তাকিয়ে দেখলাম জানালার ওপারে একটা ছাইমাখা মুখমণ্ডল। মাথায় বিশাল জটা বুক বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। কপালে ত্রিপুণ্ড্রক। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে এই নাগাবাবাকে দর্শন করে আমার একদম সসেমিরা অবস্থা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্বিত ফিরে এল নাগাসাধুর কথায়।
” বেটা থোরা পানি মিলেগা ?”
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সাধুবাবা ভেতরে এলেন না। অগত্যা ঠাকুরঘর হতে একটা পেতলের ঘটি এনে কুয়ো হতে ঠাণ্ডা জল তুলে আনলাম। কিন্তু অতিথি নারায়ণ, তাকে তো আর শুধু জল দেওয়া যায় না, তাই একটা রেকাবিতে করে কিছু গুড়বাতাসাও নিয়ে এলাম। জল খেয়ে সাধুবাবা ঘটিটা নামিয়ে রাখলেন।
“তু খুব সচ্চা আদমি আছিস বেটা। পরন্তু বেটা তেরা আচ্ছা সময় তেজিসে খতম হো রাহা হ্যা। করিব করিব সাত সাল হ্যা তেরে পাস। উস্কে বাদ ও আপদা আয়েগা।” সাধুবাবা গম্ভীর স্বরে বললেন। তার কথা আমি খুব একটা বিশ্বাস করলাম না। হয়তো এর পরেই তাবিজ কবচ নিতে বলবে।
আমি বললাম,” এ জীবনটাতো বিপদ আপদ করেই পেরিয়ে গেল, নতুন কিছু থাকলে বলুন বাবা। “
আমার কথায় হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন সাধুবাবা। তারপর জটার ভেতর হতে একখানা ভাঁজকরা কাগজ বের করে আমার হাতে দিলেন। সাধুবাবার বিকট অট্টহাসিতে আমার নার্ভ দূর্বল হয়ে উঠেছে। হাত থর থর করে কাঁপছে। সেই কম্পিত হাতেই আমি কাগজটা নিলাম। একটা তুলোট কাগজ, কোনও জায়গার মানচিত্র বোধহয়। সেই ম্যাপের জায়গায় জায়গায় চক্রের চিহ্ন দেওয়া আছে।
সাধুবাবা বললেন, “তেরে পাস যো শয়তানকা কিতাব হ্যা না উসকি অন্দরে ইয়ে রাখ দে বাদ মে কাম আয়েগা।” অবাক গেলাম, কি করে জানলেন ইনি আমার পুঁথির কথা ! … আমিই তো ভুলে গিয়েছিলাম।
কাজটা হতে চোখ তুলতেই দেখি সাধুবাবা নেই। নিয়ে যাবার জন্য ঘটিটা তুলতেই আবার একটা ঝটকা লাগল, – ঘটিটা জলপূর্ণ হয়েই আছে, একটুও জল কমেনি। তা কি করে হয়, আমার সামনেই তো ঢকঢক করে জলপান করলেন সাধুবাবা।
এরপরে মাসদুয়েক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, সংসারজীবনে হাঁপিয়ে উঠেছি। এদিকে আষাঢ় মাসের দরদর ধারায় বৃষ্টি মনকে আনমনা করে তুলেছে। সবমিলিয়ে একটা মনখারাপের আবহাওয়া চারিদিকে।
আজ আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া। রথের দিন। শাস্ত্রে আছে ‘দোলায়মান গোবিন্দং মঞ্চস্থং মধুসূদনং রথস্থং বামনং দৃষ্টবা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে”। পরের জন্মের অভিলাষ আমার নেই, তাই চললাম রথ দেখতে। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? না মশাই, এইফাঁকে কিছুটা আনন্দভ্রমণও হবে। আর রথের মেলার পাঁপড় জিলাপি, সে তো অমৃত। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে কত যে পুরানো স্মৃতি উজাগর হয়ে এল তা বলে বোঝানো সম্ভব না। তবে ছোটবেলার মতো আনন্দ এই বয়সে আর সম্ভব নয়। সেসময় না ছিল চিন্তা না ছিল ভাবনা, মেলাময় ঘুরে বেড়াতাম বন্ধুদের সঙ্গে। পয়সাকড়ি ছিল না বটে তবে সে অভাব আনন্দের জোয়ারে বিন্দুমাত্র বাধার কারণ হত না। আজ সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই। আছে কেবল বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া জর্জর একটা দেহ।
মেলায় দেখা হয়ে গেল স্বয়ং বামনদেবের সাথে, – বামনদেব সেনগুপ্ত, ব্রিটিশ সার্ভেয়ার। ইংরেজরা তাকে যথেষ্টই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে, কারণ অমন শিক্ষিত আর দুঃসাহসী ভূভারতে পাওয়া ভার। সে আমার বর্তমান অবস্থার কথা শুনে বলল, “দেখো মৈত্র, ঘরে বসে না থেকে একটা চাকরি বাকরি করো। তোমার প্রতিভা আমার কাছে অজানা নয়, তাই আমি তোমার জন্যে কাজের ব্যবস্থা করে দেব। কলকাতার অফিসে আসার আগে আমি কিছুকাল সিকিমে ছিলাম, তুমি চাইলে আমি সিকিমের রাজাকে চিঠি লিখে তোমার একটা কাজের জন্যে সুপারিশ করতে পারি। “
আমি হাতে চাঁদ পেলাম। বামনদেবের চিঠি নিয়ে পরের সপ্তাহেই সিকিম রওনা হলাম। সময়টা এখন বর্ষাকাল, তাই সিকিমের রাস্তাও খুব দূর্গম। কখনো পায়ে হেঁটে কখনো খচ্চরের পিঠে চেপে এগোতে লাগলাম। সমতলে মোটরগাড়ির কোনো কমতি না থাকলেও এ পথে মোটরগাড়ির দেখা মেলে না। গোরুর গাড়িও এ পথে অচল।
জলপাইগুড়ির পর থেকে একটানা হাঁটছি। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে, আর চলা সম্ভব নয়। কাছেপিঠে কোন গ্রাম বা বসতি পেলে আশ্রয় নেবো। তিস্তার ধার বরাবর হাঁটছি। লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। ঠিক মুখআঁধারির সময় একটা ছোট্ট গ্রামের কাছে এসে পড়লাম। গ্রামের লোক কৌতুহলী হয়ে আমার সঙ্গ নিল। আমি বললাম, “সিকিম যাব, ব্রাহ্মণ মানুষ, এই রাতটুকু যদি আশ্রয় পাই তো খুব উপকার হয়।”
আমার কথা শুনে একজন মাতব্বর গোছের লোক এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, “তা কেন পাবেন না, আমার বাড়িতে চলুন।” আমি তার পিছনে পিছনে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোকের নাম যশেশ্বর রাই, সম্পন্ন গৃহস্থ তিনি। যাওয়ার মাত্র পা ধুইয়ে বসবার জন্যে আসন দিলেন। ভেতরের ঘর হতে ঘটিভর্তি জল আর খাঁটি দুধের পেঁড়া এল। জলের সাথে গোটা পাঁচেক পেঁড়া গলাধকরন করার পর চা এল। খাঁটি দুধের বানানো দার্জিলিং চা। কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারলাম যে ভদ্রলোকের ছেলে দার্জিলিংয়ে একটা চায়ের বাগানে কাজ করে।
… চলবে