প্রত্যাবর্তন
.
কে ডাকে আমাকে ?
আজ পঞ্চাশ বছর পর এই ঈদগা’র ময়দানে এসেছি আমি , আর ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের এই জায়গাটিতেই আমি বসে আছি। সেদিন প্রথম আমার আব্বুর হাত ধরে আমি এখানে আসি। আব্বু হাত ধরে এনে এই নামাজের কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, ভিড়ে নয়, লাইনের একধারে বসো।
আজ আমার আব্বু নেই, আমি একাই এসে বসেছি। সেজদা দিতে দিতে মনে হল, আমার আব্বু এসে পাশে দাঁড়িয়েছে আর ওই একই কথা বলে চলেছে , ভিড়ে নয়, লাইনের একধারে…..
নামাজ কখন শেষ হয়ে গেছে জানি না। আমি আব্বুর পাশে বসে আছি। আমার বয়স দশ বছর। ভিড়ে হারিয়ে যাব না তাই শক্ত করে আব্বুর আঙুল ধরে আছি। হঠাৎ কে যেন ডাকল, উঠে আসুন ! সবাই চলে গেছে !
আমি পেছন ফিরে উদাস হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছি ।
খদ্দের
.
এই গলিতেই কি দাদার বাড়ি ?
৭/৩ রহমাতুল্লা অ্যাভিনিউ, এটাই তো হওয়ার কথা ! মোড়ে পানগুমটির দোকান। সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘ হরিশের মিঠা পান’ । তাহলে তো ভুল হবার কথা নয় !
সমস্ত গলি জুড়ে আবছা আলো। ঠেলাগাড়ি ও ট্রলির উপর ঘুমিয়ে পড়েছে মানুষজন। কয়েকজন নারী ও পুরুষ এদিক ওদিক চলাচল করছে। ফিসফাস কথা বলার আওয়াজ আসছে। রাত প্রায় বারোটা। শহরে অবশ্য এরাত কিছুই নয়। সারি সারি ছোট ছোট ঘরগুলিতে মিটমিটে আলো। ভিতরে কীসব কাজ করছে কিছুই অনুমান করা যায় না। দাদার বাড়িটা কি তবে পেরিয়ে চলে এলাম ? কাকেই বা জিজ্ঞেস করা যায় ? ভাবতে ভাবতে আর একটু এগিয়ে যায় রমিত। সামনে যতদূর দেখা যায় রাস্তা প্রায় বন্ধ। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ অন্ধকারে কে রমিতের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ?
— কে ?
— আমি ! আজ একটাও খদ্দের পাইনি, আসুন, সস্তায় হয়ে যাবে !
— কোথায় যাব ?
— এই তো আমার বাসায় !
আর ভাববার সময় পায় না রমিত । সারাদিনের ক্লান্তি আর ঘোরের মধ্যে এগিয়ে চলে তার সাথে। যেতে যেতে বলে , এই গলিতেই আমার দাদা থাকে মহসিন গাজী। চেনেন তাকে ?
মেয়েটি হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। গলা নামিয়ে বলে, আমি তারই আগের পক্ষের বউ।
রমিত আর স্থির থাকতে পারে না। অন্ধকারে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে , ওঃ জাহানারা ভাবি !
শাস্তি
.
একবার দুবার বারবার চুমু খেতে থাকে ওকে। চুমু খাওয়ার যেন নেশা ধরে গেছে। আজ প্রায় তিনমাস ওর দেখা নেই। কোথায় গিয়েছিল তাও জানায়নি। মোবাইলও সর্বদা সুইচ অফ। এই তিনমাস শুধু খাওয়া দাওয়া ছেড়ে রাত জেগে দুশ্চিন্তায় কী কষ্টে কেটেছে দীনেশের তা কাকেই বা বোঝাবে !
যার কথা বলছি সে তো দীনেশের প্রেমিকা উৎসা। আঠারো অতিক্রম করে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। দীনেশের পড়ার রুমে তার অবাধ যাতায়াত। এটা লিখে দিতে হবে। ওটা করে দিতে হবে। কী করে আবৃত্তি করে দেখিয়ে দাও — প্রতিদিন কতই না আবদার। আর এই করে করেই তাদের স্বপ্নের বাগানে অনেক গোলাপ ফুল ফুটে গেছে।
উৎসার লাল ঠোঁট চুমুতে চুমুতে শিশির সিক্ত গোলাপ।
— এতদিন কোথায় গিয়েছিলে !
উৎসা নিরুত্তর ।শাস্তি স্বরূপ আরও চুমু।
— মোবাইল সুইচ অফ কেন ?
উৎসা নিরুত্তর। শাস্তি স্বরূপ আরও চুমু।
— আমার কথা মনে পড়েনি ?
উৎসা নিরুত্তর। শাস্তি স্বরূপ আরও চুমু।
এবার ওর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকে। ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে দীনেশের কোলে।
দীনেশ জানতে চায় , কাঁদছ কেন ?
এবার আরও বাঁধ ভাঙা কান্না নেমে আসে। উৎসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে থেমে বলে, আজ একটা কথা বলতে এসেছি। আগামী দশই ফাল্গুন আমার বিয়ে। বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না !…
কথাটা বলতে বলতেই ওর ঠোঁট কাঁপল। দীনেশেরও কথা হারিয়ে গেল ।
টান
.
হুহু শব্দে রাত্রি ভেদ করে ট্রেন ছুটে চলেছে। অধিকাংশ যাত্রীই তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ট্রেনে তেমন ভিড় নেই বললেই চলে। কিন্তু কোথায় চলেছে ট্রেনটি ? এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সুমন। একজন যাত্রীকে জিজ্ঞেস করাতে, সে বলল, মুম্বই মেল।
ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে সে। মা অসুস্থ। বাবার কাজ নেই। সুমন বেকার। দু’পয়সাও রোজগার করতে পারে না। পাড়াপ্রতিবেশীরা এসে তার দিকেই আঙুল তুলছে। এত বড় দামড়া ছেলে বসে বসে খায় ! দুনিয়াতে কি সবাই চাকরি করে ? অন্য কাজ কি নাই ?
কথা ক’টি সহ্য করতে পারে না সুমন। নিজের বিবেক দহনে এক জ্বালা অনুভব করে। তারপর কেউকে কিছু না বলেই ট্রেনে চেপে বসে। কোন্ ট্রেন তাও জানে না। টিকিটও নেই তার। থেকে থেকে চোখের সামনে মায়ের যন্ত্রণাকাতর মুখখানা ভেসে ওঠে। তবে কি আগের স্টেশনে নেমে যাবে সুমন ?
ট্রেন ছুটছে।
মা বলেছিল, বাবা, আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে ?
সত্যিই তো, মায়ের কিছু হয়নি তো ?
সুমন ট্রেনের গেটে এসে দাঁড়ায়। উপলব্ধি করতে থাকে কে যেন নিচের দিকে টেনে নামাচ্ছে তাকে ।…