীত হয়েছে। আমাদের সম্পাদক গোষ্ঠীর ভালো লেগেছে। তবে প্রবন্ধটা অনেকটা বড়ো, প্রকাশ করতে খরচ আছে। আপনি আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দু হাজার টাকা খুব শিগগিরই পাঠান।
আমাদের প্রকাশনা থেকে বই করুন। পনেরো হাজার টাকায় ৩০০ কপি। আমরা লেখককে ২০০ কপি দেবো। ৬৪ পৃষ্ঠার বই । এখান থেকে বই করলে আমাদের ম্যাগাজিনেও আপনার লেখা ছাপানোর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এইসব নিয়ে কি প্রবন্ধ লেখা চলে? যত সব কাল্পনিক মনগড়া কথা! কোনওটার কি কোনও তথ্য প্রমাণ আছে ? তথ্যসূত্র উল্লেখ না থাকলে প্রবন্ধ হয় না। কী সব আজেবাজে লিখলেন মশাই ? বাংলা সাহিত্য সাফ সুতরো, সুন্দর। সাহিত্যিকগণ মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এঁদেরকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা ? জীবনানন্দ দাশ তাঁর সময়কালে কবি বলে খুব একটা সম্মান পাননি।
তাঁর লেখা প্রবাসী দফতর থেকে কতদ ফিরে এসেছে। অন্যান্য পত্রিকাতেও তেমনভাবে ছাপা হয়নি। মৃত্যুর পরই তাঁর সঙ্গে কবিদের পরিচয় হল। তাঁর সময়কালে যাঁরা বেশি সম্মানিত হয়েছিলেন, মানুষ ক্রমশ তাঁদের ভুলে গেল। আজ যাঁরা সম্মানের জন্য, যশের জন্য, খ্যাতির জন্য এবং অর্থের জন্য বিখ্যাত ——আগামী দিনে তাঁদের পরিণতি কী তা কি কেউ বলতে পারে ?
এসব কথা ঠিক, কিন্তু এত পঙ্গপালের ভিড়ে প্রকৃত প্রতিভা কি মারা যাচ্ছে না ? কলকাতায় বসবাস না করলে, টাকা না থাকলে, বই ছাপাতে না পারলে, সম্পাদককে শরীর বা টাকা না দিতে পারলে ——সেই কবি যে এই সমাজে মানসম্মান পাবেন একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কষ্ট হয় তখনই, যখন রবীন্দ্রসদনে দাঁড়িয়ে সত্তর দশকের বহুল প্রসবা এক কবি আমাকে বললেন, নিজের পত্রিকায় কার লেখা ছাপব, কার ছাপব না সেসব আমার ব্যাপার। নিজের পাঁঠা আগায় কাটব না গোড়ায় কাটব তা আমিই ঠিক করব।
তখন সেই কবির উপর একজন গ্রামীণ কিশোর কবির কি কোনও সমীহ থাকবে ? অবাক হয়ে কথাটি বহুদিন ভেবেছি। দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে। তারপর বহুপথ অতিক্রম করে এই তথ্যসূত্রবিহীন প্রবন্ধটি লিখলাম। পাঠককে বিশ্বাস করার জন্য মাথার দিব্যি দিচ্ছি না।