পদ্যে গদ্যে গানে চিত্রে নাটকে হাস্যকৌতুকে রাস্ট্রিক প্রয়াসে পল্লীসংস্কারে বিচিত্র চিত্তপ্রকাশের উৎস তাঁর জীবনের কেন্দ্রস্থলে নানা শাখায় উৎসারিত।
মানুষের অন্তরে রয়ে গিয়েছেন মানুষ রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির এক অপার বিস্ময় এই কবি। তাঁর বাক্যালাপে বৈঠকে গুরু লঘু সব কিছুরবঐক্য দিয়ে আছেন তিনি। .
২৫ শে বৈশাখ এলেই কারণে অকারণে সকাল থেকেই উৎসবের আমেজে আমোদে মাতে বঙ্গ। রাস্তায় লাল পাড় শাড়ি আর সাদা পাজামা পাঞ্জাবির প্রাচুর্যে উৎসবে মাতে মন। রজনীগন্ধার আনন্দিত আমোদে মাতে বঙ্গ জননীর সন্তান। .
রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি বা অন্যবিধ সাহিত্যিক নন। শুধু নানা ললিতকলাবিদ নন। তিনি এক নির্জন জীবনসত্বার ঋত্বিক। .
তিনি সমস্ত অহংকারের উর্ধে আরও কিছু। তাঁর ব্যক্তিত্ব এক সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করলে পাই অখন্ড রহস্যে ঘেরা ঢেউ। তার তলে কতশত মূল্যবান পাথররাজি খেলা করে, কতশত ঢেউ ওঠে আবার অচিরেই মিলিয়ে যায় । .
ভাবে অভাবে, দুঃখে আনন্দে বেঁচে থাকার চাবি খুঁজে পাই তাঁর গানে কবিতায়। দুঃখে তাঁর রচিত গান এক অমোঘ সান্ত্বনা বয়ে আনে। প্রতিটি মানুষের প্রতিক্ষণের অনুভূতি বয়ে নিয়ে রস ছড়ায় নিরস জীবনে। কাকে ছেড়ে কাকে ধরি? গল্পসমগ্র, তাঁর কবিতাসমগ্র সবকিছুর মধ্যেই মানুষ থেকে এক মহামানুষে উত্তরণ। .
বাঙালির আবেগ তাঁকে ঘিরে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। শুধু এই একটি দিক বাঙালি ধরে রাখতে পারলেই এই বাঙালির উত্তরণ ঘটতেই থাকবে। শুধু একটা চাল টিপে সমগ্র হাঁড়ির ভাত সিদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্তে আসার একটি মোক্ষম মাপকাঠি এই কবি। .
তাই ২৫ শে বৈশাখ এলেই চলে আসে মনে একটু গান, একটু কবিতা। বারো মাসে তের পার্বণের মত বাঙালির সংস্কৃতি ঘিরে রয়েছে আজকের দিনটি। .
ছেলে মেয়েরা সকাল হলেই ফুল সংগ্রহ করে নতুন জামা কাপড়ে সজ্জিত হয়ে চলে রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসবে যোগ দিতে। সেখানে গিয়ে একটা কবিতা বা একটা গান না শোনাতে পারলে দিনটা বৃথা হয়ে যায়। .
শহরে, গ্রামে সব স্থানে চলে দিবারাত্রি রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠান। দিনে দিনে এই দিনটির প্রসার বেড়েই চলেছে। ” সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ “, প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ এই লাইন কত নব প্রেমিকের মিলন ঘটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
এই দিনে মিলিত হয় দুটি হৃদয়। চোখের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় নব প্রেরণার সুরে নব জীবন, নবপ্রেম, নবআশা। .
তিনি বলতেন, ” তুমি নব নব রূপে এস প্রাণে “। তাই আমরাও আজকের দিনে বলি, হে কবি তুমি নবরূপে এস আবার আমাদের মাঝে। হানাহানি, জাতিভেদ সমস্ত ভুলে গিয়ে আবার বেজে উঠুক তোমার সুরে জীবনের সংগীত। .
জোড়াসাঁকো তাঁর একান্ত আপন বাসভূমি।মাটি নিয়ে সারা অঙ্গে মেখে নিতেন। গাছ গাছালি,বনবাদাড়,জীবজন্তু নদী, নালা,ডোবা সবকিছুই নিজের অত্যন্ত আপন মনে হত। আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করত না অন্য কোথাও। এইরকম মন নিয়েই কবির ছটফটানি।
তিনি তাঁর রচনা নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন।তাঁর নানা সৃষ্টি ভিড়ের মধ্যে, একান্ত তপস্যায় নয়।একই সঙ্গে একাধিক রচনা তাঁর মনে উদিত হত ক্রমাগত।।তাঁর অনির্ণেয় আন্তর তাগিদ এবং অদম্য সংকল্প সমস্ত কাব্যসৃষ্টির মূল উৎস।দেশে বিদেশে কবি ইতালি ও আরও অন্যান্য ভাষার চর্চা শুরু করেন।.
কবি তাসোর মূল কাব্য পাঠ করে অপার আনন্দ লাভ করেন।পেত্রার্ক পড়ে পন্ডিত হওয়ার নিছক আনন্দলাভ নয়, সঙ্গে সঙ্গে তিনি লেখায় হাত পাকিয়েছেন।কঠিন তপস্যার মধ্যে খুঁজে গেছে পরশপাথর, তাঁর হৃদয়।
কবি মানস সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলি।নিজে এক মহৎ লোক না হলে কাব্য সৃষ্টির ব্যাপারে বিচার সম্ভব নয়। কবির প্রধান নির্ভর রস।ইতিহাস তাই বলে।কবিতার মধ্যে ব্যক্ত্বিত্বের স্পর্শটুকু প্রয়োজন।এ এক অতি গভীর ব্যাপার।কবিকে আমরা বুঝলাম তাঁর কাব্যে,তাঁর গীতিনাট্যে।.
সাহিত্য ছিলো আবেগপ্রধান।বাস্তব জীবনের সমস্যা, জীবনের সামগ্রিক আলোচনা, দুঃখ প্রভৃতি নিয়েই সৃষ্টি হত সাহিত্য।আধুনিকতা বলতে কি বোঝায় গতানুগতিকতার বাইরে যাওয়া।তাহলে কবি মামূলি সাহিত্যপথ একটু নড়িয়ে দিয়েছিলেন বৈকি।বাংলা ভাষার এক অভিভাবকের মত তাঁর আবির্ভাব। ব্যাস,বাল্মিকী,হোমার,ভার্জিল,মিলটন,ট্যাসো প্রমুখ মহাকাব্য রচয়িতাগণ যে জীবনদর্শন রূপায়িত করেছেন পাঠকরা তার সঠিক মূল্যায়ন করেছেন।.
কবিদের মানসমুকুরের ছাপ তাঁদের রচনাতে পড়েছে।ভাবগভীরতার সঙ্গে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁদের কাব্যিক অনুভূতি।কবি এর ব্যাতিক্রম নন।বহুকালের একঘেয়েমীর অবসান ঘটান দান্তে।দান্তের কবি মানস সাহিত্যের আকাশে স্বমহিমায় দীপ্যমান।.
সার্বভৌম ভাব সংস্কৃতির এক অদ্ভূত সমন্বয় সাধিত হয়েছে।সাহিত্যের ঘটনাবিন্যাস,গঠনবৈশিষ্ট্য ও অখন্ত ভাবসংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখে চিরনির্দিষ্ট আধারে সমসায়িক ইতিহাসের তীব্র মানসবিক্ষোভ ও আদর্শসংঘাত, দ্রবীভূত গৈরিক প্রবাহের ন্যায় প্রবৃত্তির ধর্মীয় উচ্ছ্বাসে সমস্ত কলা কৌশল সমন্বয়ে সাধিত হয়েছে।.
মধ্যযুগের ধর্ম বিশ্বাস ও যাজক তন্ত্রের মধ্যে এক বিরাট আত্মার অধ্যাত্ম আকূতি, স্বর্গনরকের রহস্যভেদী দিব্যদৃষ্টি, দৈববিড়ম্বিত মানবিকতার বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। ।আমরা কবির মানস পটে সংস্কারমুক্তি ও চিত্তের উদার অগ্রগতির পরিচয় পাই তার কাব্যে,তাঁর সাহিত্যে। নবজাগৃতির যুগে মানবচেতনায় এসেছে নব প্লাবন ও নব চিন্তার জোয়ার।.
মানুষ নিজেকে দৈব নির্ভর না করে অনন্ত সম্ভাবনার প্রতি অনুরক্ত হলো।সেক্সপিয়ার,শেলী,সমারসেট মমের রচনা মানব হৃদয়ের বিচিত্র বিকাশের মধ্যে যে জীবন দর্শনের সন্ধান দিয়েছেন তার প্রশান্ত গভীরতা মানব হৃদয়কে সিক্ত করলো অনিবার্যভাবে।.