
না আর পারছি না। এবার আমার হার্ট ফেল করবেই করবে। আমি কি স্বপ্ন দেখছি ! স্বাভাবিক জ্যান্ত মানুষের পক্ষে এরকম দৃশ্য একমাত্র স্বপ্নেই দেখা সম্ভব। আমি নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখলাম। উফ্ !! একটু জোরেই হয়ে গেল। না না, আমি জেগেই আছি।
মাষ্টারমশাই আবার শুরু করলেন, ” থাকার বড় সমস্যা হে। রায়বাড়ির চিলেকোঠাটায় আছি, কিন্তু ওইটুকু ছোট্ট ঘরে আমিই বা কোথায় থাকব আর আমার বইপত্তরই বা কোথায় রাখব। এরই মধ্যে জুটেছে এক অপোগণ্ড, – একটা বিলিতি কুকুর। যেই একটু ঘুমিয়েছি অমনি লাইটপোষ্ট ভেবে দেয় মাথা ভিজিয়ে।”
“রায়বাড়ির ছোট ছেলের কুকুর ছিল। এক রাতে রায়বাড়িতে ডাকাত পড়ে। ব্যাটা চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে তোলে। ডাকাতেরা পালাবার সময় কুকুরটাকে মেরে দিয়ে যায়।” ড্রাইভার সামনের দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে।
টোটোটা আবার দাঁড়ায়। এবার ওঠে একটা মাঝবয়সি লোক। লোকটার এক হাতে লম্বা ছাতা আর অন্য হাতে দইয়ের ভাঁড়। সে ওঠামাত্র শশীবালা রে রে করে ওঠে। ” ওরে অলপ্পেয়ে, তুই আবার এসেছিস। তুই সাত অনামুখোর এক অনামুখো। তোর জন্যেই সেদিন গাড়িটা উল্টোল। নাম নাম হতচ্ছাড়া।”
এবার শশীবালা একা নয় সাথে জামসেদ চাচা আর মাষ্টারমশাইও যোগ দিলেন। লোকটাকে কলার ধরে হিড় হিড় করে নামানো হল। লোকটাও নাছোড়বান্দা সে আবার টোটোতে উঠে বসল। আবার তাকে নামানো হল। আবার উঠে বসলেন। এইভাবে কতক্ষণ চলল জানিনা, কারণ আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। একসময় সবাই মিলে হইহুল্লোড় শুরু করল। একদম দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড।
শশীবালা লোকটার উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লেন, ” ওরে হারু নাপতে, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।” এই বলে হারুর জামা ধরে টানাটানি শুরু করল। সুযোগ বুঝে জামশেদ চাচাও লাগলেন হারুর পিঠে এক কামড়। হারুও বাদ যাবে কেন, – সে তখন জামশেদ চাচার মুরগির ঝুড়িটা তুলে মারলেন শ্রীপতি মাষ্টারের মাথার উপর।
এইরকম যখন দক্ষযজ্ঞ চলছে তখন আমি আর সুযোগ হারালাম না। ব্যাগপত্র ফেলেই দে দৌড়। ঝোঁপঝাড় ডিঙিয়ে কাদা মাড়িয়ে দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছিই । যখন থামলাম তখন দেখি একটা ফাঁকা মতো জায়গায় এসে পড়েছি। শুক্লা নবী থাকায় চাঁদের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাশের ঝোঁপটা হতে একটা খরগোশ ছুটে বেরিয়ে গেল। সামনের মরা গাছটার ডালে বসে বসে একটা কালপেঁচা ডেকে উঠল। আতঙ্কে আমার হাড় হিম হয়ে এল। একটা ঠাণ্ডা স্রোত নামতে লাগল মেরুদন্ড বরাবর।
এপাশ ওপাশ তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। সোজা নাক বরাবর। এবার যাই হোক পলাশের ঘরে না পৌঁছনো পর্যন্ত আমি থামছি না। সঙ্গে ব্যাগটাও নেই। গলাটা শুকিয়ে এসেছে, – কিন্তু জলের বোতল তো ব্যাগে। গলা না ভেজালে আর হাঁটা সম্ভব নয়। এইরকম ভাবছি তখনই নজরে পড়ল দূরে লি লি করছে একটা আলোর বিন্দু। দেহের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
কাছাকাছি আসতেই বুঝতে পারলাম আলোটি আসছে একটা কুঁড়ে ঘর হতে। আমার মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হল। আলো যখন আছে তখন মানুষও আছে। জলের খোঁজ করতে হবে। আর আজকের রাতটা এখানেই কাটাব, সকালে উঠে তারপর পলাশের বাড়ির পথ ধরব।
কুঁড়ে ঘরের সামনে এসে হাঁক দিলাম ” ভেতরে কেউ আছেন ?” কোনো উত্তর এল না। আবার হাঁক দিলাম। এবারেও কোন উত্তর এল না।
তিন চার বার ডাকার পর ভেতর হতে খুনখুনে গলায় উত্তর এল, ” কে ! ভেতরে এস। দরজা খোলা আছে।”
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের ভেতরে আবছা আলোতে মোটামুটি দৃষ্টি চলছে। দেখলাম একজন বৃদ্ধ ব্যাগে জামাকাপড় গোছাচ্ছেন । আমাকে দেখে তিনি একগাল হেঁসে বললেন, ” জল চাই ! জানি। এতদূর ছুটে এলে কার না তৃষ্ণা লাগে ! ওই যে ঘরের কোনায় কুঁজো আছে, জল খেয়ে নাও। আমি আবার একটু মেয়ের বাড়ি যাব। গাড়ি বলে রেখেছি। আমার সঙ্গে যাবে তো চল।”
এতক্ষণে মনে বল এল। ঘরের কোণায় রাখা কুঁজো হতে জল গড়িয়ে নিলাম একটা অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে। তারপর ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম। একটা বিদঘুটে গন্ধ আছে, ঠিক যেমন অনেক দিন ধরে জল জমে থাকলে নষ্ট হয়ে যে গন্ধ হয়। নাককে প্রাধান্য দিলে চলবে না এখন, – জীবন বাঁচানোর তাগিদই বড়।
লোকটা আমার দিকে ফিরে বলল, ” এই পথটা ভালো নয়। এপথে তেঁনারা যাতায়াত করেন। তুমি এখনকার ছেলে এসব মানো কি না জানি না। তবে সাবধানতা ভালো।” এতদূর বলেই লোকটা কাশতে লাগলেন। আমি একগ্লাস জল ঢেলে লোকটির কাছে ধরলাম।
লোকটি চোঁ চোঁ করে এক নিঃশ্বাসে জলের গ্লাস খালি করে দিলেন। তারপর বললেন, “অ্যাকসিডেণ্টের পর থেকে এরকম কাশি হয়। শ্বাসনালিতে জল ঢুকে গেছে কিনা….. “
আমি লোকটার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। এরপর লোকটার সাথে ঘর হতে বেরিয়ে রাস্তার ধারে এলাম। কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা মৃদু আওয়াজ কানে এল। তাকিয়ে দেখলাম একটা টোটো এগিয়ে আসছে। টোটোটা দেখে প্রথমে ভয় লাগলেও সামনে আসতেই ভয় কেটে গেল। আমরা দুজনে চড়ে বসলাম টোটোতে।
সিটে বসেই চোখ বন্ধ করে দিলাম। না আর চোখ খুলে কিছু অপ্রীতিকর দেখতে চাই না। কিন্তু কিছুদূর যাবার পর টোটোটা একটা ঝাঁকুনি দিল। ঝাঁকুনিতে আমার চোখ খুলে গেল। কিন্তু এ কি ! আমার পাশে বসে আছেন সেই জামশেদ চাচা, মুরগির ঝুড়িটা কোলে নিয়ে। সামনে বসে খিঁক খিঁক করে হাঁসছে শশীবালা ও তার স্বামী। মাষ্টারমশাইও আমার দিকে মুণ্ডুটা এগিয়ে দিলেন।
ইতিমধ্যে টোটোটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছুটে যাচ্ছে ব্রিজের ধারের দিকে। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। টোটোটা জাম্প দিয়ে আকাশের দিকে কিছুটা উঠে গেল, – তারপর মাধ্যাকর্ষনের নিয়মে আছড়ে পড়ল নদীর জলের উপর। আরোহীরা ছিটকে পড়ল দিগ্বিদিকে। আমি জ্ঞান হারালাম।
একটা ঠান্ডা স্পর্শে জ্ঞান ফিরল। দেখলাম আমার সামনে বসে পলাশ। তার মুখ হতে যা শুনলাম তার মর্মার্থ এই, আমি পড়েছিলাম ভূতের পাল্লায়। বহুদিন আগে ঐ রাস্তায় একটা আরোহী বোঝাই টোটো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজ হতে পড়ে যায়। কেউ বাঁচেনি। আর প্রতিরাতেই সেই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি কাল রাত্রে সেই দৃশ্যের অন্যতম কুশীলবে পরিণত হই।
ট্রেন থেকে নেমে পলাশকে ফোন করেছিলাম। আমার আসতে দেরি দেখে পলাশ লোকজন নিয়ে আমার খোঁজে বের হয়। স্টেশন হতে দু’কিলোমিটার দূরে আমি একটা ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম।
সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি অজানা পথে রাতের বেলায় আর একা একা বেরোব না। কি বলেন আপনারা ?
—সমাপ্ত – – –