রেলিস্টেশনের পাশেই মনে হয় তার বাড়িঘর। ওখানে গেলেই তাকে দেখা যায় বসে বসে সিগারেট টানছে। গাড়ি বা রেলে কিংবা বাসট্যান্ডে বসে গল্প করার কোনো অভ্যেস আমার নেই। অনেকে কথা বলতে বলতে ঠোঁটমুখ শুকিয়ে নেয়। দৌড়ের ঘোড়ার পায়ের ধূলির মতো ঝরে পড়ে এদের মুখ থেকে কথা। না শোনে যাব কই এজন্য শুনি। আর ঘুমুতে পারি না বলেই দেখি। মনতাজ আলীকে ২৪ জুলাই যেখানে রেখে গিয়ে ছিলাম ৩০ জুলাই ফিরে এসে দেখি সেখানেই বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। কিন্তু মলিন সেই শার্টটি আজ গায়ে নেই। আছে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, আচড়ানো মাথার চুল। মোটামুটিভাবে গোছালো।
বাসট্যান্ডের দিকে রওয়ানা করতেই স্যার স্যার বলে কে যেন ডাকছে। কে কার ডাক শোনে। কত স্যার নামছেন রেল থেকে। পেছনে না ফেরে সামনে অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু ডাকতেই আছে সে। কিছু দূর গেলে একেবারে নিকটে এসে বলছে “স্যার আমি আপনারে ডাকিয়ার, একবারতা খাড়াওউক্কা, আপনারে লইয়া এককাপ চা খাইতাম।” তখন আমি ফিরে চাইলাম, দেখি স্টেশন পাহাদার। জিজ্ঞেস করলাম ‘তুমি কে?’ বলল “আমি মনতাজ আলী, সিলেট লামাপাড়া থাকি। মূল বাড়ি গোয়াইনঘাট।” ‘আপনার বাড়ি গোয়াইনঘাট না’ জিজ্ঞেস করল আমাকে। হ্যা আমার বাড়ি গোয়াইনঘাট। যখন আসি তখনই পাওয়া যায় এখানে তুমি কী কর? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
মনতাজ: জ্বী না স্যার, সবসময় থাকি না। বাসায় কাজকাম নাই তাই অবসর সময় কাটাই এখানে ওখানে বসে।
আমি: তাহলে পরিবার চলে কেমনে?
মনতাজ: জ্বী স্যার, পরিবার চলে দুই ছেলের রোজগার দিয়ে। তারা বাইরে থাকে। আলহামদু লিল্লাহ ভালো একটা টাকা পাটায় ছেলে দ্বয়।
আমি: ঠিক আছে। এখন যাই। অন্য কোনোদিন বসে গল্প হবে। আর চা ও খাব।
মনতাজ: জ্বী না স্যার, আজকে চা খেলে খুশি হতাম। আজকে না খেলে আমার আফসুস থেকে যাবে স্যার।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী করে ছুটি। নাচোড় বান্দা। হাবভাবে মনে হচ্ছে ‘চা’ না খেলে সে ছাড়বে না। আর ‘চা’ বলে কথা! এককাপ কড়া লীগার দুধ চা মানে নতুন কিছু করা। ঠিক আছে চল বললাম আমি। এখন মনতাজ আগে আগে হাটছে। তখন আমার বুক ধুরুম ধুরুম করে কাপছে। কারণ, অনেক অঘটন ঘটে এখন এমন চা চক্রের মধ্য দিয়ে। অনেক দুষচিন্তা করতে করতে রেলিস্টেশন থেকে পুরানব্রিজ হয়ে বন্দর বাজার শাহজালাল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালাম। মনতাজ আমাকে বলল স্যার আপনি আগে প্রবেশ করুন। না ইনতাজ তুমি আগে যাও আমি তাকে বললাম। সে গেল না। বরং আমাকে জোর করে আগে দিয়েই দিল।
প্রবেশ করলাম। বসতেই বয় ছেলে জিজ্ঞেস করল কী খাবেন__বিরিয়ানি, চিকেন ভার্গ, চা-বিস্কুট কোনটা দেব? মনতাজ সঙ্গে সঙ্গেই বলল বিরিয়ানি নিয়ে আস। চায়ের কথা বলে আমাকে নিয়ে এলে আর বিরিয়ানির অর্ডার দিলে এ কেমন কথা! না স্যার দেখলাম লংটাইম রেলে ছিলেন নাস্তা টাস্তা করেছেন কী না এজন্য বিরিয়ানির অর্ডার করলাম। স্যার আমার সঙ্গে বাসায় চলেন আমার গিন্নী গোস্ত ভালো রান্না করতে জানে। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে একটু রেস্ট নেবেন। দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর বেরিয়ে যাবেন। তবে তান্নি একটু রাক্ষুসে মানুষ। গরুর গোস্ত দেখলে লোভ সামলাতে পারে না। গোশত খেলে এক কিলোর না খেলে তৃপ্তি আসে না। তার গোশত খাওয়ার অনেক গল্প আছে। সে চমৎকারভাবে উপস্তাপন করে। বিরিয়ানি শেষ করতে না করতে মনতাজ আবার বলল চলুন বাসায় চলে যাই।
না মনতাজ আজকে না, অন্যদিন যাব। আচ্ছা চল এখন যাই। বাসায় অনেক কাজ। তোমার গিন্নীর রান্না ভালো হবে তোমার কথা থেকেই বুঝা যাচ্ছে। আচ্ছা স্যার আপনাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে যাব। “স্যার তান্নির গরুর গোশতের অনেক গল্প আছে। তান্নি আমার স্ত্রী। সে বললে ভালোই লাগে। আপনার শোনতে বেসুর লাগবে তবুও আমি একটা গল্প বলি।”
“গতসপ্তাহে লালবাজার গিয়ে ছিলাম মাছ ক্রয় করবার জন্য। তো তান্নি আমার সঙ্গে। সে আগে আগে হাটছে। এখন কল্লা কাটার দিন। আগে না হাটলে তার ভয় লাগে। আর আমি এদিক ওদিক চেয়ে চেয়ে এগুচ্ছি। মাছ বাজারের ভেতরে প্রবেশ করে দেখি সামনে তান্নি নেই। আমার অন্যমনস্কতার ফাঁকে তাকে হারিয়ে ফেলেছি। পেছন ফেরে দেখি পেছনে নেই। দৌড়ে গেলাম মূল গল্লিতে। দেখি সে হা করে দাঁড়িয়ে আছে কশাই বাবুর লটকানো গরুর রানের দিখে চেয়ে। ঠিক শিকারীর মতো চেয়ে আছে যেন শিকার ছুটে না যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঢুকঢুক করে মুখের লালা গিলছে।
পেছনে দাঁড়িয়ে বললাম আজ কোনোভাবেই গোশত ক্রয় করে দেব না। তখন দেখলাম তান্নি মনে হয় গভীর কোনো স্বপ্নে ছিল, আর আমি তার স্বপ্নে গুড়েবালি দিয়েছি।” মনতাজ আর আমি হাটতে হাটতে শিশু পার্কের সামনে লেগুনা স্টেশনে হাজির। মনতাজ আমাকে লেগুনায় বসিয়ে বলল “আজকে যাই অন্যদিন দেখা হলে এই গল্প বলব।” বলেই ইনতাজ চলে গেল।
এর পর আরও কতবার রেলস্টেশনে গিয়েছি। কিন্তু ইনতাজকে খোঁজে পাই নি। মনতাজের সঙ্গে রেলিস্টেশনেই পরিচয় আবার ওখানেই হারিয়ে ফেলা। তার বাসার নম্বর জানি নে। নইলে খোঁজে দেখতাম মনতাজ অসুখি হল না কোনো অসুবিদেয় আছে। তার গল্পকার স্ত্রী তান্নি কেমন আছে। কশাই বাবুর দোয়ারে গোশত খাওয়ার লোভে নিমগ্ন তান্নি দাঁড়ায় কি না? কিচ্ছুই জানি না।