.
.
নাথুলা থেকে ছাঙ্গু আসার পথে অঘোরবাবুর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মৃগাঙ্ক সেনকে আর পাত্তা দিচ্ছেন না। বুড়োর সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে আছেন। সাদা পেস্ট জাতীয় কিছু দিয়ে কপালে তিলকও এঁকেছেন। বুঝতেই পারলাম এসবই বুড়োর দুস্টুবুদ্ধির নমুনা। ছাঙ্গুতে নেমে সবাই রোপওয়ে নিয়ে মেতে উঠল। এই ফাঁকে বুড়ো কখন যে অঘোরবাবুকে এড়িয়ে পিছনের টিলাটার দিকে হাঁটা দিয়েছেন তা বুঝে উঠতেই পারিনি। একরকম দৌড় দিয়েই বুড়োর সঙ্গ ধরলাম। টিলার পেছনে একটা ছোট্ট মনেস্ট্রি। রাস্তা খুবই বন্ধুর। আমরা অনেক কষ্টে মনেস্ট্রির দরজা পর্যন্ত পৌঁছলাম।
.
.
দরজা খোলাই ছিল। দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতে যাব এমন সময় বুড়ো আমাকে আটকে দিল। আমি কিছু বলার আগেই বুড়ো বলল, “এসব কাজে পর্যবেক্ষণ শক্তি তীক্ষ্ণ হওয়া দরকার। নিচের দিকে তাকাও।”
নিচের দিকে নজর যেতেই আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। দেখি দরজার কাছেই পড়ে আছেন একজন বয়স্ক লামা। তার মাথার ক্ষত হতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুড়ো লামার ঘাড়ে ও কব্জিতে ধাত পরীক্ষা করে বলল, “বেশিক্ষণ হয়নি। প্রাণে বেঁচে আছে। জলের বোতলটা দেন তো। “
আমি জলের বোতলটা এগিয়ে দিতেই বোতল হতে জল নিয়ে লামার চোখেমুখে ছিটে মারল। জ্ঞান ফিরতই লামার মুখ দিয়ে অস্ফূটভাবে বেরিয়ে এল, “মার… মার..”
বুড়ো বলল, “মার কি করেছে ?”
“আ গেয়া….” লামা আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। মনেস্ট্রিতে ঢুকেই বুড়ো পুলিশে ফোন করেছিল।কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন কনস্টেবল সহ পুলিশ অফিসার অর্জুন কুমার প্রধান এসে হাজির হলেন। লামাকে আর্মির মেডিক্যাল ক্যাম্পে পাঠানো হল।
বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। রুটি আর সব্জির সাথে চিকেন কষা দিয়ে রাতের খাবার সম্পন্ন হল। তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে গেলাম। ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম।
ডায়েরির ভাষা অগোছালো । ডায়েরির প্রথম দুটো পাতা ফাঁকা। তৃতীয় পাতায় একটা কলমে আঁকা স্কেচ। স্কেচটা এতটাই বীভৎস যে দেখামাত্র আমার রোমে রোমে অজানা একটা আতঙ্ক খেলা করে গেল। একটা দানবীয় মূর্তি। গোল গোল দুটো চোখ আর মুলোর মতো দাঁত। লকলকে জিভখানা সামনের দিকে বীভৎসভাবে বেরিয়ে আছে। জিভের দুপাশে দুটো গজদন্ত। আর পারছি না।
কেমন একটা যেন সন্মোহন আছে ছবিটাতে। আমি নিজেকে আর বশে রাখতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন হাজারো জোনাকি ঘুরছে চোখের সামনে। যন্ত্রণায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। পাতাটা ওল্টানোর ক্ষমতাও আর আমার মধ্যে নেই। অনেক কষ্টে পাতাটা ওল্টালাম।
বেশ গোটা গোটা অক্ষরে লেখা শশাঙ্কশেখর মৈত্রের ডায়েরি, – বিভীষিকার জ্যান্ত দলিল। আমি পড়তে লাগলাম।
‘আমি শশাঙ্কশেখর মৈত্রে, জন্ম নিয়েছিলাম বীরভূমের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। হাজারো অভাব আর অনটনের মাঝেও লেখাপড়া কখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। এর একমাত্র কারন ছিলেন আমার ঠাকুরদা। তিনি পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। পৌরহিত্যের সামান্য রোজগারে সংসার ঠিকমতো চলত না। বাবা আর ঠাকুরদা দুজনেই খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন। কোনো সংস্কার তাদের চলার পথে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। আমার পড়াশোনাতেও তাই তারা কোনো বাধা উপস্থিত হতে দেন নি।
স্কুলের পড়া শেষ করে কলকাতায় গেলাম। সেখানে আমার দাদুর এক শিষ্য থাকতেন। লালবাজারের বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন তিনি। তার বাড়িতে থেকেই কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হলাম। ততদিনে দাদু গত হয়েছেন। আমাকে চাকরির সন্ধানে বিশেষ ঘোরাঘুরি করতে হল না। খুব সহজেই একটা কলেজের অধ্যাপনার কাজ জুটে গেল। কিন্তু যার কপালে বিধি বিশ্বনিখিল ঘুরে বেড়ানোর ফরমান লিখে দিয়েছেন তার এই মোহগর্তে থাকাটা যথেষ্টই বেমানান । কত যে চাকরি বদল করলাম তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কখনো মনোহরপুর রয়েলস্টেটের সেক্রেটারি তো কখনো ইংল্যান্ডের কোন অখ্যাত শহরের লাইব্রেরীয়ান। দেশে বিদেশে কত যে চাকরি ধরলাম আর কত যে চাকরি ছাড়লাম তার হিসেব আমি নিজেও দিতে পারব না।
তখন আমি চাণ্ডেলের রাজার ব্যক্তিগত সহায়ক হিসাবে কাজ করছি। দিব্যি আছি। মাসে মাসে কিছু করে টাকা ঘরে পাঠিয়ে দিই। জানি, টাকা পয়সাটাই সবসময় মানুষের জীবনের সবকিছু নয়। কিন্তু আমি করব কি ! পায়ের তলায় সর্ষে আমার। এই একটা কারনের জন্যেই স্ত্রী পুত্র কন্যা কাউকেই সুখ দিতে পারিনি । আমার ছেলেমেয়েরা তাই আজ আমি বেঁচে থাকতেও অনাথের মতো জীবনযাপন করছে।
যাই হোক সেদিন সকালবেলায় আমি আমার ঘরে বসে মহারাজের সারাদিনের রোজনামচায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। এটাই আমার কাজ। মহারাজ সারাদিন কোথায় কি করবেন, কি খাবেন, কার সাথে দেখা করবেন তার শিডিউল আমিই তৈরি করে দিই। কাজ করতে করতে মাথাটা ধরে এসেছিল। চায়ের জন্য সুন্দররামাইয়াকে হাঁক দিলাম। সুন্দররামাইয়া আমার ফাইফরমাশ খাটে।
সুন্দররামাইয়া চা নিয়ে এল। চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখার পরও যখন সে যাচ্ছে না তখন আমি বললাম, “কি হল সুন্দর তুমি কিছু বলবে ?”
সুন্দররামাইয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, “সাহেব একটা নিবেদন ছিল।”
“বল।”
“আজ্ঞে সাহেব, আমার এক বন্ধু আছে। আগে তিব্বতে থাকতো। কিছুদিন আগেই এসেছে। ওকে যদি একটা কাজ দেন তো খুব উপকার হয়।”
“আচ্ছা নিয়ে এসো দেখা যাবে।”
সুন্দররামাইয়ার সেই বন্ধুটি বিকালবেলায় এল। খুব শান্তশিষ্ট ও কথা বলে কম। ইংরাজি আর হিন্দিতে যথেষ্টই জ্ঞান আছে দেখে ওকে আমার সহকারী হিসেবে রেখে নিলাম।
দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু একদিন গোল বাধল। একদিন সন্ধ্যার সময় দেখি ছেলেটি কম্বলে ঢাকা নিয়ে ঘরের এককোণে বসে কাঁপছে । আমি কম্বলটা টেনে খুলে নিতেই সে ডুকরে কেঁদে উঠল। ” আমাকে বাঁচান সাহেব, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে……। “
আমি বললাম, “কারা তোমাকে মেরে ফেলবে ?”
“মারের সৈন্য সাহেব !!” এক নিঃশ্বাসে জবাব দিল ছেলেটি।
… চলবে