একটি মেয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

একটি মেয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়

শম্পা সাহা ,

পলাশীপাড়া ,নদীয়া

আজ শ্রাবণী একটু সাজগোজ করেছে ,সাধারণত ও সাজগোজ করা পছন্দ করেনা ,কিন্তু আজ অল বেঙ্গল বিজনেস ফোরামের যে কজন হাতেগোনা সফল ব্যবসায়ীদের হাতে এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়া হবে তাদের মধ্যে ও একজন । 

     স্টেজে যখন ওর নামটা ঘোষণা করল ,ও ধীরে ধীরে উঠে এগিয়ে গেল স্টেজ এর দিকে। প্রচন্ড করতালিতে ভাসছিল সারা অডিটোরিয়াম।ওর পাশে ওর হাজবেন্ড ইমানুয়েল। ইমানুয়েল বিদেশি, ইংরেজ বলেই নয় ও সত্যিই দেখতে ভালো এবং হার্ভার্ড এর একজন স্কলার প্রফেসর ,একটা অ্যাসাইনমেন্ট এর ব্যাপারে ওদের আলাপ ও বিয়ে। 

    স্টেজে ওর সঙ্গেই ইমানুয়েল এসেছে বউয়ের সাফল্যে ওর মুখেও খুশির ঝিলিক। স্বামীর অতি সুন্দর চেহারাটা দেখে শ্রাবণী গর্বিত বোধ করলো, নিজের জন্য তো বটেই। রাজেন্দ্রাণীর মত পুরস্কার টা হাতে নিয়ে নেমে এল ওরা দুজনে। নামার সময় ইমানুয়েল শ্রাবনীর হাতটা ধরে, ওকে নামতে সাহায্য করল । 

    একটা ছোট্ট মেয়ে কালো, দাঁত উঁচু,দেখতে খারাপ, রোগা ,মুখ চোরা ,সরল সাদাসিধে ,পড়াশোনাতেও ভালো না, অথচ ও সব সময় ভালো মেয়ে মানে ওই বয়সে যারা পড়াশোনায় ভালো ,যাদেরকে লোকে ভালো বলে ,তাদের সঙ্গে মিশতে যেতো, কারন ওর মা বলেছেন ভালো মেয়েদের সাথে মিশতে। কিন্তু ওর খারাপ চেহারা আর গরিব পোশাক-আশাক, কেউ ওকে পাশে বসতে নিত না, খেলতেও দলে নিতো না কারন, পড়াশোনা, খেলাধুলা কোনোটাতেই ও ভালো ছিল না। আবার পেছনের সারির মেয়েদের মত বকাটে ও নয় তাই বেচারা সারা জীবন একা একাই ঘুরে বেড়াতো। দিদিমণিরা যদিও ওর শান্ত মিষ্টি স্বভাবের জন্য ওকে ভীষণ ভালোবাসতো কিন্তু সমবয়সীদের সঙ্গে ও কখনই মিশতে পারতো না, যাদের সঙ্গে মেশার জন্য ও ছিল ভীষণ লালায়িত ,যাদেরকে সকলে ভালো মেয়ে বলে । ও সবার সঙ্গে ই বন্ধুত্ব করতে চাইতো কিন্তু কেন জানি না ওর কোন বন্ধু হলো না। সবাই ওকে কেমন একটা হেয় করতো, ঠাট্টা করত, এছাড়া ও যেহেতু গায়ে পড়ে ভালো মেয়েদের সঙ্গে মিশতে চাইতো , সেই কারণে সেই সব ভালো মেয়েরা ওকে দিয়ে সুযোগ মত নিজেদের সব কাজ করিয়ে নিত কিন্তু কখনোই বন্ধুর মর্যাদা দিত না। তাদের ব্যাগ নিয়ে আসা,  জলের বোতল ভরে আনা বা কারোর খাতা জমা দিয়ে আসা, বা নিয়ে আসা এসব ও নিজেই খুশি হয়ে করত কিন্তু বন্ধু হিসেবে ওরা কোনদিনই ওকে পাশে বসতে দিত না বা গল্পের সঙ্গী করতো না। 

       ওরে বাঁ পায়ে একটু ডিফেক্ট ছিল ,সামান্য নিচু হয়ে হাঁটতো, তা নিয়ে কত মেয়েরা ওকে অনুকরণ করতো। মেয়েটা একা একা লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসতো,টিফিনে সিঁড়ির এক কোণে বসে টিফিন করত আর ওর সব দুঃখ কষ্টের কথা বলতো ওর একমাত্র বন্ধু ওর মাকে। ওর মা শুধু একটা কথাই বলতেন যে, “জানিস রবি ঠাকুর বলেছেন ,’মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে'”। আজ মা নেই কিন্তু মায়ের দেওয়া রবি ঠাকুরের সেই  মন্ত্র টা আজও মেয়েটির জীবনের সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে।

      স্টেজ থেকে নেমে শ্রাবণী একবার চারপাশে তাকিয়ে  দেখল ,সবাই কেমন ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে  সফল লোকেদের সকলে বোধহয় এভাবেই দেখে! আজ ও নিজে মনে মনে দাঁড়ালো ওর ছোটোবেলার বন্ধুদের সামনে, ওদের উদ্দেশ্যে বলল, “মেঘ দিয়ে  তোরা আমার ছোটবেলার সব খুশি ডেকে দিয়েছিলি, আজ সে মেঘ কেটে গেছে ,আজ সূর্য উঠেছে। আজ আর আমি তোদের কথা মনে করে কষ্ট পাই না। “

   শ্রাবনী  মনে মনে আরো একবার গুনগুন করল মায়ের বলা ,কবিগুরুর সেই অমোঘ বাণী, “মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় ,আড়ালে তার সূর্য হাসে”। 

Leave a Reply