.
.
.
চণ্ড শীত আর উচ্চতার জন্য অনেকেরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমরা যখন নাথুলা পৌঁছলাম তখন অনেকেই অসুস্থ্য। কিন্তু তিন বুড়োর শরীরে এতটুকুও পথশ্রমের বা আবহাওয়াজনিত ক্লেশের কোন চিহ্ন নেই। নাথুলায় বাবা হরভজন সিংয়ের স্মৃতিমন্দির।.
বাবা হরভজন সিং ১৯৪৬ সালের ৩০শে আগষ্ট পূর্বতন পাকিস্তানের সদর্ণাতে জন্মগ্রহণ করেন। প্যারামিলিটারি ট্রেনিংয়ের পর তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যোগদান করেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে চিনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে তার মৃত্যু হয়। তিনদিন পর তার দেহাবশেষ খুঁজে সমাহিত করা হয়। দাবি করা হয় যে এই কাজে নাকি তিনি খোঁজিদলের সাহায্য করেন। আজও তিনি কর্তব্যরত হয়ে রক্ষা করে চলেছেন দেশবাসীকে। ওই এলাকায় কোন সৈন্য কর্তব্যে অবহেলা করলে বা কোনও খারাপ কাজ করলে বাবা তাকে চড় মেরে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রতিবছর ১১ই সেপ্টেম্বর একটা জীপ তার স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে নিকটবর্তী নিউজলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে যায়। সেখান থেকে সেই স্মৃতিচিহ্ন একটা ফাঁকা বার্থে করে রওনা দেয় কাপুরথালার কুকা গ্রামের উদ্দেশ্যে । তিনজন সৈন্য তার প্রহরায় নিযুক্ত থাকে। সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি নাথুলায় কর্তব্যরত সৈন্যরাও বাবা হরভজন সিংয়ের মায়ের কাছে প্রতি মাসে কিছু কিছু সাহায্য পাঠায়।
নাথুলাকে তিব্বতি ভাষায় লেখা হয় རྣ་ཐོས་ལ་ । এটি প্রাচীন সিল্করুটের একটা অংশ। ‘নাথু’ শব্দের অর্থ কান আর ‘লা’ শব্দের অর্থ পার্বত্যপথ। সমুদ্রতল হতে ৪৩১০মিটার উঁচু এই নাথুলা পাশে এসে অব্দি মৈত্রবুড়োর ছটফটানির বিরাম নেই। লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে। কিছুটা কৌতূহলের বশেই আমি বুড়োর পিছু নিলাম। বুড়ো পেছনে না তাকিয়েই বলে উঠল, “টুপিটা ফ্যাশনের জন্য নয়। কানটা ঢাকুন।”.
আমি অবাক হয়ে গেলাম। টুপিটা আমি পরেছি মিনিট খানেক আগে। আর বুড়ো তো একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি। তাহলে জানল কি করে যে আমার কান টুপি হতে বেরিয়ে আছে ! ম্যাজিক জানে নাকি ! আমি বললাম, “আপনি কি ম্যাজিসিয়ান !”
বুড়ো বলল, “এতে কোনো ‘ভানুমতীর খেল’ নেই। সঠিক অনুমান আর সঠিক পর্যবেক্ষণ করলে আপনিও এরকম বলতে পারবেন। আমার পেছন পেছন আসুন। আরেকটা চক্রের হদিস মিলেছে।”
বুড়োর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম। একটা টিলামতো অংশের উপরে উঠেই আমি তাজ্জব। আগের বৌদ্ধস্তুপটার মতোই একটা স্তুপ ভেঙ্গেচুড়ে পড়ে আছে। বুড়ো স্তুপটার কাছে গিয়ে সেই খুরপির মতো জিনিসটা দিয়ে কিছু একটা বের করে আনল। উদ্ধার করা বস্তুটি পকেটে রাখতে রাখতে বুড়ো বলল,” শুধু শারীরিক বল আর চালাকি দিয়ে সবসময় কার্যসিদ্ধি সম্ভব হয় ন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়জ্ঞান আর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির দরকার। আপনার মৃগাঙ্ক সেন শেয়ালের মতো চালাক হলেও জ্ঞান বুদ্ধির ছিটেমাত্রও তার মধ্যে নেই। যাইহোক এবার চলুন শিবের মূর্তির কাছে যাই। অঘোরবাবুর তো অনেক ছবি তুলে দিলেন, এবার আমার উপরে দয়া করুন। “
বুড়োর কথাগুলো সন্মোহিতের মতো শুনছিলাম। যত দেখছি ততই শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে বুড়োর উপর। এই যা ! নামটা তো জিজ্ঞাসা করিনি। বললাম,” আপনার সঙ্গে এই এত আলাপ কিন্তু কি আশ্চর্য বলুন তো একবারের জন্যেও নামটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। “
বুড়ো তার ব্যাগ হতে জলের বোতল বের করে গলাটা ভিজিয়ে নিল। তারপর বলল, “নামে কি আসে যায় ? যদি রবিন্দ্রনাথের নাম চন্দ্রশেখর হত তাহলেও তিনি কবিকুলচূড়ামনণিই থেকে যেতেন। কর্মই আসল। তবুও যখন একান্তই জানতে চান তখন অগত্যা..। অধমের নাম ইন্দ্রজিৎ মৈত্র। ডায়েরিটা পড়া হয়ে ওঠেনি আপনার তাই জিজ্ঞাসা করলেন। “
সত্যিই তো, ডায়েরিটার কথা আমার মনেই ছিল না। কি ভুলো মন আমার। আজকে রাতে ডায়েরিটা নিয়ে বসব। জানতে হবে সেই রহস্য যার জন্যে শশাঙ্কশেখর মৈত্র পাগল হয়ে গেলেন আর তার ছেলে এতগুলো বছর পরে এসেছ পাণ্ডববর্জিত স্থানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। মৃগাঙ্কবাবু যে ভালোমানুষ নন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর এই ইন্দ্রজিৎ বুড়োর আর মৃগাঙ্কবাবুর উদ্দেশ্য যে একই তা বোঝার জন্যে খুব বুদ্ধির দরকার পড়ে না। যাইহোক দুজনে শিব মূর্তিটার কাছে এগিয়ে গেলাম।
“কি সুন্দর আবহাওয়া দেখেছেন মশাই ! …” অঘোরবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। হঠাৎ তার আনন্দের চুলোয় জল ঢেলে বুড়ো বলে উঠল, “আর্থ্রাইটিসে ভোগেন, সাইনাসের ধাত, বাথরুমে পুরো একপালা গাওয়ার পরেও কোষ্ঠ সাফ হয় না,….. এরপরেও প্রাণে ফূর্তি আসে ! “
অঘোরবাবু প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন, তারপর একদম আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললেন, “কে আপনি মশাই ! ডাক্তার ! আমার গেঁটে বাত থাক, আমাশা থাক আর যাখুশিই থাক না কেন তাতে আপনার কি ? জানেন আমি কে ? এই অঘোর বাঁড়ুজ্জেকে আপনি টিটকিরি মারেন ! দেশে ফিরি তারপর আপনার নামে যদি মানহানির মামলা না করি তবে আমার নামে কুত্তা পুষে দেবেন মশাই।”
বুড়োর মুখে কিন্তু ফিচেল হাসি লেগেই আছে। বোঝাই যাচ্ছে যে অঘোরবাবুকে রাগিয়ে দিয়ে মজা নিচ্ছে বুড়ো। আমিই বাধ্য হয়ে অঘোরবাবুকে শান্ত করলাম। অঘোরবাবুর রক্তচাপ একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে বুড়ো অঘোরবাবুর কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল,” চটে যাচ্ছেন কেন, আমি যা বলেছি তা কি মিথ্যা ?”
অঘোরবাবু মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন। বুড়ো বলল, “জন্ম থেকেই আমার এই গুনটা আছে। আমি কপাল দেখে মানুষের ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান বলে দিতে পারি।” কথাটা বলেই বুড়ো আমার দিকে চেয়ে চোখটিপে ইঙ্গিত করল। বুঝতেই পারলাম অঘোরবাবুর ঘোর লাগানোর জন্যে বুড়ো সচেষ্ট হয়ে উঠেছে।
অঘোরবাবুর চোখদুটো এবার যেন চকচক করে উঠল। তিনি বুড়োর দিকে নিজের প্রশস্ত কপাল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,” সময় খুব খারাপ চলছে মশাই। কোন এক উটকো মৃগাঙ্ক সেন আমার ভ্রমণের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল। একটু ঠিক করে দেখে দেন তো ! আর যা কিছু বলেছি তার জন্য দুঃখিত মশাই। হয়ে গেছে বয়ে গেছে।”
বুড়ো পকেট হতে আতসকাচ বের করে অঘোরবাবুর কপাল পর্যবেক্ষণ ও ত্রিকাল দর্শনান্তে প্রতিকার বাতলাতে লাগলেন। আমি নাথুলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কি অপরুপা এই প্রকৃতি ! পাহাড়ের শ্রেণি ভূমি আর আকাশের মাঝখানে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে। সেই স্তম্ভের মাথায় উঠছে মেঘেদের জয়ধ্বজা। রোদ আর ছায়ায় মায়াময় হয়ে উঠেছে উপত্যকা।
.
.
… চলবে