ছেলেবেলার তিনটি বুড়ো মানুষের কথা আজও ভুলতে পারিনি। এখনও তাদের নড়াচড়া যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রুনুপাড়া থেকে, যেখানে মামা ভাগিনা খাল শেষ হয়েছে, সেখান থেকে আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসতো এক বুড়ো মানুষ, অনেকটা পথ হেঁটে। হাজারীপাড়া, বাগমারী পোদপাড়া বা নস্করপাড়া, যারা কলকাতার বাগমারী থেকে এসে এখানে বসতি করেছিলেন, বাগমারী যেখানে প্রাক্তন সেচ মন্ত্রী সুভাষ নস্কর,
আমাদের সুভাষদার আদি বাড়ি, তখন তিনি জেলা পরিষদের সদস্য ছিলেন, গানপাড়া, যে পাড়াটিতে বাবাদের মামারা একাংশ শাঁকসরের বাউশহর বা বক্সর থেকে উঠে এসে বসতি করেছিলেন, বাগদীপাড়া ছাড়িয়ে আমাদের আটিপাড়ায়। আমাদের রান্না ঘরের পাশে ছিল ঢেঁকিশালা। সেখানে তাকে বসতে আর খেতে দিত মা।
আমরা ছোটরা অবাক হয়ে তাকে আর তার খাওয়া দেখতাম। খাওয়া শেষ হলে একটু বসে জিরিয়ে নিত বুড়ো মানুষটা। আমরা তাকে খুচরো কিছু পয়সা দিলে নীচুস্বরে প্রাণভরে আশীর্বাদ করত। তারপর একসময় লাঠি ঠুকঠুক করে চলে যেত। অন্য কারো বাড়ি যেতে বা ভিক্ষা করতেও আমরা তাকে দেখিনি।
এবার বলি কুঞ্জোবুড়োর কথা। এই বুড়ো মানুষটা থাকতো একেবারে বিদ্যাধরীর কাছের পাড়া, বুনোপাড়ায়। সে ছিল আঁটকুড়ো, মেয়েদের বিয়ে থা দিয়ে বুড়োবুড়ির সংসার। মাজা নুয়ে পড়েছে, হাঁটবার সময় তাই পিঠে লাঠি দিয়ে দু’বগলে চেপে হাঁটতো।
আমাদের বাড়ির কাছাকাছি তার বিঘে দেড়েক জমি ছিল। সেই জমিতে খোয়ালি, ধান রোয়া, এটা ওটা কাজে আমরা ছোটরা তাকে সাহায্য করতাম। ধান কাটার সময়ও এটা ওটা করে দিতাম। বিনিময়ে মিলত অকুন্ঠ আশীর্বাদ। খাঁটো ধুতি পরা কালো মানুষটা কথা বলতো খুব কম।
এবার বলি বিপত্নীক চক্কোত্তি ঠাকুরের কথা। তিনি বাবার বন্ধু, ফর্সা, লম্বা, শক্তপোক্ত শরীর, সরুপাড়ের ধুতি আর পাঞ্জাবী পরতেন। ওপার বাংলা থেকে এসেছিলেন। থাকতেন জমিদারের কাছারিবাড়ির ভিটেতেই। জমিদারীর কাজে সাহায্য করতেন। সঙ্গে বিধবা শাশুড়িও থাকতেন। আর বুনোপাড়ায় থাকতেন তাঁর মাসশাশুড়ি, বিধবা, সন্তানহীনাও।
আমি মাঝে মধ্যে বারার সঙ্গে যখন কাছারি গেলে ঠাকুরের শাশুড়ি আমার সঙ্গে গল্প করতেন। তাঁর বাঙাল ভাষা সবটা আমি বুঝতে পারতাম না। বলতেন, মেয়ে মারা গেলে জামাইকে তিনি আবার বিয়ে করতে বলেছিলেন, জামাই সে কথা শুনে নাকি বলেছিলেন, মানুষের আবার ক’টা বিয়ে করতে হয়? জামাইকে নিয়ে শাশুড়ির গর্ব ছিল খুব।