শুক্লপক্ষের প্রতিপদের রাত, খাওয়া দাওয়া সেরে সবেমাত্র শুয়েছেন মৃগাঙ্কবাবু। এমন সময় বাইরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। অনেক রাত করে শোয়ার দরুন ঘুম আসার নামগন্ধও নেই। তার উপরে এই অনাহুত জ্বালাতন, – মাথা গরম হয়ে গেল মৃগাঙ্কবাবুর।
.
.
“অ্যাই কে রে ! বড্ড জ্বালাতন করিস তো ! যাই যাই।” অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠলেন মৃগাঙ্কবাবু। ঘরের খিল খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। হ্যারিকেন হাতে চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে এগিয়ে গেলেন উঠান বরাবর। বহিরদরজার সামনে আসতেই কড়া নাড়ার শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল।
মৃগাঙ্কবাবু হাঁক পড়লেন,” কে রে ! ” কোনো উত্তর নেই। নিজের মনে গজগজ করতে করতে ফিরে চললেন তিনি। কয়েক পা’ যেতেই আবার কড়া নাড়ার শব্দ। আবার ফিরে এলেন দরজার কাছে। আগেরবারের মতোই এবারও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
এবার আর থাকতে পারলেন না মৃগাঙ্কবাবু। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গালাগালি দিতে লাগলেন। ” ওবে হারামজাদা, আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছিস ! আমার সাথে ইয়ার্কি ! মেরে পুঁতে দেব –
সত্যিই তো, মৃগাঙ্ক সেন ওরফে কেশব জালান ওরফে জগাই দাস ওরফে আরো কত কি যে সে তা বোধহয় সৃষ্টিকর্তাও জানেন না। ঘন্টায় ঘন্টায় রং বদল করে যে তার সাথে পেরে ওঠার সাধ্য কারোরই নেই।
অনেক চিন্তা এসে ভিড় করে মৃগাঙ্কবাবুর মাথায়। কে আছে এমন যে তার সাথে এধরনের তামাশা করতে পারে। ধীরে ধীরে ঘরের দিকে এগিয়ে যান তিনি। তড়িঘড়ি জুতোজোড়া না খুলেই ঘরে ঢুকে পড়েন, দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে পড়েন মৃগাঙ্ক সান্যাল।
ছোটোবেলা হতেই খুব ধীর স্থির ছিল ডেভিড। বাবা মায়ের আষ্টম সন্তান ডেভিডকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল একটা সরকারী স্কুলে। স্কুলের প্রথম দিনেই ইউসুফ মাষ্টারের মাথায় ঢিল মেরে ফেরার হয়ে গিয়েছিল সে। গ্রামে ফিরল টানা চারমাস পরে। আর স্কুলে ঠাঁই হল না। বৈকল্পিক শিক্ষায় শিক্ষিত ডেভিড হয়ে উঠল তার সমাজের মাথা।
দিন যায় দিন আসে, ডেভিড সুশীল সমাজের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে থাকে। সবাই সবকিছু জেনেও চুপকরে থাকে অজানা আতঙ্কে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে খুন ধর্ষন আর তোলাবাজীতে সিদ্ধহস্ত ডেভিডের পায়ের তলায়।
কিন্তু সব পাপেরই অন্ত আছে। ধরা পড়ল ডেভিড। জোরপূর্বক আটক, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি একাধিক ধারায় দোষী সাব্যস্ত ডেভিডের ফাঁসির সাজা দিল আদালত।
– – দুই–
কিছুদিন ধরেই হাতে কোনো কাজকর্ম নেই। একা বোকার মতো বসে আছি। এই বেকার জীবনটা বড় একঘেয়ে লাগছে। গ্যাসের উনুনে চাল, আলু আর ডিম বসিয়ে দিয়ে পুরানো একটা খবরের কাগজে শব্দছক করছি। এমন সময় বাইরের দরজায় খটখট আওয়াজ হল। উঠে গিয়ে দরজাটা খুললাম। দেখি আমার ট্রাভেল এজেন্ট বন্ধু সৌম্য।
চা খেতে খেতে সৌম্য বলল, “তোর হাতে তো ইদানিং কোনো কাজ নেই, বেকার বসেই আছিস। আমি যদি কোনো কাজ দিই করবি ?”
আমি হাড়ি হতে ডিমটা বের করতে করতে বললাম, “করব না মানে, আলবাত করব। কি কাজ তুই বল।”
সৌম্য চায়ের কাপটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে বলল, “জানিসই তো আমার ট্রাভেলের ব্যবসা। তুই যদি আমাকে খদ্দের ধরে দিস তাহলে তোকে আমি কমিশন দেব। আর তোরও নিখরচায় বেড়াবার সূযোগ হবে। ইচ্ছা করলে এজেন্ট হিসাবে যেকোনো ট্রিপে সঙ্গে যেতে পারিস। তবে সেক্ষেত্রে মিনিমাম পাঁচজন কাস্টমার চাই। এবার ভেবে দ্যাখ কি করবি।”
ভাবার কোনো সূযোগ ছিল না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আটজন কাস্টমার জোগাড় করে ফেললাম সিকিম গ্যাংটক ভ্রমণের জন্য। আমারও বহুদিনের ইচ্ছা ছিল সিকিম দেখার। আজ স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। হারিয়ে যেতে চাই কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ের কোলে। ইয়াকের পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়তে চাই নিরুদ্দেশে।
জুনের মাঝামাঝি, আমাদের এখানে তাপমাত্রা বিয়াল্লিশ হতে চুয়াল্লিশে ঘোরাঘুরি করছে। এসময়টাই সিকিম ভ্রমণের জন্যে উত্তম সময়। যাত্রীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সবেমিলে জনাচল্লিশেক যাত্রি। তাদের ঠিকমতো ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে আমি আপার বার্থে উঠে শুয়ে পড়লাম। শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। ট্রেন চলেছে দ্রুতগতিতে নিউজলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে।