ঘুণধরা সমাজের গল্প

ঘুণধরা সমাজের গল্প

শম্পা  সাহা

  রক্তমাংসের গল্প 

তুহিনার এখন সবে চোদ্দ বছর । না ,দেখলে মনে হওয়ার যো নেই।সেই কোন ছোটবেলা, তখন সবে থ্রি তে পড়ে ,স্কুল থেকে ফিরছিল । গায়ের স্কুল ,ছোট্ট তুহিনা মটর ক্ষেতে কচি মটর চিবোতে চিবোতে বাড়ি ফিরছিল একা। কতটুকুই বা রাস্তা মোটে পনেরো মিনিট পায়ে হেঁটেই যাচ্ছিল ,সবাই তো যায় । কিন্তু মুশকিল হল এ রাস্তায় ওদের ক্লাসের আর কেউ আসে না  তাই একাই ওকে যেতে হতো। হঠাৎই একটা মোটর সাইকেল এসে থামলো ওর সামনে। মোটর সাইকেলে বসে ছিল একজন আর একজন নেমে ওকে নাকে কি একটা শুঁকিয়ে দিলো ,ব্যস !

      যখন ঘুম ভাঙ্গলো নিজেকে পেল এই বস্তিতে, যেখানে ছোট ছোট ঘর, গাদাগাদি মেয়েরা ,আর সব মেয়েরা কেমন সেজেগুজে থাকে! ন বছরের তুহিনা বুঝতে পারছিল না যে ও কোথায় ,তাছাড়া কেমন একটা ঘোর তখন কাজ করছিল ওর মধ্যে। তারপর যখন একটা খুব সেজেগুজে থাকা মহিলা যাকে সবাই ফতেমা মাসি বলছিল সে আর সবাইকে বলল ,তুহিনা কে খাইয়ে রেডি করতে ,ও তো কাঁদতে লেগেছিল । ততক্ষনে ওর ঘোর কেটে গেছে ,আম্মা আব্বাকে না দেখতে পেয়ে ও কেঁদেছিলো খুব ,কিছুতেই ওদের কথা শুনতে চাইছিলো না। প্রথমে বকাঝকা তারপর শুরু হল মার , তাতেও যখন কাজ হলো না, ওকে কি একটা শুঁকিয়ে দিলো, কেমন মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ আর ওর প্রচন্ড ঘুম পেলো।ও ধীরে ধীরে ঢলে পড়লো গভীর ঘুমে। 

    আধো ঘুমেরও মধ্যেও টের পেল ,ওর ওপর কে যেন চেপে বসেছে !ছোট্ট তুহিনা শব্দ করতে পারছিল না, ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ,হাত পা ছুঁড়তে ইচ্ছে করছিল ,প্রচন্ড যন্ত্রণায় ও মরে যাচ্ছিল ,কিন্তু কিছুই করতে পারছিলো না । সকালের দিকে যখন ঘুম ভাঙলো টের পেল ওর সারা গায়ে কালশিটে দাগ ,মুখ চোখ ফুলে গেছে, তলপেটে প্রচন্ড যন্ত্রণা আর অসহ্য ব্যথা সারা শরীরে, গোপন অঙ্গেও প্রচন্ড ব্যথা । ও বোঝেনি কিছু ,খালি কেঁদেছে।  রাতে জ্বর ও এসেছিল ব্যথায় ,কিন্তু তাতেও রেহাই নেই! ঘোরের মধ্যে অসুস্থ শরীরটাকে জ্বরের ওষুধ খাইয়ে কি একটা শুঁকিয়ে, আবার শুরু এক ই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।ছোট্ট মেয়েটা ঘোরের মধ্যেই টের পেত ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। 

    ওর আব্বা কোথায় ?ওর আম্মা কোথায় ?কেন ওরা ওকে এতো কষ্ট দেয়? কেন এ সব শোঁকায় ?কেনই বা এরকম মনে হয় ?কেনই বা সারা শরীর জুড়ে এত ব্যথা, এত কষ্ট ? ধীরে ধীরে যখন কয়েক দিনে ও সব বুঝতে শিখলো ততদিনে ওর কাছে সব গা সওয়া হয়ে গেছে ।ওর এখানে যারা আছে রাজীয়া, মিনতি ,সাথী ,শাহনাজ, ফতেমা ,ওদের ই বা বয়স কত ?কেউ কেউ ওর বয়সী কেউ বা ওর থেকে বছর পাঁচেকের বড় !

     ধীরে ধীরে তুহিনার এই মাংসের বাজারে কেটে গেল পাঁচ পাঁচটা বছর। এখন ও সব বুঝে গেছে, ওর ব্যথা, ওর যন্ত্রণা, ওর এখানে আসা ,সব সব । এটাও বুঝে গেছে এখান থেকে ওর আর মুক্তি নেই।বোঝার পর থেকে ওর প্রায়ই মনে পড়ে ওদের বাজারের গফুর চাচার মুরগির খুপরিটার কথা। মুরগি গুলো চুপ করে বসে থাকতো আর খরিদ্দার আসলে একটা কে ধরে ধপ্ করে এক আছাড় দিয়ে মেরে ফেলে, গলাটা কুচ্ করে কেটে ফেলতো। রক্ত ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পড়তো চারিপাশে। আঁশটে রক্ত মাংসের গন্ধে ভারি বাতাস, সামনে খরিদ্দারের বিশাল লাইন। 

Leave a Reply