বিক্রম হেসে বলল,” অঘোরবাবু, আপনি সত্যিই ছেলেমানুষ, বয়সটাই যা হয়েছে। দেবলীনা বেচারী কি করবে বলুন, ও না পারছে আমাকে ছেড়ে যেতে আর না পারছে বাবা মায়ের মনে দুঃখ দিতে। সে যাকগে, খাওয়া দাওয়া সেরে নিই সকাল সকাল।”
বিক্রমের কথা শেষ হতে না হতেই মাধবদা হাজির। ” দাদাবাবুরা সব চলে আসুন, খাবার রেডি। ” মাধবদার আহ্বানে আর না সাড়া দিয়ে পারলাম না। টেবিলে পৌঁছেই দেখি এলাহি আয়োজন, বুঝলাম এসবের পেছনে একমেবাদ্বিতীয় অঘোরবাবু। আমরা তিনজনেই অবশ্য খাদ্যরসিক। অঘোরবাবু খাঁসির মাংসের প্লেট চেটেপুটে সাফ করে দিলেন, বিক্রমও কম যায় না। ওদের মধ্যে আমিই একটু যা নড়বড়ে, পরোটার গুনতিতে ওদের ধারেকাছে যেতে পারলাম না। খেয়েদেয়েই নিদ্রার ব্যবস্থা।
পাশাপাশি দুটো ঘরের একটা বিক্রমের রেজিস্টার্ড ঘর, সেখান কারোর অ্যালাউ নেই। পাশেরটাতে আমি আর অঘোরবাবু। বিছানার পাশে টেবিলে বেশ যত্ন করে রাখা হয়েছে ক্রিস্টাল ড্রাগনটাকে। অঘোরবাবু বিছানায় উঠেই ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়েন, ” সবই মায়া সায়ক, সবই মায়া । এ জগতে কে কার ? পেটই ব্রহ্ম। এই দেখ পরোটা আর কষা মাংস খেয়ে উদরের পূর্ণতার সঙ্গে সঙ্গে কেমন সন্ত সন্ত ভাব আসছে। এটাই ব্রহ্ম জ্ঞান।”
আমি বললাম, “বিয়েসাদী তো করেননি, তাহলে এই মোহে পড়ে না থেকে সাধু সন্ন্যাসী হলেন না কেন ?” উত্তরে শুধু দুটো শব্দই কানে এল,” সব মায়া……. ” এরপরেই সেই মারাত্মক ব্রহ্মনাদ, ঘড়ঘড় নাকের আওয়াজ। আমিও শশাঙ্কশেখরবাবুর ডায়েরিটা বের করলাম। আধশোয়া হয়ে আমেজ করে পড়তে লাগলাম।
শশাঙ্কশেখরবাবু লিখছেন, ‘আমি আমার সুস্থ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত, কে কি বলল তাতে যায় আসে না। শয়তানের বাচ্চাটাকে আমি ছাড়াও রাজা এবং পাইকপেয়াদারা সবাই দেখেছে, যদিও পাইকপেয়াদাদের মধ্যে হাতেগোনা দু’চারজনই বেঁচে ফিরেছে । কালকে রাজসভায় যাব। মহারাজের খবরটাও নেওয়া দরকার।
আজকে শরীরটা বেশ সুস্থ্য লাগছে। শ্রাবণের শেষ হতে চলল, বর্ষার প্রকোপ এখনো যথেষ্ট। জায়গায় জায়গায় ধ্বস নামা অব্যাহত। রাজসভায় পৌঁছেই মহারাজের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনিও যথেষ্টই উদ্বিগ্ন। এ অঞ্চলে তান্ত্রিক বজ্রযানের প্রভাব অত্যধিক বলে দিন দু’য়েক ধরেই রাজার মঙ্গলার্থে তান্ত্রিকেরা আসছেন ও কেরামতি দেখাচ্ছেন। এদেরকে স্থানীয় লোকেরা যমের মতো ভয় পায়। এঁরা পারেন না এমন কাজ নেই, মারণ বশীকরণ উচাটন সব বিদ্যাতেই এরা সমান পারদর্শি।
বজ্রযানের মতে মনকে এককেন্দ্রিক করতে হবে চিত্তশুদ্ধি ও যোগের মাধ্যমে। এইভাবে মন হবে বজ্রের মতো কঠিন, তাই এই পন্থাকে বজ্রযান বলে। মন এককেন্দ্রিক হলেই আসে মহানির্বাণ, আর এই মহানির্বাণে যোগী বিজ্ঞান, শূন্যতা ও মহাসুখ লাভ করেন। চর্যাপদেও এই মহাসুখের বিশেষ উল্লেখ আছে। এই পরম জ্ঞানই হল নৈরাত্মা, এই নৈরাত্মাতেই আত্মা লয়প্রাপ্ত হয়। হেবজ্রতন্ত্রে হেবজ্রের শক্তি হলেন নৈরাত্মা। অতীশ দীপঙ্করের গুরু জেতারি ছিলেন এই বজ্রযানের অন্যতম প্রবক্তা।
এই বজ্রযান হল হিন্দু তন্ত্রের বিস্তৃত এবং বিকৃত রুপ। এই শাখাতে পঞ্চমকার, মারণ, উচাটন, স্তম্ভন ইত্যাদি গুপ্তক্রিয়া প্রচলিত ছিল। রাজার সভায় আসা লামারা এক একজন বড় বড় তান্ত্রিক। তন্ত্রশাস্ত্র এরা গুলে খেয়েছেন। সভায় আসা যাওয়ার ফলে তান্ত্রিকদের সাথে আমার আলাপ পরিচয় গড়ে ওঠে। কিন্তু সেদিন আমি খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
সেদিন রাজসভাতে এসেছিলেন একজন বজ্রযানী মহাতান্ত্রিক মোহাবেশ। উনি নাকি তিব্বতের কোনও এক দুর্গম জায়গায় থাকেন। রক্তবাস পরিহিত তান্ত্রিক মোহাবেশের মুণ্ডিত মস্তক ও কপাল প্রশস্ত। চোখদুটো জ্বলছে আগুনের ভাঁটার মতো। তার চোখের দিকে তাকাতেও যে সে লোকের সাহসে কুলোবে না। কেন জানি না প্রথম হতেই মোহাবেশের নজর ছিল আমার উপর। মহারাজের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ব্রাহ্মণসন্তান বলে বেঁচে গেছ।”
আমি সভয়ে বললাম, “কিন্তু মহারাজও তো ছিলেন..”
মোহাবেশ একটা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেন, “ওহে অর্বাচীন, ওই শয়তানের আসল লক্ষ্য ছিলে তুমি, মহারাজ নয়। তোমার উপর মারনক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়েছে। আর তা করেছে তোমার দেখা ওই ভণ্ড সন্ন্যাসী। “
মোহাবেশের কথা মানতে আমার মন সায় দিল না। আমি প্রকাশ্যে কিছু না বললেও মোহাবেশ আমার মনের কথা কিছুটা আঁচ করতে পেরে বললেন,” বিশ্বাস হচ্ছে না ! তাহলে আজ রাত্রে পেছনের পাহাড়ের মাথায় এস। আমি এখন ওখানেই আছি। “
বিকেল হতেই বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের দিকে। আমার সঙ্গে আমার বিশ্বস্ত কাজের লোক শেরিং। পাহাড়ের তলদেশে আসামাত্রই শেরিংয়ের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। সে আর একপা’ও অগ্রসর হতে চাইল না। আমি জোরাজুরি করতেই সে বলল,” আর না যাবে সাবজী, ও লামা বহুৎ খতরনাক আসে। ” আমিও আর শেরিংকে জোরজবরদস্তি করলাম না। একাই উঠতে লাগলাম পাহাড়ের ঢাল বরাবর।
কিছুটা উঠতেই একটা চাতালের মতো জায়গা দেখতে পেলাম। পাহাড়ের ঢালে এমন ফাঁকা চাতাল সচরাচর দেখা যায় না। সেই ফাঁকা চাতালের একেবারে মাঝখানে একটা হোমকুণ্ড, হোমকুণ্ডের পাশে বজ্রাসনে বসে তান্ত্রিক মোহাবেশ । হোমকুণ্ডের চারপাশে সিন্দূর, তেল, নরকরোটি আর হাড়ের মতো বিভৎস সব দ্রব্যের সমাবেশ। উপকরণগুলির মধ্যে সবচেয়ে যেটা নজর কাড়ছে সেটা হলো দুটো স্ফটিকের ড্রাগন, একটা লাল আর অন্যটা নীল।
কাঠি দিয়ে যন্ত্র আঁকতে আঁকতে মোহাবেশ বললেন, “বসো।” একটিবারও আমার দিকে তাকালেন না। আমি সন্মোহিতের মতো বসে পড়লাম। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ যেন আমাকে বেঁধে রেখেছে, মোহাবেশের নাম সার্থক, মোহের আবেশে বাঁধা পড়েছি যেন। হোমকুণ্ড জ্বলে উঠল, তান্ত্রিক মোহাবেশ মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন। মন্ত্রের তালে তালে দুলে দুলে উঠছেন। বিভিন্ন উপকরণ একে একে হোমকুণ্ডে উৎসর্গ করে চলেছেন। আর ড্রাগনদুটো একটু একটু করে ঊজ্জ্বল হয়ে উঠছে। একটা অজানা গন্ধে চারিদিক ভরে উঠেছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি সীমাহীন এক অন্ধকারে, যেখানে সব ভ্রান্তি সব শূন্য।
সকালবেলা শেরিংয়ের ডাকে চেতনা ফিরল। “ও সাবজী, ও সাবজী, উঠেন। সারি রাত অপেকছা করলাম, ফিরভি আপনি অলেন না, তো সুবহা আর অপেকছা না কোরে আসে গেলাম।”
শেরিংয়ের কাঁধে ভর দিয়ে কোনোক্রমে পাহাড় হতে নেমে এলাম। সারা শরীরে একটা অবসন্ন অবসন্ন ভাব। ঘরে ফিরেই আবার অবাক হওয়ার পালা, দেখি শেরিংয়ের হাতে লাল রঙের সেই ড্রাগনটা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,” এই ড্রাগনটা তোমার কাছে কিভাবে এল শেরিং ? “
শেরিং থতমত খেয়ে বলল,” আপনার শরীর কে নিচে এইঠো দাবিপড়ি থি সাবজী। আসার সোময় আমি লে এসেছি।”
ড্রাগনটাকে। হাতে তুলে নিলাম। কি অপূর্ব কারুকার্য! লাল রঙের স্ফটিক দিয়ে তৈরি এই ড্রাগন, – সম্ভবত রক্তমুখী নীলা। ড্রাগনটার চোখদুটো যেন অপরিসীম ক্রোধে জ্বলছে, মুখ হতে বেরিয়ে আসছে লেলিহান আগুনের শিখা। সঙ্গে সঙ্গে আগের রাতের ঘটনাগুলো ভেঁসে উঠলো চোখের সামনে। তাহলে কি আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই স্ফটিক ড্রাগনটা আমার শরীরের নিচে চাপা পড়ে যায় ! ঠিক কি হয়েছিল সেসময় ? নিজের মনেই উত্তর হাতড়াতে থাকি, উত্তর মেলে না।
ইতিমধ্যে রাজামশাই খুবই অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন, তাকে চিকিৎসার জন্যে কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। আমি রাজামশাইয়ের সঙ্গী হলাম । কলকাতায় পৌঁছেই কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেল। রাজামশাইয়ের ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করা, সাহেব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা, গ্যাংটকের সঙ্গে চিঠি চাপাটির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা, আরো কত কি। সেই ব্যস্ততার মধ্যেই ভুলে গেলাম স্ফটিক ড্রাগনটার কথা।
এমনই করে একটা সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। রাজামশাই এখন একটু সুস্থ্য, ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। মাঝরাত্রে একটা ভীষণ দুঃস্বপ্নে ঘুমটাও ভেঙ্গে গেল। স্বপ্নে দেখলাম জলের মাঝখানে একটা মন্দির, আর সেই মন্দিরে পাহারা দিচ্ছে লাল আর নীল রঙের দুটো ভীষণাকার ড্রাগন। মন্দিরের বেদীতে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বসে ‘নাংগা লামা’, আর আমার সামনে ভ্রূকুটি কূটিল নেত্রে তাকিয়ে আছেন তান্ত্রিক মোহাবেশ।
… চলবে