নয়নতারা প্রতি সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে, কখনো সিঁড়ির ধাপের একদম নিচে, কখনো বা প্রথম ধাপে। কয়েকবার গুণে ফেলে সম্পূর্ণ সিঁড়িগুলি! আবার বসে, আবার গুণতে থাকে! এক আশ্চর্য খেলা! অর্থহীন মনে হতেই পারে। তবুও অর্থ থেকে যায় বৈকী! মনে থাকে দুটি প্রধান অনুভব
– এক, রবীন্দ্রনাথের গান, দুই, এক চিরন্তন প্রতীক্ষা! গুণগুণ করে, “বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে, / শূন্য ঘাটে একা আমি, পার করে লও, / পার করে লও খেয়ার নেয়ে”। বেলা যায়, সন্ধ্যা নামে, নয়নতারা গুণে যায়, প্রতীক্ষা নিয়ে বুকে! কখনো শোনা যায়, “ঘাটে বসে আছি আনমনা, / যেতেছে বহিয়া সুসময়, / সে বাতাসে তরী ভাসাব না, / যাহা তোমাপানে নাহি বয়”।
গল্পটি ছিল এমন…
একাকীত্ব – শব্দটি বড়ই করুণ শোনায়, কিন্তু সে, অর্থাৎ এই একাকীত্ব অন্তরে পরম ঐশ্বর্যশালী। মনে পড়ে, সেই মেয়েটির কথা। নাম ছিল! ভেবে নেওয়া যাক – ‘নয়নতারা’। মেয়েটি নদীর ঘাটে বার বার যায়। দিনের নানাবিধ কাজে, নানা অজুহাতে। খুব ভোরে, সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছে যায় একবার, তারপর অনেক বার, শেষে সন্ধ্যাতারার সাথে। দেখা যায়, মেয়েটি শান্ত স্তব্ধ, বসে থাকে নদীর ঘাটে। মিষ্টি মধুর উপস্থিতি, প্রায় চল্লিশোর্ধ্ব বয়স, তবু কোমলতায় ভরা দুটি চোখ থাকে নিমীলীত। একটি দুটি করে নৌকা আসে যায় ঘাটের কিনারায়। যাত্রী পথিক পারাপার করে। কেউ ভাবে, কেউ ভাবে না মেয়েটির কথা। কেউ বা শুধায় – ‘কে গো! তোমার বাস কোথা!’ মেয়েটি নিরুত্তর, শুধু হাসি থাকে নয়নে। নদীর পাশেই বাড়ি, তবু ঘাটে আসা চাই।
গল্পটি হল – প্রায় বছর কুড়ি আগে এক পথিক ওপারের ঘাটে যাওয়ার সময় সহসা থেমে যায় নৌকায় পা দিয়ে। মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সৌম্যদর্শন, নম্র চলন যুবক। সেদিন সেই ক্ষণে ছিল সন্ধ্যার আগমনীর বারতা। অর্থাৎ মনোরম অপরাহ্নের আলোমাখা পশ্চিমতীর, নদীর শ্রান্তিভরা দিনান্তের বহতা। গোধূলির স্নিগ্ধ আলোয় দৃষ্টি বিনিময় চকিতে আকূল করে দুটি অপরিচিত হৃদয়। সেই প্রথম আকুলতা আজও একইভাবে সঞ্চিত নয়নতারার মনে।
কিন্তু সেই প্রথম দেখাই শেষ দেখা হয়ে থাকে। আর কোনদিন কখনো তার দেখা পায় না মেয়েটি। অন্তত আর একটিবার, যদি দেখা পায়, এই আকূল আশায় বুক বেঁধে এত বছরের প্রতীক্ষা নিয়ে ঘাটে বসে থাকে আনমনা। যেন পণ করেছে, ‘সে বাতাসে তরী ভাসাব না, যাহা তোমা পানে নাহি বয়’। এই নিবিড় একাকীত্বের ঐশ্বর্য সে অন্তরে অনুভব করে দৃঢ়তার সাথে। গভীর প্রাণশক্তি। যা বয়ে নিয়ে যায় জগতের সকল মালিন্য ধুয়ে মুছে।
অভিমান শূন্য হৃদয় নির্মল প্রভাতের প্রতীক্ষায় ফিরে ফিরে আসে, সেই নদীর তীরে।