সুমনা বলল, ওই যে তোমার ঘর।পরিষ্কার করে রেখেছি। বিছানাও করা আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে এঘরে চলে এস। ব্রেকফাস্ট রেডি। তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু ঋজুদা। আমরা ওয়েট করছি।
সুমনাকে কি বলে ডাকবে ঋজু আজ পর্যন্ত ঠিক করতে পারে নি। সুমনা এখন মেজদার বৌ।কিন্তু ওর থেকে বয়েসে ছোট।ছোটবেলা থেকে ওকে যে নামে ডাকত সেই নামে ডাকলে মেজদা রাগ করবে কি না কে জানে? এখন ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলতেও একটু অস্বস্তি তো হচ্ছেই।চাবিটা সুমনার হাত থেকে নিতে গিয়ে একটু অনভিপ্রেত স্পর্শ হল।চেনা স্পর্শ অচেনা লাগছে আজ।আগে যে স্পর্শে রোমাঞ্চ জাগত আজ তা পেয়ে যেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল ঋজু।
সুমনা কি ইচ্ছে করেই ছুঁয়ে দিল তার হাত? মনে পড়িয়ে দিতে চাইল কি কিছু ? তার চোখের চাউনিতে কি অন্য কিছু লেখা ছিল? যাই থাক , সে সব পড়তে চাইছে না তার মন। চাবিটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।দরজা খুলে এই ঘরের ভেতরে তার ঢোকাটাকে আক্ষরিক অর্থে এই ঘরের গৃহপ্রবেশই বলা যায়। ফ্ল্যাটটা তৈরী হওয়ার পর সে কখনো আসে নি এ ঘরে।অথচ ফ্ল্যাটটার মালিক সে।সুমনা ঘরটা যৎসামান্য সাজিয়েছে। একটা খাট পাতিয়ে চাদর বালিশ পেতে দিয়েছে। একটা চেয়ার টেবিলও রেখেছে। টেবিলে জলের বোতল গ্লাস আর একটা ভাসে একগুচ্ছ গোলাপ দিয়ে সাজাবার চেষ্টা করেছে।
তিনরুমের ফ্ল্যাট। যা থাকে সঙ্গে আজকাল। তিনটে রুম ছাড়া একটা হলঘর , এক চিলতে রান্নাঘর, দুটো বাথরুম, আর একটুকরো ব্যালকনির সীমাবদ্ধ জীবন। পুর্বের জানলা দিয়ে তেরছাভাবে রোদ ঢুকেছে ঘরটায়।ঋজু দরজা খুলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। চারতলার এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চারপাশের ঘরগুলো ওপর থেকে চারিদিকটা দেখার চেষ্টা করল।দেখে কিছুই চিনতে পারল না। কোনটা বুবাইদাদের ঘর, কোনটাই বা গোগোলদাদের ঘর । তুলসীদিদার পুরনো পলেস্তারাহীন ঘরটাও খুঁজে বার করতে পারল না সে।অথচ এই ঘরেই সে কাটিয়ে গেছে তার জীবনের সুখকর উনিশ কুড়ি বছর।তখন ছিল সবকিছু চেনা হাতের মুঠোয় ।
ঋজু কিছুতেই ঠাহর করে উঠতে পারল না এ বাড়িতে তাদের সব থেকে প্রিয় ঘর যেটাকে ওরা বলত ঠাম্মার ঘর , যে ঘরটার পুব দিকের জানলার ওপরে অর্ধবৃত্তাকারে রঙীন কাচের সার্শি লাগিয়েছিলেন দাদু,সেই ঘরটা কোথায় ছিল? ছুটির দিনে সকাল থেকে সবাই ঠাম্মার ঘরে ভিড় জমাত। ওখানেই খাটের ওপর বসে চলত চা খাওয়া, কাগজপড়া।ঠাম্মার ঘরে খাটের ওপর তখন রঙীন কাঁচের সার্শি বেয়ে রং বেরঙের রোদ্দুর বিছানার ওপর খেলা করছে।বাবা, মা জ্যেঠু জ্যেঠিমারা পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় মত্ত হয়ে যেত।আর ঋজুদের খুদের দল বিছানার ওপর নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি মারামারিতে ব্যস্ত।একসাথে বসে পাত পেড়ে খাওয়া, একসাথে ভাইয়ে ভাইয়ে জড়াজড়ি করে শোওয়া, সব হাসি মজায় একসাথে ভাগ, এইভাবে চার শরিকের ঘরটাতে একটা প্রানের স্পন্দন জেগে থাকত।ঠাম্মার সেই ঘরটা এই ফ্ল্যাট ঘরের জ্যামিতিক নকশায় কোথায় হারিয়ে গেছে।
ঠাম্মার ঘরটার আর একটা আকর্ষণ ঋজুর মধ্যে জন্মে গেল যৌবনে পদার্পণের পর।সময় পেলেই ঠাম্মার ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে খবর কাগজ পড়া বা পরীক্ষার পর গল্পের বই পড়াটা ঋজুর নেশার মত ছিল।সেই নেশাটা রঙীন হয়ে উঠল একটা ঘটনার পর।একদিন ঠাম্মার খাটে শুয়ে বই পড়াতে মগ্ন ঋজুর চোখ হঠাৎ আটকে গেল সামনের ঘরের জানালায়। ঠাম্মার ঘরের জানলা দিয়ে সোজাসুজি দেখা যায় ওই জানলাটা। জানলায় দাঁড়িয়ে আছে সুমনা। সুমনা গোগোলদার বোন।এঘর থেকে ওদের ওই ঘরটার প্রায় সবটাই দেখা যেত।সুমনাকে ছোটবেলা থেকে দেখেছে ঋজু জানলা দিয়েই ওই ঘরে ঘোরাফেরা করতে।কিন্তু আজ যেন অন্যচোখে দেখল ঋজু।আজ সত্যিই মনে হল অন্যকিছু।মেয়েটা কখন অগোচরে এত বড় হয়ে গেছে, বদলে গেছে চোখের চাউনি ! যেন এক রঙিন প্রজাপতি।ঠোঁটের কোনে এক রহস্যময় হাসি নিয়ে অপলকে তাকিয়ে আছে তার দিকে চেয়ে।
সেই প্রথম হৃদয় ভ্রমর গুনগুনিয়ে উঠল ঋজুর।আগে কত কথা বলেছে , আজ কেন ভাষা হারিয়ে গেল তার? কি বলবে অপলকে চেয়ে থাকা মেয়েটাকে ভেবে না পেয়ে চোখ ফিরিয়ে বইয়ের পাতায় ফিরে গেল সে।অবাধ্য চোখ, বাধা মানে না, আবার ফিরে গেল জানলায়। সুমনা তখনো তার দিকে চেয়েই আছে।নীরবতা ভেঙে সুমনাই প্রথমে বলল
একটু পেপারটা দেবে ঋজুদা, পড়ে ফেরৎ দেব।
এ সময়টা ঘরে কেউ নেই।কাগজটা মুড়ে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতে গিয়ে সুমনার হাতের প্রথম স্পর্শ পেলো ঋজু ।সারা শরীরে বিদ্যুৎস্পর্শের মতন অনুভুতি বয়ে গেল। সেদিন সুমনার হাতের ছোঁয়া তার যৌবনবৃক্ষের ডালে নাড়া দিয়ে গেল।তারপর থেকে ঋজুর মন সকাল সন্ধ্যে ওই জানলার দিকে পড়ে থাকে। সকলের নজর এড়িয়ে একঝলক দেখে নেওয়া বা হাত বাড়িয়ে গল্পের বই, পেপার দিতে গিয়ে সুমনার কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে যাওয়া, এসবের জন্য মনটা উন্মুখ হয়ে থাকত।
সেটা ছিল ক্লাস টেনের শেষ। বড়দার মত ঋজুও ভালো রেজাল্ট করে ইলেভেনে উঠে গেল। বড়দা ততদিনে ভাল রেজাল্ট করে বড় কোম্পানীতে চাকরি পেয়ে গেছে। বড়দার একটা স্বভাব ছিল ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়া।মেজদা সেজদা ঋজু নিজে ওভাবে পড়ত না। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পড়া ওদের ধাতে ছিল না।পড়ার মাঝে তিনভাই মাঝে মাঝে এ ওর ঘর থেকে ঘুরে আসত।ইলেভেনে ওঠার পর ঋজু নিজেকে পালটে ফেলল।বড়দার অনুপ্রেরণায় নিজেকে পড়ার মধ্যে ডুবিয়ে ফেলল,তাতে মেজদা সেজদা একটু অসন্তুষ্ট হলেও ঋজু দরজা বন্ধ করে পড়া চালিয়ে যেতে লাগল।
আজকাল পড়ার চাপে ঠাম্মার ঘরে আসাটা কমে গেছে।প্রথম প্রেমের হাতছানি,যৌবনের দাপাদাপি, ভবিষ্যতের কঠোর বাস্তবতার কাছে হার মানছিল ধীরে ধীরে।কিশোরীর প্রেমের আহ্বান জোর করে দূরে সরিয়ে ঋজু সময় নিতে চাইছিল।খবরের কাগজের ফাঁকে একদিন চিরকুটে সুমনা লিখল
বাবাঃ, বিদ্যাসাগর মশাই, শুধু বিদ্যের জাহাজ হলেই চলবে?
চিরকুটে জবাব গেল
এই দুটো বছর একটু ব্যাস্ত থাকব।
আবার চিরকুটে প্রশ্ন এল
আমি কি অপেক্ষায় থাকব ?
শেষে তীরে এসে তরী ডুববে না তো?
ঋজু কোনো জবাব দিতে পারল না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে কি প্রতিশ্রুতি দেবে?ভালভাবে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে জয়েন্ট দিয়ে ঋজু যখন সময় পেল প্রেমসাগরে ডুব দেবার, ততক্ষনে জল অন্যদিকে গড়িয়েছে।বেচারা ঋজু নানা অছিলায় ঠাম্মার ঘরে এসে বসে।কিন্ত সে দেখা দেয় না।অনেক কষ্টে একদিন পেয়ে চিরকুটে লিখল ঋজু
তোমার সাথে কোথাও দেখা করতে চাই।
চিরকুটে জবাব এল
বড় দেরী করে ফেললে ঋজুদা।
চার শরিকের ঘরটাতে ভেতর ভেতর দ্বন্দে দ্বিধা বিভক্ত হচ্ছিল। ঋজুদের সেটা টের পাওয়ার কথা নয়।বড় জ্যেঠু মেজজ্যেঠুদের ঘরের দরজা অবারিত থাকলেও কোনো এক সকালে ঋজু দেখল একসাথে বসে তারা ভাইবোনেরা আলাদা আলাদা খাবার খাচ্ছে। খুব বিস্ময় নিয়ে পাঁচ ভাইবোন এ ওর পাতের দিকে চেয়েছিল। ভাল করে কারুরই খাওয়া হয় নি সেদিন। মনের মধ্যে একটা প্রবল অস্বস্তি নিয়ে ভাইবোনেরা যে যার ঘরে ঢুকে গেছিল।ঋজু মা বাবাকে জিজ্ঞেস করতে চায় নি, আজ কেন এমন হল? মা বাবাও যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই সেটা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় নি তার।
সুমনা কেন মুখ ফিরিয়ে নিল ঋজু জানত না।সেজজ্যেঠুর মেয়ে টিয়া যদিও ঋজুর থেকে ছোট আর আদরের।অল্প বয়সেই মেয়েরা অনেক কিছু বোঝে।সেই ঋজুকে বলল
ছোড়দা তুই বড় দেরী করে ফেললি।
মেজজ্যেঠু মেজদার জন্য সুমনার হাত চেয়েছে গোগোলদার বাবার কাছে।
বড়দার তো আগেই পাত্রী পছন্দ করা ছিল। কলেজ লাইফ থেকে বন্ধুত্ত্ব।বড়দার বিয়ে হলে মেজদার বিয়ের ব্যাবস্থা করবে মেজজ্যেঠু। এতসব খবর ঋজুর জানার অসাধ্য ছিল। টিয়ার কাছ থেকে এই খবর পাবার পর ঋজুর অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল।দমবন্ধ এই পরিবেশ ছেড়ে ঋজু তখন পালাতে চাইছিল।
সুযোগটা এসে গেল তার কৃতকর্মের ফল হিসেবে । অল ইন্ডিয়া জয়েন্টে ভাল র্যাংক হল।বাইরে পড়ার সুযোগ এসে গেল।সারা ঘর হাওড়া স্টেশনে এসেছে । সবার মন খারাপ।একটা বৃত্ত যেন ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে।সবাই বুঝতে পারছে বৃত্তটা হয়ত আবার জুড়বে কিন্তু পরিসরটা ছোট হয়ে যাবে।ট্রেনটা ছেড়ে দিচ্ছে। ভেতরে জিনিসপত্র রেখে ঋজু দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। যতক্ষন দেখা যায় হাতনেড়ে যাচ্ছে।ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে জন্মভূমি।ক্রমশ ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনেরা।দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের আলো ঝলমলে মহানগর।ট্রেনটা ঋজুকে নিয়ে ছুটে চলেছে এক দূরের গন্তব্যে, যেখান থেকে শুরু হবে এক নতুন জীবন।
কলেজের পড়া থেকে বছর দুয়েকের চাকরী জীবনের মাঝে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল ঋজুর জীবনে। প্রথমে ঠাম্মা চলে গেলেন।তারপর বড়দার বিয়ে, তারপর দু বছর আগে কিছুদিনের তফাতে মা আর বাবা দুজনের আকস্মিক মৃত্যু ঋজুকে একা করে দিয়ে গেল।ঠাম্মা মারা যাবার পর চার শরিকের ঘরে ফাটলটা বড় করে দেখা দিল।ঘরটা মেরামতি আর রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ত্ব কেউ নিতে চাইছিল না।শেষে এখনকার অমোঘ নিয়মে বাড়ীটা প্রোমোটারদের হাতে তুলে দেওয়া এবং যে যার অংশ ভাগের ব্যাবস্থা করে নেওয়া হল।
ঋজুর এবারের আসা ঘরটার রেজিস্ট্রেশন করতে। দুবছর ধরে জ্যেঠুরা বলে আসছে। ঋজু কোনো তাগিদ অনুভব করে নি।আজ যে সে এসেছে এতদিন পরে তেমন অভর্থ্যনা তাকে কেউ করে নি , নিজের লোকেরা।শুধু যাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল সেই সুমনাই এগিয়ে এসে তার হাতে চাবি তুলে দিয়েছে। ছোটবেলায় যে জ্যেঠুদের ঘর অবারিত থাকত তারাই এখন ফ্ল্যাটবাড়ির বন্ধ দরজার ভেতর বদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে।
কতক্ষন এইভাবে বসে হারিয়ে গিয়ে ছিল ঋজু অতীতের মধ্যে নিজেই জানে না। সম্বিত ফিরল তার কলিংবেলের আওয়াজে।উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতে দেখে সুমনা।
কি গো ঋজুদা এখনো তৈরি হও নি? কি ভাবছিলে এতক্ষন বসে?
ঋজু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
নাঃ কিছু না।তুমি চল আমি এখুনি আসছি।
সুমনা তবু দাঁড়িয়ে রইল দেখে ঋজু বলল
কিছু বলবে?
সুমনা মাথা নীচু করে বলল
একটিবারও তো জিজ্ঞেস করলে না ঋজুদা কেমন আছি?
ঋজু চোখেমুখে জল দিতে দিতে বলল
সরি সুমনা,ভুল হয়ে গেছে। সেদিনও ভুলটা আমিই করেছিলাম, কিন্তু সে ভুলের মাশুল দেবার সুযোগ তুমি আমায় দিলে না।
না ঋজুদা , তুমিই ঠিক ছিলে। কাঁচা মন আমার তোমার ওপর অভিমানে ভরে উঠেছিল তখন।সেই রাগে তোমার জ্যেঠু যখন বিয়ের কথা বলতে এসেছিল, রাজী হয়ে গেলাম।ভেবেছিলাম তোমার চোখের সামনে তোমাদের বাড়ির বৌ হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে তোমায় শাস্তি দেব।বোন আমাকে অনেকবার বলেছিল , দিদি তুই ভুল করছিস।ঋজুদার কোনো দোষ নেই।নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার এই তো সময়।তুই ঋজুদাকে সময় দে।আমি শুনতে চাই নি। তোমার ওপর রাগে অন্ধ হয়ে গেছিলাম।পরে বুঝতে পেরেছি ভুলটা আমিই করেছিলাম।
ঋজু বুঝতে পারল সুমনা ভেতরে ভেতরে কাঁদছে।সে নিজেও কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতার পর নিজেকে স্থির করে সুমনা আবার বলল
বিয়ে করবে না ঋজুদা?
না কি আমার দুঃখে দেবদাস হয়ে কাটাবে ?
এখনো কিছু ঠিক করি নি সুমনা।
তুমি কি আর নিজে নিজে তোমার বিয়ে ঠিক করবে? আর এঘরের এখন যা অবস্থা কেউ তোমার জন্য বৌ খুঁজে এনে দেবে এ আশা কোর না।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে সুমনা হঠাৎ এগিয়ে এসে ঋজুর হাতটা ধরল,
আমাকে আমার ভুলের একটা প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেবে ঋজুদা ? আমার ছোট বোনকে বিয়ে করবে? আমার মনে হয় ও তোমাকে সুখী রাখবে। তুমি খুব একা হয়ে গেছ ঋজুদা। তোমার জন্য খুব কষ্ট হয় আমার।
ঋজু বলল
জানো সুমনা, কিছু ভালোবাসা নিজে নিজেই গড়ে ওঠে আর কিছু নিজেকে গড়ে নিতে হয়। আমাকে হয়ত সেটাই করে নিতে হবে।তোমার কথাটা পরে ভেবে দেখব।
সুমনার হাতের তৈরি লুচি তরকারি খেতে খেতে সবার সাথে দেখা হয়ে গেল। সুমনাই সবাইকে ডেকে আনল।বড়মা, মেজমা সেজমার হাতে আদর খেতে খেতে ঋজু হারিয়ে যাচ্ছিল পুরোন দিনগুলোতে।তাকে ঘিরে এখন সবাই রয়েছে।সুমনা প্রস্তাব দিল যে কদিন ঋজুদা থাকবে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবে সবাই।সবাই রাজী হয়ে গেল। মাটিতে বিছানা পেতে আবার একসাথে আগের মত জড়াজড়ি করে সব ভাইয়েরা শুল।গল্পে গল্পে রাত কেটে গেল।কি করে জানল সুমনা ঋজু জানে না, সে যা যা খেতে ভালবাসত বেছে বেছে সেই পদগুলো রান্না করাল।সেজমা রাঁধল চিতল মাছের মুইঠ্যা।মেজমা রাঁধল মাছের ডিমের বড়ার চচ্চড়ি কাটোয়ার ডাঁটা দিয়ে।বড়মার হাতের মাংসের ঝোল।ঋজুর মনে পড়ে ছুটির দিনে বাবার সঙ্গে যেত মানিকতলার বাজারে।বাবা দরদাম করে পছন্দসই মাছ কিনে আনত। সেজমা মাছ কাটায় পটু ছিল।জানলার কাছে মাটিতে বসে কি অনায়াসে কথা বলতে বলতে মাছ কাটত সেজমা।দুটো দিন হৈ হৈ করে কি ভাবে যে কেটে গেল।ভেঙ্গে যাওয়া বাড়ীটা আবার আগের মত প্রানের স্পন্দন ফিরে এল মনে হয়।
সুমনার সঙ্গে কথা বলায় এখন আর আড়ষ্টতা নেই ঋজুর।ওকে এখন বড় নিজের লোক মনে হচ্ছে তার।সুমনা এই দুদিনে তার যত্ন আত্তির কোনো ত্রুটি রাখে নি।আজ ঋজুর মনে আর কোনো দুঃখ নেই। মনের কোনে জমে থাকা বিষাদের মেঘ সরে গিয়ে সেখানে রোদ খেলা করছে।ঋজু আজ আর একা নয়।তার জন্যে ভাবার লোক কেউ আছে।
ফিরে যাবার সময় এসে গেল ঋজুর। সন্ধ্যের ফ্লাইটে ফিরে যাবে ব্যাংগালোর।এক মহানগর থেকে আর এক মহানগরে। আসার সময় সুমনার হাতেই ঘরের চাবি ফিরিয়ে দিয়েছিল।আবার সুমনার হাতের ছোঁয়া পেল ঋজু। না , এবারে কোনো আড়ষ্টতা নেই, নেই কোনো শিহরন। বরং এক আশ্চর্য্য ভালোলাগার অভয়ানুভুতি।চাবিটা দিতে দিতে ঋজু বলল
আমার ঘরের দরজা সবার জন্য খোলা রইল। যার যখন দরকার পড়বে ব্যাবহার কোরো।
সুমনা চাবি নিয়ে বলল
আবার এসো ঋজুদা। যখনই সময় পাবে চলে এসো। ভালো লাগবে।
চেক ইন করে লাউঞ্জে বসে ছিল ঋজু।মনটা একটা ভালোলাগার আবেশে ভরে আছে। হোয়াটসএ্যপে একটা মেসেজ এলো। খুলে দেখল সুমনা পাঠিয়েছে।
তুমি এঘরে অনেকদিন পরে এক চিলতে রোদ্দুর এনে দিলে ঋজুদা।আমার প্রথম ভালোবাসা তার পরিণতি পায় নি ।তবু তুমি এসে মনটা ভালোলাগায় ভরে দিলে।আমার মনের মেঘটাও কাটিয়ে দিয়ে গেলে। আর কি বলব ? সাবধানে যেও। পৌঁছে একটা খবর দিও।আর তোমার ভাবনাটা একটু ভেবে আমায় জানিও।
ঋজু লিখল
সুমনা, আজ আমার মনে আর কোনো দ্বিধা দ্বন্দ নেই। আজ আমার মনে হচ্ছে আমি আর একা নই। আমার সব ভালোবাসার লোকেরা আমারই আছে।সব কিছুর হয়ত শেষ একটা আছে, ভালোবাসার কোনো শেষ নেই।স্থান কাল বিশেষে তার শুধু প্রকারভেদ হয়।
তুমি বয়সে ছোট তবু আজ তোমায় বৌদি বলে ডাকতে খুব ইচ্ছে করছে। আজ আমার ভাবনা গুলো সব তোমায় দিলাম।আমি জানি তুমি যা করবে আমার ভালর জন্যেই করবে।
আর হ্যাঁ, পৌঁছে তোমায় খবর দেব।
সুমনার জবাব এল
ঋজুদা আমায় বৌদি বলে তুমি হয়ত তোমার আমার সম্পর্কের একটা সীমারেখা টানতে চাইছ , কিন্তু আমার কাছে সারাজীবন তুমি আমার ঋজুদাই থাকবে আর তোমার কাছে আমি তোমার সুমনা হয়েই থাকতে চাই। তোমার ভাবনাগুলো আমায় দিয়েছ। কথা দিচ্ছি তোমার ভাললাগার, তোমার ভাল থাকার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি আমি রাখব না।যে ভুলটুকু করেছিলাম সেটুকু কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে নিতে চাই। ভালো থেকো ঋজুদা। আশা করি খুব শিঘ্রী আবার দেখা হবে তোমার সাথে।
ফ্লাইট ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। সীটবেল্ট বেঁধে নিল ঋজু।প্লেনটা আকাশে উড়তেই জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকাল ঋজু। অন্ধকারের বুকে হাজার তারার ঝলকানি নিয়ে হাসছে মহানগর।যেন ঋজুকে বলতে চাইছে এখানে, এই ইঁট কাঠ পাথরের জঙ্গলেও প্রেম আছে গো, ভালোবাসাও আছে। এই শহরে হৃদয় আছে, প্রাণ আছে, প্রাণের আরামও আছে।যার যা চাই সব আছে গো এই শহরে। শুধু খুঁজে নিতে হবে।
ঋজুর খুব ঘুম পাচ্ছে। ভালোবাসার একটা আবেশ মনের মধ্যে জিইয়ে নিয়ে কানে হেডফোনটা লাগিয়ে ঋজু চোখ বন্ধ করল।কানের মধ্যে খুব মৃদুসুরে বাজতে লাগল
“দেখ আলোয় আলো আকাশ,
দেখ আকাশ তারায় ভরা
দেখ যাওয়ার পথের পাশে
ছোটে হাওয়া পাগল পারা
এত আনন্দ আয়োজন
সবই বৃথা আমায় ছাড়া”
নীচে মহানগর তখন কোন সুদূরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।