১৭ই এপ্রিল
কাল লিখতে পারিনি । সারাদিনটা এমনভাবে কেটেছে যে ডনের খবরও নিতে পারিনি। ডন অবশ্য আমার কাজের লোক কাম কেয়ারটেকার মাধবদার কাছে থাকে। মাধবদা আসল নাম মাধব মিশ্র। খুবই বিশ্বস্ত। আমি বছরের বেশিরভাগ সময়ই বাইরে বাইরে কাটাই, সে সময় মাধবই ভরসা। দীর্ঘ দেহ, মার্বেলের পালিশকরা মেঝের মতো টাঁক আর মুখে অমায়িক হাঁসি, – এই হল আমাদের মাধবদা।
যাই হোক প্রসঙ্গে আসি। কাল সকালে উঠেই গিয়েছিলাম রামুয়াদের গ্রামে। জঙ্গলের একাধারে সবুজ মাঠের চোখজুড়ানো স্নিগ্ধতা আর তার পাশদিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণস্রোতা দ্বারকা নদী। নদীর বুকে শুধু বালি আর বালি। এই বালির বুক চিড়ে দুটি ধারায় বয়ে চলেছে দ্বারকা। ক্ষীণ ধারায় সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। কিছু ছেলে লাঠি নিয়ে পেঁড়া মাছ ধরছে। জলের গভীরতা কম বলে মাছ লক্ষ্য করে চালাচ্ছে লাঠির বাড়ি। বালি খুঁড়ে স্বচ্ছ জল বের করছে এক তরুণী। বাটিতে করে সেই জল ভরবে কলসিতে।
মাঠের পাশে কয়েকটি কুঁড়ে ঘর। এখানেই রামু ও তার বন্ধুরা বাস করে। রামুর বাড়িতে গিয়ে দেখি হিজুর মা উঠোনে বসে। আমাকে দেখে বুড়ি বলে উঠল
– কে রে বাপ ? দ্যাখ দেখিন রামুট আমার কোথা গেল ? উ শালো খুব বদ হয়েছে। বলি হারে কথা বলিস না ক্যানে ?
– ও খুড়ি, কেমন আছো ! হিজু কোথায় ? আমি ঐ বাংলোর বিক্রম বাবু।
– ও দাবাবু, তা তুমি জাওনাই গো ?
– কোথায় ?
– পটলাকে নিয়ে গেল সবাই শ্মশানে। ঐ যি দুটো অজ্জুন গাছ আছে ঐখানে।
আর কথা না বাড়িয়ে চললাম শ্মশানের দিকে। আদিবাসীদের দেহ আগে পড়ানোর পর অবশেষকে কবর দেওয়া হত। এখন সম্পূর্ণরূপে দাহ করা হয়। শ্মশানে লোকের ভিড়। বাঁশের মাচায় রাখা পটলার দেহ। পায়ের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা কালো মুরগির ছানা। মৃতদেহের সাথে থাকা অশুভশক্তিকে দূর করতে মৃতদেহ সৎকারের পর বলি দেওয়া হবে মুরগির ছানাটিকে ।
সবার চেহারাতেই আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। বিধি অনুযায়ী দেহ সৎকার হল। স্নান করে বাড়ি ফিরলো সবাই। আমিও বাড়ি ফিরে এলাম। স্নান করে খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম।
সন্ধ্যার সময় মাধবদার কাছে গল্প করতে আসে গাঁবুড়ো দীনেশ। আজ আমিও ওদের সঙ্গি হলাম। কথায় কথায় এল পটলার প্রসঙ্গ। দীনেশ বললো, – “বাবু, তোরা শহরের লোক ইখানে আসিস আয়, কিন্তু উ নিয়ে আর আলুচুনা করিস না।”
অনেক সাধ্য সাধনার পর দীনেশ বলল মুয়াদেবের ইতিকথা।
অনেক অনেক বছর আগে এই জঙ্গলে নেমেছিলেন দুই দেবতা। মুয়া আর মুয়ি । আগুনের হল্কায় পুড়ে গিয়েছিল অনেক গাছপালা। যে টিলাটা আমরা দেখছি সেইটা টিলায় চেপে এসেছিলেন তারা। এই জঙ্গল গাছপালা পশুপাখি সমস্ত কিছুই মুয়াদেবের ভয়ে কাঁপে।
বেশ চলছিল সবকিছুই। মুয়া আর মুয়ি দুজনে বনে শিকার করে আর কাঠের আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে খায়। কিন্তু মুয়ি অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে দরকার এক বিশেষ ওষুধের যেটা একমাত্র পাওয়া যায় স্বর্গে। স্বর্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হল মুয়াদেব। কিন্তু বিধি বাম। টিলাটা আর উড়ল না। মুয়াদেব মুয়িকে জাদুর প্রভাবে চিরঘুমে নিদ্রিত করে দেন।
রাত ১১টা
আজ সকাল থেকে তেমন কিছু ঘটেনি। দীনেশের বাড়ি গিয়েছিলাম বিকেলে। কিছু পাথর দেখতে পেলাম ওর উঠানে। জাহের থানের কাছে জড় করে রাখা। আমি সবার নজর এড়িয়ে ছবি তুলে এনেছি। পাথরগুলো টিলাটার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরগুলোর মতো বিচিত্র সব ছবি আঁকা।
কাল একবার কলকাতা যাবো। আমার ওখানে এসপ্ল্যানেডের কাছে ফ্ল্যাট নেওয়া আছে। মাঝে মাঝে যাই। কখনো প্রয়োজনে আবার কখনো নিছক বেড়াতে। এবার যেতে হবে দরকারে। আমার এক বৃদ্ধ বন্ধু আছেন যিনি সর্ববিষয়ে পারদর্শী। ছবিগুলো ওকে দেখাতে হবে।
পটলার মৃত্যু আর দীনেশের বলা কাহিনী যে রহস্যের সূচনা করেছে তার সমাধান দরকার। হোরাশিয়ো ! এ পৃথিবীতে এমন অনেককিছু আছে যা তোমার কল্পনারও বাইরে।
পটলের দেহ ময়নাতদন্ত করা হয়নি। সমাজ এখানে খুব কড়া। কিন্তু আমি কিছু বিষয় লক্ষ্য করেছি।
এক, দেহ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে।
দুই, দাঁত নীল হয়ে গিয়েছিল।
তিন, চুলের প্রায় তিরিশ শতাংশ পেকে সাদা হয়ে গিয়েছিল। অথচ পটলার বয়স নয় কি দশ হবে।
চার, কানের লতির পেছনে কালো দুটো দাগ।
খাবার সময় পিস চারেক রুটি আর ডিমের ডালনা দিল মাধবদা।
-আর কিছু নেই মাধবদা ? রুটি আর ডিমের ডালনা !
– পেঁয়াজ দিয়ে ছাতু মাখিয়েছি। দিনের মুরগির মাংস আছে নেবেন ?
– দাও।
– তা পটলাটাকে শেষমেশ ভূতেই খেল বাবু।
মাধবদা মাংস দিতে দিতে প্রশ্ন করল। আমি হুঁ দিয়েই সারলাম। মাধবদা এতে সন্তুষ্ট না হলেও আর কোন প্রশ্ন করল না।
……….( চলবে )