আগের পর্বেই বলেছিলাম আমার মাতামহের কথা। তিনি অত্যন্ত সৎ ও জেদী ব্যক্তি ছিলেন। আমার মতোই তার বাল্যকালের কিছুটা সময় মামার বাড়িতে কেটেছিল। তার মামার বাড়ি ছিল বাঁকুড়া জেলার দধিমুখা বা তার আশেপাশের কোন এক গ্রামে। মাতামহের বন্ধু ছিলেন রমা চাষা। কোন উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মাতামহ একবার তার বন্ধুকে নিজের শখের কোটটি পরতে দিয়েছিলেন। এই খবর জানামাত্র মাতামহের মামা মাতামহকে তীব্র ভৎসনা করেন।
সেযুগে জাতিভেদের কঠোরতা ছিল প্রবল। আমার মাতামহ সেই ঘটনায় অপমানিত বোধ করেন এবং পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। সিউড়ির কাছাকাছি আসতেই একজন পরিচিত গাড়োয়ানের নজরে পড়ে যান। সেই গাড়োয়ান তাকে গরুর গাড়িতে চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
চন্দ্রপুর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার পূর্বে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ডেউচা গ্রাম। এই গ্রামে বহুবছর আগে উত্তরপ্রদেশ হতে আসেন এক সাধুমহারাজ, – নাম সীতারাম দাস মহান্ত। তিনি এই গ্রামে একটা রামসীতার মন্দির নির্মাণ করান।
সঙ্গেই নিজ খরচে তিনশ’ বিঘা ধানি জমি আর আমের বাগান সহ বিপুল সম্পত্তি ক্রয় করেন। তিনি আমার মাতামহকে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত নিযুক্ত করেন। কিছুদিন পর গ্রামের কিছু ব্যক্তি মহান্তজীকে বলেন মন্দির ও সব সম্পত্তি ট্রাস্টের নামে লিখে দিতে। মহান্তজী অসন্মত হলে দুপক্ষের মধ্যে আইনি লড়াই শুরু হয়।
মহান্তজী আমার মাতামহকে বলেন তার পক্ষে সাক্ষী দিতে, তাহলে তিনি মন্দির সহ সমস্ত সম্পত্তি মাতামহের নামে লিখে দেবেন। মাতামহ এই প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি বলেন, ” সাক্ষী দিতে হলে আপনার পক্ষেই দেব। কিন্তু আমি গরীব ব্রাহ্মণ, গ্রামবাসীদের বিপক্ষে যাবার মতো ক্ষমতা আমার নেই।।” মাতামহ মন্দিরের চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর কোর্টে কি হল জানি না মহান্তজী দেশে চলে গেলেন। গ্রামবাসীর অনুরোধেও মাতামহ আর কাজে যোগ দিলেন না। এর বহুবছর পর মহান্তজী আবার ফিরে আসেন ও মন্দিরেই দেহত্যাগ করেন।
রামজিউ মন্দিরে পুরোহিত থাকার সময় আমার মাতামহ একবার ডাকাতের পাল্লায় পড়েছিলেন। দেদারি ডাকাত তখন বীরভূম সহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর ত্রাস। সেই দেদারি একদিন রাতে পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকলো মন্দিরে। মাতামহের কাছে কিছু খাবার চাইলো । খাবার খেয়ে দেদারি গহনার একটা পুঁটলি মাতামহকে দিতে গেলেন, – মাতামহ নিলেন না।
বললেন, “তুমি ক্ষুধার্ত ছিলে তাই খাবার দিয়েছি, তোমার পাপের কামাই আমি নিতে পারব না। যাবার সময় দেদারি ডাকাত মাতামহকে প্রণাম করে বলেছিলো,” ঠাকুর মশাই, যদি কোনোদিন কোনো দরকার পড়ে আপনার এই পাপী ডাকাত ছেলেকে ডাকতে দ্বিধা করবেন না। “
এই দেদারি ডাকাত ডাকাতি করতে গিয়েছিল এক বড়লোক বাড়িতে, সিন্দুকের চাবি না পেয়ে বাড়ির সবাইকে হত্যা করে। বাড়ির একমাত্র ছেলের বয়স নয় কি দশ। সে লুকিয়ে পড়েছিল দরজার আড়ালে। দেদারি সিঁড়ি দিয়ে যেই না নেমেছে ছেলেটি দরজার পাশে রাখা বর্শা তুলে দেদারির বুকে বিঁধিয়ে দেয় । দেদারি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। অবসান হয় একটা আতঙ্কের।
আমার মাতামহ দাবা খেলতে পাশের গ্রাম সারেন্দায় যেতেন । আসার সময় অনেক রাত হয়ে যেত। সে সময় মানুষের মনে ভুতের একটা আলাদা স্থান ছিল। এখন যদিও ভুতেরা তাদের কৌলিণ্য হারিয়েছে। আমার মাতামহও অনেকবার ভুতের দেখা পেয়েছেন। একবার হয়েছিল কি আমার মাতামহ পাশের এক গ্রামে গিয়েছিলেন কালিপুজো করতে। রাত আড়াই-তিনটে নাগাদ বাড়ি ফিরছেন, – সঙ্গে পাঁঠার মাথা । আমার মাতামহ কিছুদূর এগিয়ে একটা বাঁক পেরোতেই লক্ষ্য করেন কালো মতো একটা ছায়ামূর্তি তাকে অনুসরণ করছে। মাতামহ সাহসে ভর করে এগিয়ে যেতে থাকেন। সেই ছায়ামূর্তিও তাকে অনুসরণ করে এগোতে থাকে।
সেসময় রাস্তাঘাটে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল। তিনি ভাবলেন, – এ নির্ঘাত চোর না হয়ে যায় না। কিন্তু ব্রাহ্মণের কাছে নেবেই বা কি ! তার সম্বল বলতে পুজোর চালকলা আর পাঁঠার মাথাটা। তবুও মনের দ্বিধা যায় না। কথায় আছে, – ‘চোরের কোপনি ( কৌপীন ) লাভ’, এখন যা করেন ঈশ্বর।
ছায়ামূর্তি কখনো সামনে চলে তো কখনো আগে। গ্রাম ঢোকার ঠিক আগের মূহুর্তে ছায়ামূর্তি বলে ওঠে, “যাঁ খুঁব বেঁচে গেঁলি।” আমার মাতামহও তেজস্বী পুরুষ ছিলেন, তিনিও উত্তর দিলেন, “তুইও খুব বেঁচে গেলি।”
বাড়ি এসে মাংস ছাড়িয়ে রান্না বসাবার উদ্যোগ চলছে, এমন সময় মাতামহ বললেন, ” পাজীটা মনে হয় বাইরেই আছে, ওকে একটুকরো মাংস দাও।”
একটুকরো মাংস নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিতেই টুকরোটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এরপর রান্নাবান্না হল। খাবার সময় সবাই স্বীকার করল যে মাংসে একফোঁটাও স্বাদ নেই। কেউ যেন সমস্ত মাংসটা চুষে রেখে গিয়েছে।
…. চলবে