.
.
নাসিম এ আলম (১৯৬৬)এই মুহূর্তে আমার মনে হল বাংলা কবিতায় একটি জীবন্ত কিংবদন্তি । নব্বই দশকের বাংলা কবিতার ইতিহাস জানতে হলে কবি নাসিম এ আলমের নাম প্রথম সারিতেই উচ্চারিত হবে। নব্বই দশক থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল : আইরিশ কলোনীতে সন্ধ্যা, ময়ূর ক্লান্ত মানে বর্ষা শেষ হল, লিটল ম্যাগাজিন ও অন্যান্য কবিতা, চাঁদসদাগরফিরে আসবে, দ্রোহকাল, ধুলোর নির্জনে লেখা ইত্যাদি।.
.
বীরভূম জেলার নিমড়া গ্রামে থাকেন কবি। তাঁর মায়ের পিতা ছিলেন এম আব্দুর রহমান (১৯০৯ —১৯৯২) বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও লেখক। বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন । তাঁরই কন্যা ফাতেমা খাতুনের ছেলে নাসিম। পিতার নাম নুরুল আবসার।.
.
বাংলা সাহিত্য নিয়ে রবীন্দ্রভারতীতে মাস্টার ডিগ্রি করার সময়ই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৮৮ সাল থেকে অনিয়মিত “কবিতা উৎসব” পত্রিকাটি সম্পাদনা করছেন। ইতিহাস ও বিজ্ঞান দুই শাখাতেই তাঁর সমান আগ্রহ। নাসিম মনে করেন জীবন ভালবাসার, ঐতিহ্য আর পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই তাকে গড়ে তোলা সম্ভব। ভৌগোলিক সীমারেখাকে তিনি মানেন না। মানেন না সময়ের বিভক্তিকরণকেও।.
.
তাই নিজের সত্তাকে দেখতে পান মিশরের পিরামিডে, গ্রীসের রাস্তায় ও আইরিশ কলোনিতে। অন্যের মুখে যেমন নিজের মুখ, তেমনি নিজের মুখেও অন্যকে উপলব্ধি করেন। রহস্যলোকের চাবি খোঁজেন এভাবেই । কলকাতা নয়, গ্রামই কবির কাছে মাতৃস্নেহের ছায়া দেয়।.
.
হৃদয়ের গান শোনায়। চাঁদসদাগর আবার ফিরে আসবে ধনধান্যে পূর্ণ করতে এই ধ্বংস ম্লান বাংলায়। কবির এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই কাব্যবোধের বিস্তার। মঙ্গল কাব্য থেকে বাউল, পিরামিড থেকে মাটির কুটির, গুপ্ত যুগ থেকে মুঘল যুগ সব একাকার হয়ে যায় তাঁর কাছে। তবু শান্ত স্নিগ্ধ মাতৃ বন্দনা কবির :.
.
“মাঝে মাঝে ফিরে আসে একই ভেলা, স্তব্ধ নদী, জল
সোনালি ইলিশ খুব সঙ্গত মনে হয়
সঙ্গত মনে হয় তীরের খয়েরি চিল, হেলে পড়া অশ্বত্থের ডাল
মিটিং মিছিলে ঝড় ওঠে, সভাঘর গমগম করে
কে পাবে নদীর অধিকার।”.
.
.এই নদী শিবের, এই নদী ব্যাসদেবের, এই নদী মৎস্যকুমারীর, এই নদী বেহুলার এবং এই নদী চাঁদসদাগরের। তাই বাংলা ও বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতি এই নদীকে কেন্দ্র করেই। এই নদীকে কেন্দ্র করেই বেঁচে থাকে বাঙালি, ঐতিহ্য আর অনন্ত ভালবাসায়।
.
নাসিম মানব রসায়নের প্রত্ন ইতিহাস থেকে আত্মস্ফুরণের যে Stream of consciousness কে তুলে আনেন তা Self-confession হয়ে যায়। আর এই Self-confession একজন শিল্পীর কাছে খুবই আবশ্যক। আলবার্ট কামুজ এই জন্যই বলেছেন :.
.
“A guilty conscience needs to confess.
A work of art is a confession.”
.
খুব মার্জিত শব্দবোধের চিত্রকল্প নির্মাণ এবং প্রাচীন সভ্যতার আশ্চর্য নিদর্শ প্রতিটি কবিতাতেই ব্যাপ্তি ও অভিজ্ঞানের সম্মোহিত নিরিখ দান করে। দেশীয় মিথ পুরাণে স্বচ্ছন্দ যাতায়াত করেও এই স্বীকারোক্তিতে নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে পারেন। প্রতিটি কবিতাতেই অনন্তের পথিক কবি অনন্তের হাতছানি দেন। যুদ্ধ শোক পরাজয় আর খিলান গম্বুজ ঘন্টা পতাকা সবই কালের সীমানা ঘিরে শাশ্বত হয়ে যায়। কবি লেখেন :
.
“দেখি জন্মে, দেখি জন্মান্তরে
দুর্গের প্রাচীর, শ্যাওলার আস্তরণ
স্যাঁতসেঁতে সবুজাভ দেওয়াল, রোমান হরফে
মৃত সৈনিকের নাম লেখা, লেখা ডাকনাম।”
.
এই জন্মান্তর ঘিরে কবির তথা দ্রষ্টার আবির্ভাব যে Self-confession এ বারবার ফিরে আসা তা বলাই বাহুল্য। নাসিম তাঁর সৃষ্টির এই বৃহত্তর ক্ষেত্রে যে বিস্তার ও প্রত্ন প্রজ্ঞা নিয়ে বিরাজ করেন তা তাঁর কাব্যবৈশিষ্ট্যেই সমুজ্জ্বল । আর একটি কবিতায় নাসিম এই প্রত্ন বিস্তারের সম্মোহন এভাবেই ছড়িয়ে দিয়েছেন :.
.
” আমার কবিতা ধর কোন এক প্রাচীন রেস্তোরাঁ
দেওয়ালে মরচে পড়া অজস্র মুখোশ —বন্ধুর মুখ
কী কী চান মেনু চার্টে লেখা আছে
পাবেন পেরুর রানির চোখের জল; চর্যাপদের হরিণা
নীলনদের শুদ্ধ মাছ আর অসীম নিঃসঙ্গতা।”.
.
সভ্যতা, জীবন ও জীবনের চিরন্তন নিঃসঙ্গতাকে তুলে আনলেন কবি। দর্শনের পরম্পরা থেকে কবিতাগুলি শাশ্বতীর তীর্থ করে তুলেছেন। পাঠক যতবার পড়বেন ততবারই নতুন বলে মনে হবে।
.
.