মারিয়ার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। সে মনে মনে কি যেন জপ করছে। আর ওদিকে জিগনেশ দেশাই কটমট করে চেয়ে আছে মারিয়ার দিকে। দেশাইয়ের চোখদুটো পাকা করমচার মতো লাল, গা থেকে সেই বিচিত্র গন্ধটা বের হচ্ছে।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর বিক্রম নিজের ঘরে চলে গেল। শরীর ক্লান্ত, শোয়ার মাত্রই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সে। এসির সোঁসোঁ আওয়াজ আর মৃদু নাসিকাধ্বনিতে ঘর মুখরিত হয়ে উঠল।
এইভাবে মিনিট চল্লিশ যাওয়ার পর দরজায় খুঁট্ করে একটা শব্দ হল। হাল্কা পায়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল একটা ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বিক্রমের লাগেজের দিকে। ট্রাভেল ব্যাগটাকে টেনে নিয়ে এক ঝটকায় খুলে ফেলল ব্যাগটা। তারপর তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজতে লাগল।–
ঠিক এসময় ছায়ামূর্তির পিছনে এসে দাঁড়াল আরেকটা ছায়ামূর্তি। দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি প্রথম ছায়ামূর্তির কানের পেছনে পিস্তল ধরে বলল, “তোমার খেল খতম মিস্টার দেশাই।”–
মিঃ দেশাই মাথার উপরে হাত তুলে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের লাইট জ্বলে উঠল। দুজন কপ সমেত পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকলেন।
” আপনার ইনফরমেশন একদম সঠিক ছিল দেখছি।” পুলিশ অফিসার বিক্রমের দিকে এগিয়ে গেলেন ।–
বিক্রম বলল, “আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। অন্য কেউ হলে আমার কথায় বিশ্বাস করে এতটা রিস্ক নিত না।” বিক্রম জিগনেশ দেশাইয়ের কলারে ধরে টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে এল। পুলিশ দুজন তড়িঘড়ি এসে জিগনেশ দেশাইকে বিক্রমের হাত হতে নিজেদের হেফাজতে নিল। দেশাইকে হলে বসানো হল। মারিয়াও এতক্ষণে হাজির হয়েছে।
মারিয়াকে দেখে জিগনেশ বলল,” আমাকে ধরিয়ে দিয়ে তুমি বেঁচে যাবে ভেবেছি ! হাজার সন্তান তার আদেশের অপেক্ষায় আছে, তোমাকে তারা ছাড়বে না।”
বিক্রম জিগনেশের দিকে তাকিয়ে বলল,” মারিয়া আমাদের কিছু জানায়নি মিঃ দেশাই। আপনার দুর্ভাগ্যই আমাদের দীর্ঘ কয়েক বছর পর একসাথে এনে দাঁড় করিয়েছে।”
পুলিশ অফিসার বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনারা নিজেদের মধ্যেই গল্পগুজব করবেন না আমাকেও কিছু বলবেন।”
বিক্রম হেঁসে বলল, “বলব অফিসার, সব বলব। কিন্তু কোন জায়গা থেকে শুরু করি ! হ্যাঁ, পেয়েছি। তাহলে শুনুন… “
বিক্রম শুরু করল,” আজ হতে বছর চারেক আগে দিল্লিতে একটা আর্কিওলজিক্যাল সামিট হয়। সেই সামিটে যোগ দিতে আসেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে নামকরা সব আর্কিওলজিস্ট। এই সামিটের কনভেনর ছিলেন মিঃ জিগনেশ দেশাই। মারিয়াও এই সামিটে অংশগ্রহণ করেছিল।
সামিট চলাকালীন আততায়িদের হাতে ছুরিবিদ্ধ নিহত হন এক সুইডিশ আর্কিওলজিস্ট। আমার ডাক পড়ে। ডেকেছিলেন অবশ্যই মিঃ দেশাই। ডাকবার কারণও ছিল। তদন্ত যখন শেষের মুখে তখন নানা দিক হতে হুমকি আসতে থাকে। নেতা, মন্ত্রী, প্রভাবশালী, বুদ্ধিজীবী কেউই বাদ গেলেন না হুমকি দিতে। আমি হাল ছাড়লাম না, কেস গুটিয়ে আনলাম।
যেটুকু জানা গেল তা রহস্যপিপাসুদের হতাশ করবে। সুইডিশ ভদ্রলোক মারা যাবার আগে কোনো গোপন অনুষ্ঠান দেখে ফেলেছিলেন। শুধু দেখেছিলেন তাই নয়, মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছিলেন। সুইডিশ আর্কিওলজিস্টকে হত্যা করে আততায়িরা তার রুম তন্ন তন্ন করে খোঁজে। মোবাইলটির হদিশ পায়নি। আমাকে মূলত ডাকা হয়েছিল মোবাইলটা খুঁজে বের করার জন্য।
আমি যাতে ওদের কিংপিনের কাছে পৌঁছতে না পারি তার জন্য পুলিশ হেফাজতেই আততায়িদের মেরে ফেলা হয়। “
অফিসার বললেন,” তা তো হল বিক্রমবাবু, কিন্তু মোবাইলটির কি হল ? “
বিক্রম পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভে বের করে অফিসারের হাতে দিয়ে বললেন,” মোবাইলটি আমার বাড়িতে আছে। এখানে আসার সময় আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলেছিল যে ভিডিও ক্লিপিংটার এই কেসে দরকার। তাই পেনড্রাইভটাতে ভিডিও ক্লিপিংটা কপি করে নিয়েছি। “
অফিসার মারিয়ার ল্যাপটপে ভিডিওটা চালালেন। ভিডিওটা অস্পষ্ট। তবুও বোঝা যায় কতগুলো মুখোশপরা লোক ফাঁসির দড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন অনুষ্ঠান করছে। অফিসারের চোখ কপালে উঠে গেল, তিনি বলে উঠলেন,” ও মাই গড ! ম্যাসনারি ব্রাদারহুড ! “
বিক্রম বলল,” হ্যাঁ, ম্যাসনারি ব্রাদারহুড। আর এদিন নবতম সদস্যা হিসাবে দীক্ষা হচ্ছিল মারিয়ার। মারিয়ার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা দেখে মিঃ দেশাইয়ের সন্দেহ হয়। তিনি মারিয়াকে চাপ দেন যাতে সে আমার কাছ হতে ভিডিও ফুটেজের ব্যাপারে জানতে পারে। কিন্তু মারিয়া হাজার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। “
মারিয়া ডুকরে কেঁদে ওঠে,” আমাকে ক্ষমা করে দাও বিক্রম। আমার কোনো উপাই ছিল না। “
বিক্রম বলল,” জানি। আর দীর্ঘ চার বছর পর সেই সূযোগ এল। হুয়াকোপার গুহার ভেতরে খননকার্য্য চালানোর সময় মারিয়া আর তার টিম খুঁজে পেল একটা মমি। কিন্তু তারা জানত না যে টিমের ভেতরেই লুকিয়ে আছে একাধিক ম্যাসনিক সদস্য। তারা মমিটাকে বদলে দিল একটা মৃতদেহের সঙ্গে। “
এবার অফিসার চমকে উঠলেন,” মৃতদেহ ! বলেন কি ! “
বিক্রম বলল,” হ্যাঁ অফিসার, মৃতদেহ। সন্দেহটা আমার তখনই হয়েছিল যখন আমি মমিটা দেখি। মমিটার চুলে কলপ করা হয়েছিল। কিন্তু মিঃ দেশাইয়ের টিম এটা ভুলে গিয়েছিলেন যে মৃত্যুর পরও দু’একদিন চুলের বৃদ্ধি হয়।
আর কলপ দেওয়া চুলের বৃদ্ধিই কাল হয়ে দাঁড়ায়। চুলের গোঁড়ায় সোনালী চুল দেখে আমার সন্দেহ হয়। আমি চুল আর দেহে লেগে থাকা চিপচিপে তরলের স্যাম্পল আপনার মাধ্যমেই ফরেন্সিকে পাঠাই। “
অফিসার সন্মতিসূচক মাথা নাড়েন। বিক্রম আবার বলতে থাকে,” ফরেন্সিক এক্সপার্ট ডঃ ভি আর জেকভ আমাকে হোয়াটস অ্যাপে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। রিপোর্ট অনুসারে মৃতের বয়স তিরিশের মধ্যে। সে একজন সোনালী চুলের ককেশিয়।
আর গায়ের চিপচিপে তরলটি একটা প্রাকৃতিক ড্রাগ। স্থানীয় আদিবাসীরা এই ড্রাগ আগে নরবলির কাজে ব্যবহার করত। যাকে বলি দেওয়া হবে তাকে মাখানো হত এই তরল। এর প্রভাবে ওই ব্যক্তি হ্যালুসিনেশনের পর্যায়ে চলে যেত। আর বলির সময় কোনো বাহ্যিক জ্ঞান থাকত না।
সম্ভবত কোনো হতভাগ্যকে খুব সম্প্রতি বলি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ড্রাগের অভারডোজে তার মৃত্যু হয়। “
মারিয়া বলল,” সব মিঃ দেশাইয়ের কারসাজি। উনিই আমাকে দিয়ে তোমাকে এখানে ডেকে আনা করিয়েছেন। আর ওই ডেডবডিটাও আমার চেনা। ও হল রবার্ট, এখানে বেয়ারার কাজ করত। কিন্তু তুমি পিস্তল পেলে কোথা থেকে ? “
বিক্রম অফিসারের দিকে তাকাল। অফিসার বললেন,” বিক্রমবাবু পরে আমার কাছে এসেছিলেন। আমি বিক্রমবাবুর অনেক নাম শুনছিলাম, তাই তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। মিঃ দেশাইয়ের ফেলে যাওয়া ডামিটাকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল। বিক্রমবাবু ছিলেন দরজার পাশে আলমারির আড়ালে। আর আমরা বাইরে থেকে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছিলাম।
অফিসার মারিয়া আর মিঃ দেশাইকে অ্যারেস্ট করলেন। গাড়িতে ওঠার সময় মারিয়া বিক্রমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। বিক্রম বলল, ” সাজা শেষ হলে চলে এসো আমার ওখানে। বন্ধুর কাছে বন্ধুর দ্বার সর্বদা অবারিত।”
যাবার সময় মিঃ দেশাই কটমট করে তাকালেন বিক্রমের দিকে। চিৎকার করতে করতে তিনি বললেন, ” ওহে ছোকরা, রেহাই তুমিও পাবে না। সবকিছুর বিচার হবে। তিনি আসবেন….তোমাদের পাপের শাস্তি দিতে তিনি অবশ্যই আসবেন……… “
–
–
–
–
পাঠকদের প্রতি নিবেদনঃ- কেমন লাগলো আপনারা মন্তব্যে জানান। আপনাদের অনুভবি মনই আমাদের রচনার ত্রুটি বিচ্যুতি ধরার একমাত্র কষ্টিপাথর।
–
–
–