-” চিন্তা করো না গিন্নী… চিন্তা করো না। একটু ভাত দাও তো। মাছের ঝোলটা কিন্তু অসাধারণ রাঁধ গিন্নী। কেকার মা স্বামীর পাতে ভাত আর মাছের ঝোল তুলে দেন। তারপর চাটনির পাত্রটার ঢাকনা খুলতে খুলতে স্বামীর দিকে তাকান, ” কেমন মেয়ে দেখেছ। সেই সাতসকালে বেরোল এখনো আসার নামগন্ধ নেই। খাবেই কখন আর কলেজ যাবেই কখন।” -“তোমারই তো মেয়ে। শোনে কারোর কথা ?
ওর পড়াশোনারও যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। শালাবাবু যে কি লক্ষ্য রাখতেন !!” উদ্দালকবাবু খেতে খেতে মন্তব্য করলেন। উদ্দালকবাবু খাওয়া শেষ করে উঠলেন। কলেজে যাবার সময় হয়ে গেছে। এদিকে কেকা ও ভূবনের এখনো না ফেরাতে মনে মনে বিরক্ত হলেন তিনি।
এভাবে দিনের পর দিন যায়।
কেকা আর ভূবন বেস্ট জুটি হয়ে ওঠে কলেজে। কফিহাউস বল আর কোন পার্কই বল দুজনকে সর্বত্রই দেখা যায় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকতে। উদ্দালকবাবুর কলিগেরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে চর্চা করেন কিন্তু বলে ওঠার সাহস হয়নি কারোর।
খবর অবশ্য চাপা থাকে না কোনোদিন। এ খবরটাও চাপা থাকল না। অফিস বেয়ারারের মুখ হতে শুনলেন সবকিছু। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন উদ্দালকবাবু। -” মধ্যযুগীয় বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট নিয়ে পড়ে আছে সবাই। আরে এটা নতুন যুগ…. নতুন সময়। ওদেরকে ওদের মতো বাঁচতে দাও। বুঝলে জগদীশ, তোমাকে যারা খবর দিয়েছে তারা হাতেপায়েই বড় হয়েছে শিক্ষাতে নয়। ওদেরকে বলো কেকা ভূবনকে নিয়ে টেনশন না করতে। আমি আছি কি জন্য !!!! “জগদীশ মাথা নেড়ে বাধ্যতামূলক সন্মতি দেয়। Boss is always right.
আমার পাঠককূল এখন কি ভাবছেন আমি জানি। গরীবঘরের ছেলে ভূবন, সীমার মা বাবা তাকে এত আদর ভালবাসা দিল আর সে কিনা নতুন ডালে নৌকা বাঁধল। সীমার কথা আমি বাদই দিলাম। উঁহুহু…. বাদ যাবে কেন ? ভালবাসা কি সুখ সম্পদ বিত্ত বৈভবের কাছে ফেলনা ? আপনারাই বলুন প্রেম কি হাটেবাজারে সহজে কেনা যায় এমন দ্রব্য ? যার একটা ভালো কোয়ালিটি পেলে পুরানোটা বাদ !
মানুষ যেরকম ভাবে সেভাবে যদি জীবনটা চলত তাহলে তো কোন সমস্যাই ছিল না। কথায় আছে দাতা দেয় তো বিধাতা দেয় না। আমরা যা চাই তা ঘটে না, আর যা ঘটে তা অভিপ্রেত নয়। ভূবনও নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করেছে। কেকাকে সে প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারে নি। কেকাকে দেখলেই দু’চোখে ভেঁসে উঠত সীমার অপাপবিদ্ধ মুখ। কিন্তু যারা তাকে উচ্চশিক্ষার সূযোগ দিয়েছে, যারা তাকে সন্তান স্নেহে নিজেদের বাড়িতে স্থান দিয়েছে তাদের অবজ্ঞা করবেন কিভাবে।
কলেজে অনেকেই কেকা আর ভূবনের জুটিকে ঈর্ষার চোখে দেখত। এমনকি সময় সময় তা প্রকাশ করেও ফেলত। অনেকগুলো মেয়ে গাছের তলায় বসে আড্ডা মারছিল। হঠাৎ নজরে পড়ল ভূবন আর কেকাকে। সবাই মুখ তুলে তাকাল। – “কি জুটি রে, সবসময় বকবকম বকবকম করে বেড়াচ্ছে।” সেকেন্ড ইয়ারের একটা মেয়ে মন্তব্য করল।- “তোরা যা বলবি বল ভাই ওরকম শাসালো শ্বশুর পেলে ভালবাসা যেকারোরই উপচে পড়বে।” পাশের মেয়েটি মুখ বেঁকিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল। –
“দেখাই যাক ঐরকম লাইলা-মজনু ভালবাসা কতদিন টেকে ! ” প্রথমজন মন্তব্য করল। পরের কথাগুলো শোনার মতো ইচ্ছা আর কেকার ছিল না। সে ভূবনের হাত ধরে টানতে টানতে দূরে নিয়ে চলে। – চলে এসো। ঐসব বাজে মেয়েদের কথায় কান দিয়ো না। ওরা নিজেরা ডিপ্রেশনে ভোগে আর অন্যদের গলদ খুঁজে বেড়ায়। ওরা নিজেরাও সুখি নয় আর অন্যদের সুখও দেখতে পারে না।- কিন্তু কেকা ওরা যা বলছে তার সবটাই তো মিথ্যা নয়। তোমার বাবার আশ্রয়ে আমি আছি। তিনি দয়া করেছেন বলেই না… – “তুমি চুপ করো।
যা জানো না বলো না। বাবা তোমাকে কতটা ভালবাসে সেটা তুমি যদি বুঝতে পারতে তাহলে ও কথা বলতে না।” কেকা ভূবনের দুটো হাতকে দুহাতে চেপে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মুখটা আরো কাছে নিয়ে আসে। কেকার দুটো ঠোঁট ভূবনের ঠোঁটদুটোকে চেপে ধরে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভূবনের একটা হাত কেকার পিঠের উপর চলে আসে।
অপর হাতটি দিয়ে কেকার বাহুমূল চেপে ধরে।হঠাৎ পাশ হতে একটা কাশির শব্দ আসে। তাকিয়ে দেখে সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে তিমির দা। তিমির ওদের সিনিয়ার। তাহলেও দুজনকে খুব ভালবাসে।
-“কি রে মানিকজোড়, পাব্লিক প্লেসে ওইসব করাটা আন এথিকেল বস্। তাছাড়া ভালবাসা বড় সংক্রামক।” তিমির একচোট হেঁসে ওঠে।
-“এটা কিন্তু ঠিক নয় তিমির দা। এইরকম রোমান্টিক সিচুয়েশনে বাগড়া দেওয়াটাও আনএথিক্যাল ।” কেকার স্মার্ট জবাব।
-“হুমম্ ! সেটাও ঠিক। কিন্তু কেকা, ভূবন তো কোন কথাই বলছে না। এমন নয়তো কোন চন্দ্রাবলীর কথা ভাবছেন শ্রীমান। ” তিমির পরিহাস ছলে কথাগুলো বললেও কেকা যে কথাটা হাল্কাভাবে নেয়নি তা বোঝা গেল।
-” এমনটা কখনোই হবে না তিমির দা। আর যদি হয়ও তবে এক পাঞ্চে সেই চন্দ্রাবলীর নাকটা ভাঙতে আমার বেশি সময় লাগবে না। ” কেকা হাত মুঠো করে পাঞ্চ দেখায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় তিমির কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে তৎক্ষণাৎ সিচুয়েশন কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। ” আমি এমনি হাঁসির ছলে বলেছি কিন্তু। আই অ্যাম স্যরি ভূবন। “
-” না না স্যরি বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমিও কথাটা সিরিয়াসলি নিইনি।” কেকা মৃদু হেঁসে উত্তর দেয়।
তিমিরের কথায় আর যার যা হোক না কেন ভূবনের মনে একটা দ্বিধার জন্ম দিল। একদিকে সীমা আর অন্যদিকে কেকা। কাকে কাছে টেনে নেবে ভূবন,… আর কাকেই বা দূরে সরিয়ে দেবে ? আজ বড় অসহায় হয়ে পড়েছে ভূবন। ত্রিকোণ প্রেম কি একেই বলে ?
-” কি হল ভূবন তুমি তো কিছুই বলছ না। তিমির দার কথা না শেষপর্যন্ত সত্যি হয়ে যায়।” কেকা ভূবনকে প্রশ্ন করে।
-” না আমি আসলে অন্য কথা ভাবছিলাম।” ভূবন ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দেয়।
-“অন্য কথা ? কোথায় আছ তুমি ? ফ্যান্টাসি !!!” কেকা ভূবনের কথায় বিস্মিত হয়। তার কথায় এবার বিরক্তি ফুটে ওঠে।