এবার কবি মধুসূদনের উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলা তথা মাতৃভাষার তাৎপর্য কি সেটা সংক্ষেপে আলোচনা করে নেব। উল্লেখযোগ্য যে শুধু মধুসূদন নন তখন অনেকেই তাদের যৌবনে ইংরেজ সভ্যতায় মুগ্ধ হন। এমনও মনে করতেন ইংরেজদের সভ্য আইনের শাসনেই ভারত ও ভারতবাসীর কল্যাণ। ইংরেজিই এই শিক্ষা সভ্যতাকে বহন করে। রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তবে এই সভ্যতার বর্বর দিকটাও তাঁর চোখ এড়ায় নি।
সভ্যতার সংকট বইতে তিনি সেটা প্রকাশ করন। আর মাতৃভাষা ছিল তাঁর কাছে মাতৃ দুগ্ধ। শুধু কথা বলা নয় মাতৃভাষা মানুষের এক গভীর মনন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে তাকে পুষ্ট করে। মানুষের স্মৃতির উদ্যানে মাতৃভাষা প্রস্ফুটিত সেই ফুল যার বর্ণ গন্ধ আর রূপে স্মৃতির বাগান সেজে ওঠে। মাতৃ ভাষায় মানুষ স্বপ্ন দেখে কল্পনা করে। এই ভাষায় চিন্তা ভাবনা তাকে সম্পূর্ণতা দিতে পারে। এটা মানুষে সহজাত বিকাশে সাহায্য করে। কিন্তু বিদেশি ভাষা আরোপিত। মাতৃভাষায় সহজাত সম্ভাবনার বিকাশ না ঘটলে বিদেশি ভাষা আত্মস্থ করা যায় না। সে বাইরের অতিথি হিসেবেই থেকে যায়। একটা জাতির জাতিসত্তা মাতৃভাষা ছাড়া লালিত হতে পারে না।
মাতৃভাষার ওপর দখল থাকলেই বিদেশি ভাষাকে আত্মস্থ করা যায়। ঠিক যেমন নিজের সত্তা থাকলে আত্মসম্মান বোধ থাকলেই অন্যকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া যায় তার ভালো মন্দ বিচার করা যায়। না হলে সবটাই হয়ে দাঁড়ায় মেকি। আর এই উপলব্ধিটাই প্রকাশ পায় মধুসূদনের একটা কবিতায় যার বাংলা অনুবাদটা নিচে দেখে নিতে পারি:
বিরহের গান গাহিব না আর
মধুসূদন দত্তের AN ACROSTIC থেকে একটি কবিতা অনুসরণে
পৃ ৪১৮
[ ৭ ]
দিগন্ত সুন্দরী
প্রিয়তমা আমার,
তুমি পশ্চিমের পরী
আমি পানিগ্রাহী তোমার।
প্রিয়া কি জানে
শোকে প্রিয় যে ভাসে,
তার প্রত্যাখানে
হৃদয় বিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাসে।
তুমি কি বোঝো না
তার প্রেমে নেই বঞ্চনা !
প্রত্যাখ্যাত সে যে।
তার প্রেম, অমর সে
যাকে বোঝ না তুমি,
কাঁদে সে হতাশে।
তবু সে,
আজও তোমায় ভালবাসে।
হে প্রিয়ে,
তুমি তার হতাশে
তুমি তার দীর্ঘশ্বাসে
তুমি ফের বাতাসে।
তবু সে,
তোমায় ভালবাসে।
হে প্রিয়তমা
নিঠুর হৃদয়হীনা
তুমি কি ভেবেছ যথা
কাঙাল এই অভাগার কথা,
হতাশায় তার,
কখন-ও বাজে না
তোমার হৃদয় বীণা?
দুর্ভাগ্য এই অভাগার,
শোকস্তব্ধ, আজ সে দুখি।
তবু সে,
তোমায় ভালবাসে।
মায়াবী ললনা
তুমি যে হৃদয়হীনা,
তোমার মায়ায়
ছেড়েছে আপন ঘর,
তার প্রেম যে অমর,
তার বিষাদ বেদনায়
হৃদয় তোমার
ভরে নাকি করুনায় ?
হে বিদেশিনী
তোমায় ,
সে আজও ভালবাসে।
ও ! পুবের পরী
ক্ষম তারে,
চেনেনি সে তোমারে গৃহদ্বারে,
তুমি যে ছিলে মলিন বেশে
মাতৃ অহংকারে,
ত্যাজিছে তোমারে,
ত্যাজিয়া তোমারে হয়েছে বিবাগী,
ফিরেছে তোমারই দ্বারে
ভিক্ষা মাগিবারে,
ফিরায়না তারে।
পুবের পরী,
মহিয়সী তুমি
তুমি মহাময়ী,
হে দয়াময়ী !
মোরে দিও না মরিবারে,
চাই আমি বাঁচিবারে
এ সুন্দর ভুবনে;
লহ তুলে কোলে,
আমার এই বাহু বন্ধনে
জড়ায়ে লই তব গলে,
বিষাদের গান
গাহিব না আর
দীর্ঘশ্বাস পড়িবে না তব বুকে,
কাঁদিব না আর বিরহ শোকে।
আমরা আগেই বলেছি যে বাংলায় তথা মাতৃভাষার ওপর মধুসূদনের অবাধ দখল ছিল। দেশের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই বিদেশি ভাষা তার ওপর আরোপিত ছিল না। সেটাকে তিনি আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তাতে তিনি যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। তাকে তিনি ভালো বাসতেন। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেন যে সেটা ছিল বিদেশী।
সে ভাষা তার কাছে ছিল পশ্চিমের সুন্দরী উর্বশী, তার প্রেমিকা। কিন্তু মাতৃভাষা তাঁর কাছে নিজের মা যাকে তিনি উপেক্ষা করেছেন সাময়িক মোহে পড়ে। সেই মায়ের কোলে তিনি লালিত হয়েছেন পালিত হয়েছেন। তাকে বাদ দিয়ে কবি ভিখিরি হয়ে যান। তার সত্তা লোপ পায়। তাই তাকে মায়ের কোলেই আশ্রয় নিতে হয়। সেখানেই তিনি আশ্রয় প্রার্থী তার উপরোক্ত কবিতায়।