-“আপনার সঙ্গে দেখা করতে পেরে আমি খুবই খুশি স্যার। আর আপনার এতটা প্রশংসার যোগ্য আমি নই।”
ডঃ টেণ্ডুলকর একটা কন্টেক্ট ফর্ম আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,” আমরা যে বৃহস্পতি গ্রহে অভিযাত্রীদল পাঠাচ্ছি সেটা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আমি চাই একজন সদস্য হিসাবে ওই অভিযানে আপনি অংশগ্রহণ করুন। “
.
.
সেদিন হতেই আমার ভাগ্য আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল। আটসদস্যের দলে আমিই ছিলাম একমাত্র ভারতীয়। মহাকাশযানে ওঠার আগে টানা একবছর ধরে চলল ট্রেনিংয়ের পর্ব। ভারশূন্য অবস্থায় খাবার গ্রহন, কাজ করা ইত্যাদি ছিল প্রাথমিক ট্রেনিংয়ের অঙ্গ।
.
.
আমাদের স্পেসশিপ ‘ফরচুন-2’ কে ঘিরে আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনার শেষ নেই। আমাদের টিমেও তারকার সমাহার। কি নেই, – বায়োলজিস্ট, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, রসায়নবিদ । আমিই এদের মধ্যে বেমানান, – হংস মধ্যে বক যথা । টিমের পদার্থবিদ ওরেন রোদেনস্টাইন একটু পাগলাটে টাইপের, কারোর সঙ্গে তেমন মেশে না। ওরেন পদার্থবিদ হলেও রসায়ন ও জীববিজ্ঞানেও তার অসম্ভব পাণ্ডিত্য।
.
.
সেদিন সকালে ক্যামিলিয়া তার ল্যাবে আমাকে ডাকল। রসায়নবিদ হলেও অসাধারণ গানের গলা ক্যামিলিয়ার। আমি যখন ল্যাবে ঢুকলাম তখন ও একটা বিকারে কিছুটা ফ্লুরোসেন্ট লাল রঙের তরল নিয়ে ঝাঁকাচ্ছে আর গুনগুন করে গাইছে ।
.
.
“আজি মাধবীলতার কুঞ্জে পূবের বাতাস করে খেলা,
এলে এলে মোর মনোময়, হৃদয়ে লাগালে দোলা।
কোন বৈশাখী ঝড়ের রাতে ঝরা বকুলের মালা হাতে
দাঁড়ালে গো দুয়ারে আমার, – তখন বিরহ বেলা।
এসেছিলে দুয়ারে আমার তখন শাওনরাতি
নীপশাখে নববারিধারা পূবালীবায় উঠেছিল মাতি,
ভ্রমর কালো কুন্তলপরে দেখেছিনু দামিনীর খেলা।
আজ যবে এলে মোর দ্বারে বেণু বাজে মিঁয়া মল্লারে,
কেতকীর কলি ঝরে পড়ে, উদাসী এ সন্ধ্যার বেলা। “
.
.
আমাকে দেখেই গুনগুনানি থেমে গেল। বিকারটা টেবিলের উপর নামিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল ক্যামিলিয়া। তারপর একটা মিষ্টি হেঁসে বলল,” ডেকেছি বলে বিরক্ত হননি তো ? “
আমি বললাম,” না না, বিরক্ত হব কেন ! আমি তো ফাঁকই বসে আছি, কোনো কাজকর্ম নেই। “
.
.
ক্যামিলিয়া বলল,” এই প্রফেশনে তুমি বড্ড বেমানান। তোমার তো কবি হওয়া উচিত ছিল। কেন যে মরতে এলে এখানে।”
আমি হেঁসে জবাব দিলাম, “কবি আর হতে পারলাম কই ! লিখিনি তাও নয়, তবে পাঠক নেই। আর গাঁটের কড়ি খরচ করে বই ছাপানোর সামর্থ্যও নেই। তাই কবি আর হলাম না।
.
.
শুনেছি জীবনানন্দ দাশের কবিতা তার জীবদ্দশায় মূল্য পায় নি। আমার মতো মফস্বলের আনকোরা ছেলে যতই ভালো লিখুক পাত্তা পাবে না কোনোদিই। তাই এলাম এই অনির্দিষ্টের পথে। “
.
.
ক্যামিলিয়া হাঁসল না। আমি একটা চেয়ারে বসে ছিলাম সে এসে পেছন হতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে… দূরে… বহুদূরে…। যেখানে থাকবে না কোনো সভ্যতার জঞ্জাল আর হিংসার বিষ, – থাকবে শুধু প্রকৃতির অকৃপণ ভালোবাসা। একটা ছোট্ট নদী, আর নদীর ধারে ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর। আমি নদীর হতে কলসীতে করে জল ভরে আনব আর আমার সে একটা একটা করে কঞ্চি দিয়ে বেড়া বাঁধবে। উঠানময় নাম না জানা ফুলেরা বাতাসে দোল খাবে। আর… “
.
.
-” আর কি ? “
-” আর একটা ন্যাংটা খোকা হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াবে সারা উঠোন। “
আমি কাব্য করে বললাম,
“তবে করে ফেলে দেখি বিয়ে।
কেন কর মিছে ঘষাঘষি যত শিশিবোতল নিয়ে !
ভুলে বেঞ্জিনবন্ধনি উদকসন্ধানি বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়,
বক যন্ত্রের যন্ত্রণা ভুলিয়া হে উন্মনা মরাল মাংসের পাক কর।
টগবগ তেলে বার্তাকু ফেলে লুচি ছাড় তাজা ঘিয়ে।
তবে করেই ফেল তুমি বিয়ে।
.
.
যদি প্রাণসখা আসে ঘরে-
তবে চোখের কাজলে আর আঁখিজলে রাখিয়ো তাহারে ধরে।
যদি নিশী শেষে নেশা লাগে-
তবে নব অনুরাগে আদরে সোহাগে তণুবনে ঝড় জাগে।
তাই কি হবে এ হিয়া দিয়ে ?
যখন যৌবনের কলি আকুলি বিকুলি খেলে মধুকর লয়ে।
তাই করেই ফেল তুমি বিয়ে। “
.
.
——– চলবে
.
.
.
.চলবে