তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা | তখনো Differently Abled বাচ্চাদের special Education বা বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি দেশে ততো চালু হয়নি | মানে থিওরি চালু হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তেমন একটা পরিচিতি পায়নি | বরঞ্চ special child জন্মালে বাবা মা তাকে স্বাভাবিক ভেবে নিয়ে কল্পরাজ্য তৈরি করে ফেলতেন -নিজেদের মিছামিছি তৃপ্ত করতেন কিংবা শিশুটিকে লুকিয়ে রাখতেন |
দেশে যখন Special Education প্রসারের এমন হাল ঠিক সেই সময় এক বৃদ্ধ মানুষ লক্ষ্য করলেন —-তাঁর একমাত্র নাতনিটি স্বাভাবিক বাচ্চার মত আচরণ করেন না | জন্মের মাস পাঁচেকের মধ্যেই স্থিতধী ঠাকুরদা অনুভব করলেন —কাছেপিঠে শব্দ হলে তাঁর নাতনিটি ফিরে তাকায় না এবং হাত পা ঘাড় কিছুই পুরুষ্টু নয় | দুপুরে কোলে নিয়ে ছাদে বসে ঠাকুরদা দেখেন — সূর্যের আলোয়ও দূরের বস্তু দেখতে সে চোখ কুঁচকোয় |
সেই দিন থেকে Multiple Disabled নাতনীর সাথে অদ্ভুত এক খেলা শুরু করলেন ঠাকুরদা | শব্দখেলা | হাতের কাছে একটা দোলনা বানিয়ে তার ওপর বসালেন শিশুটিকে | দোলনায় দোল খেতে খেতে শিশুর মনে মজা জন্মায় — | ছন্দ বলে —” এই তো আমি এসেছি রে |”
আর তখন কী করেন ঠাকুরদা ? দুলতে থাকা শিশুর সামনে সারাদিন ধরে ছড়া বলে যান | নাগাড়ে ছোটে সে ছড়ানদী | এমনকি প্রতিদিন যে সমস্ত সাংসারিক কথা আমরা বলে থাকি বা ঘটনাচক্রে যা আমাদের বলতেই হয় — সবকিছুই ইচ্ছে করে দোলনায় বসা শিশুটিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন |
ধরুন বাড়ির কেউ সত্যি দোষ করেছে | তাকে বকুনি দিতে হলেও শিশুটির সামনেই দিতেন | শিশু শেখে —কোনটাকে দোষ বলে , দোষ হলে কতটা রাগ করতে হয় এবং রাগ প্রকাশে কতটা চেঁচিয়ে ( Adequate Loudness ) শব্দ করতে হয় |
নিষ্ঠাবান শিক্ষক ঠাকুরদার নাতনি বড় হলো | শব্দ শিখলো | শব্দের ছন্দ শিখলো | সেই সঙ্গে শিখলো — কোথায় কোন শব্দ প্রয়োগ করতে হয় অর্থাৎ সমাজে শব্দপ্রয়োগের ন্যূনতম ঔচিত্যবোধ সে অর্জন করলো | সে যেমন কেউ দোষ করলে রাগের শব্দ বলতে শিখল আবার কেউ ভালো কাজ করলে কোন শব্দ দিয়ে তাকে প্রীত করতে হয় তাও শিখল | কারণ আলাদা ঘরে রেখে নয় —সবটাই ঠাকুরদা তাকে শেখালেন সমাজ ও সংসারের মাঝে ফেলে দিয়ে |
যে শিশু কোনোদিন স্কুলে যেতে পারবে না বা যাবার কথা চিন্তাও করতে পারে না কেউ তারও একটা স্কুল যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো | এবার কী করলেন ঠাকুরদা | প্রিয় নাতনী —যার full spasticity তখন detected হয়ে গেছে সে যাতে স্কুল যাওয়াটাকেই ধর্ম জ্ঞান করে তার জন্য ফেলে দেয়া রঙিন কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঠাকুরদা বানালেন স্কুলঝুলি | তাতে ভরে দিলেন কিছু বই | নাতনি ঐ স্কুল ঝুলি নিয়ে সারাদিন দাদুর কাছে বসে থাকে | তার মধ্যে তৈরি হতে থাকে একটা বইভর্তি বাড়ি অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার উত্তেজনা —খুশি —একটা —একটা ইচ্ছে | ভীষণ এবং তীব্র |
কোনো এক সকালে ঐ ঝুলিটি নিয়েই সে স্কুলে রওনা দিল তার special বুটজোড়া পরে | এক পা বড় এক পা সামান্য ছোট |আজও সে আমাদের স্কুলে পড়ে চলেছে | তার তিরিশ বছর বয়স হল | আজও তার স্কুলে আসার ইচ্ছেটাকে কেউ মারতে পারেনি | যেদিন স্কুলে আসা হয় না চিৎকার করে ঝগড়া করে —সে তো জানে স্কুলে না আসা বেঠিক কাজ এবং বেঠিক কাজে কীভাবে রাগ করতে হয় কিংবা কতটা রাগ করা উচিত | আজও আমি ক্লাসে ফাঁকি দিলে কড়া গলায় ধমকে ওঠে |
পড়া –ঝগড়া –প্রেম —আমার সাথে কোনটারই কি বিরাম আছে তার ? ঠাকুরদার ছড়া পাখি হয়ে আজো তার ঠোঁটে বেঁধে আছে বাসা |
কেন গল্পটা বললাম ?
একজন সংস্কারমুক্ত বৃদ্ধের differently Abled শিশুর উন্নতির জন্য এই অনুভব ও তাৎক্ষণিক বুদ্ধিপ্রয়োগকে সম্মান জানাতে | সেই সঙ্গে গ্রাম ও শহরে যে সব গরিব মা বাবার এই ধরণের শিশু আছে তাঁদের খানিকটা নির্ভয় করতে |
সরকারী অর্থদান প্রকল্পের সুযোগ নিশ্চয় নেবেন –কারণ এ প্রাপ্তি আপনার অধিকার | কিন্তু কোনো কারণে হাতে অর্থ ও কাছেপিঠে special school এ পড়াবার সুযোগ না থাকলেও এ ধরণের শিশুকে প্রকৃতি ,সমাজ ও মানুষের মাঝে স্থাপন করে —নিজের বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে জীবনে চলার উপযোগী করে তুলুন | তিরিশ বছর আগে এক বৃদ্ধ পেরে থাকলে আপনিও পারবেন | কারণ বইয়ের পাঠের চেয়ে এইসব শিশুর জীবনের পাঠ অনেক বেশি জরুরি |
দয়া করে Special Child কে normal স্কুলে পাঠিয়ে ভুয়ো পাশের খেলায় মাতাবেন না | বাবা মাকে টেনেহিঁচড়ে পয়সার লোভ দেখিয়ে normal স্কুলে special child কে নিয়ে গিয়ে বই খুলে টুকতে শেখাবেন না | এরা আগে trainable তারপর educable ,তাই না ? একটি স্বাভাবিক শিশুর যেখানে এই পাশ ফেল না রাখায় মারাত্বক ক্ষতি সেখানে এইসব বাচ্চার ক্ষতির পরিমাণ নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছেন | নাকি আন্দাজ করা যাচ্ছে না ?