.

.
.
.
সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরবর্তী সময়ে যে ক’জন ঔপন্যাসিক বীরভূম জেলার আঞ্চলিক পটভূমিতে উপন্যাস রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফজলুল হক (১৯৫১)। ১৩৮০ বঙ্গাব্দে “প্রবাসী” পত্রিকায় তাঁর “বিপ্রলব্ধ”নামে ছোটগল্প লেখার মধ্যে দিয়েই সাহিত্য জগতে পদার্পণ।
.
.
বহু ছোটগল্পের জন্ম দিলেও এপর্যন্ত তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হল :“জাদুবাক্স”, “ছায়াবৈরী”,”নিসর্গের রূপকথা” ইত্যাদি। এবছরই ২০১৯ এ কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সবচেয়ে বৃহৎ ও জটিল উপন্যাস “ছায়ানিলয়” ।
.
.
সত্তর দশকের অস্থির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বামপন্থী ও নকশাল আন্দোলনের প্রভাব, মধ্যবিত্ত গৃহস্থের সংকটময় জীবন-জীবিকা, পার্টির বোলচাল করা একশ্রেণির যুবকের উদ্ভব ঘটে। উচ্চবিত্তের জমি-জায়গা, ধন-সম্পদ, মাঠের ফসল, পুকুরের মাছ, গাছের ফল, বাগানের গাছ লুঠপাট করার রেওয়াজ শুরু হয়। এমন কাজে তাদের বাধা দিতে গেলে খতমের তালিকায় তাদের নামও তোলা হয়। খতম করে তারপর লাশও গায়েব করা হতে থাকে।
.
.
সাধারণ মানুষের বিবাহ-প্রেম, বিচ্ছেদ-মিমাংসা, আচার-অনুষ্ঠান, ডাক্তার-হাসপাতাল-চিকিৎসা, চাষ-বাস-ঘরবাড়ি করতে গেলেও তাদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে ক্যাডার বাহিনী। মিটিং মিছিল করা থেকে শুরু করে পার্টি অফিস, চাঁদা কালেকশন প্রভৃতির প্রচলন করে। তাদেরই ছত্রছায়ায় শ্রমিক, দিনমজুর, চক্রান্তকারী, দালাল ও লেঠেলরাও আশ্রয় পায়। গৃহস্থের জমি, জায়গা, পুকুর খাস ঘোষণা করে বর্গাপাট্টা বিলি করা হয়। কোথাও জোর করে দখল নেওয়া হয়।
.
.
এই পটভূমিতে বীরভূম জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের বাসিন্দা বিখ্যাত কাজি পরিবারকে কেন্দ্র করেই গ্রন্থটি রচিত হয়। জমিদার কাজি হোসেন পরিবারের কর্তা। তাঁর আভিজাত্য, চালচলন, কথাবার্তায় সেই সময়ের পরিচয় ফুটে উঠেছে। তাঁরই বড়ো ছেলে মেধাবী ছাত্র মিহিলালের উত্থানকে কেন্দ্র করে যে ব্যক্তিগত সংঘাত এবং তিনজন মহিলার সঙ্গে তার প্রেমের বহু বিচিত্র গতি তা খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই গ্রন্থটিতে বিশ্লেষিত হয়েছে।
.
.
কাজি হোসেন জমি-জিরেত ভাগ-বাঁটোয়ারার হাত থেকে রক্ষার জন্য এক প্রকার জোর করেই বোন আসফিয়ার মেয়ে আফরিন হীরার সঙ্গে বিয়ে দেন। এই বিয়ের আগে মিহিলালের প্রথম প্রেম হয় সহপাঠী মলির সঙ্গে। সুন্দরী, বুদ্ধিমতি মলির চিঠি পড়ে তার প্রেমে পড়ে সে। কিন্তু পরীক্ষার পর গ্রামে এসে বাল্যকালের সাথি চাঁদনিহারাকে দেখেই আর স্থির থাকতে পারে না। তাকেই কথা দিয়ে ফেলে। দুজনে গোপনে গোপনে মিলিত হতে থাকে।
.
.
কিন্তু চাঁদনিহারাকে পারিবারিক ও রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হতে হয়। রাতের অন্ধকারে তার মামাতো ভাই লালনের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর ঘর পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের আগে চাঁদনিহারা মিহিলালের কাছে সন্তান ভিক্ষা নেয়। পেটে সন্তান নিয়ে অন্য পুরুষকে মুসলিম সমাজের শরিয়ত অনুযায়ী বিয়ে কবুল করা যায় না। তাই লালনকে সব কথা জানায়। পার্টিকর্মী লালন শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন দম্পতি হিসেবে থাকলেও কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠে না।
.
.
পেটের সন্তানটি প্রসব হলে পূর্বনির্ধারিত তার নাম রাখা হয় অন্তর। দারিদ্র্যের সংসারে লালনও একদিন রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যায় যা খুন হিসেবেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। বৃদ্ধা শাশুড়ি ও অন্তরকে নিয়ে চাঁদনিহারা লড়াই করতে থাকে। এক সময় তার পিতা-মাতাও মারা যায়। একমাত্র ভাইকে জেলে বন্দি করে রাখে আত্মীয়রা। তার শরীরেও দেখা দেয় মারণ রোগ ক্যান্সার।
.
.
মিহিলালের সুখের দাম্পত্যজীবনেও অন্ধকার নেমে আসে। রূপবতী হীরার অভিমান তাকে দূরে ঠেলে দেয়। দুটি সন্তান নিয়ে সে কাজিবাড়িতেই থেকে যায়। রাজনৈতিক চক্রান্তে তাদের অধিকাংশ জমি, পুকুর ও বাগান দখল হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে অভাব দেখা দেয়। সংসারে উদাসীন মিহিলালকে পিতার রোষে পড়তে হয়। মনখারাপ করে সে চলে যায় মামাবাড়ি। সেইখানে দেখা হয়ে যায় প্রথম প্রেমিকা ডাক্তার হয়ে আসা মলির সঙ্গে।
.
.
পুরোনো সব স্মৃতি জেগে ওঠে। সেইখানেই তার কাছে শোনে চাঁদনিহারার কথা। তার শেষ দেখা আর হয় না। দেখা হয় মৃত অবস্থায় হাসপাতালে। মরার আগে দিয়ে যায় তারই দেওয়া পানবাটা আর একটা সোনার আংটি আর তার ঔরসের সন্তান অন্তরকে। বড়ো করুণ সেই দৃশ্য। মিহিলাল, মলি ও অন্তর একটা লাশকে ঘিরে নির্বাক ভবিষ্যৎ শূন্যতার দিকে চেয়ে থাকে।
বহুমুখী ও জটিল মানব চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক রসায়নে গ্রাম্য সমাজ, রাজনীতি, ঈশ্বর বিশ্বাস ও শরিয়ত এবং প্রেম ও যৌনতার অভিঘাত খুব বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন। “ছায়ানিলয়” নামটিতে নায়ক- নায়িকাদের স্বপ্নবাড়ির স্বপ্ন জড়িয়ে ছিল। লেখক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : “আমাকে নিয়ে সংসার করবে। সুন্দর সংসার সে যেখানেই হোক।
.
.
বলত, ছোট্ট ঘর, মাটির দেয়াল, খড়ের চাল, উঠোনে একটি বকুল গাছ। সারাদিন উঠোন জুড়ে ছায়া থাকবে।…. বাসাটির নাম দেবে `ছায়ানিলয়’ ।” এই ছায়ানিলয় তো মিহিলাল চাঁদনিহারা ও হীরার বুকের মাঝেও দেখতে পেয়েছে। মলির মনেও এই ছায়ানিলয় এর উপস্থিতি। কখনও তাদের বড়ো পুকুরটির দুই তীরে ছায়া সুনিবিড় গাছপালা আর পাখপাখালির বসবাসকেও ছায়ানিলয় বলে উল্লেখ করেছে।
.
.
.
.
গ্রাম্য পটভূমিতে নানা বিশ্বাস ও সংস্কার, পরকীয়াসক্ত দাম্পত্যজীবন, স্থূল রসিকতা, নিষ্ঠুরতা, জ্বিন ও ভূতে পাওয়া নারীপুরুষ, মৌলবিদের কুমারী নারী আসক্তি, আদর আপ্যায়ন, গালিগালাজ, মুসলিম সমাজের নানা উৎসব, আদব কায়দা, মৃতদেহের বর্ণনা, আবেগপ্রবণতা, প্রেমের ভাষা, প্রার্থনা কাহিনি ও উপকাহিনিগুলিকে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছেন।
.
.
গ্রন্থটি যেন একটা আঞ্চলিক মহাকাব্য আর একটি পরিবারই তার কেন্দ্রবিন্দু। বারবারা এল ফ্রেড্রিসনের কথায় বলতে হয় : “Love is that micro-moment of warmth and connection that you share with another living being.”. তাদের প্রেমের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উষ্ণতার মুহূর্তগুলিও আমাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার, বিশ্লেষণ, আবহাওয়া ও বিচিত্র ধারার মানুষের জীবনবোধ একজন নিখুঁত শিল্পীর মতোই স্পষ্ট ও চিরন্তন করে তুলেছেন।
.
.
সত্তর দশকের মানুষের জীবনযাত্রার মান, প্রেম নিবেদন, পারিবারিক জীবনের ছবি, তাদের স্বপ্ন ও হতাশা, মুসলিম সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক উপন্যাসটির বিষয়। নায়ক মিহিলাল এবং মলি, চাঁদনিহারা ও হীরা নামে তিনজন নায়িকার অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রতিমুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার হাহাকার উপলব্ধি করা যায়। গদ্যশিল্পী হিসেবে ফজলুল হকের মুন্সিয়ানাও প্রশ্নাতীত। বিশেষ করে সরল বাক্য ব্যবহারেও তিনি গভীর ব্যঞ্জনা দিতে পেরেছেন।
.
.
ছায়ানিলয় : ফজলুল হক, দে পাবলিকেশন, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩, মূল্য ২৮০ টাকা।
.
.
.
.
.
.