ছবি তুলতে তুলতে বিক্রম বলল,” এই ধরনের ভাবাবেশ বড় বড় কবি শিল্পী আর উচ্চস্তরের সাধকদের হয়, সাবধান সায়ক অঘোরবাবুর সমাধি হতে পারে। “
দেবলীনা হাসতে হাসতে বলল,” State of trance না buried ? ” আমিও আর হাসি আটকে রাখতে পারলাম না। অঘোরবাবু কটমট করে বিক্রমের দিকে চাইলেন, মনে হল যেন ভস্ম করে দেবেন।
হঠাৎ ঘটল বিপত্তি, গোটাচারেক বেশ বড় সাইজের সাপ উপর হতে সটান আমাদের সামনে এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বিক্রম চিৎকার করে উঠল,” কেউ নড়বে না, যে যেখানে আছ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাক।”
বিক্রমের পরামর্শে কাজ হল। সাপগুলো আস্তে আস্তে স্রোতধারার দিকে চলে গেল। কিন্তু কপালের নাম গোপাল। একটা সাপের আবার কি মতিভ্রম হল সটান ফিরে এল স্বস্থানে। এরপর অঘোরবাবুর শরীর পেঁচিয়ে উঠতে লাগল। অঘোরবাবুর অবস্থা তখন দেখার মতো। বিক্রম ব্যাগ হতে কি একটা বের করল, তারপর লাইটার দিয়ে ওটাতে আগুন ধরিয়ে দিল। বস্তুটা হতে ধোঁয়া বেরোতে থাকলে ওটা অঘোরবাবুর কাছাকাছি আনতেই সাপটা ফণা গুটিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল। বিক্রম বলল, “মহুয়ার খইল, খুব এফেকটিভ। এর ধোঁয়া সাপ সহ্য করতে পারে না। গ্রামবাংলায় ঘর হতে সাপ তাড়াতে এই মহুয়ার খইলের ধোঁয়া ব্যবহৃত হয়।”
অঘোরবাবু এযাত্রা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমরা আবার চলতে লাগলাম। সূর্যের আলো প্রায় আসছেই না, চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। সূর্যালোকের ঘাটতি আর অনবরত চুঁইয়ে পড়া জলের প্রভাবে বেশ শীত শীত বোধ হচ্ছে। আস্তে আস্তে শীত বাড়ছে। সবাই ঠাণ্ডাতে কাঁপছি। অঘোরবাবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “এ তো দেখছি জিরো পয়েন্ট-নাথুলারও বড়বাবা, কি ঠাণ্ডা মশাই ! নির্ঘাত বরফ পড়বে। দেবলীনা, তোমার ব্যাগ হতে চায়ের ফ্লাস্কটা বের কর তো।”
দেবলীনা ফ্লাস্ক আর একটা কফিমগ বের করে ফ্লাস্ক হতে চা ঢালতে গেল, কিন্তু চা বের হলো না। বিক্রম হেসে উঠলো। অঘোরবাবু কপালে হাত দিয়ে বললেন,” সবই অদৃষ্ট। ”
দেবলীনা বলল,”চকলেট আছে, খাবেন ? ” অঘোরবাবু মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন। দেবলীনা একটা বড় মাপের চকলেট বের করল। স্বাভাবিক ভাবেই চকলেটের অর্ধেকটাই অঘোরবাবু পেলেন, বাকি অর্ধেক আমরা ভাগবাঁটোয়ারা করে নিলাম।
রাস্তা ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। একে অন্ধকার, তার উপর সরু প্যাসেজের মতো রাস্তা, সবেমিলে এগিয়ে যেতে যথেষ্টই বেগ পেতে হচ্ছে। যেতে যেতে একটা জায়গায় মাথা ঠুকে গেল। সামনের রাস্তা বন্ধ। বিক্রম টর্চ জ্বালালো, টর্চের আলোতে দেখা গেল সামনে চুনাপাথরের দেওয়াল। কিন্তু অঘোরবাবু কই ? অঘোরবাবুকে আশেপাশের কোত্থাও দেখা যাচ্ছে না। এই একটু আগেই দেবলীনার হাত হতে চকলেট নিয়ে খেলেন, তারপর গেলেন কোথায় ? সবচেয়ে ভুল হয়েছে ব্যাটারী বাঁচানোর জন্যে টর্চ অফ করে রাখা। এটা দেবলীনার বুদ্ধি। দেবলীনাই বলেছিল অকারণে আলো না জ্বালাতে।
বিক্রম চিৎকার করে ডাকল, “অঘোরবাবু…” আমি আর দেবলীনাও বিক্রমের সঙ্গে যোগ দিলাম। সবার গলা প্রায় বসে এসেছে ঠিক সেই সময় একটা ক্ষীণ কণ্ঠ ভেঁসে এল, “আমি এখান। ফেঁসে গেছি মশাই। আমাকে বাঁচান।”
অনেক খোঁজাখুজির পর অবশেষে একটা পাথরের ফাটল আবিষ্কার হল, ফাটলের ওপার হতে আওয়াজটা আসছে। বিক্রম বলল, “আপনি ওখানে গেলেন কি করে ?”
ওপাশ হতে জবাব এল, “কি জানি মশাই, দেওয়ালে হেলান দিতেই ঢুকে পড়েছি এখানে। আর বেরোতে পারছি না। যে করেই হোক আমাকে উদ্ধার করুন। “
বিক্রম পাথরের জোড়টার আশেপাশে অনেক ঠেলাঠেলি করল, কিন্তু কোন কাজ হল না। আমি দেখেশুনে হতাশ হয়ে গিয়েছি। আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতাও নেই। কাছেই একটা কচ্ছপের পিঠের মতো পাথর পড়েছিল, বসে পড়লাম পাথরটার উপর। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘড় ঘড় শব্দে পাথরের ফাটলটা বড় হতে লাগল। বিক্রম বলল, “সায়ক উঠো না, আমি আসছি।
বিক্রম আশেপাশে কি যেন খোঁজাখুজি করতে লাগল, ইতিমধ্যে অঘোরবাবু বেরিয়ে এসেছেন। বেরিয়ে এসেই বোমা ফাটালেন,”আরে বিক্রম গোয়েন্দা কই ? কি আবিষ্কার করেছি দেখবে চল সবাই। “
বিক্রম ইতিমধ্যে একটা বড়সড় পাথর এনেছে। পাথরটা কাছিমের পিঠের মতো পাথরটার উপর রাখল। তারপর বলল, “চলুন অঘোরবাবু, আপনার আবিষ্কার দেখি।”
আমরা সবাই পাথরের আড়ালে থাকা গুহার ভেতরে ঢুকলাম। সত্যিই এক অনবদ্য আবিষ্কার অঘোরবাবুর। গুহাটার দেওয়ালগুলো অপূর্ব সব কারুকার্যে ভর্তি। তাপমাত্রাও স্বাভাবিক। মেঝেটা একদম ঝকঝকে পরিষ্কার। ঠিক করলাম রাতটা এখানেই কাটাবো। বাইরের আলো এখানে এসে না পৌঁছালেও দেহের ভেতরে যে একটা জৈবিক ঘড়ি আছে সেটা জানান দিচ্ছে যে আমাদের বিশ্রাম আবশ্যক।
দেবলীনা ব্যাগ হতে মুড়ি আর চানাচুর বের করল, আজ ঘুমোবার আগে এটাই আমাদের উদরপূর্তির মেনু। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম যখন ভাঙল তখন ঘড়িতে রাত তিনটে। বিক্রম দেওয়ালের মূর্তিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর অঘোরবাবু বসে বসে ঢুলছেন । আমি দেবলীনার ঘুম ভাঙিয়ে বললাম, “এখানেই বসে থাকবে কি ?”
দেবলীনা বার দুয়েক হাঁই তুলে ঢুলুঢুলু চোখে বলল, “বিক্রম..। ” তারপর পাশে পড়ে থাকা একটা ব্যাগকে আঁকড়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। আবার ডাকলাম, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শেষে বিরক্ত হয়ে বললাম, “তোমার বিক্রম বহাল তবিয়তে আছে। এখন গাত্রোত্থান করুন ম্যাডাম।”
অঘোরবাবু চোখ না খুলেই বললেন, “দেবলীনার এখন মাঝরাত, ওকে ঘুমোতে দাও। পিকনিকে এসেছি কিনা…” দেবলীনা এবার একগাল হেসে বলল, “বেড-টি কই ?”
অঘোরবাবু এবার একচোখ খুলে একবার দেবলীনাকে দেখে নিলেন, তারপর দু’চোখ খুলে বজ্রাসনে বসলেন। রকমসকম দেখে আমার হাসি পেলেও বহুকষ্টে সে হাসি চেপে বললাম, “হঠাৎ বজ্রাসনে কেন ?”
দেবলীনা বলল,”কাকুরও বেড-টি চাই বোধহয়। তবে বজ্রাসনে হজমশক্তি বাড়ে বলেই জানতাম। ”
বিক্রম এতক্ষণ সবকিছু শুনছিল, গুহার দেওয়ালের থেকে নজর না সরিয়ই সে বলল, “বেড-টির কথা ভুলে যাও বৎসে, কারণ এখন যা বলবো তা তোমার হুঁশ উড়িয়ে দেবে।”
আমি দৌড়ে গেলাম বিক্রমের কাছে, দেবলীনার ঘুমও তৎক্ষণে উড়ে গেছে। দেখলাম বিক্রমের সামনের দেওয়ালে একটা এনগ্রেভ, – ছিনি দিয়ে উৎকীর্ণ একটা ছবি। ছবিটায় একজন দেবতার মতো মুকুটধারী লোক সিংহাসনে বসে আছেন। দেবতার পায়ের কাছে দুদিকে হাঁটুগেড়ে বসে আছে দুজন। একজন দানব আর অপরজন মানুষ। দেবতাটি দানবটির হাতে তুলে দিচ্ছেন দুটো ড্রাগন, আর মানুষটির হাতে তুলে দিচ্ছেন একটা পূর্ণপাত্র।
বিক্রম বলল, “কিছু বুঝতে পারলে ?” আমি ও দেবলীনা না সূচক মাথা নাড়লাম। বিক্রম আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “অমৃত তত্ত্ব । দেবতা অমৃত তত্ত্ব দান করছেন মানুষকে আর দানবকে দিচ্ছেন দুটো ড্রাগন। এই ড্রাগনের ব্যাপারটাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। দুটো ড্রাগন, মানে শশাঙ্কশেখরবাবুর স্বপ্নে দেখা লাল আর নীল ড্রাগন। এরমধ্যে লাল ড্রাগনটা আমাদের কাছে আছে, বাকিটার হদিশ নেই।”
দেওয়ালচিত্রটির একটা ছবি তুলে নিয়ে বিক্রম বলল,”চল এগিয়ে যাই। ” ব্যাগপত্র নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। গুহাকক্ষটি প্রায় কুড়ি পঁচিশ ফুট লম্বা। এই কক্ষটি পেরিয়েই আরেকটি কক্ষ, সেটি আগেরটির থেকে অনেক সুদৃশ্য। কক্ষটির দেওয়াল ও মেঝে মার্বেলের তৈরি ও মসৃণ। কক্ষের দেওয়ালের ধার বরাবর সার দিয়ে অগুনতি ড্রাগন দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটি ড্রাগনের পিঠে একটা করে পূর্ণপাত্র। ড্রাগনগুলোর প্রত্যেকটাই কোয়ার্টজ শিলায় তৈরি।
ড্রাগনগুলোর পিঠের উপরে যে যে সমস্ত পূর্ণপাত্র আছে সেগুলো বিভিন্ন রঙের তরলে ভর্তি। অঘোরবাবু পাত্রের তরলে আঙুল ডোবাতেই যাচ্ছিল, কিন্তু বিক্রম তাকে নিরস্ত করল। এরপর বিক্রম দেবলীনার খোঁপা হতে কাঁটা খুলে নিয়ে একটা তরলে ডোবালো। তরলে ডোবাতেই ধাতব কাঁটাটা গলতে শুরু করল, আর তার সঙ্গে বের হতে লাগল ঝাঁঝালো ধোঁয়া। সব দেখেশুনে অঘোরবাবু কল্পনার রাজ্যে চলে গেলেন। তিনি কল্পনার চোখ দিয়ে দেখলেন তার পুরো শরীরটা ড্রাগনের পিঠে রাখা একটা বিশাল পাত্রের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে আর সেই পাত্রের তরলে দ্রবিভূত হয়ে যাচ্ছে মাংস আর চর্বি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত মাংস গলে গিয়ে কঙ্কালে পরিণত হয়েছেন অঘোরবাবু। অঘোরবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “না.. আ.. আ.. আ…”
…. চলবে