কনকাঞ্জলি : শম্পা সাহা

বিয়েটা খুব সুন্দর ভাবে হয়ে গেল , কোথাও কোনো ঝঞ্ঝাট নেই ,একদম মসৃন ভাবে । আর হবে নাই বা কেন? একমাত্র মেয়ে , রায় বাবু একেবারে প্রাণভরে খরচ করেছেন। এক্সাইজের বড় অফিসার ছিলেন আর মেয়েও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জামাই ও তেমনি নামি কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ারের মোটা মাইনের চাকরি করে। আর সব থেকে বড় কথা ভীষণ দৃঢ়চেতা, আধুনিকমনস্ক। তাই সুচরিতা এত সুন্দর, স্মার্ট ,দৃঢ় মনের মেয়ে হয়েও শেষ অবধি প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়। ওদের প্রেম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকে যদিও পার্থিব ওর থেকে দু বছরের সিনিয়র । যখন সুচরিতা ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তখন থেকেই ওদের প্রেম।
তবে সমস্যা একটাই পার্থিব যেমন জেদি একরোখা দৃঢ়চেতা , ঠিক ওর বাবাও তেমনই এবং বড় বেশি প্রাচীনপন্থী । প্রথমে তো ছেলের প্রেমের বিয়ে কিছুতেই মেনে নেবেন না কারণ ওনাদের বংশে নাকি কেউ কখনো প্রেম করে বিয়ে করেনি ,তাই পার্থিবর প্রেমের বিয়েটা উনি কিছুতেই মেনে নেবেন না । কিন্তু যখন পার্থিব স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে যেহেতু সুচরিতাকে বউ হিসেবে না মেনে নেবার কোন কারণ নেই তাই ও যদি বিয়ে করে সুচরিতাকেই করবে নইলে নয়। শেষমেষ
সেনবাবু মানে দোর্দণ্ড প্রতাপ অফিসার প্রতাপাদিত্য সেন বাধ্য হলেন বিয়েটা মেনে নিতে,তবে প্রাচীনপন্থী হলেও ওদের বাড়ি থেকে কিন্তু পণ টন কিছু চাওয়া হয়নি কারণ সেনবাবু প্রাচীনপন্থী ,সংস্কারি তবে লোভী নন।
বিয়ের পরদিন বাসি বিয়ের পর মেয়ের বিদায়ের পালা ,একটা কাঁসার রেকাবে একটা কাঁচা টাকা ,ইঁদুরের মাটি ,চাল এইসব দিয়ে সাজানো হয়েছে কনকাঞ্জলির থালা । তখন যদিও মাইকে সানাই বাজছিলো না কিন্তু বিষাদের সুর চারিপাশে । সবারই চোখ ভিজে, বাবা-মায়ের তো কথাই নেই । একমাত্র মেয়ে বলে কথা আর তাছাড়া সুচরিতা যেমন উচ্ছল চঞ্চল আর প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, পাড়ার সবাই কে একেবারে মাতিয়ে রাখতো । তাই সুচরিতার বিদায়ের দিন সবাই মনমরা হবে তা তো স্বাভাবিক।ছোট পিসী এসে সুচরিতার হাতে ধরিয়ে দিলেন রেকাবিটা, তারপর বললেন, ‘নে এটা, পেছনে না ঘুরে সবটা মায়ের আঁচল ফেলে বল তো ,যে মা আমি তোমাদের সব ঋণ শোধ করে দিয়ে গেলাম,”।কিন্তু সুচরিতা কিছুতেই ও থালা ধরতে রাজি নয় ।
যখন সবাই বলছে এটা বল ,এটা বলতে হয় ,কিন্তু সুচরিতার এক কথা ,”না মা-বাবার ঋণ শোধ করা যায় না আর যা করা যায় না ,তা আমি বলব কেন ?”ঠাকুরমা বকলেন, রায় বাবু মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললেন ,”মা সামান্য ক’টা কথা বললে কি হবে ? বল “,কিন্তু সুচরিতার এক কথা,”না ,আমি বলব না ,কিছুতেই বলবো না “।এই নিয়ে শুরু হল তুমুল হট্টগোল ,এদিকে বেলা হয়ে যাচ্ছে। সেনবাবু বর কর্তা হিসেবে তাড়া দিতে লাগলেন ,বোনের ছেলে আদিত্যকে বললেন ,”যা তো, ভেতরে দেখে আয় কেন দেরি হচ্ছে ?”আর এইসব কান্ড দেখে পার্থিব একেবারে হকচকিয়ে গেছে ,এই পরিস্থিতিতে যে কি করতে হয় বা হবে তা ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। শেষে সুচরিতার পিসি একটু ধমকে উঠলেন, “তাড়াতাড়ি কর ,দেরি হয়ে যাচ্ছে তো !”কিন্তু সুচরিতা ও ঘাড় বেঁকিয়ে বললো, “ওসব না বলতে হলে বলো ,আর যা করার করছি কিন্তু বাবা-মায়ের ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না, তাই বলব ও না ।”
এদিকে দেরি দেখে বাধ্য হয়ে সেনবাবু গাড়ি থেকে নেমে আবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে এসে সব শুনলেন। তার মুখ একবার গম্ভীর হয়ে গেল ,ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন নতুন বৌমার কাছে তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”ঠিক বলেছিস মা ,বাবা মায়ের ঋণ কি শোধ করা যায় ?যায় না। তুই একদম ঠিক করেছিস। “নিন বেয়াই মশাই ওটা বাদ দিয়েই বাকি নিয়ম কানুন সারুন দেরি হয়ে যাচ্ছে যে । ”
এরপর আমাদের সুচরিতা পার্থিব বাবুর সঙ্গে ড্যাং ড্যাং করে শ্বশুরবাড়ি চললেন।