খারাপ খবর বাতাসে ভেসে আসে, আঁশটে মাছের মত গন্ধ লেগে থাকে তাতে, নাক সিটকিয়ে আসে, সমস্ত গা গুলিয়ে ওঠে, তবু গিলতে হয় তাকে, খানিকটা জোর করেই…
তোমার বুকে কত রাত মাথা রেখে ঘুমিয়েছি, নিরাপদে, নিশ্চিন্তে চোখ বুজিয়ে, সে বুকে এতটা জমানো ব্যাথা ছিল বুঝি! সেবারে লোডশেডিং-এ হাতটাকে তুমি শক্ত করে চেপে ধরেছিলে, আমার আরেক হাতে তোমার নিপাট পাঞ্জাবির খুটটা কুঁকড়ে গিয়েছিল ভয়ে আমারই মত!
তোমার তো সেদিকে কোনো খেয়ালই ছিল না, তুমি তখন আমাকে জোনাকি দেখাতে ব্যস্ত… এইতো, গত পরশুতেও তো তুমি আমায় একা ছাড়লে না, ঠায় রাস্তায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলে, একসাথে বাড়ি ফিরলাম, আমি নাকি এখনো বড় হইনি, তাই তুমি আমাকে তোমার বাঁদিকে রেখে হাত ধরে নিয়ে বাড়ি ফিরলে,
কই, তখনও তো তুমি বুঝতে দাওনি তোমার বুকে এতটা জমানো ব্যাথা! বাড়ি ফিরতে দেরী হলে তুমি না খেয়ে বসে থাকতে, অপেক্ষা করতে, বাড়ি ফিরলে ভীষণ বকুনি দিতে, তখনও কি তোমার বুকের ভেতরটায় কষ্ট হত ভীষণ? ছোট্টবেলা থেকে সমস্ত গোপন তোমার কাছে উজাড় করে দিতাম, বড় হতে গিয়ে কিছুটা মেয়েলি আড়ষ্টতা সেখানে রাশ টানল, তুমি বোধহয় সেটাও বুঝতে, আমার মুখ দেখে মন পড়ে নিতে পারতে তুমি, অথচ আমি কোনোদিন বইয়ের বাইরে আর বিশেষ কিছুই পড়ে উঠতে পারলাম না!
জোনাকিদের দেশ এখান ঠিক কতটা দূরে? তারা ফোটে ওখানে? কালপুরুষ, সপ্তর্ষি আসে ওখানে রোজ রাতে নিয়ম করে? ওখানেও কি লোডশেডিং হয়? চিলেকোঠা জুড়ে রূপকথারা ছুটে বেড়ায় সেখানে? তুমি বলতে, কখনো কখনো বাঙ্ময়তাও শব্দমুখর হয়ে ওঠে, উফ্! চারিদিকে এত শব্দ কেন !
ওরা কি শান্তিতে দু-দন্ড কথাও বলতে দেবে না তোমার সাথে? তোমার গায়ের গন্ধ মেখে এতদিন বেড়ে উঠেছি, আর আজ তোমার কাছ থেকে বারবার টেনে সরিয়ে নিচ্ছে! তুমি এতটা নিথর হয়ে ওদের দুঃস্পর্ধাগুলোকে সহ্য করে যাচ্ছ! কেমন নিস্তেজ দেখাচ্ছে তোমায়! সাদা রঙটায় আজ যে তোমায় বড্ড ফ্যাকাসে লাগছে!
নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, নিস্তব্ধতা -এসবের মানে তখনও ঠিক বুঝতাম না, কতগুলো আক্ষরিক নকশা এই শব্দগুলোর প্রতি কোনো অনুভূতি জাগাতে পারেনি, তুমি বলতে সঠিক সময় আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে, এখন খুব বৃষ্টি হচ্ছে জানো, এলোপাথারি হাওয়া দিচ্ছে,
ধুলোগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে, কখনোবা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, মেঘে মেঘে আর্তনাদ হচ্ছে, খানিকটা চেনা সে আওয়াজ, সকালবেলা ওরা যখন তোমায় নিয়ে বেরিয়ে গেল তখনও যেন এইরকমই একটা আর্তনাদ আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল কি! জল জমছে চারিদিকে, রাস্তায়, গলিগুলোয়, বাড়ির সামনের উঠোনটায়, আর বুকের ভিতর!
আজ সারাদিন ঘরে আলো জ্বলেনি, এতটুকু আলোর শিখাও দেওয়ালগুলোকে ছুঁতে দিইনি, জানলা খোলা, দরজাটাও হাট করে খোলা, সেই কখন থেকে ঠায় এই কেদারাটায় প্রতীক্ষা করছি, যদি একটা-দুটোও জোনাকি আসে তোমার খবর নিয়ে…