আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের নিতাইদার একটা রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। অল্প দামি H.M.V. প্লেয়ার। তখন C.D., D.V.D. তো দূরের কথা, ক্যাসেটের ব্যবহারও সেইভাবে চালু হয় নি। নিতাইদার কাছে অনেক আজেবাজে হিন্দী গানের রেকর্ড তো ছিলই, বাংলা গানের প্রায় সবটাই ছিল সাবস্ট্যান্ডার্ড ঝিনচ্যাক্ গান। কিশোর কুমারের মতো শিল্পীর সব গান ছেড়ে, নিতাইদার সংগ্রহে ছিল— “এই ঝুমরু ঝুমরু রে”, বা “বলহরি হরিবল” ইত্যাদি গান। আমার প্রিয় ছিল সে সময়ের সেই সব গান, যা আজও স্বর্ণ যুগের গান হিসাবে বিবেচিত হয়। রাগ রাগিণী বা রাগাশ্রয়ী গান বুঝতামও না, ভালোও লাগতো না।
.
তখন দুপুরবেলা রেডিওতে “গীতিকা” নামে একটা আধ ঘন্টার অনুষ্ঠান হতো। তাতে এক একদিন এক একজনের গান বাজানো হতো। শনিবার, গীতিকা শুনবার জন্য স্কুল থেকে প্রায় ছুটে বাড়ি ফিরতাম। অনেক সময় গলদঘর্ম হয়ে বাড়িতে এসে গীতিকায় পুরানো দিনের কোন শিল্পীর গান বাজানো হচ্ছে, অথবা অত্যন্ত অপছন্দের কোন শিল্পীর গান বাজানো হচ্ছে শুনে ভীষণ রাগ হতো। যদিও আজ মনে হয়, তখনকার অনেক অতি সাধরণ শিল্পীও, আজকের কোন অসাধারণ নামী শিল্পীর থেকে খুব খারাপ বোধহয় গাইতেন না। অন্তত তাঁরা বাংলা গান, বাংলা ভাষায়, বাংলা উচ্চারণে গাইতেন, এবং সেইসব গানে চাঁদ, ফুল, তারা, জোছনার ভিড়েও, গানের কথার একটা মানে বোঝা যেত।
.
বাবা খেয়াল শুনতে খুব ভালো বাসতেন, আর পছন্দ করতেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, শচীন দেববর্মন, কানন দেবী, কে.এল.সায়গল, ইত্যাদি শিল্পীর গান। প্রায় প্রতিদিনই রাতে, ন’টা থেকে সাড়ে ন’টা, খেয়ালের অনুষ্ঠান হতো। বাবা প্রায় প্রতিদিনই ওই অনুষ্ঠানটা খুলে দিতে বলতেন। পরবর্তীকালে দাদা চাকরি পাবার পর, একটা ভালো তিন ব্যান্ডের রেডিও তৈরি করিয়ে বাড়িতে দিয়ে গেছিল। বাবা নিজে রেডিওতে কোন সেন্টার ভালমতো ধরতে পারতেন না, তাই নিজে খুব একটা খোলা বা বন্ধ না করে, আমাদের ওপর নির্ভর করতেন।
.
আজ এই বয়সে ভাবলে খুব দঃখ হয়, কষ্ট হয়, লজ্জাও করে, যে আমি নিজের স্বার্থ, নিজের ভাললাগা অনুষ্ঠানের জন্য বাবাকেও কিভাবে ঠকাতাম। এসব ঘটনা না বললেই সব মিটে যেত, কেউ কোনদিন জানতেও পারতো না। কিন্তু স্মৃতি থেকে অপছন্দের কোন ঘটনা, বা ভালো না লাগা কোন ঘটনাকে, নিজের ইচ্ছায় মুছে দেওয়া যায় না। স্মৃতি নিজের ইচ্ছায় তার ভান্ডার থেকে পছন্দ মতো ঘটনাকে ডিলিট্ করে দেয়। হয়তো আমাকে এইসব পাপবোধ বয়ে বেড়াবার জন্য, মানসিক কষ্ট দেবার জন্যই, স্মৃতি এইসব ঘটনা আজও সযত্নে রক্ষা করে যাচ্ছে। আর আজ জীবন সন্ধ্যায় স্মৃতি রোমন্থন করতে বসে, এসব প্রকাশ না করলে মিথ্যাচার হবে, পাপ হবে, স্মৃতি রোমন্থনের সার্থকতা থাকবে না।
.
বাবা যে সময়টায় খেয়াল শোনার জন্য রেডিওটা খুলে দিতে বলতেন, সেই সময় আমার পছন্দের কোন গান শোনার জন্য, বা পরবর্তীকালে বিবিধ ভারতী চালু হওয়ার পরে, ওইসব পছন্দের অনুষ্ঠান শোনার জন্য, মন আনচান করতো। কিন্তু এখনকার ছেলে মেয়েদের মতো নিজের ইচ্ছা, নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে জেদ ধরে কোন কিছু দেখা বা শোনার কথা, ভাবতেও পারতাম না, সাহসও ছিল না। ফলে কিছু ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতেই হতো।
.
রেডিওতে যখন খেয়াল বাজছে, অন্য কোনভাবে সেটাকে পরিবর্তন করা যাবে না বুঝে, পাশের ঘরের সুইচবোর্ডের একটা নির্দিষ্ট সুইচ ধরে নাড়াতাম। বোধহয় ওই সুইচটায় কোন লুজ কানেকশান বা অন্য কোন গোলমাল ছিল। ওই নির্দিষ্ট সুইচটায় হাত দিলেই, রেডিওতে একটা গোঁ গোঁ করে বিশ্রী শব্দ হতো। অনেকক্ষণ এই প্রক্রিয়ায় রেডিওতে শব্দ করিয়ে, “বড্ড শব্দ হচ্ছে” বলে রেডিওটা বন্ধ করে দিতাম। একটু পরে নিজের পছন্দের কিছু হলে, বিনা ডিষ্টার্বেন্সে শুনতাম।
.
রেডিওতে কোন বিশ্রী আওয়াজ হচ্ছে না দেখে, বাবা অনেক সময় আবার খেয়ালটা চালিয়ে দিতে বললে, আবার আগের প্রক্রিয়া। আরও একটা পন্থা ছিল। রেডিওর পাশ দিয়ে যাবার সময় চট করে রেডিওর নবটা মিডিয়াম ওয়েভ থেকে সর্ট ওয়েভ করে দেওয়া। ফলে কোনভাবেই খেয়ালের অনুষ্ঠান খোলা না গেলে, সুবিধা মতো নিজের পছন্দের গান শোনায়, কোন বাধা থাকতো না।
.
কিন্তু কী আশ্চর্য, যে আমি হিন্দুস্থানী মার্গ সংগীত একদম বুঝতাম না বা পছন্দ করতাম না, সেই আমি ধীরে ধীরে এই সংগীতের ভক্ত হয়ে পড়লাম। পরবর্তীকালে বিবিধ ভারতীতে “সংগীত সারিকা” আর “স্বরসুধা’ নামে দুটো অনুষ্ঠানে এক একদিন এক একটা রাগের ওপর একটা হিন্দী ফিল্মী গান, একটা ইনস্ট্রুমেন্ট, ও একটা ভোকাল বাজানো হতো। এই অনুষ্ঠান দুটোয় যেন আমার নেশা হয়ে গেছিল। একসময় আমি বহু রাগ রাগিণী চিনতে শিখে গেছিলাম। গানবাজনা শোনার সময়ের অভাবে সেই ক্ষমতা আজ অনেকটাই কমে গেছে, তবু আজও আমি বহু রাগ রাগিণী চিনতে পারি। ছোট বোন গান শিখতো, মেয়ে সরোদ বাজাতো, পরে সরোদ ছেড়ে গান শেখা শুরু করে।
.
কিন্তু তাদরও দেখেছি, তারা রাগ রাগিণী চিনতে পারে না। যে রাগের ওপর একাধিক গান তারা জানে, গায়, সেই রাগেই অন্য কোন গান বা বাজনা বাজলে, তারা কোন্ রাগ চিনতে পারে না। যাহোক্, অনেক পরে চাকরি পাবার পরে, “বালিকা বধু” নামে একটা সিনেমায়, এক বিপ্লবী শিক্ষকের গভীর রাতের বেহালা বাদন শুনে মহিত হয়ে, বেহালা কিনে শিখতে শুরু করি। বেশ কিছুদিন শেখার পর বুঝতে পারি, এই যন্ত্রটা আমার জন্য তৈরি হয় নি। নিতাইদাকে ধীরে ধীরে হিন্দুস্থানী মার্গ সংগীতে আকৃষ্ট করতে সফল হয়েছিলাম। যে নিতাইদা, ‘ব্যোম ব্যোম মাকু’ বা ‘বলহরি হরিবল’ ছাড়া গান শুনতো না, সে নিজেও একসময় সেতার শিখতে শুরু করে। ভালোই বাজাতো। আমরা দু’জনে একসাথে, যাকে যুগলবন্দী বলে আর কী, বাজিয়েও অনেক সময় কাটিয়েছি। শেষে আমি বেহালা বাজানো ছেড়ে দিলেও, নিতাইদা কিন্তু সেতার বাজানো চালিয়ে যায়।
.
চাকরি পাওয়ার পরে একটা ফিলিপস্ রেকর্ড প্লেয়ার কিনেছিলাম। বেন্টিঙ্ক্ স্ট্রীটে জে.জে.মল্লিকের দোকান থেকে প্রায়ই রেকর্ড কিনতাম। রবীন্দ্র সংগীত বা ভালো বাংলা আধুনিক গান ছাড়া, অধিকাংশই ক্লাশিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট বা ভোকাল রেকর্ড। দোকানের ভদ্রলোক আমার বয়সি একটা ছেলেকে হিন্দী গানের রেকর্ড না কিনে, আব্দুল করিম খাঁ, বিলায়েৎ খাঁ, বেগম আখতার, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় বা হরিপ্রসাদ, রবিশঙ্করের রেকর্ড কিনতে দেখে অবাক হতেন, এবং প্রথম প্রথম, রেকর্ড কেনার পর ফেরৎ নেওয়া হয়না জানাতে ভুলতেন না। এটা সাতের দশকের মাঝামাঝির ঘটনা। আজ দুঃখ হয় এই ভেবে, যে সেদিন আমি নিজেও সেইসব গান বাজনা শুনলাম না, বাবাকেও তাঁর একমাত্র্র আনন্দ থেকে বঞ্চিত করলাম।
.
চাকরি পেয়ে বাবাকে তাঁর পছন্দ মতো অনেক রেকর্ড কিনে শুনিয়েছি, ভালো সিনেমা দেখিয়েছি, অনেক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিও বটে, কিন্তু ফেলে আসা সেই দিনগুলো, সেই সময়টা তো আর ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। তাই একটা পাপ বোধ মনের মধ্যে রয়েই গেছে। আর আপশোস? বাবার তখন একবারে শেষ অবস্থা, কলকাতা সি.এম.আর.আই. হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এসে আবার ভর্তি করতে হবে, এরকম একটা অবস্থা। বাবা একটা ঘোরের মধ্যে আছেন, কথা জড়িয়ে গেছে। ওই অবস্থায় তিনি পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর গান শুনতে চাইলেন।
.
আমার কাছে বাবার পছন্দের অনেক রেকর্ড আছে, কিন্তু আমার সংগ্রহে একটাও অজয় চক্রবর্তীর রেকর্ড নেই। বাধ্য হয়ে আবার বাবাকে ঠকিয়ে, অন্য শিল্পীর রেকর্ড বাজিয়ে, অজয় চক্রবর্তী গাইছেন বলতে হলো। অজয় চক্রবর্তী আমার অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী। পরবর্তীকালে তাঁর ক্যাসেট বা সি.ডি. কিনেছি, তাঁর বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছি, কিন্তু অন্তিম সময় বাবাকে তাঁর গাওয়া গান শোনাতে পারিনি। সে সুযোগও আর কোনদিন পাইনি, হাসপাতাল থেকে তাঁকে আর ফিরিয়ে আনতে পারিনি, শবদেহ নিয়ে ফিরেছিলাম।
.
— সমাপ্ত – –
.
.
.