ফাঁদ
শম্পা সাহা

শাশ্বতী অনেকদিন থেকেই ভাবছে একটা চাকরির বড় দরকার, যদিও কলেজে ওঠার পর থেকেই ও টিউশনি করে, কিন্তু তাতে হাজার তিনেক টাকার বেশি হয় না। নিজের পড়াশুনার খরচ, হাত খরচ বাদ দিয়ে বাড়িতে দেওয়ার মতো কিছুই থাকে না। কিন্তু ওর বাবার হকারির পয়সা, ওই প্লাস্টিকের মগ, সাবান কেস, গড়িয়া হাটের মোড়ে রাস্তায় প্লাস্টিক পেতে। ছোট থেকেই সংসারে শুধু নেই আর নেই । ভাই সৌমিক অনেক ছোট সবে ক্লাস এইট এ পড়ে।
নিজে থেকেই তাই মনে মনে নিজের কাঁধে নিজের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে শ্বাশ্বতী। গ্রাজুয়েশন শেষ হতেই ও খবরের কাগজ দেখে আ্যপ্লাই করলো একটা প্রাইভেট ফার্মে । ঢুকেই স্যালারি সাত হাজার,আস্তে আস্তে বাড়বে নিশ্চয়ই, রিসেপসনিস্টের জব । ও আর ওর বন্ধু সোমা দুজনেই একই জায়গায় আ্যপ্লাই করলো । আসলে সোমার চাকরির দরকার তেমন নেই কারণ ও বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে ,বালিগঞ্জে বিশাল নিজস্ব বাড়ি,নিজেদের গাড়ি ।
ওদের কলেজ থেকেই আলাপ ,মোটামুটি বন্ধুত্ব ও। সোমা বেশ স্বাধীনচেতা, তাই শ্বাশ্বতীর কাছ থেকে খবরটা শুনে ও ও জুটে গেল,অনেকদিন থেকে ওর চাকরি করার শখ। দুই বন্ধু মিলে এক দুপুরবেলা গিয়ে সিভি জমা দিয়ে এলো। ফেরার পথে দুজনে কত জল্পনা-কল্পনা, সোমা হিসেব করে দেখলো বিগ বাজার থেকে দুটো জিনস্ আর গোটা চারেক টপ কিনবে প্রথম মাসের স্যালারিতে। সোমার হিসেব অবশ্য অন্যরকম ,ও ঠিক করল বাবাকে বলে মাসের চাল ডাল আর মুদিখানার খরচটা এবার থেকে ও ই দেবে ।
নির্দিষ্ট দিনে ঠিক সকাল এগারোটার মধ্যেই দুজনে গিয়ে পৌঁছলো অফিসে । অফিসটা গড়িয়া হাটের মোড় থেকে লেকের দিকে যেতে রাস্তার উপরে একটা বিল্ডিং এর দোতালায় । সোমা শ্বাশ্বতীর জন্য আগে থেকে গড়িয়া হাটের মোড়ে ট্রেডার্সের উল্টোদিকের বাস-স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল । ঠিক সাড়ে নটায় শাশ্বতী এসে নামল ,আজ ও প্রথম কোথাও যাওয়ার জন্য শাড়ি পরেছে ।
এর আগেও শাড়ি পরেছে কিন্তু সেটাও সরস্বতী পুজোতে ,অন্য সময় নয় । কিন্তু আজ প্রথম ইন্টারভিউ বলে কথা ওদিকে সোমা যথারীতি জিন্স আর টপ। আসলে সোমার তো আর তেমন প্রয়োজন নেই, হলেও ভালো আর চাকরিটা না হলেও ভালো। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছল ওদের ইন্টারভিউ এর ভেনুতে ,’দ্য এক্সেলেন্সি ‘।
কিসের অফিস, কি অফিস না জেনেই ওরা খবরের কাগজের আ্যড দেখে এসেছে। ভেতরে ঢুকে ওরা অবাক ,যেদিন বায়োডাটা জমা দিতে এসেছিল সেদিন ছিল অফিস ফাঁকা আর আজ’ গিজগিজ করছে, ভিড়ে ভিড় !যেখানে সব আ্যপ্লিক্যান্টসদের বসার জায়গা ওখানে তিলমাত্র জায়গা নেই। সোফা চেয়ার সব ভর্তি ,ঠাসাঠাসি ভিড়।
দু একজনের সঙ্গে কথা বলে জানলো কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ এম এ,কেউ পিএইচডি । ও অবাক হয়ে গেল ,এত শিক্ষিত অথচ এখানে এসেছে চাকরির জন্য।ফিসফিস করে সোমাকে বলল, “চল পালাই এখানে চান্স নেই । ” সোমা ডেসপারেটলি বলল, “চুপ কর তো এসেছি যখন, ইন্টারভিউ কি জিনিস একটু দেখে যাবো।” প্রায় আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর নাম ডাকা হল, ওরা অবশ্য আগে থেকে খেয়াল করছিল একজন একজন করে নাম ডাকা হচ্ছে আর তারা কেবিনের ভেতরে যাচ্ছে ,তারপর তাদের সঙ্গে একজন করে অপরিচিত, বোধহয় অফিসের স্টাফ দিয়ে বাইরে কোথাও পাঠানো হচ্ছে, নাকি মার্কেট সার্ভের জন্য! শাশ্বতী একটু অবাক হল রিসেপশনিস্ট এর চাকরির জন্য মার্কেট সার্ভে কি কাজে লাগবে? তবে এসেছে যখন শেষ দেখে যাবে ,এই ভেবে বসে রইল।
শেষে যখন ওদের নামটা ডাকা হল, আগে সোমার নাম ডাকা হল। সোমা বেরিয়ে গেল একটি মেয়ের সঙ্গে আর শ্বাশ্বতীর নাম ডাকার পর একটি রোগা কালো মতন খুব সাধারণ চেহারার মেয়ে ওর কাছে এসে বললো, “চলো আজ আমার সঙ্গে একটু মার্কেট সার্ভে করতে হবে। তাতে তোমার পারফরমেন্সের উপর আমাদের সিলেকশন ।”শাশ্বতী একবার বলল, “আমাদের ইন্টারভিউ হবে না? ” মেয়েটি জানালো ইন্টারভিউর বদলে এই ব্যবস্থা।
দুজনে গড়িয়াহাটে এসে বড়বাজার যাবার বাসে উঠলো,ভাড়া অবশ্য সঙ্গের মেয়েটি দিল । বড়বাজার শ্বাশ্বতীর অচেনা, কারণ যাতায়াত বলতে কলেজ, টিউশান আর যে বাড়িগুলোতে ও পড়াতে যায় সে বাড়িগুলো, এ ছাড়া তেমন খেয়াল খুশি মতো ঘোরাঘুরি করার ও সুযোগ পায় না আর এইসব ব্যবসায়ীদের জায়গায় আসার তো কোন প্রশ্নই ওঠেনা। সঙ্গের মেয়েটি বাসস্ট্যান্ডে নেমে ওকে বলল,”-আমার সঙ্গে এসো”, বলে সোজা হাঁটতে হাঁটতে বড় বাজারের গলি গুলোর মধ্যে ঢুকতে শুরু করলো । এবার শাশ্বতীর অস্বস্তি হতে লাগল, কি ব্যাপার ?কিসের মার্কেট সার্ভে? এই নোংরা ভিড়ে ঠাসা ঠাসি ছোট ছোট খুপরি দোকানে আবার কিসের মার্কেট সার্ভে ?কিছুদূর গিয়ে একটা ছোট্ট ভাতের হোটেলের সামনে এসে মেয়েটি বলল ,”দুপুর প্রায় আড়াইটে বাজে, আমার খুব খিদে পেয়েছে কিছু খেয়ে নিই তারপর যাব ।
“এতক্ষণ শ্বাশ্বতী চাকরি ,ইন্টারভিউ ,এসব ভেবে চুপ করে ছিল কিন্তু খাবার জন্য মেয়েটি যখন একটা তস্য গলির ভেতরতস্য সস্তা ভাতের হোটেল এর দোতালায় উঠলো সেখানে খেতে বসেছে যারা তাদের দেখে মুটে মজুর ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছিল না । তখন শ্বাশ্বতী প্রথম বলল, “আচ্ছা তোমাদের কাজটা ঠিক কি আমাকে একটু বলবে? “মেয়েটি একটা কোনের দিকে টেবিল খুঁজে তাতে তার হাতব্যাগটা রেখে বললো, “তুমি বসো আমি একটু মুখে চোখে জল দিয়ে আসি। ” শ্বাশ্বতী মরিয়া হয়ে বললো, “তোমাদের কাজটা ঠিক কি আমাকে তো বললে না? ” কারণ এইসব হাবিজাবি লোক ,চারপাশের লোকজন এসব লোকজনের আচার-আচরণ ওর মোটেই ভাল ঠেকছিলনা । তখন মেয়েটি ওর কাঁধ ব্যাগ টা খুলে একটা ছোট্ট ডায়েরী বের করে শ্বাশ্বতীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল মুখ ধুতে।
ডাইরি খুলে শ্বাশ্বতীর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল ,একটা ঠান্ডা স্রোত ওর মেরুদন্ড বেয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল, ডায়েরীর প্রথম পাতায় মোটা মোটা করে লেখা ,”সেক্স, এক্সাইটমেন্ট,সিডাকশান”! ওর আর পড়ার ক্ষমতা রইল না সঙ্গে সঙ্গে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো, ও হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে, ডায়েরী টা ওখানে ফেলে সোজা হাঁটা দিলো সিঁড়ি দিয়ে নিচে । তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে প্রায় দৌড়ে এসে পৌঁছল বড়বাজার মোড়ে। তারপর শিয়ালদা গামী একটা বাসে উঠে পড়লো ততক্ষনে পিছন ফিরে দেখলেও যে ওই মেয়েটি বা অন্য কেউ তাকে ফলো করছে কি না ? না তেমন তো কাউকে মনে হচ্ছে না ।
এবার ওর মনে পড়ল সোমার কথা, তখন তো মোবাইল ফোন সবার হাতে হাতে ছিল না, নিজেদের বাসস্ট্যান্ডে নেমে ও একটা বুথ থেকে ফোন করে সোমাকে। ওপাশে সোমার গলা শুনে আশ্বস্ত হল। এতক্ষণে ওর খালি মনে হচ্ছিল ও তো পালিয়ে এল কিন্তু সোমার কোনো বিপদ হয়নি তো? সোমাকে শুধু এটুকু জিজ্ঞাসা করলো যে, “কখন এসেছিস বাড়ি? “” অনেকক্ষণ “সোমার উত্তরে এবার ধাতস্থ হয়ে শ্বাশ্বতী বাড়ির দিকে পা বাড়ালো আর প্রতিজ্ঞা করল যে যত ই চাকরির দরকার থাকুক এভাবে হঠাৎ করে কোন ইন্টারভিউ তে আর কোনদিন যাবে না, ততদিন না হয় টিউশনি ই ভরসা।
সব চরিত্র কাল্পনিক
পলাশীপাড়া : নদীয়া