With groans, of trampled men, with Smarting wounds–?
At once they groan with pain, and shudder with the cold!
—S. T. Coleridge
.
আমরা নির্বাসিত পরাজিত কোনও বাহিনী। তাই পীড়িত আহত অবস্থায় আমাদের ক্রন্দনধ্বনি, আমাদের যাতনা আজ আকাশে বাতাসে কলরোল তুলছে। আমরা কাঁপছি দারুণ প্রতিকূলতায়। এরকমই অভিভাবকহীন সময়ের বিষণ্ণতা ক্রমাগত তির ছুঁড়ছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঘোরের ভেতর নিঃসঙ্গ চেতনার বাদামি ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে। মানব-বিকাশের দীপ্ত প্রগলভতায় সভ্যতা যখন এগিয়ে চলেছে, তখন আত্মিকদৈন্যের অন্ধকারে আমরা কেন দিশেহারা? আজ এই প্রশ্নের ভেতরই দাঁড়িয়েছে সমূহ শিল্পীসত্তা।
.
নাগরিক জীবনের ক্রমবর্ধমান বিলাসিতার চাহিদা, ভোগসর্বস্ব মূল্যবোধের অগ্রাধিকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণ আমাদের জীবনকে খণ্ডিত করে চলেছে। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক চিহ্নিতকরণ বিভক্তি। যে আদিম হিংস্রতা প্রকৃতিগত এবং আত্মশক্তিতে সীমাবদ্ধ তা হয়েছে পরিশীলিত তথা উন্নত এবং গোষ্ঠীগত।
.
ফলে বিশ্বাসের আড়ালে লালিত হচ্ছে অবিশ্বাস, দয়ার আড়ালে নিষ্ঠুরতা এবং মুখোশের আড়ালের মুখ। ভোগসত্তা বা স্বার্থপরতা বা আত্মকেন্দ্রিকতা প্রায় উলঙ্গ হয়ে উঠেছে। আর সেই কারণেই সঙ্গমরত অবস্থায় স্বামী বা প্রেমিক কর্তৃক স্ত্রী বা প্রেয়সীকে হত্যা করার কৌশলও রপ্ত হয়েছে। বন্ধু হিসেবে বন্ধুকে হত্যা করার পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে স্বার্থ চরিতার্থ করা সহজ হয়েছে। আবার ধর্মের ভেক ধারণ করে শয়তানি-খেলা খেলারও অবকাশ পাওয়া গেছে।
.
কিন্তু এসমস্তই তো আত্মদৈন্যের পরিচয়। যে সংকটে আমরা শুধু বিনাশের পন্থা অবলম্বন করি তা কখনোই সভ্যতাকে পুষ্ট করে না। বরং রোগা, দীন এবং নিঃসঙ্গতারই পরিচয় দান করে। যেখানে মানবতার অনুশীলন হয় না, যেখানে স্বপ্ন সাধ্য সান্ত্বনার লালন নেই, দুঃখ যাতনার আন্তরিক স্পর্শ নেই —সেখানে কীসের সভ্যতা? শুধু জৈব তাড়নার লেলিহ উত্তাপে অবিরাম দৌড় আর ভণ্ডামির আবর্তে পাক খাওয়া।
.
সামঞ্জস্যহীন জীবনযাপনে এক অধোগতির শিকার হওয়া। এখানে কি সুস্থ শিল্প সাধনা সম্ভব? সত্য-সুন্দরের কাছে কি আমরা পৌঁছাতে পারব? ব্যক্তিহৃদয়ের খণ্ড খণ্ড চাঁদ জুড়ে কি আমরা সর্বব্যাপী চন্দ্রলোক সৃষ্টি করতে পারব? যদি তা না পারি তবে কেন এ সাধনা?
.
.
এ-সাধনা যে পরিপূর্ণভাবে মানুষ হবার জন্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং সামাজিক অবস্থান বিশেষ করে আমাদের অসহিষ্ণু এবং অগভীর চেতনাসম্পন্ন করে তুলেছে।
.
শিল্প-সাহিত্যেই এর প্রভাব বেশি। অতীত ঐতিহ্যের প্রতি প্রবহমান শ্রদ্ধা আমরা হারিয়ে ফেলছি বলেই আজ রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছি। কালচেতনায় সবকালই যে বর্তমান সেখানে রবীন্দ্রনাথও বর্তমান, তা অস্বীকার করছি। এও তো আমাদের হীনতা এবং সীমাবদ্ধতার পরিচয়। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁর আদিচেতনায় সর্বব্যাপী কাল জুড়ে আমাদের মধ্যে বিরাজ করেন। সৃষ্টির মূল উৎস থেকেই তাঁর প্রকাশ –
.
“যেন আমি তীর্থযাত্রী অতিদূর ভাবীকাল হতে
মন্ত্রবলে এসেছি ভাসিয়া। উজান স্বপ্নের স্রোতে
অকস্মাৎ উত্তরিনু বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে
যেন এই মুহূর্তেই। চেয়ে চেয়ে বেলা মোর কাটে।”
(অবরুদ্ধ ছিল বায়ু :প্রান্তিক)
.
এখানেই অখণ্ড সত্তায় অনুধাবিত অখণ্ড কালচেতনারই উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে। আজ যে উত্তর-আধুনিকতার প্রভাব নিয়ে আমরা হইচই করি তা তো মূলের উৎসেই ফিরে যাওয়া এবং অতীত ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ আমাদের মধ্যেই বিরাজ করেন। রবীন্দ্রনাথেই আমরা খুৃঁজে পাই “অস্তিত্বের পূর্ণমূল্য”।
.
সুতরাং সত্য-সুন্দরের সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বের মৌল অনুসন্ধানও শিল্প-সাহিত্যের প্রধান শর্ত। এই শর্ত থেকেই আমরা বিচ্যুত হচ্ছি। অবশ্য আমরা যেমন মননধর্ম মেনে চলি না, তেমনি অনেক সূক্ষ্ম বিষয়গুলিও উপেক্ষা করি। আত্মনৈবেদ্যে পার্থিবতার স্থূল বস্তুসর্বস্ব অনুকার যোগ করি, সেখানে বৃহৎ ত্যাগের মহিমা উপেক্ষিত হয়।
.
শিল্পের যে সদ্-গুণ আত্মার মুক্তি, সেই মুক্তি নিরন্তর সংঘাতে ও সংঘর্ষে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। তখন সংকীর্ণ এবং রূঢ়তার কদর্যে শিল্প আবিল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ অন্ধ, আত্মক্রন্দনেই সীমাবদ্ধ। জীবনানন্দ দাশ অনুভব করেছিলেন এরকম শিল্প যা নেহাৎ বাইরের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবেই বন্দি, যেখানে অনুভূতির প্রগাঢ়তা বিস্তার করতে পারে না। তখন তা তো “নিছক ক্রিয়া”ই –
.
“মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া ; বিশেষণ ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।
অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু
আমাদের এই শতকের
বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু –বেড়ে যায় শুধু;
তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই বলে অর্থময়
জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে ; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।”
.
(১৯৪৬-৪৭)
.
অনির্বচনীয় বাচনের ভঙ্গি থাকলেও “প্রেম নেই”। অর্থময় জ্ঞান নেই। শুধু সংকলিত জিনিসের ভিড়। দৈন্য তো এখানেই। যে অসুস্থতা নিয়ে আমাদের সভ্যতার সকাল হয় এবং রাত্রি নেমে আসে ; সেখানে আমাদের গভীর হবার অবকাশ কোথায়? মৃত্যু যেন আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছে।
.
তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পার্থিব বস্তুকেই আঁকড়ে ধরে ভোগের পরিতৃপ্তি চাইছি। বৃহৎ মহাকাব্য নয়, আত্মক্ষরণের ক্ষীণ তটরেখায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখছি। মানুষের সঙ্গে মানবের দূরত্ব অনুধাবন করতে পারি না। MAN কখনো HUMANএর পথও খুঁজতে চায় না। রক্তারক্তি পৃথিবীর ধর্ষণ-বঞ্চনা থেকে শুধু নিজের স্নিগ্ধতাটনকু ভিক্ষে করে আর আত্মগত প্রার্থনায় সেই বেদনা বেহাগের নিরন্তর অনুরণন তোলে –
.
“আমরা বেঁচে থাকি কিংবা মরে যাই, দাশবাবুর এসে যায় না কিছু
–যে যার ঘামাচি নিয়ে সকলেই ব্যস্ত এখন।
যা-কিছু দেখেছি তা কি বলতে পেরেছি ঠিকঠাক?
যা-লিখেছি, দশ বিশ বাইশ বছর, বোঝাতে পেরেছি কিছু?
শুধু বেঁচে-থাকা নিয়ে বেঁচে-থাকা শুনতে পাই শিল্পময় খুব —
সেসব আমার জন্যে নয়”
..
(দাশবাবুকে :স্বপ্ন দেখার মহড়া :ভাস্কর চক্রবর্তী)
.
কবি আশাহীন, বেঁচে থাকলেও অস্বীকার করলেন। “নিজের ঘামাচি” তো আত্মসীমানার সংকটকেই বুঝিয়েছেন, সেখানে মানবের স্থান কোথায়? সুতরাং “মানব” কথাটি কেটে দিতে হচ্ছে, তার বদলে ভাঙা-চোরা খুচরো পাণ্ডুর ব্যক্তি, ভীষণ দৈন্য এবং অসংযমের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছেন। সংকটের পর্যাপ্ত বলয়ে পাক খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তাঁর বোধ ও বোধি। মধুসূদনের মতো কখনোই কি তিনি বলতে পারবেন
.
––“গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত!”
.
এই মুহূর্তে তা বলা উপযুক্তও নয়। পরিস্থিতির চাপ এক অন্বয়হীন নিঃসঙ্গতার ভেতর আমাদের ঠেলে দিচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রুজ-রোজগারের টান, মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের প্রলোভন, সুখের হাতছানিও নানাভাবে আমাদের প্ররোচিত করছে।
.
সারাবিশ্বের যুদ্ধবাজনীতি, বিধ্বংসী শক্তির উত্থান এবং নিত্য-নতুন ইজম্-এর ছড়াছড়ি কোনও স্থির দর্শনেই পৌঁছাতে দিচ্ছে না। তবু এর মধ্যেও প্রকৃত শিল্প থেমে নেই। বহুর ভাবকে গ্রহণ করেই বহুর সঙ্গে মিশে যাওয়াই একজন যোগ্য শিল্পীর কাজ। তখন তো তিনি নিজেই পৃথিবী –
..
“সকল কিছুর পরে সকল সাধনা শিল্প যোজনার পরে
একবার পৃথিবীর দিকে চোখ ফেরাবার রীতি
প্রাত্যহিক ব্যক্তিগত ব্যাপার ঘটনাবলী কী করে ভূমায়
মিশে আছে তাই দেখা, পৃথিবীর ঢেউগুলি স্বয়ং পৃথিবী
এই ভালো আমাদের যে-কোনো প্রকার ভালো লাগা
কর্তা কর্ম করণেরা ভরে আছে অপরের মুখাপেক্ষিতায়।”
.
(শাশ্বতকালীন :বিনয় মজুমদার)
.
প্রাত্যহিক ব্যক্তিগত ব্যাপার ঘটনাবলী সকলকিছুই ভূমায় মিশে আছে। আর সেগুলিকেই কবিতায় তথা শিল্পে তুলে আনা হয়। তখন তো ব্যক্তিক-কান্না ব্যক্তিক-হাসির ভেতর পৃথিবীকেও দেখতে পায়। একজন মানুষ তখন আর একজন থাকে না – অন্যসকল মানুষ হয়ে ওঠেন।
.
কর্তা কর্ম করণেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় অন্যদের নিয়েই। আর এই জন্যই আজকের অশান্ত পৃথিবীর জন্য সকল মানুষই দায়ী। একের রিরংসা একের দৈন্য সকলেরই পদসঞ্চারে উদ্ভূত এবং লালিত। শুধু সময়ের সন্তান হয়ে আমরা পাঠ নিচ্ছি মাত্র। তুমুল বিমূঢ়তায় আমাদের সমষ্টিচৈতন্যেই আজ নেমে আসছে অন্ধকার। সেই আক্রমণ থেকে বাঁচবার রাস্তা কোথায়?
.