কবি : সুন্দরের অসন্মান করো না ভাই, সুন্দরের ছোঁয়াতে কথা হয় গান, মন হয় কবি, বাঁশ হয় বাঁশি,……
পুরোহিত : এ বেউর বাঁশ কবি, সর্বাঙ্গে কাঁটা। এই বাঁশ বাঁশি হয় কিনা জানিনা, তবে গরীবের স্বাস্থ্যের পক্ষে সুখকর নয়। এদের মনভরা শুধু নরকের আগুন। সাবধানে থেকো ভাই, দূরে থাকাই নিরাপদ।
কবি : আমাদের মনেও বারুদ জমা হচ্ছে ঠাকুর, এদের একচিলতে আগুনই সেই বারুদে বিস্ফোরণ ঘটাবে। তাই সাধু সাবধান।
কালের চাকা উঠলো দুলে জাগলো হাজার প্রাণ
সাবধান সাবধান !
অচলের চলল চাকা, অদেখার মিলল দেখা,
কালের ভালের করালরেখা করল অভিমান।
ভেঙ্গে ঘুম দেখরে চেয়ে সে আসে ওই যে গেয়ে –
মরণ জয়ের গান।
সাবধান সাবধান !
[ গান গাইতে গাইতে চলে গেলেন কবি, সবাই চেয়ে রইল তার যাত্রাপথের দিকে।]
পুরোহিত : আমিও এবার চলি মহান্তজী, পুজোর সময় হয়ে এল। সন্ধ্যায় আবার পশ্চিমপাড়ায় যেতে হবে সেখানে আজ উৎসব। চলি মহান্তজী । [ প্রস্থান ]
স্থবিরক : পাপিষ্ঠ ! একধার হতে চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেওয়া উচিত এদের। সব নরকে যাবে। দেখে নিও মোহক সব নরকে যাবে।
[ মহান্তজী বিচলিত হয়ে পায়চারি করতে লাগলেন। মোহক ছাতা নিয়ে মহান্তজীর পেছন পেছন শশব্যস্ত হয়ে বেড়াতে লাগলেন। যবনিকা পতন হল। ]
–দ্বিতীয় দৃশ্য–
একটা পরিস্কার নিকানো উঠানে কতগুলো মেয়ে আলপনা আঁকছে। উঠানের একদিকে কয়েকটা ধানের মরাই, সারা উঠানে রোদ-ছায়া খেলা করছে। আকাশের কালো মেঘে পড়েছে চপলার চকিত চরণ । শাওণ উৎসবে মেতেছে তারা।
মেয়েরা : এলো এলো বরষা নীপবনে,
ওলো নাগরী ভরো গাগরি আনমনে ।
এলো এলো বরষা নীপবনে ।
কালো কাজর মেঘে দেখ শ্যামল জাগে
জাগে পূবালী বাতাস তার সনে।
এলো এলো বরষা নীপবনে ।
রামধনু রাঙা রঙে আঁকি আলপনা
কাজর মেঘে চলে চকিত চরণা,
কাজরির রাগে তমাল বন জাগে,
ঝুরে অনুরাগে তমালীর সনে।
এলো এলো বরষা নীপবনে ।
[ ফুলের সাজি হাতে একটা মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল। ও কূর্চি, গ্রামের পাঠশালার পণ্ডিতমশাইয়ের মেয়ে। তাকে দেখে গান থামিয়ে দিল ওরা। ওদের মধ্যে যে মেয়েটি আকন্দের মালা খোঁপায় পরেছে, সে হল মাধবী। ]
মাধবী : কি হল সই, মুখটা অমন বেজার কেন ?
কূর্চি : হুলোর উৎপাত।
মাধবী : হুলোর উৎপাত ! বলিস কি ! মহান্তজীর হুলোর পাল এখানেও হানা দিয়েছে!
কূর্চি : হ্যাঁ সই। একপাল হুলো মিলে রান্নাঘর, ফুলের বাগান, পাঠশালা, এমনকি পুরোহিত মশাইয়ের পুজোর থালাতেও……. কি যে পরিস্থিতি সই না দেখলে বুঝতে পারবি না। অনেক কষ্টে জান বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছি।
সব মেয়েরা : [ গালে হাত দিয়ে ] কি বিপদ ! কি বিপদ !
[ এমন সময় একদল হুলোর প্রবেশ। আলপনা, ঘট, সমস্তকিছু তছনছ করতে থাকে তারা। ]
হুলোর দল : আমরা কাকে ডরাই
যাই যেথায় সেথায়।
আছে মহান্তজীর বর
মাথার উপর,
করি লণ্ডভণ্ড ছিঁড়ি মুণ্ড, কে দেয় দণ্ড আমাদের ?
আমরা যত অপোগণ্ড ভাঙি ভাণ্ড সম্ভ্রমের।
ভাঙি রাজার মুকুট কাটি প্রজারা মাথা,
নাচি আহ্লাদেতে, ছিঁড়ি বই আর খাতা।
কে নেবে হিসাব ? ঘাড়ে ক’টা মাথা ?
আমরা হুলোর দল বেজাই তৎপর।
[মেয়েরা ভয়ে একদিকে সরে দাঁড়ায়। হুলোর দল চলে যেতেই আবার উঠানের মাঝখানে আসে তারা। ]
মাধবী : দেখেছিস কি আস্পর্দা, সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিলো। মহান্তজীর আস্কারা পেয়ে পেয়ে ওরা যা খুশী তাই করছে।
কূর্চি : যা বলেছিস। কিচ্ছুটি বলার নেই। আজ কি কাণ্ড হয়েছে জানিস ?
মেয়েরা : কি কাণ্ড ! কি কাণ্ড !
কূর্চি : [হাসতে হাসতে ] একটা হুলো পুরোহিতের নৈবেদ্যর থালায় উঠে নাচছিল। তখন যদি পুরোহিতের মুখটা তোরা দেখতিস…! [হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। ]
মেয়েরা : [ কৌতুকে হাসতে লাগল। ]
[ দুধের বাঁক কাঁধে নিয়ে গোয়ালার প্রবেশ। ]
গোয়ালা : অত হেসোনা গো মেয়েরা। কান্নার এখনো ঢের বাকি।
মাধবী : কেন কেন… আমরা কাঁদব কেন ?
গোয়ালা : নেপোয় দই মেরে দিয়েছে গো দিদিমণিরা, তোমাদের উৎসবে দই পাবে কোথায়। আর দই না পেলে দই-চিঁড়ে দিয়ে পান্না করবে কি করে ?
কূর্চি : তোমার কথার তো মাথামুণ্ডু বুঝিনা গোয়াল দাদা। বুঝিয়ে বল দেখি।
গোয়ালা : হুলোর দল সব লুটে খেয়েছে গো। এখন রাতারাতি এত দুধ পাবো কোথা যে দই পাতব ! মহান্তজীর হুলো কারোর বারণ মানে না, প্রতিবাদ করেছ কি গিয়েছ। নখের আঁচড়ে যতটা ব্যাথা সহ্য হয় গো দিদিমণিরা, কিন্তু মহান্তজীর রোষে পড়ার ইচ্ছে কি কারো হয় গো ! তিনি হাতেও মারেন আবার ভাতেও মারেন।
….. চলবে