=
সন্ধ্যার সময় মারিয়া বিক্রমকে নিয়ে গেল মিউজিয়ামের ভেতরে । একটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ভেতরে মমিটি রাখা আছে। মারিয়া বলল,” যা দেখবার দেখে নিন। আর দু’একদিনের মধ্যেই মমিটা জাতীয় মিউজিয়ামে চলে যাবে। “
=
বিক্রম ভালো করে মমিটা পর্যবেক্ষণ করল। একটা কুড়ি হতে বাইশ বছরের যুবকের মমি। মমিতে কোনো ঔষধি কাপড়ের প্রলেপ নেই। তবে দেহটির উপর একধরনের বিশেষ গন্ধবিশিষ্ট চিপচিপে তরলের প্রলেপ দেওয়া আছে। এই তরলটিই গুহার চেম্বার হতে পেয়েছিল বিক্রম।
=
মমিটার দেহে কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই। তাই এই যুবকটিকে ঠিক বলি দেওয়া হয়েছে কিনা বলা সম্ভবপর নয়। মারিয়া বলেছিল শিরোবন্ধনির কথা, না মমির মাথায় তো কোনো শিরোবন্ধনি নেই। বিক্রম এ বিষয়ে মারিয়াকে জিজ্ঞাসা করলে মারিয়া বলল, ” ওটা ভল্টে রাখা আছে। আমি বের করে আনছি।”
=
বিক্রম আবার মমিটার উপর মনোনিবেশ করল। মমিটার মাথার চুলগুলো ভালো করে লক্ষ্য করল বিক্রম। একি ! এই যুবকটি কি মৃত্যুর আগে চুলে রঙ করেছিল ? চুলের গোঁড়াগুলো সোনালী রঙের কেনো ? ইনকারা তো ব্লন্ড নয়।
=
সোনালী চুল একমাত্র ককেশিয়দের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। বিক্রম চারপাশটা দেখে নিল, না কেউ লক্ষ্য করছে না। এরপর পকেট হতে একটা স্যাম্পল শিশি নিয়ে তাতে মমির দেহের সেই চিপচিপে তরলের নমুনা আর খানদু’এক চুল ছিঁড়ে নিল। তারপর শিশি আর চুলগুলো একটা স্যাম্পল ব্যাগে ভরে পকেটে চালান করে দিল।
=
মিনিট দশেক পর মারিয়া এল। মারিয়ার হাতে একটা কাঁচের বাক্স। বাক্সের ভেতরে রাখা জিনিসটি খুব স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। মারিয়া বাক্সটি বিক্রমের হাতে দিল । বিক্রম বাক্স হতে জিনিসটা বের করে বাক্সটি টেবিলের উপর রাখল।
=
জিনিসটা অনেকটা ঘড়ির বেল্টের মতো, তবে গঠনগত দিক হতে একেবারেই আলাদা। বেল্টটি সোনার তৈরি। মাঝখানে একটা প্লেট আর দু’পাশে চেইনের মতো। মাঝের প্লেটটিতে ইনকা ভাষায় কিছু খোদাই করা আছে। জিনিসটা নেড়েচেড়ে দেখার পর মারিয়ার হাতে ফেরত দিয়ে দিল।
==
মারিয়া প্লেটের লেখাগুলো দেখিয়ে বলল, ” এই সেই শিরোবন্ধনিতে। আর এই হল সেই প্রাচীন ইনকা লিপি। এতে লেখা আছে “ইনটিপ ছুরিন” অর্থাৎ সূর্যের সন্তান।”
=
বিক্রম বলল, “আমার মনে হয় এই যুবকটিকে সূর্য্যেদেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়েছে, যাতে সে সূর্য্যেদেবতার কাছে যেতে পারে পুত্র হিসাবে। তবে বলির জন্য কোনো চিরাচরিত প্রথা মানা হয়নি। “
=
মারিয়া বলল,” হিউম্যান স্যাক্রিফাইস সন্মন্ধে তোমার অভিজ্ঞতা নেই তাই বলছ। একজন আর্কিওলজিস্ট হিসাবে আমি পৃথিবীর বহু জায়গায় গিয়েছি।
=
বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শন আমি নিজহাতে দেখেছি, তাই আমি জানি স্যাক্রিফাইস বা বলি ঠিক কি। বলি মানেই হত্যা নয়। সংস্কৃতে বলি মানে উৎসর্গ, সেটা যে কোন প্রানী বা মানুষই হতে হবে এমন কোনো মানে নেই।
=
প্রাচীন ইউরোপে শিশুবলি ছিল তাদের একটা কাল্ট। সেখানে শয়তানের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হত। হিন্দুদের মধ্যে কাপালিকরা নরবলির ব্যাপারে কুখ্যাত।
=
আর শক্তি উপাসনায় পশুবলি তো চলে আসছে। ইহুদিরা তাদের ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে গোবৎস্য উৎসর্গ করত ।পরবর্তী কালে খ্রীষ্টধর্মের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে যায়। আমার মতে বৈষ্ণব, বৌদ্ধ আর জৈন ধর্মের মতো কিছু ধর্ম ছাড়া প্রায় সব ধর্মেই বলির বিধান আছে। স্যাক্রিফাইস বল, বলি বল বা কুরবানী বল এগুলো সবই কিন্তু প্রাচীন রীতি। একটা জীবের ভেতরে যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি থাকে সেই প্রাণশক্তির নির্গমনই এর উদ্দেশ্য। “
=
বিক্রম শান্ত হয়ে শুনতে থাকে। মারিয়া বলতে থাকে,” নরবলি ছাড়াও ইনকা সভ্যতা আরেকটি কারনে রহস্যময়, সেটি হল গুপ্তধন। আনুমানিক ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এক মহামারী শুরু হয়। এই মহামারীতে তদানীন্তন ইনকা রাজা ও তার ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী মারা যান।
=
রাজার অন্য পুত্র অ্যাটাহুয়ালপা তার ভাই হুয়াস্কার বা মানকোর সাথে সিংহাসন নিয়ে লড়াইয়ে মেতে ওঠেন। অ্যাটাহুয়ালপা এই যুদ্ধে জিতে গেলেও পরবর্তীতে স্পেনীয় ঔপনিবেশিক ফ্রান্সিস পিজারো অ্যাটাহুয়ালপাকে পরাজিত ও হত্যা করে মানকোকে সিংহাসনে বসান।
=
অ্যাটাহুয়ালপার মৃত্যুর পর ইনকারা তাদের সমস্ত সোনা গলিয়ে একটা শিকলের আকার দেয়। সেই শিকল তারা দুর্গম কোনো স্থানে লুকিয়ে রাখেন। আজও সেই বিশাল শিকলের সন্ধান পাওয়া যায় নি। “
=
বিক্রম এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার সে নৈশব্দ ভাঙ্গে। ” তুমি কি ভাবছো জানি না, তবে আমার ধারনা এই মমির সাথে অ্যাটাহুয়ালপার গল্পের একটা সন্মন্ধ আছে । “
=
মারিয়া বলল, ” তাহলে তুমি বলতে চাও যে এই মমির সাথে গুপ্তধনের সম্পর্ক আছে। “
বিক্রম হাত হতে গ্লাভস খুলতে খুলতে বলল,” ডেফিনিটলি। ইনকারা সূর্যের উপাসক। আর সূর্য্য এবং সোনা হল সমার্থক। সূর্যের সন্তান মানে সোনা দিয়ে তৈরি। আর তাছাড়া অ্যাটাহুয়ালপার বাবার নাম কিন্তু ‘হুয়া-কাপাক’, এমন তো নয় যে এই হুয়া-কাপাক হতেই হুয়াকোপা শব্দ এসেছে।”
মারিয়া বিস্মিত হয়ে বলল, “ও মাই গড ! এদিকটা তো আমি ভাবিইনি। “।
=
আজ রাত্রে আবহাওয়া ভালো ছিল। রাত আটটা নাগাদ প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। আকাশে বাতাসে তাই শীতলতার স্পর্শ। মারিয়া আজ নিজে রান্না করেছে। ইন্ডিয়ান ডিশ। চিকেন বিরিয়ানি, পনির কারি, আর বেগুন ভাজা। দিল্লিতে গিয়ে ও যা যা খেয়েছে তার ইন্টারনেট সংস্করণ হাজির করেছে খাবারের টেবিলে। বিক্রম কিন্তু একটু ভয়ে ভয়ে আছে। যত সময় যাচ্ছে মারিয়ার গিন্নী গিন্নী ভাবটা ক্রমাগত বাড়ছে। এটা ভালোবাসার একটা অন্যরকম প্রকাশ।
=
=
…. চলবে