লক্ষ্মণ কর্মকার ঐতিহ্য ও অন্বয়ের এক সমানুভূতির কবি
তৈমুর খান
একজন শিল্পী বা কবির মনের সূক্ষ্ম চেতনা আর অনুভূতির প্রকাশ চিত্র এবং কবিতার মধ্যেই সম্ভব। কারণ চিত্রে দৃশ্য কম এবং কবিতাতেও প্রকাশ কম, কিন্তু ভাবনা বেশি। চিত্রের একটা আঁচড়ে এবং কবিতার একটা শব্দে যে ব্যঞ্জনা ও দীর্ঘ না-বলার শূন্যতা বা space থাকে আর কোনো সৃষ্টিতে তা পাওয়া সম্ভব নয়।
এই কারণেই ভ্যান্ গঘ বলেছেন : “Poetry surrounds us everywhere, but putting it on paper is, alas, not so easy as looking at it.”(Vincent Van Gogh). কবিতা আমাদের জীবনময় চারপাশেই ঘিরে আছে। যখন তা লেখা হয় তখনই উপলব্ধি করতে পারি। সুতরাং কবিতাকে কবির যাপনক্রিয়ায় নিজ অস্তিত্ব সন্ধানের এক নিরীহ নিরুচ্চার শিল্পও বলা যেতে পারে। একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষরণ ও সম্মোহন, স্মৃতিতর্পণ অথবা স্বপ্ন ও অন্তরায়গুলি কবি তুলে আনেন। এই ধারা থেকেই কবি লক্ষ্মণ কর্মকারের বৈশিষ্ট্যটি অনুধাবনযোগ্য।
লক্ষ্মণ কর্মকারের কবি পরিচয়টি অনেকেরই অজানা থাকতে পারে। তিনি প্রবন্ধকার হিসেবে, লোকসাহিত্যের কৌতূহলী লেখক হিসেবে এবং একজন দক্ষ সম্পাদক হিসেবে অনেকের কাছেই পরিচিত। কিন্তু কবি হিসেবে ফল্গু ধারার যে অন্তঃসলিলা তাঁর হৃদয়ে বহমান এবং অনন্ত দিশারি এক প্রজ্ঞার অধিকারী তিনি —তার খোঁজ অনেকেই রাখেন না।
তাঁর সমকালীন বেশকিছু লিটিল ম্যাগাজিনে তিনি কবিতা লিখেছেন, সেসব কবিতার পাঠকও আছে, কিন্তু কবি কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেননি বলে অনেকের কাছেই বিস্মৃতির অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন। এই সামান্য আয়োজন সেই কারণেই : কবিকে তুলে আনা এবং পাঠকের সামনে দাঁড় করানো।
সত্তর দশক থেকেই তরুণ কবি হিসেবে লক্ষ্মণ কর্মকার পাঠকের কাছে পরিচিত। সাম্যবাদী আর প্রতিবাদী চেতনায় শোষণমুক্ত সমাজের পক্ষপাতী হিসেবে তাঁর কণ্ঠস্বর প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে। কলাবৃত্তের নিখুঁত উচ্চারণে উচ্চবিত্ত শোষকদের জানিয়েদেন :
“আরাম কেদারার বুকে তুলে পা
সুখে আছেন দিব্যি মশাই লজ্জা করে না?
মিষ্টি মধুর বোলে স্বার্থ গোছান তলে
ফন্দি সুলুক ছেড়ে এবার ঝেড়ে কাশুন না!
চলতে গিয়ে স্রোতে একটুখানি থামুন
ভাবনা ফেলে পথে সত্যি করেই নামুন।
আয়না জুড়ে একা দেখুন নিজের মুখ
আপনি মানুষ না, আস্ত উজবুক।” (তিন সত্যি)
এই মানুষ হওয়ার শিক্ষা পরাশ্রয়ী পরজীবীদের নেই। তাদের সবক শেখানোর দরকার হয়েছিল সেই সময়। সমাজ-ভাবনার এই বিপ্লবচেতনা সেই সময়ের কবিদের উৎসাহিত করেছিল। লক্ষ্মণ কর্মকারও তা এড়াতে পারেননি। “গাঢ় রঙের আলোয়ান” নামে একটি কবিতায় শীতের শেষে গাঢ় রঙের একটি আলোয়ান প্রিয়জনকে কিনে দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন :
“দীর্ঘ শীত শেষে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি
তুমি চাইছ গাঢ় রঙের আলোয়ান।
তুমি আর কাঁপবে না পথের ধারে
মিছিল-ছুট হিসেবি ছা-পোষার মতো
লুকিয়ে পড়বে না ভেল্কির আসরে
শীতার্ত শরীরে নবীন উষ্ণতায়
হেঁটে যাবে যতদূর পথ, পথ গেছে….
উত্তাপ খোঁজনি তুমি মানুষের ভিতরে
মুষ্টিবদ্ধ উত্তাপ স্পর্শ করোনি
ত্বকের নীচে শিরার ভিতরে
মাটির গভীরে শিকড়ে প্রবাহিত
উষ্ণতা টের পাওনি এই ফেব্রুয়ারিতেও
তাই একটা গাঢ় রঙের আলোয়ান…।”
এই আলোয়ান কেনাকেও কবি এক বিলাসিতা মনে করেছেন। গরিবেরা অধিকার আদায়ের মিছিল-ছুট হয়ে ফিরে যায় ঠাণ্ডায়। কিন্তু প্রিয়জন ফিরে যায় আলোয়ান গায়ে। “বুকের উষ্ণতা” টের পায় না। বুকের উষ্ণতা তো বিপ্লবেরই আগুন। যা সংগ্রামময় জীবনের প্রত্যয়কে জাগিয়ে তোলে। কবির সূক্ষ্ম বোধ কতখানি তীব্র তা বোঝা যায়।
কখনো কখনো মানুষের জন্যই কবির হৃদয়ের টান গভীর হয়ে ওঠে। শহর, আভিজাত্য, কৃত্রিমজীবনের অভিনয় থেকে বেরিয়ে তিনি সেই সুদূর জন্মভূমির শালপিয়ালের অরণ্যময় প্রান্তরে উপস্থিত হতে চান। “লৌকিক প্রণয়” কবিতাটি সেভাবেই শুরু করেন :
“আমি চলে যেতে চাই
দূরে বাস-স্টপ ছাড়িয়ে
পিয়ারডোবার আদিম শাল
শালের অরণ্যময় মায়া পার হয়ে
একা, কেবলই একা”
যেখানে লোভনীয় বাঁধন আছে, লোকলজ্জা আছে, প্রিয়ার হাতছানি আছে, তবু কবিকে ধরে রাখতে পারে না। কবি অনড় অদম্য উৎসাহে বেরিয়ে পড়তে চান :
“আমি চলে যেতে চাই
জেদী কিশোরীর অভিমানে
স্মৃতিতে সহোদর হয়
মানুষ, মানুষের জীর্ণ আস্তানা
কেবলই পিছু ডাকে লৌকিক প্রণয়।”
এই লৌকিক প্রণয় কতখানি অমোঘ, কতখানি দুর্মর ও অভিন্ন হৃদয়ের টান তা উপলব্ধি করা যায়। প্রতিটি শব্দেই কবির ছলনাহীন অভিব্যক্তি অন্তরের সংরাগে প্রশ্নহীন মানবীয় আবেগের উচ্ছ্বাসে অভিষিক্ত তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
লক্ষ্মণ কর্মকার উত্তরাধিকারকেও সর্বদা স্বীকার করে নেন। ঐতিহ্য ইতিহাস পরম্পরা তাঁর সঞ্জীবনী মন্ত্রের মতো সবকিছু নির্ণয় করে দেয়। বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত ঐতিহ্যের অন্বয় থেকেই ধাবিত। বিগত যাপিত জীবন, পিতা-পিতামহের দৈনন্দিনের পরিচয় কবিতায় লিপিবদ্ধ করেন। গভীর ইংগিতময়তায় সেই সময়টি জীবন্ত হয়ে ওঠে। কবিতার এই রসায়ন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। “অশ্রুত শব্দগুলি” কবিতাটি উল্লেখ করলে বিষয়টি খোলাসা করে বলা যায় :
“এই মাটিতে তোমার পিতা-মাতা
পিতামহ, তাদের সহোদর সহোদরা
সকলেই ঘুমিয়ে আছে।
তুমি কান পাতো, চুপিচুপি জেনে যাও
তাদের প্রেমের কথা, পরাজয়ের কথা।
একটা আশ্বিনের ঝড়ে তারা ছিন্নমূল
শিকড় ছেঁড়া যন্ত্রণায় নির্বাক
আশ্চর্য, আবার আগমনী গেয়েছিল
আর এক আশ্বিনের জন্যে।
মহাজনী ৠণ পরিশোধে পণ্য করেছিল নিজেদের
আবার জান কবুল করে শপথ নিয়েছিল
বাঁচিয়ে রাখতে তুলসীমঞ্চ, গোয়ালঘর এবং ভদ্রাসন।
তাদের স্বপ্নগুলিও এঁকে নাও দু’চোখে
শ্রুত-অশ্রুত তাদের হৃদয়ের
প্রতিটি শব্দই ধরে রাখো কান পেতে।”
কবি যেন তাঁদেরই প্রতিনিধি। উত্তরসূরী। ঐতিহ্যকে সমীহ করা, প্রতিপালন করা এবং রক্ষা করা ও প্রজন্মের হৃদয়ে সঞ্চারিত করা তাঁরই কাজ। এই মাটি, বাতাস, আকাশ, নক্ষত্র সকলেই স্মৃতিময় ঐতিহ্যের সম্মোহনকে উচ্চারণ করে চলেছে। কান পাতলে সেই দীর্ঘশ্বাস শোনা যাবে। তাঁদের মহাজনী ৠণ নেওয়া, বেগার খাটা, পুনরায় বাঁচার স্বপ্নে ফসল বোনা, তুলসীমঞ্চ, গোয়ালঘর, ভদ্রাসন পরিচর্যা করা কবি ভুলতে পারেন না। কবিতা জীবনেরই উচ্চারণ হয়ে ওঠে।
মানবতাবাদী কবি প্রকৃতির অকৃপণ দানকে সুখী মানুষের সেবায় নিয়োজিত হতে দেখেছেন “আদিগন্ত ছায়া”,”মর্মরিত বাতাসের গান”, নদীর কাছে “পুণ্য অবগাহন” প্রভৃতি সবই অফুরন্ত ভাণ্ডারের উজাড় করে দেওয়ার রীতিটি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এত পেয়েও মানুষ কি মানুষ হতে পেরেছে? কবি বলেছেন :
“অথচ মানুষের পাশে মানুষের কাছে
তোমার বর্ণপরিচয়ই হল না।” (মানুষের বর্ণপরিচয়)
মানুষের বর্ণপরিচয় সুখে হয় না। মানুষের কষ্টকে নিজের কষ্ট করে তুলতে পারলে তবেই মানুষ। সেই মানুষ কোথায়?
নশ্বরতা জেনেও অবিনশ্বর সূর্যের উপাসনা শিখে নিয়েছে মানুষ। কিন্তু পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। যাদের মানুষ বলে মনে হয়েছে তারাও প্রকৃত মানুষ কিনা কবি তাদের পরীক্ষা করতে বলেছেন :
“হিরণ্ময়! খুঁজে দ্যাখ
মানুষের বুকে-পিঠে মানুষের গন্ধ আছে কিনা!”
(হিরণ্ময় খুঁজে দ্যাখ)
কারণ মানুষ বড়োই ঘাতক ও অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। যে-কোনো সময় সে ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠতে পারে। ভোগাকাঙ্ক্ষায় তারই আজন্ম টান ।
সুতরাং “প্রতিশ্রুত মানুষের অমলশরীর” আজ কোথায়?
“যাবতীয় ত্রাসমুক্ত স্বপ্নময় ভোর” এর অন্বেষণ করেছেন কবি। বিষাদময় আকাশের অভিমানী মুখ কবিকে ক্লান্ত করেছে। বার বার নতুন উদ্যম চেয়েছেন । হত্যা মৃত্যু মিথ্যাচারে বেঁচে থাকা যে প্রকৃত বেঁচে থাকা নয় তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। “আগুনের গান” শুধু ধ্বংসই আনে। কবি বলেছেন :
“মেঘ ঢাকা আকাশেতে হাসে শুধু নীল
বিষাদের ছায়া মেখে অচেনা নিখিল” (ব্যাকরণ)
এই বিষাদ যে আমাদের সভ্যতারই আমদানিকৃত ফসল তা সবাই জানি। আমরা এর থেকে মুক্তি চাই, শান্তি চাই। আমরা বাঁচতে চাই। প্রেমের বাঁধন চাই। সেই শান্ত সমাহিত জীবনের নৈবেদ্য সাজাতে চেয়েছেন স্বপ্নমুকুলের ডালিতে । কবিতাগুলি নিবিড় আত্মবাচক উচ্চারণে ইতিবাচক মানবিক মমতায় সমৃদ্ধ। বেশি কবিতা না লিখেও লক্ষ্মণ কর্মকার একজন সার্থক কবি। ঐতিহ্য অন্বয়ের এক সমানুভূতির কবি । তাঁর কাব্যভাবনা ব্যক্তি সময় ও ইতিহাসের নবচেতনায় পাঠক নতুন করে আবিষ্কার করতে বাধ্য হবে।