সত্যবাদী কেকাও ছিল না। সীমার সাথে মেলামেশার ব্যাপারটা উদ্দালকবাবুর নজরে পড়েছিল বহুদিন আগেই। তিনি ভূবনকে নিষেধ করতে পারেননি। পরের ছেলে, আর যাই হোক তার উপর খবরদারি করতে উদ্দালকবাবুর মতো মানুষ পারেন না। তাই উল্টো পথে হেঁটেছেন তিনি। ভূবনের পেছনে লাখ লাখ টাকা টাকা খরচ করেছেন তিনি এই দিন দেখার জন্যে ! তাই সটান এসেছেন স্ত্রীর কাছে।
– আজ ভূবনকে দেখলাম। একটা মেয়ের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ হয়ে…. লজ্জ্বায় মরে গেলাম গিন্নী।
– “ভূবনকে !! তুমি ভুল দেখনি তো।” কেকার মা অবাক হয়ে যান স্বামীর কথায়।
– ভূল দেখলে আমিই সবচেয়ে খুশি হতাম গিন্নী। আমার কাছে অনেক আগেই খবর ছিল। জগদীশ অনেকবার দেখেছে। ওর বাড়ির পাশেই পার্ক। ওই পার্কেই যাতায়াত আছে দুজনের।
– তুমি কিছু বলবে না ?
– বলব না গিন্নী আমি করে দেখাব। তবে সেজন্য তোমাকে আমার দরকার।
– আমি ? আমাকে কি করতে হবে ?
– “কিচ্ছু না। শুধু মেয়েকে বোঝাও। ধরো ও যদি প্রেগনেন্ট হয় আর সে খবর ঐ মেয়েটার কানে গেলে সম্পর্কটা টিকবে তো” উদ্দালকবাবুর মুখে একটা বাঁকা হাঁসি ফুটে ওঠে।
এই শুরু। এরপর শুরু হয় সলতে পাকানোর পর্ব। কেকাকে তার মা ভালোভাবে বোঝায়। ভূবন এলে কিভাবে অভিনয় করতে হবে তার রিহার্সাল শুরু হয়ে যায়। মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়ে আনেন উদ্দালকবাবু। আর এসময়ই ঘটে যায় সেই অঘটন। ভূবনের পিতৃবিয়োগ ঘটে। ভূবন চলে যায় গ্রামের বাড়ি। আর সমস্ত পরিকল্পনার তখনকার মতো মুলতুবি ঘটে।
ভূবনের মনে হয় এই বিষয়টা নিয়ে সীমার সাথে একবার কথা বলাই ভালো। হয়তো সীমা তাকে ভুল বুঝবে কিন্তু এছাড়া আর উপায় কি ! সীমা যদি তাকে ক্ষমা করে দেয় তবে তবে তারা পালিয়ে যাবে অনেক দূরে। কেউ তাদের খুঁজে পাবে না। কিন্তু যদি সীমা তাকে ক্ষমা না করে…… । ভূবন গিয়ে দাঁড়ায় সীমার সামনে।
– “এভাবে ডাকলে কেন ? বিকেলে কফি হাউসে আসার কথা তো হয়েছিলই।” সীমা প্রশ্ন করে।
– আমার কিছু বলার আছে সীমা।
– বলে ফেল। এমন কোনদিন হয়েছে যে আমি তোমার কথা শুনিনি।
– আজ যা বলব তারপর তুমি আমাকে কি চোখে দেখবে জানি না কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হবে।
– ” এমন কি করেছ যে তোমায় ঘৃণা করব ! ” সীমা অবাক হয়ে ভূবনের মুখের দিকে তাকায়।
– আমাকে ক্ষমা কর সীমা। আমি তোমায় মিথ্যা বলেছি। উদ্দালকবাবুর মেয়ে কেকার সঙ্গে…..
– কি ? কি সঙ্গে…..
– ও প্রেগনেন্ট।
– আর ইউ ম্যাড ! তুমি কি বলছ জানো ? এবার বলবে নিশ্চয় ঐ সন্তানের বাবা তুমি….
ভূবন মাথা নেড়ে সন্মতি জানায়। সীমা আর অপেক্ষা করে না। সে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। ভূবন মূর্তির মতো স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এরপরের গল্প না শোনাই ভালো। উদ্দালকবাবুর চাপে আর কেকার আত্মহত্যার হুমকির কাছে মাথা নত করতে হয় ভূবনকে। পরের মাসেই শুভদিনে ভূবন সাতপাকে বাঁধা পড়ে কেকার সঙ্গে। বিয়ের আগে সীমার অনেক খোঁজ করেছে, দেখা হয়নি। যতবারই সীমার বাড়ি গিয়েছে ততবারই হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে ভূবনকে।
কেকার সঙ্গে বিয়ে, তিন তিনটে সন্তান, তাদের বিয়ে, নাতি পুতি – – – – এভাবেই সময়ের স্রোতে জীবনের দিনগুলো পার করে দিলেন ভূবনবাবু। বছর দশেক আগেই কেকা ছেড়ে গিয়েছে তাকে। আজ শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা। দুই ছেলে বড় বড় চাকুরে, বাবার কাছে আসার সময় পায় না। মেয়ে মাঝে মাঝে আসে থাকে কিছুদিন, কিন্তু বাবার সঙ্গে কেবল দেখা করে যায় মাত্র। কারোরই সময় হয় না।
অনেকে খুঁজছেন সীমাকে। খোঁজ পাননি। এতদিন পরে যে তাদের আবার দেখা হবে তা ভূবনবাবুর চিন্তাশক্তিরও বাইরে। হ্যাঁ পারছেন, পারছেন তিনি হাতটাকে নাড়াতে। ভূবনবাবু অনেক কষ্টে হাতটাকে পাশের স্ট্রেচারে নিয়ে যান। সীমার হাতটাকে চেপে ধরেন তিনি। সীমাও সাড়া দেয়। তাহলে সীমা কি চিনেছে তাকে ?
আস্তে আস্তে দুজনের হাতই শিথিল হয়ে আসে। এ দুনিয়ায় যে প্রেম পূর্ণতা পেল না সেই প্রেম পূর্ণতার খোঁজে এগিয়ে চলে মহাশূন্যের অন্তহীন পথে।
– – সমাপ্ত – – –
এখন পাঠকের কাছে আমার প্রশ্ন এই গল্পের খলনায়ক কে ? গল্পের কোন চরিত্র নাকি তিনি যিনি উপরে থেকে একের পর এক দৃশ্যের অবতারণা করছেন।