৩
মিকিদির আমাদের বাড়িতে আসাটা ছিল, প্রতিদিনের সূর্য ওঠার মতো, না এলেই আশ্চর্য!
আজ মিকিদি সেজেছেও দারুণ, কাজলটা কেমন আশ্চর্য খোলতাই হয়, চোখ আর সরে না, মনে হয় তাকিয়েই থাকি, শুধু একমনে তাকিয়েই থাকি। আর হাসলে টোল পড়ে কমসে কম চারটে। দেখে দেখে আশ আর মেটে না।
এমন করলে মিকিদি কাছে এসে গায়ে হেলান দিয়ে চুপটি করে বসে, কখনও কোলে বসে, শোয়। কত আদর, কত আদর! কিংবা ভরাট সুরেলা গলায় ছড়া কাটে,
এই যা তুমি অবাক হয়ে দেখছো খালি খালি
এ রূপ তোমার, তোমার দেওয়া এ সোনালি ধানের ক্ষেতে মউ ভরা ধান নাচে
চোখ ছুটে যায় তোমার চোখের কাছে
গানের সুরে দোল খেয়ে যায় মন
মন চিনে নেয় মনের আপন জন।
আচমকা পেছন দিক থেকে বেড়াল হেঁটে হালুম শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিকিদি। এটা মিকিদির বরাবরের অভ্যেস, বদ অভ্যেসও বলা যায়। চমকে দিয়ে কি সুখ পায় কে জানে!
বললে বলে, হুঁ হুঁ তুই এসব বুঝবি না বাচ্চা ছেলে।
বলি, তো যারা বোঝে তাদের ভয় দ্যাখা না।
এসব করার পর মিকিদি বুকে মাথা দিয়ে দেখবেই মানে ধুকপুকুনি শুনবেই, বলবেই ইস সত্যি সত্যি ভয় পেলি! তুই কিরে! তুই বুঝি জানিস নে? দিদিও মিকিদির মত ভয় দেখায় আর হো হো করে হাসে।
ঠাকুমাকে বলে, ও ঠাম্মি, দেখে যাও তোমার নাতি কেমন ডরপুক!
ঠাকুমা বকলে দিদি আরো হাসে, হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ে। কি হাসির ছিরি! এ ননিয়ে কিছু একটা বললে, পিঠে একটা গুম করে কিল পড়বেই, আর চুল ধরে টান তো আছেই।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। মিকিদি, আজ আমি অন্য গন্ধ পাচ্ছি, বুঝতে পারছি একটা ঝড় উঠতে চলেছে ….। কেমন যেন মনে হচ্ছে, মনে, শরীরে আর তোর ব্যাগে ঝড় ও আগুন আনলি মিকিদি। তোর গলাও কেমন মধু মধু, শরীরে খেলছে জ্যোতি, এ জিনিস তুই আমাকে, মিকিদি, আগেও দিয়েছিস। আমাকে ঘনিষ্ঠ বেঁধে তুই নীল সাদা আকাশ, চলন্ত সূর্য, আর বাতাসকে সাক্ষী মানলি। কি হতে যাচ্ছে? মিকিদি তুই মাঝেমধ্যে এমন করিস না! কিচ্ছু বুঝতে পারি না। ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে মিকিদি দু’টি গোড়ের মালা বের করলো। মাগো, কাঁপন লাগে হাতে পায়!
চোখ তোল সোনা….. তাকা….. তাকা না! আমার জন্মজন্মান্তর! গাঢ় হয়ে আসে মিকিদির স্বর।
মিকিদি…..মিকিদি……..মিকিদি ……. মি কি দি…..! আমার মিকিদি শ্বাসভরা দীপ্তিতে ঝলমল করতে করতে মালা দু’টি আমাদের ঠাকুরঘরে নিয়ে গেল…….। আমাকে বলে গেল, গত সপ্তাহে দিয়ে যাওয়া নতুন জামা প্যান্ট পরে ফেলতে। হুম।
হুম, তাহলে মিকিদির এটা এক্কেবারে পরিকল্পিত প্রকল্প। মিকিদির পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। আনন্দ যে হচ্ছে না সেটা নয়, কিন্তু সেটা মিকিদি এসেছে বলে। নতুন পোষাক পরার আগে চট করে চানটা সেরে নিলাম। কেমন একটা শিরশিরাণি ভাব। মিকিদি এখনও ফেরেনি, রেডি মিকিদি, আমি রেডি, আয় এবার। বাব্বা, এতক্ষণ মন্দিরে কি করে রে! বেরতে গিয়েই মিকিদির গলা পেলুম।
এই সাতসকালে প্রণাম কেন রে! ঠাকুমা বলছে।
এমনি গো এমনি। পুজো দিলুম, একটু প্রসাদ নাও, হাঁ কর তো, হাঁ। দেখ দেখি মেয়ের কান্ড!
তা হ্যাঁ রে তোর কি আজ বিশেষ দিনটিন না কি?
না, না, ঠাম্মি, এমনি গো এমনি, বুঝলে ঠাম্মি, বুঝলে?
তোকে বোঝার সাধ্যি কি আমার আছে!
কি যে বলো না ঠাম্মি!
হাসি হাসি মুখে ঘরে ঢোকে মিকিদি। আমাকে দেখে হাসি যেন শতগুণ হলো। আমার কেমন যেন করে উঠলো শরীর, মন দু’টোই। গুড বয়, কাছে আসে মিকিদি, মালা দু’টো বার করে।
পরপর এপিসোডগুলো যেন সাজানোই ছিল। পরম সুখে থাকলে যেমন হয়, আমিও তেমনি, একবারও, কি করছি, কেন করছি, এসব বলিনি আর করিনিও। আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, প্রবল আবেগ-বন্যার জলের তোড়ে যেন ভেসে গেলাম! হৃদয়ের একূল ওকূল যায় ঐ ভেসে যায়, আমি কি আর আমি আছি! এই প্রথমবার, বারবার শোনা মিকিদির জন্মজন্মান্তরের কথা সত্যি মনে হল। মিকিদি আমার, মিকিদি আমার, মিকিদি তুই আমার, মিকিদি তুই আমার জন্মজন্মান্তরের! সেদিন শান্ত হতে আমাদের বেশ সময় লাগছিল। ঠাকুমা না ডাকলে বোধহয়…..। যাবার আগে মিকিদি মালা দু’টি নিয়ে নিল, যাই ঠাকুরের পায়ে দিয়ে আসি বলে উঠলো।
এবার মিকিদি পোষাক বদলাবে। ওর আদরের ঠাম্মির কাছে কাছে থাকবে, রান্না শিখবে আর মাঝে মাঝে আমার কাছে আসবে, একেবারে স্যারের মতই এটা ওটা পরামর্শ দেবে, বুঝিয়ে দেবে, করিয়ে দেবে। এই মিকিদিকেও চিনি হাড়ে হাড়ে। রেলের চাকরি ছেড়ে দিদির মতই ব্যাঙ্কে ঢোকার ধান্দা করছে নিজেও। সব যেন ঠোটস্থ!
ধ্যুততেরিকা! এত জোরে ব্রেক মারলো না! আনমনা ছিলাম বলে লাগল জোর। আগুপিছু না ভেবেই ড্রাইভারের একশো গুষ্টির ড্যাশ মারা শুরু হলো। তারপর সবাই জানলো আসল খবর। কিনা না কি, এক ইয়াং বাইকওলা, যেমন হয় আরকি, হঠাৎই রাস্তা ক্রশ করতে গেল, মেন রাস্তায় কে আসছে দেখার দরকার আর যার থাক বাইকওলার থাকতে পারেই না। ওড়ার জন্যে বাইক, বাইকের জন্যে ওড়া। মরলে মর তোরা। বাইকওলা জেনে বাসযাত্রীরা আরও ক্ষেপে গেল। আমি নিশ্চিত, বাইকওলার কিছু হলে এরা ড্রাইভার, কন্ডাকটারকে তো ছিঁড়ে খেতই, বাসটাও বাদ যেত না।
সামলে সুমলে বাস আবার চলতে শুরু করল। আজকের দিনের মতো অধিকাংশ দিনই ডান দিকের জানালার ধারে জায়গা মেলে। দেখতে দেখতে চলো, দেখতে দেখতে ফেরো। বি আর সিং হাসপাতাল ছাড়াতে বাসের বড্ড মায়া লাগে। একে একে আসে প্রথম খাল ব্রীজ, কমার্শিয়াল ট্যাক্স, খ্রীষ্টান কবরখানা, গান্ধী ভবন, ২য় খাল ব্রীজ, পার্সী টাওয়ার, বড় একটা খেলার মাঠ, জোড়া মন্দির – পরপর। আর গোটা বেলেঘাটায় রাস্তা জোড়া মনীষী মূর্তি, কে নেই? গান্ধীর মূর্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
বাস এগোতেই সাই কমপ্লেক্স, তারপর কলকাতা ইউনিভার্সাটির সল্টলেক কমপ্লেক্স, শ্রুশ্রুত আই হাসপাতাল, হোমিওপ্যাথি হাসপাতাল, আনন্দলোক হাসপাতাল, করুণময়ীতে বিদ্যুৎ ভবন, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, উচ্চমাধ্যমিক সংসদ, ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট ভবন, সেন্ট্রাল পার্ক – ইতিহাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসা। কে এম ডি এ, ময়ূখ হয়ে নামো জলসম্পদে। কণ্ডাক্টররা বিকাশ ভবন চেনে, চেল্লায়ও তাই বলে, পাশের নির্মাণ ভবনও, যার আগে নাম ছিল সেচ ভবন, চেনে না, চেনে না সিজিও, ইন্দিরা ভবন, যেখানে জ্যোতি বসু আমৃত্যু ছিলেন। ময়ূখ ভবনের পিছনে পূর্তভবনকে অবশ্য চেনে। পাশাপাশি কত অফিস, জমজমাট অফিসপাড়া, রাইটার্স থেকে যখন এই দপ্তরগুলো আসে তখন এত গমগম করতো না। একটু দূরেই সিটি সেন্টার। দিদি আর মিকিদি একদিন সবকিছু ঘুরে গেছে। বনবিতানেও আড্ডা মেরেছে। সেও দেখতে দেখতে অনেকদিন হয়ে গেলো।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মাঝপথে নামি, পার্শি টাওয়ারে ঢুকি বা গান্ধী ভবনে, মিকিদিকে বললে বলে, বেশতো নেমে দেখে আয়, তারপর আমাদের নিয়ে যাবি। একা একা আমার সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না, বলে বৎস, অপেক্ষা কর, সময় পালিয়ে যাচ্ছে না। হুম। আঙুল কামড়াই আর বলি, অপেক্ষা কর বৎস!
অপেক্ষা করতে করতে ভাবি, আর নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হিরোকে দেখতে পাই। কোথাও মারপিট হচ্ছে, দেখেই মনে হল, আঃ, আমি যদি দারা সিং হতাম, এক ঝাড়ে সবগুলোর দফারফা করে ছাড়তাম! লোকেরা অবাক হয়ে বাহবা ছুঁড়তো। কিংবা বড় একটা শাড়ির দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, মনে হবেই, ইস, যদি পয়সা থাকতো না, পুরো দোকানটাই মিকিদি আর দিদির জন্যে নিয়ে যেতাম! ওঃ, কী খুশিটাই হতো। পাড়া প্রতিবেশী ধন্য ধন্য করত।
কখনও হয়তো রেল ব্রীজের উপর দিয়ে যাচ্ছি, পাশাপাশি দু’টো ট্রেনকে যেতে দেখলেই মনে হবে, আরে, একলাফে পা দু’টো দু’টোর ছাদে রাখলেই তো বেশ হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া যায়! এসব শুনলে দিদি, মিকিদি হাসে, বলে পাগলের পাগলামি আর কারে বলে!
ছোটবেলা থেকেই তো কত পাগলামি, আগে মা, ঠাকুমা আর দিদি সামলাত। এখন মার বদলি মিকিদি।
দিদি মাঝে মাঝে খুব রেগে যায়, বলে, যা আজ থেকে আর দিদি বলবি না, মিকিকেও তোর সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দেব, পাগলামি তোর ছুটে যাবে।
সে যাইহোক, দিদি কিন্তু কাউকে বলতো না আর মিকিদিকে তো নয়ই, তবে খুব রেগে থাকতো। বাব্বা, কী রাগ! সত্যি সত্যি ক’দিন কথাও বলতো না।
নানা অছিলায় কথা বলার ধান্দা করলে কড়া করে বলতো, মাথা থেকে বাঁদরামির ভূত নেমেছে? পাগলামি তখন হয়ে যেত বাঁদরামি!
স্যার যদি কিছু বলতেন, তো স্যারকেও একহাত নিতে ছাড়তো না দিদি। আমার উপর রাগটা স্যারের উপর গিয়ে পড়তো।
দিদি বলতো, আপনি তো সাপোর্ট করবেনই, একই মেটেরিয়াল কিনা!
স্যারও রেগে যেতেন। বলতেন, এ বিষয়ে আর একটাও কথা বলতে চাই না। মর কাট, যা খুশি কর, চোখবন্ধ করে থাকবো।
দিদি আরো রেগে যেত। বলতো, তা তো থাকবেন, থাকবেন না! সেটা জানি তো।
(চলবে)