স্পর্ধিত বিশ্বাসে //সুচন্দ্রা হালদার
যে সব কথা বলা হয় না….
যে ছবিগুলো ছোঁয়া হয় না…
রোজ রাতে,
রাত জেগে সেগুলোই উগড়ে দিই খাতার পাতায়।
ধরতে চাই পেন্সিলের টানে।
সকালের ব্যস্ততা এসে চুরি করে নেয় সবটুকু ভালোলাগা।
সারাদিন… শুধু সময়ের অভ্যাস।
তবু মাঝে মাঝে,
পিছু টানে খাতার পাতার মূহুর্তগুলো।
যদি বলতে চাই…
তাহলে,ভুলতে হবে অভিমান।
সস্তার হাততালি পাওয়ার জন্য,
শুধু হাসি ধরে রাখা মুখে।
অনেকগুলো দিন,অনেকগুলো রাত,রোদ,ঝড়,বৃষ্টি
পেরোলাম তো সবই…..।
হেরে যাওয়ার যন্ত্রনাগুলো ঠিকানা খোঁজে শুধুই।
মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় স্পর্ধিত বিশ্বাসে,
ভালোলাগা এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায় অদৃশ্য নিঃশ্বাসে।
কেমন হতো?
যদি হারিয়ে যেতাম দুজনে হাত ধরে…..
আমার কপালে উড়ে এসে পড়া চুলগুলো,
তুমি সরিয়ে দিতে ভালোবেসে আদর করে….
আমার দুচোখ তোমার চোখে হত দৃষ্টিবিলীন…
একটু ছোঁয়া…. যেন স্বপ্নের আবেশ….
কেমন হতো বলতো?
.
নিসর্গ নির্যাস মাহাতো এর দুইটি কবিতা
কনাই
গলির মুখে চেয়ার পাতা ।
রোজ বসে থাকে
কেউ কেউ দালাল ভাবে।
কেউ ভেবে নেয় মাসির ঘাঁটি,
পুলিশ ভেবে রাস্তা এড়ায় সদ্য দূর্বা দাঁড়ি যুবক ।
চেয়ারে কেউ হাত দেয়না
স্থির।
রোদ ওঠে। বৃষ্টি পড়ে।
সন্ধ্যা নামে ঘাটে।
আলো জ্বলে, গোঙানি। খিস্তি-শীৎকার।
চেয়ার স্থির ।
খদ্দের নয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে মাঝে মাঝে মেয়ে দেখে ।
ঢুকে পড়ে মেয়েছেলেদের ঘরে ।
খিস্তি খায়। মুরাদ নেই ।
মুরাদ কি আর টাকার হয় ?
যে মাতাল দশটা বছর বউ খুঁজছে কুঠি ঘুরে-
হরিণ চোখ বেশ চিনবে ।
সেও কালো। প্রেমিক নয় ?
চেয়ার ঘেরা- মরদ নয় !
কবি
রক্তাভ পান্ডুলিপি জ্বলতে জ্বলতে-
অঙ্গারে পরিণত হয়।
নিভে যায়।
পড়ে থাকে জমাট কালো অনুভূতি।
চুল্লী থেকে ছিটকে গেলে
সেও বিদ্রুপ করে,
আস্ফালন !
.
পাখি উড়ে চলো -মাধব মন্ডল
মেরঠ নগর স্টেশন ঢোকার মুখে
কত পাখি ঘরে ফেরে…..
কত উষ্ঞতা ঠোঁটে….
পাখি শুধু তুই বড় একা….
কোথায়ও পিঁচুটি মোছে না কোন পাতা….
ডানার পালকে ম্যাড়ম্যাড়ে রোদ…..
আদরে মাখামাখি ভালবেসে….
ঝড়ের মেঘে কেউ তোকে দু’মিনিট জিরোতে বলে না……
ওদের জানালা ছোট থেকে আরও ছোট হয়…..
একা ভয়ানক একা, শুধু উড়ে চলা…..
দুঃখের ভিতরে বাস করে আরও আরও দুঃখ…..
পাখি, সবার কি ঘর থাকে?….
সবাই কি আদর পায় মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে?…..
ওড়াটাই তোর ঘর, মেঘটাই তোর আদর, ঝড়টাই তোর উষ্ঞতা…….
আর কিছু নেই, আর কিছুতে তোরই কি দরকার পাখি!!
চারদিকে আন্তরিক হাহাকার !!
..
.
লেখক পরিচিতি
নাম: প্রয়াত আশীষ ধর
জন্ম: ১৬/০৮/১৯৪২ প্রয়াণ : ০৮/০২/২০১৪
কর্মজীবন: আই সি আই পেন্ট
অবসর জীবন: সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা
বসবাস: শ্রীরামপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
প্রয়াত আশীষ ধর
প্রথম প্রেম // আশীষ ধর
তখন আমার বয়স উঠতি,
নতুন চাকরী মনে ফূর্তি,
যাওয়া আসার অফিস পথে
নিত্য দেখা তার সাথে
এক হাস্যময়ী তন্বী ললনা
চকিত চপলা, হরিনী নয়না
প্রথম দর্শনে জাগলো প্রেম
এমন নারী একটি জেম
জীবন সঙ্গিনী তারে পেলে
সব দুঃখ যায় চলে I
সাহস করে একদিন তারে
নিবেদন আমার আবেগ ভরে I
মিষ্টি হেসে লাজুক ভাবে
জানতে চাইলো চাকুরী কবে ?
কোন অফিসে এপয়েন্টমেন্ট
ক্যাসুয়াল না পার্মানেন্ট ?
ক’জন’বাড়িতে ডিপেন্ডেন্ট ?
এই ব্যাপারে নেই সেন্টিমেন্ট
সব জেনেই তো করব প্রেম
সিকিউরিটিটাই প্রধান ক্লেইম I
সুন্দরীর কথা শুনে
ভাবি আমি মনে মনে
প্রেমের যদি এই স্টাটিস্টিক
নাই বা হলাম আর রোমান্টিক
বদলে গেল জীবন ছন্দ
মিথ্যে কবি জীবনানন্দ
থাকলে আজ দেবদাস
যেতে হতো বনবাস I
.
বৃত্তের সঞ্চার – সঞ্জয় সােম
আমাদের সমস্ত সরলরেখাদের এখনও জানা হয়নি
তারা নিজেরা একা একা সরলরেখা থেকে যায়
আমাদের ঘিরে তৈরি হয়েছে একাধিক স্বার্থপর কেন্দ্রীয় বৃত্ত
হেঁটেছি অনেকটা পথ
আমাদের ডানদিক বাঁ-দিক ভরে আছে টুকরাে টুকরাে
খােলামকুচি জটিল বৃত্তচাপে
বৃত্ত’র জ্যা-বরাবর হেঁটে আমাদের এক-একজন কতটুকু আর গিয়েছি !
নেমেছি পরিধি পরিক্রমায় বৃত্তের সঞ্চার পথ
কখনও থেমেছি, কখনও হেঁটেছি আগের থেকে জোরে
শেষ হ’ল কি হাঁটা ?
এখনও কেন্দ্রগামী বৃহত্তর সরলরেখাটি ছুঁয়েও দেখা হল না আমাদের
আমাদের সমস্ত সরলরেখাদের কবে জানব আমরা ?
.
মেরুদাঁড়াটা সােজা করতে // অমিয়কুমার সেনগুপ্ত
পাশে আছি । প্রয়ােজনে তােমার হাত ধরব, প্রয়ােজনে
কাঁধে হাত দিয়ে রাস্তা হাঁটব –
কেউ বলে না এখন।
সঙ্গে আছি বা সামনে আছি। প্রয়ােজনে
বিপদ সামলে দেব, সতর্ক করে দেব –
কেউ বলে না এখন।
অথচ, মানুষ আছে মানুষের জন্যে। মানুষকে নিয়েই।
এই যে সমাজবন্ধন, এই যে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবােধ
এ সবের জন্যেও তাে কখনও কখনও বলা যায়
এমন সাহস দেওয়া কথা।
কিন্তু কেউই বলে না আজকাল।
বলে না, বরং মনে-মনে ভাবে,
পিছনে আছি তােমাকে সুযােগ বুঝে গাড়ায় ফেলতে,
কলার ধরে টেনে পাঁকে ডােবাতে।
এই তাে জগত! এই তাে মানুষের জন্যে মানুষ !
অথচ যে পিছনে থাকার কথা ভাবে, তারও পিছনে কিন্তু
কেউ-না-কেউ ফেউ হয়ে আছে।
তা সে বুঝতে পারে না।
এই না-বােঝা নিয়েই চলছে জগত-সংসার
সব কিছু। কেউ কারও মুখের দিকে এখন
সােজা হয়ে তাকাতেই পারে না। একটু বাঁকা ভাবে তাকায়,
হাঁটেও একটু বাকা ভাবে। কিন্তু সে যদি নিজের
মেরুদাঁড়াটা সােজা করতে পারত, তাহলে
এমন কোনটাই ঘটার কথা নয়।
অথচ ঘটছে আকছার …
বাক্প্রতিমা সাহিত্য পত্রিকা থেকে সংগৃহীত
উর্বশীর নৃত্যের মাদকতা – অলোক আচার্য
স্বর্গের উর্বশীর নাচের সুনাম শুনেছি অনেক
শুনেছি সে নৃত্য কলায় পারদর্শী,
মুগ্ধ দেবাতারা মুগ্ধ নয়নে দ্যাখে সে নাচ।
আমিও দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি বহুবার
তবে সে উবর্শী নয়
পাহাড়ী ঝর্ণার নৃত্যের ছন্দ।
অবিরাম নৃত্যের তালে বয়ে আসা ঝর্ণার স্রোত
নৃত্যের ছন্দে পাথরে করে আঘাত,
নুপূরের ঝংকারে মেতে ওঠে ধরণী
উর্বশীর পদাঘাতে যেমন স্বর্গের মাটি,
জল আর পাথরের ছন্দে, দেবতার মত
আমিও মুগ্ধ হয়েছি বহুবার।
.
কবি, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
পাবনা
.
দাদু – আশীষ ধর
আজকে তোমায় পদ্যে বলি
আমার দাদুর গল্প
লোম ভর্তি সারা গায়
মাথায় চুল অল্প I
মুখটা যে তার গোল ফুটবল
নকল দাঁতে হাসে
সবার আগে ভুড়ি চলে
খুক খুকিয়ে কাশে I
দিনরাত সে শুয়ে থাকে
পান চিবিয়ে খায়
তাড়াতাড়ি কথা বলে
বুঝতে না কেউ পায় I
রক্ত চাপ তো একটু বেশী
তাইতো রেগে যায়
চশমা ফাঁকে তাকায় যখন
প্রাণটা উড়ে যায় I
মোটা গলায় ধমক দিলে
চমকে ওঠে পিলে
বুঝতে পারছো কি নাম তার
না বলেও দিলে I
.
আমার স্নায়ুর সমুদ্রে //রণেশ রায়
আমার স্নায়ুর সমুদ্রে
স্মৃতি খেলা করে
বসে এসে চেতনার মজলিসে
অন্তরালে লুকানো কত সে কথা
নি:শব্দে বলে যায়,
আমি উড়ে চলি
তার ডানায় ডানায়,
সে আসে শৈশবের ডিঙা বেয়ে
মেলে এসে বাল্যের আঙিনায়,
যৌবনের প্রেম উঁকি মারে
কৈশোরের সে বেলায়।
উদ্ধত যৌবনে সমুদ্রের গর্জনে
আমি ভেসে যাই
অনিশ্চিতের ভেলায়;
প্রৌঢ় চোখ রাঙায়
ধরে আমায় নিয়ে যায়
সংসারের হিসেবের খেলায়;
বে-হিসেবি আমি হিসেবের খাতায়
হিসেব মেলে না আমার
ফাঁক থেকে যায় দেনা পাওনায়।
রেখে আমায় বার্ধক্যে এ বেলায়
স্মৃতি কোথা চলে যায় !
আমি খুঁজে ফিরি তাকে
পাহাড়ের প্রত্যয়ে
জীবন-নদীর আঁকে বাঁকে
বাতাসের গুঞ্জনে শিশুর ক্রন্দনে।
.
স্মৃতি চারণ – আশীষ ধর
জন্ম থেকে সঙ্গে আছি
চিনেছি তোমায় জ্ঞান হলে
এর পরেতেই বুঝতে পারি
আদর স্নেহ কাকে বলে I
ভালোবাসার কোমল টানে
মমতার স্পর্শ দিয়ে
মানুষের মত মানুষ হতে
করেছো চেষ্টা মনপ্রানে I
অনেক বছর পেরিয়ে এসে
জীবনের এই সায়াহ্নে
হিসেব করতে গিয়ে দেখি
কি করেছি তোমার জন্যে?
শুধুই কর্তব্য ! আর কিছু নয়
নিয়েছি শুধু দুহাত ভরে
দেবার বেলায় সবকিছুতেই
যুক্তি তর্কে রেখেছি দূরে।
জীবন দীপের শেষ প্রহরে
যখন তুমি চলে গেলে
বোবার মত চেয়ে থাকি
কাঁদে মন অন্তরালে।
জানি সবই ভুলে থাকো
দিন দুই চার পরে
আছি তোমার ভূমিকাতেই
পালন করে সন্তানেরে I
.
মামা মামী – আশীষ ধর
বিদেশে থাকেন মামা
সবাই ডাকে বুম্বা
ছিপ ছিপে গড়ন তার
ফুট ছয়েক লম্বা।
রঙটা যদিও একটু কালো
মামা আমার ভীষণ ভালো
গোঁফের ফাঁকে মিষ্টি হেসে
হাতবাড়িয়ে ভালোবেসে
কোলে তুলে নেয় আমারে
‘পুটে’ বলে আদর করে।
ডাকে সবাই মামুন বলে
আমার ওই মামীকে
আমি ডাকি মণি মা
মামা কিছু অন্য ডাকে।
হাসি খুশি মণি মা
সদাই ব্যস্ত থাকেন
হরবরিয়ে কথা বলেন
তরবড়িয়ে চলেন।
ভালোবাসেন ঘুমতে
সকাল দুপুর রাতে
কোন রকম জায়গা পেলে
সোজা হয়ে শুতে।
মশা মাছি ব্যাপার নেই
গরম কিংবা ঠান্ডা
নিদ্রা ভঙ্গ হয় না তার
বাজলেও কাঁসর ঘন্টা
ভীষণ খুশি আমিও ভাই
এমন মামা মামী পেয়ে
দেখে এলাম এবার তাদের
সুদূর ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে।
সমাজচিত্র // কিশলয় মিত্র
সমাজে রয়েছে কত স্বপ্ন লুকানো–
কিন্তু সেসব কী পারে সব প্রকাশ পেতে ?
কেউ কাঁদে হাহাকারে- কেউ বা হা-হা করে
কেউ মরে পরিশ্রম করে-কেউ আরাম করে।
এখনও যায়নি চলে শিশু শ্রমিক, নারী নির্যাতন
অবহেলা মানুষের প্রতি।
কঠোর পরিশ্রমে জোগাতে হয়
একমুঠো ভাত
একটু নুন তাদের।
কেউ করে না সম্মান, করে কি তাদের সঙ্গে
একটু আলাপ- ভালো ব্যবহার ?
সমাজ তাদের দিকে পিছু ফিরিয়ে চলে
অন্ধ হয়ে যাই তখন মানবধর্ম–
কেও কি ভেবেছে তাদের কথা ?
যদি করে চুরি পেটের জ্বালায়–
চাবুক মারতে ব্যস্ত সবাই।
কখনও কি একথা উঠে, ‘সে অনাথ, অনাহার, ছেড়ে দাও তাকে !’
হায় রে এ সমাজ !
যুগ-যুগ ধরেই বেড়েই চলেছে
কালোবাজারি-অসৎ মানুষের দল।
ভেঙে পড়েছে অসহায়- নিপীড়িত শিশুর দল,
তাদের মুখের অন্ন কেড়ে খাচ্ছে কত-শত প্রাণ।
একদিন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে,
এই সমস্ত শিশুর দল।
তারা শেষ-মেশ না পেয়ে উপায়,
নাম লেখায় খারাপ খাতায়;
তখন সমাজ তাদের নিয়ে বচসা শুরু করে।
কিন্তু, কেউ কি ভেবেছে তাদের উৎস কোথায় ?
তারা কেন এমন করছে ?
যদি কেউ ভাবতো,তাহলে থাকতো না সমাজে —
কুলষিত অবস্থা
দরিদ্রসীমা ;
থাকতো না সমাজে হীন-অপমানিত-খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা।
.
সেই ছেলেটা – সাজ্জাদ আলম
হয়তো ভুলে গেছো সেই রোগা-লম্বা
অগোছালো চুলওয়ালা ছেলেটাকে
যে ছেলেটা প্রত্যেক সকালে এসে দাঁড়াত
তোমার বাড়ির সামনের রোয়াকে
তাকিয়ে থাকত ব্যালকনির দিকে কিছুক্ষণ
যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি শুকোতে চুল আর পোহাতে সূর্যকিরণ
তুমি দেখেও তাকে না দেখার করতে ভান
ছেলেটা একটু হেসে রওনা দিত যেখানে তার স্থান
হয়তো ভালোবেসে ফেলেছিল তোমাকে, কিন্তু বলতে পারেনি
তোমার দোতলা বাড়ির সঙ্গে নিজের মাটির বাড়ি,সমান ভাবতে পারেনি
তারপর কেটে গেছে কত শীত,গ্রীষ্ম আর বৃষ্টিরা বইয়েছে বন্যা
ছেলেটা যায়নি একদিনও বাদ, তার ভালোবাসাটা নয় সস্তা
কোনোদিন তোমাকে না দেখেই চলে যেতে হয়েছে তাকে
কালকের হাঁসিটা আসেনি আজ তার দুই কালো ঠোঁটের ফাঁকে
সে হয়তো জানেনা তোমার হয়ে গেছে বিঁয়ে
তুমি থাক না এই বাড়ি
ছেলেটা রোজ আসে আটটায়, দাড়িয়ে দেখে
তারপর; না হেঁসেই দেয় পাড়ি ।