.
এটি কোন গল্প নয়, নয় কোন বাস্তব করুণকাহিনী। একটি সাদামাঠা দৃশ্যের পরবর্তী দৃশ্য কী হতে পারে তা নিয়ে কল্পনা করবো আমরা। তো চলুন আগে দেখা যাক সে দৃশ্যটা কী?
.
পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ যখন সূর্যালোকের বিপরীতে চলে যায়, তখন কৃত্রিম আলোতে জেগে উঠে এখানকার নগরী। ব্যস্ততা যেন আরো বেড়ে যায়। ক্ষুধার তাড়নায় হন্য হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই। প্রতিদিন ঠিক এ ক্ষণে একটা টিউশনো যেতে হয় আমাকে। ফুটপাত ধরে দশ মিনিটের মত হাঁটতে হয়। সর্বংসহা এ ফুটপাত প্রতিদিনের কত ন্যায়-অন্যায় সাক্ষী হয়েছে তার হিসাব হয়তো মহাকালও রাখে না।আবার স্রষ্টার অনাসৃষ্টি বা ভুলবশত সৃষ্টিকেও ধরে রাখে এই ফুটপাত।
.
আমি যে ফুটপাত দিয়ে টিউশনো যাই সে ফুটপাতও এমনি সবংসহা, মমতাময়ী। এ ফুটপাতে প্রতিদিন একটি দৃশ্য চোখে পড়ে। আর ঐ দৃশ্যটি আমার মনোজাগতিক ভাবনার দুয়ারে এত প্রভাব ফেলে যে, পথ চলতে চলতে দৃশ্যটি নিয়ে না ভেবে পারি না। যাহোক আর গৌরচন্দ্রিকা বাড়িয়ে লাভ কী ? ঐ ফুটপাতেই সন্তানসহ বাস করে এক নারী। প্রতিরাতে দেখি একটা মশার কয়েল জ্বালিয়ে আপাদমস্তক কাঁথা মুড়িয়ে মা ছেলে ঘুমাচ্ছে।শিয়রে নোংরা দুটি বালিশ।মেঝেতে একটি কাঁথা বিছানো আরেকটি মা-ছেলের ক্ষীণ অঙ্গ দু’টি ঢেকে রাখার জন্য যথেষ্ট।
.
মাথার দিকে করে একটা কলসি আর একটি গ্লাস ও একটি মেলামাইনের থালা। প্রথম প্রথম একটু দূরত্ব রেখেই হেঁটে যেতাম। কিন্তু দিন যত গড়াতে থাকল কেন জানি এই মা-ছেলের প্রতি আমার আাগ্রহটা বাড়তে থাকল। একদিন দেখি ঐ ছেলেটার হাতে একটা নীল বল ভেতরে লাল বাতি জ্বলে। ওটা কিছুক্ষণ মা ছেলেকে দিচ্ছে, কিছুক্ষণ ছেলে মাকে দিচ্ছে। ভাবলাম যাদের দুঃখ দেখে আমি ব্যাথায় নীল হয়ে যাচ্ছি, তারা কিন্তু আমাদের চেয়ে সুখী।
.
পর রাতের দৃশ্য আরো চমকপ্রদ। এক আধবয়স্ক লোক, হয়তো আধ পাগলই হবে। কিন্তু পোশাকে সাহেবের মত। পরনে লম্বা প্যান্ট ও ইন করা শার্ট, মাথায় হ্যাট। কাঁধ দুটোকে উপর নিচ করে নাচের ভঙ্গিমা করে হেঁটে যাচ্ছিল। লোকটা যেভাবে হাঁটছিল ছোট ছেলেটাও ঠিক সেরকম করে তার মাকে দেখাচ্ছিল । আর মা মুখে কাপড় দিয়ে হাসির বেগকে চেপে রাখার চেষ্টা করছিল। চেষ্টা করলাম, রাস্তার অপর পাশে সারি সারি উঁচু দালান ভবনগুলোতে এমন হাসি খুঁজে পাওয়া যায় কিনা?
.
পথ পথ চলতে প্রতিদিনই আবিষ্কার করি নতুন নতুন বিষয়ে নতুন নতুন আনন্দ। কোন সময় দেখি ছোট একটা লেদার লাইট নিয়ে তার আলো ফেলছে কিছুক্ষন গাড়ির উপর কিছুক্ষন মানুষের গায়ের উপর। আর এ নিয়েও মা-ছেলের মধ্যে আনন্দের ঝড় উঠেছে , কোন সময় দেখি মা-ছেলে একটা পুতুলের মুখে কালি লাগিয়ে দিয়েও হাসির উৎস খুঁজে নিয়েছে।
.
কিছুদিন পরে আরো নতুন কিছু আবিষ্কার করলাম। এই মা-ছেলে যেখানে থাকতো তার পাশে একটি দেওয়াল ছিল। দেওয়ালের অপর পাশ থেকে একটি গাছের কয়েকটি শাখা তাদের মাথার উপর অনন্ত নাগের মত ফণা বিছিয়ে দিয়েছে। ভদ্রপল্লীর ঈশ্বরের দৃষ্টি দেখছি এখানেও কিছু পড়ে। যাহোক, দেখি যে ডালগুলো হাতের নাগাল পাওয়ার মত, সেগুলোতে কতগুলো ফুলানো বেলুন ঝুলছে।
.
জসীম উদ্দীনের পল্লী জননী ছেলের শখ মিটাতে না পারলেও, স্বস্তি খবর, এখানকার নগর জননী কিন্তু তাতে ষোল আনা সফল। সন্তানের খুশির জন্য মায়ের এ প্রচেষ্টাগুলো চিরন্তন। হয়তো তাতে কেউ সফল, কেউবা অনেক চেষ্টার পরও পুরোপুরি সফল হন না। আমার হয়তো জানা নেই কিভাবে এ মা তার সন্তান আবদারগুলো পূরণ করেন, এমন কি জানার কোন ইচ্ছা নেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে এ সন্তান বড় হলে মায়ের কী কী উপকার হবে?
.
চলুন, একটু কল্পনা করি। ধরুন, ছেলেটি বড় হয়ে ডাক্তার হলো বা ইঞ্জিনিয়ার হলো বা ম্যাজিস্ট্রেট হলো বা জজ হলো কিংবা উকিল হলো। আরে ভাই, ধরে নিন না একটা কিছু। আচ্ছা ঠিক আছে, ধরেই নিলাম উচ্চ শিক্ষিত হলো। কী, হাস্যকর ব্যাপার ? মনে মনে হয়তো ভাবতেছেন, ফুটপাতের ছেলে কীভাবে উচ্চ শিক্ষিত হবে ? যে মা সন্তানের হাসির জন্য এত কিছু করতে পারে, সে মা সন্তানের ভবিষতের করতে পারে না এমন কোন কাজ আছে বলে আমি মনে করি না। ধরে নিন সেটা আজ থেকে পঁচিশ বছর পরে। ধরুন, তখন ছেলেটার অনেক জ্ঞানীগুণী বন্ধু হবে।
.
এমনকি তার চিরসঙ্গীনীও অনেক জ্ঞানী হবে হয়তো। এতজ্ঞানীর ভিড়ে ছেলেটার মস্তিষ্কও হয়তো উর্বর হয়ে উঠবে। মস্তিষ্কে হয়তো কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরবে বারবার, তার বাবা কে? তাকে অমানুষ করার পয়সা জুটেছিল কোথা থেকে? তার মা কী কাজ করতো। এ চিন্তায় তার ঘুম হয়তো হারাম হয়ে যাবে। কিন্তু মাকে জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়তো হবে না। ধরুন, কোনদিন তার সহধর্মিনী সাথে তার মায়ের তর্কবিতর্ক হচ্ছে। ঠিক সে মুহূর্তে সে ঘরে হয়তো ঢুকল।
.
হয়তো সেদিন খুব বেশি গিলে ফেলার কারণে মস্তিষ্ক আরো উর্বর হয়ে উঠবে। তাই এতদিনের অন্তরের গোপন প্রশ্নগুলোকে আর চেপে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। যে বিষ ধারণ করে সে দিনদিন নীলকণ্ঠ হয়ে উঠবে, সে বিষ সেদিন মণি হারা কোবরার মত উগাড়তে থাকবে। অবশেষে কালবৈশাখীর ঝড় যখন থামবে
.
তখন হয়তো নীড় ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। তবে বেলুন দিয়ে সাজানো বৃক্ষ আজ যেমন আছে তেমনি থাকব। সে বৃক্ষ মাকে ডাক দিয়ে বলবে, “আয় মা, আয়, এবার তুই একটু একা আমার তলে বিশ্রাম নেয়।”
.