গ্রামটির নাম গঙ্গাপ্রসাদ । আমার পৈত্রিকবাড়ি সেখানেই । কর্মসূত্রে থাকি অন্য জায়গায় । সেখানে একটি পরিবার বাস করতো । যে পরিবারে ছিল পাঁচটি প্রাণী । একটি মহিলা, তার স্বামী ও তার তিন ছেলে , জামিল,ফিরোজ,শামীম । জামিল পড়াশুনা আমার সাথেই করত । এখন তার একটা দোকান রয়েছে । না, দোকানটা সে নিজে করেনি ,তার শ্বশুর করে দিয়েছে । তাই শ্বশুর তার সব।ফিরোজ আর শামীম ভিন রাজ্যে কাজ করে ।
মহিলা টি ছেলেদের বিয়ে দিয়ে দেন এবং ভাবেন “হয়তো এবার দায়িত্ব শেষ হলো এবার যতদিন আছি ছেলেদের সাথে থেকে খেয়ে কেটে যাবে “। সংসার সুখেই ছিল । হটাৎ একদিন মহিলাটির স্বামী মারা গেল । বাবার শেষকৃত কাজ সেরে কয়েক দিন পরে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল । পরিবারের কর্তা মারা যাওয়ার প্রায় দেড় মাস পরে শুরু হয় অশান্তি — মহিলাটি থাকবে , খাবে কার কাছে । বড় ছেলের কাছে থাকার কোনো গল্প হয় না, কারণ সে শশুরবাড়ি থাকে ।
তারপরে সিদ্ধান্ত হয় একমাস ফিরোজের বাড়ি তো পরের একমাস শামীমের বাড়িতে মহিলাটি থাকবে । ভাগ্যের কি পরিহাস , যে মা ছেলেদের পেটে ধরে জন্ম দিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার উপযোগী করে তুললো সেই মায়ের দু মুঠো অন্ন যোগাতে তিন ছেলে মিলে পারে না। মাসের পর মাস কাটে এইভাবেই চলে একমাস এখানে তো একমাস ওখানে ।
কিন্তু মহিলাটিকে যথেষ্ট কাজ করতে হয় দুবেলা খাবার খাওয়ার জন্য । কখনো এঁটো বাসন মাজতে হয় তো আবার কখনো বাজারে গিয়ে রেশন আনতে হয় । এই ভাবে কয়েকমাস চলার পর ছেলেরা নানা অজুহাতে তাকে আর বাড়িতে রাখতে রাজি হয়না । কেও বলে আমার ছেলে বড় হচ্ছে, তো কেউ বলে আমার বউয়ের অসুবিধা হচ্ছে । এমত অবস্থায় একদিন মহিলাটিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় । তারপর ঘন্টা কাটে, দিন কাটে, মাস কাটে কেউ মহিলাটির খবর নেই না । এখন মহিলাটি গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে , বাড়ি বাড়ি চেয়ে খাবার খায় । কেউ খাবার দেয়, আবার কেউ তাড়িয়ে দেয় ।
সেদিন যখন গ্রামের বাড়িতে যায় তো দেখি মহিলাটি এসেছে খাবার চাইতে, দেখে চিনতে পারিনি প্রথমে, পরে চিনতে পারলাম । মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলাম এখন সে কোথায় থাকে । প্রতুত্তরে তিনি বলেন গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক কোনাই ছাউনি দিয়ে থাকেন । শুনে কষ্ট হলো এবং কিছুটা রাগ হলো তার ছেলেদের প্রতি । যে মা পৃথিবীর আলো দেখালো সেই মাকে মানুষ কি করে কষ্ট দিতে পারে । এমন সন্তান থাকার চাইতে না থাকায় ভালো ।
মানুষের যখন বোধজ্ঞান হয় না তখন বলে আমার মা , আমার মা । আর যখন বুঝতে শেখে , যখন মাকে দেখাশুনার প্রয়োজন তখন বলে তোমার মা , তোমার মা । আসলে মা তখনো কাঁদতো ছেলে খাইনা বলে , মা এখনো কাঁদে ছেলে খাবার দেয়না বলে । তবুও সব মা বলেন বাবা তুই সুখে থাক ।
আসলে যে স্বর্গ আর নরক এই পৃথিবীতেই সব ― যারা বোঝেনা তারাই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বছরের পর বছর বাড়াতে থাকে, আর নিজেকে আধুনিক বলে পরিচয় দেয় ।