বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল

মহুল কথা

মহুল কথা
=========
বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল
গদীবেড়ো, রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া

চলতি কথায় ‘ মহুল ‘। কেতাবি নাম ‘ মহুয়া ‘। সংস্কৃত ভাষায় ‘ মধুকা ‘ হিন্দি তে ‘ মহুয়া ‘ বা ‘ মউয়া ‘। এই বসন্তের একটা সুন্দর ফুল মহুল। হালকা মন মাতানো গন্ধ । যা মোষ বা শেয়াল, ভাল্লুক, হাতিদেরও মাতাল করে দিতে পারে। কোকিল ডাকা ভোরে, হালকা হিমেল হাওয়ায়, জঙ্গল মহল বা পুরুলিয়ার বিভিন্ন জঙ্গলে জঙ্গলে মহুল কুড়াতে যাওয়ার সুন্দর ছবি চোখে পড়বে। বেশি অন্ধকারে বনে গেল নানারম পশুর, কুকুর, শেয়াল বা হাতির ভয়ে সাবধানে থাকতে হয়। মহুল তলায় সারা রাত্রি ধরে টুপ টুপ বৃষ্টির মতো মহুল পড়ে। এই সময়ে ভরের দিকের যে শীত শীত করে তাকে বলে ” মহুল্যা জাড় ” । ভোরবেলা গাছ তলায় চাদর বিছানোর মতো পড়ে থাকতে দেখা যায়। বাঁশের তৈরি ‘ টুকি ‘ , ‘ টুপা ‘ ‘ পেছ্যা ‘ নামের বাঁশের তৈরি ছোট ছোট পাত্রে তুলে তুলে বড় পাত্রে ‘ ঝুড়ি’ বা ‘ ধামা ‘ ভর্তি করা হয়। প্রান্তিক মানুষের একটা আয়ের উৎস হল এই মহুল ফুল। এই ফুল শুকিয়ে স্থানীয় বাজার বা হাটে বিক্রি হয়। তখন এই ফল আকারে চুপসে যায় ও বাদামী রঙ ধারণ করে। বিভিন্ন গ্রামীন হাটে ২০ টাকা – ৫০ টাকা কিলো দরে বিক্রি হয়। এখান থেকে আড়তে মজুত করে। চাহিদা ও যোগদানের ভিত্তিতে দর বাড়া – কমা হয়।

এই শুকনো মহুয়া ফুলের ভিতরে তুষ থাকে সেই তুষ পরিস্কার করে বের কর নিতে হয়। আগে পাকা তেঁতুলের বীজ মাটির খলায় বালি দিয়ে ভালো করে ভেজে বাদাম ভাজার মতো খোসা ছাড়িয়ে রাখতে হয়। এবার ভাজা তেঁতুল বীজ, মহুয়া ফুল, জলে একটু আখের গুড় মিশিয়ে মাটির হাঁড়িতে কাঠের জ্বালে রাত্রিতে ভালো ভাবে সিদ্ধ করে নিয়ে সকাল বেলা থেকে সারাদিন থকথকে মহুল সিদ্ধ খাওয়ার চল আছে। তবে দেখতে হবে তেঁতুল বীজ সেদ্ধ হয়ে নরম হয়েছে কিনা। তরল পদার্থ মহুল গুড় নামেও পরিচিতি আছে। অনেকে মুড়ি মাখিয়েও মহুল গুড় খায়।
আমার খেতে ইচ্ছে হলেও কিছু করার নেই। মহুল বন মহুলা থেকে অনেক দূরে ভাগ্যচক্রে এসে পৌঁছে গেছি ” দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো – – –

” মহুল সিজার স্বাদ লিখে মেটাতে বাধ্য হয়ছি। “

এই মহুল সেদ্ধ খাওয়ার রেসিপি থেকে বর্তমান সমাজ অনেক দূরে সরে গেছে না আছে মহুল গাছ, মহুলবন না আছে কচড়া আর কচড়া তেল – – –

” নাই গাছ, ফুল আর না খাচ্ছে কেউ সিদ্ধ মহুল।”

এই স্বাদ উপভোগ করতে হলে বসন্ত কালে জঙ্গলে ছুটে গিয়ে সংগ্রহ করতে হবে মহুল ফুল।

মহুলফুল থেকেই পাতন পদ্ধতিতে তৈরি হয় মহুয়া মদ বা ” মহুল্যা মদ ” তৈরির বেলা মহুল ফুল আর বাখর চার পাঁচদিন পঁচিয়ে নিয়ে গুড় জল মিশিয়ে ফুটিয়ে যে বাষ্প তৈরি হয় তা সংগ্রহ করলেই মহুয়ার খাঁটি মদ তৈরি হয়। এই মদ আগুনে দিলে দপ্ করে জ্বলে ওঠে এতটাই তীব্র। এই কাজেই মহুয়া ফুলের বেশি চাহিদা। মদের মর মহুল সেদ্ধ বা গুড় কাঁড়া ( পুরুষ মোষ ) কে চাষীদের খাওয়াতে দেখেছি। তবে কি উপকার হয় তা আযষমার জানা নেই। আদিবাসী পুরুষ মহিলারা এই মদ খায় বললেও অআদিবাসী মানুষ খায় না বললে অতুক্তি করা হবে – –

” সব পাখি খায় মাছ , মাছ রাঙার নামে যায়।”

কিছু মহুয়া ফুল ঝরে না, গাছে থেকে যায়। ফলে পরিনত হয়। সেই সবুজ ফল বাজারে বিক্রি হয়। এর নাম ‘ কচড়া ‘ । এই ফলের খোসা ছাড়িয়ে তৈরি হয় শাক দিয়ে কচড়া সব্জী, বা কচড়া আলু পোস্ত করা হয়। আমি এর স্বাদ পেয়েছি যখন সাঁতালডিহি শ্বশুর বাড়ি যেতাম।

কচড়ার ভিতর যে বীজ থাকে সেই বীজ ঘানিতে পেষাই করে যে তেল পাওয়া যায় তাকে বলে ” কচড়া তেল “। এর অনেক ভেষজ গুণ আছে। সাবান তৈরিতে জৈব তেল হিসেবে কচড়া তেল ব্যবহার করা হয়। কচড়া তেলে মালিশে যে কোন ব্যথা বিশেষ করে বাতের ব্যথার উপসম হয়।

মহুল পাতা থেকে থালা পাতা বা ‘ পতরি ‘ বাটি বা ‘ দনা ‘ ‘ খালি ‘ ‘ ডোঁররি ‘ তৈরি করে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন পূজা পারবনে বিশেষ করে ষষ্ঠী পূজায় লাগে। ‘ ডোঁররি ‘ হল দনার থেকে বড় পাতার তৈরি পাত্র।

মহুল কাঠ খুবই শক্ত কাঠ। বাড়ির জানলা দরজার কাঠ। কোঠা বাড়ির কড়ি, বর্গা তৈরির কাজেও লাগে। এই কাঠের যাবতীয় কাজ রস থাকতেই করে নিতে হয়। শুকিয়ে গেলে লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়, কাজ করা যায় না, পেরেক গাড়াও যাবে না । তৈরি আসবাবে ঘুন ধরতে চায় না।

লুপ্ত প্রায় পেষাই যন্ত্র ” ঢেঁকির ” জন্য এই কাঠের মাঝ কাঠ প্রয়োজন হয়।

এই সমস্ত উপকারি, অর্থকরি ভেষজ গাছ। পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন যা কাম্য নয়।

বৃক্ষটি শাখা – প্রশাখা বিশিষ্ট লম্বায় ৩০-৩৫ ফুট গুড়ি বিশিষ্ট হয়। এর ছাল ধূসর বর্ণ দু ইঞ্চির মতো পুরু হয়। পাতা ৮/৯ ইঞ্চি লম্বা কনক চাপা ফুলের পাতার মতো হলেও আগার দিকটা সূচালো নয়। পাতার রঙ ঘন সবুজ। বৈজ্ঞানিক নাম
‘ Madhuka longifolia ‘ বা ‘ Madhuka india ‘ পাহাড়ি অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে এখনও দিকে দিকে দেখতে পাওয়া যাবে।

মহুয়া ফুলের গন্ধে মাতাল

বিকাশ চন্দ্র মন্ডল

” দোদুলিয়া কাঁপে পাতা
ডাহুক কোথা ডাকে – –
মহুয়া ফুলের গন্ধ ভাসে
রাঙামাটির বাঁকে । “

এগিয়ে দেখি মহুয়া তলাতে
মহুয়া ফুল প্রচুর ঝরেছে প্রাতে,
রয়েছে যেন বিছানা বিছায়ে
বুনোমোষ মাতাল হয়ে শুয়ে তাতে।

– – – () – – –

ঝুমৈর গাথায় – – –

” শাল মহুল পিয়াল বন
নেচে ওঠে হামদের মন। “

– – () – –

স্বত্ব লেখক সংরক্ষিত।
ছবি – সৌতম মাহাত।

বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল

বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল

Leave a Reply