গোয়েন্দা বিক্রম
মাঘের মাঝামাঝি, তারাপীঠের কাছেই দ্বারকা নদীর ধারে একটা লজ। বিশাল একটা ঘেরা জায়গার মাঝে একটা তিনতলা বাড়ি। পাশে কিচেন, গোডাউন আর গাড়ি পার্কিং। মেইন বিল্ডিং হতে একটা মোড়াম রাস্তা উঠোনের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে মিশেছে বড় রাস্তায়।
মোড়াম রাস্তার দুপাশে ফুলের কেয়ারি, তার পাশে সব্জির বাগান আর বাউন্ডারি বরাবর কয়েকসারি ফলের গাছ। লজের জনাচারেক কর্মচারীই এসবের দেখাশোনা করে। লজের ম্যানেজার শশীকান্ত রায় বয়স্ক মানুষ, বেশি দৌড়াদৌড়ি আর সহ্য হয় না তার। তিনি বসে বসে কাজকর্মের তদারক করেন আর আরামকেদারাখানা নিয়ে রোদে বসে চোখ বন্ধ করে স্মৃতি রোমন্থন করেন।
এই লকডাউনের সময়টা খুব কষ্টে কেটেছে তার । একে বেকার মানুষ, তার উপর বৌমার ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে নাজেহাল হওয়া, – এ কষ্ট বলে বোঝানোর নয়।
কষ্ট সব মানুষের জীবনেই আসে, এ কষ্টের চেয়েও বহুগুন কষ্ট পেয়েছেন পাঁচবছর আগে। নব্বই দিন লকআপে থাকতে হয়েছে। তবে লজের মালিক মানুষ ভালো, তিনি শশীকান্তকে বিশ্বাস করেন। তাই আবার কাজে বহাল করেছেন।
-“কাকু, আমাদের রুমের ওয়াশরুমে জল আসছে না, একটু দেখবেন।”
একটা মেয়েলি কণ্ঠের আওয়াজ শুনে ঘোর কাটল শশীকান্তর। উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “হ্যাঁ, চলুন দেখছি।”
মেয়েটির নাম কেকা। আজই সকালে এসে উঠেছে ওরা । এদের দলের পাঁচজনেই কলকাতার একটা নামকরা বেসরকারি কলেজের অধ্যাপিকা । দীর্ঘ লকডাউনের পর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই বেরিয়ে পড়েছে প্রমোদ ভ্রমণে।
মোট পাঁচটি মেয়ে, – কেকা, কাবেরী, চান্দ্রেয়ী, বিপাশা আর জেসমিন। এরমধ্যে কাবেরী ছাড়া বাকিদের বয়স আঠাশের মধ্যে। কাবেরী রায়, বয়স বিয়াল্লিশ, কলেজের প্রিন্সিপাল ইনি। এই ট্যুর মূলত উনার উদ্যোগেই। ফোন করে ইমেল করে জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে এই চারজনকে পেয়েছেন মোটে। আর মজার বিষয় হল এই চারজনই কাবেরী ম্যামের ছাত্রী। আজ হতে ঠিক পাঁচবছর আগে এই হোটেলেই এসে উঠেছিল ওরা। তবে সেদিন ওরা সংখ্যায় ছিল সাত । আর চেকআউট করেছিল এই পাঁচজন। বাকি দুজনকে তারাপীঠ মহাশ্মশানে রেখে যেতে হয়েছিল ওদের।
এসব কথা আর মনে করতে চান না কাবেরী। তবে হোটেলটা যেন আজও তাকে টানে। দুর্নিবার আকর্ষণ। এ কথা কাউকে বোঝানো যাবে না। আজ দীর্ঘ পাঁচবছর পর এই একই লজে ওঠাটাও যে সেই আকর্ষণ তা কিভাবে বোঝাবেন অন্যদের ?
নিজের কথা নাহয় বাদই দিলেন, কিন্তু বাকি মেয়েরা ? বাকি স্টাফরা যেখানে বিভিন্ন অজুহাতে ট্যুরে আসতে চাইল না সেখানে এরা সহজেই রাজি হয়ে গেল কিভাবে ? তাহলে এদেরকেও কি টানছে সেই আকর্ষণ ? কে জানে, হতেও পারে।
দরজায় নক করার আওয়াজে সম্বিত ফিরল মাধবীর। দরজা খুলতেই ভেতরে এল কেকা, আর সঙ্গে ম্যানেজার বুড়ো। এই বুড়োটাকে দেখলে ইরিটেশন হয় মাধবীর। বুড়োটা বহুকিছু জানে। সেদিনও মুখ খোলেনি, আর খুলবে বলে মনেও হয় না। এরকম লোককে টুকরো টুকরো করে কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো উচিত। দাঁত কিড়মিড় করে মাধবীর।
-“আপনাদের বাথরুমের কলটা নাকি খারাপ, জল আসছে না।” শঙ্কিত গলায় বললেন শশীকান্ত।
মাধবী কোনও উত্তর দিলেন না। কেকে ঈশারায় বাথরুমে যেতে বলল শশীকান্তকে। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর কলের মুখে লেগে থাকা একটা প্লাস্টিকের টুকরো বের করে দিতেই জল বেরোতে লাগল সবেগে। শশীকান্ত একটু জোর গলায় বললেন,”কাজ হয়ে গেছে। আপনারা দুপুরে এখানেই খাবেন তো ?”
কাবেরী বললেন, “হ্যাঁ, তবে পুজো দিয়ে আসতে দেরি হতে পারে।”
মাথা নেড়ে চলে গেলেন শশীকান্ত।
একটু বেলা হতেই স্নান করে বেরিয়ে পড়ল পাঁচজন। সবার পরনেই লালপাড় গরদের কাপড় । টোটোর মুখোমুখি দুটো সিটের একটাতে কেকা, কাবেরী আর জেসমিন, অন্যটাতে চান্দ্রেয়ী আর বিপাশা। গোটা গাড়িটাই রিজার্ভ। এমনকি পুজো দেওয়ার পর ফোন করলে ওই অটোটাই আসবে ফেরত নিয়ে যেতে।
কিন্তু আটলা মোড়ের একটু আগেই ঘটল অঘটন। একটা বয়স্ক মতো লোক এসে দাঁড়াল অটোর সামনে। পরনে রঙিন ধুতি আর হলুদ পাঞ্জাবী, কপালে কালো তিলক । না আকস্মিক নয়, ইচ্ছা করেই দাঁড়িয়েছে সে। দাবি একটাই, মন্দির পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে তাকে।
জেসমিন বলল, “না না হবে না। আমাদের রিজার্ভ আছে।”
চান্দ্রেয়ী পেছন দিকে মুখ করে বসেছিল। সে মুখ না ঘুরিয়েই বলল, “হবে না হবে না।”
বুড়ো তো কোনোমতেই মানবে না, সে ড্রাইভারের পাশের সিটে জোর করে বসে পড়লেন । বসতে বসতে বললেন, “আমি ছোট খোকা মা জননীরা। মায়েদের এতবড় গাড়িতে নিশ্চয়ই জায়গা হবে আমার।”
রেগে গিয়ে বিপাশা বলল, “এ.. এই বুড়ো, আমাদের দেখে মা বলে মনে হয় তোর ? তোর বৌ কে মা বল। ”
বুড়ো পেছনের দিকে তাকিয়ে আঁতেল হাসি হেসে বললেন, “বিয়ে হলে কি আর একা একা ঘুরি দিদিরা। সে সাধ তো এ জন্মেও মিটল না আমার। তবে এখনও বয়স পেরোয়নি।”
এবার চটে গেলেন মাধবী। হাতব্যাগ হতে আয়না বের করে নিজের চাকচিক্য পরীক্ষা করতে করতে বললেন,”কি বললি মুখপোড়া, দিদি ? এজন্যই তোর বিয়ে হয়নি। আর হবেও না।”
হো হো করে হেসে উঠল সবাই। ড্রাইভারও মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। বুড়ো কিন্তু তবুও নির্বিকার। মুখে সেই হাসি। আর এই কথা কাটাকাটির মাঝেই টোটো চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে মন্দিরের কাছে।
ব্রিজ পেরোতেই ভাড়া দিয়ে নেমে গেল বুড়ো। মেয়েরাও নেমে গেল টোটো হতে। মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে।
মন্দির হতে পুজো দিয়ে বেরোতেই টোটোটাকে স্ট্যান্ডেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। ড্রাইভারের পাশে বসে সেই বুড়ো। ড্রাইভার বলল, “কিচ্ছু করার নেই দিদি, একে তাড়ানো শিবের অসাধ্য।”
এবার খিখি করে হেসে উঠলেন বুড়ো। বললেন, “দ্যাখো কান্ড, ড্রাইভার ভাইটিও দেখছি আপনাদের দিদি বলছে।”
-“আচ্ছা এখানে কি করতে এসেছেন বলুন তো ?” বলল কেকা।
পর্ব ২
-“আচ্ছা এখানে কি করতে এসেছেন বলুন তো ?” বলল কেকা।
মাধবী বললেন, “কি করতে আবার, আমাদের মতো বেড়াতে আর মা তারার দর্শন করতে এসেছেন। ”
বুড়ো মুখ গম্ভীর করে বলল, “একটু ভুল হয়ে গেল ম্যাডাম, আমি এসেছি নিজের কাজে।”
-“কি কাজ ?” শুধালেন মাধবী।
বুড়ো বললেন,”জীবনসঙ্গিনী খুঁজতে। এখানেই থাকেন বাবা ঘটকানন্দ, এই দ্বারকার ধারেই, উনাকে দিয়ে বিবাহমুক্তি যজ্ঞ করালাম। বিয়ে আমার হবেই। দেখি কে আটকায়।”
-“সে কি মশাই, একেবারে বিবাহমুক্তি !! আইবুড়োর আবার বিবাহমুক্তি ! ” বললেন মাধবী। শুনে হাসতে লাগল সবাই। বুড়ো নিজেও যোগ দিল সেই হাসিতে।
জেসমিন ঈশারায় তার মুখের কাছে কান আনতে বলল। পাঁচটা মাথা এক হলে জেসমিন বলল,”বুড়োটা বেশ মজার। ও সঙ্গে থাকলে বেশ মজা হবে।”
সবাই একযোগে সম্মতি দিলে মাথা তুলল জেসমিন। বুড়োর দিকে তাকিয়ে বেশ মিহি গলায় বলল,”এই যে চিরকুমারবাবু, উঠেছেন কোথায় ? সঙ্গে কে কে আছে ?”
-“এই তো রাতে এসেই উঠেছিলাম বাবা ঘটকানন্দের আশ্রমে। অনেক রাত পর্যন্ত যজ্ঞ হয়েছে। সকাল হতেই আশ্রম হতে বের করে দিল।”
-“আমরা যেখানে উঠেছি সেখানে চলুন। আপনার লাগেজপত্র কোথায় ?” বললেন মাধবী। চোখে মুখে একটা অজানা লজ্জা। সংসারের নানান ঝামেলায় বিয়ে না করে ওঠা মাধবীর যেন মনে ধরেছে বুড়োকে। হোক না বুড়ো, মনের দিক হতে সরস ও সরল। আর তাছাড়া মাধবীই বা কি কচি খুঁকি।
বুড়ো বলল,”রাতেরবেলা আশ্রমে চোর ঢুকেছিল, লাগেজপত্র সব চুরি হয়ে গেছে। যেটুকু পয়সা আছে তাতে মাসিরবাড়ি পর্যন্ত যেতে পারব। কিন্তু একটু আগেই আমার এক গুণধর বন্ধু ফোন করেছিল। সে এখানেই আসছে। একটা লজে রুম বুকও হয়ে গেছে। সেখানেই যেতে হবে আমাকে।”
-“কোন লজ ?” শুধালেন মাধবী।
-” ‘সবুজের সন্ধানে’। তবে সেটা একজ্যাক্ট কোথায় তা জানি না। ”
-“আরেব্বাস, আপনার বন্ধু তো আমাদের ওখানেই রুম বুক করেছে।” বলল কেকা।
বুড়ো মিথ্যা বলেনি। লজে পৌঁছতেই ম্যানেজার বললেন,”আসুন আসুন। আপনার বন্ধু এইমাত্র ফোন করেছিলেন। আপনাদের রুম রেডি আছে। উনি তো কাল আসবে ? ”
-“আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাদের এখানে টিকটিকি নেই তো ?”
-“টিকটিকি তো সর্বত্রই বিরাজ করে। কিন্তু কেন বলুন তো ?” বিস্মিত হলেন ম্যানেজার।
বুড়ো মাথা চুলকে বললেন, “টিকটিকি আমার জন্য অপয়া মশাই। বিয়ে আটকে দিচ্ছে।”
মুখ টিপে হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন ম্যানেজার। মেয়েরাও কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিল। একযোগে হেসে উঠল তারা। বুড়োর ভাবান্তর নেই।
রাতেরবেলা খাবার সময় বুড়োর সাথে যথেষ্টই হাসিঠাট্টা করল সবাই। কিন্তু এত হাসি আনন্দের মাঝেও যেন স্বস্তি পাচ্ছিল না মাধবী। ম্যানেজারকে যতবার দেখছে ততবারই মাথা বিগড়ে যাচ্ছে তার। আর এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই বিচলিত হয়ে উঠল মনোজ।
মনোজ এখানকার একজন কর্মচারী। ম্যাডামকে চিনেছে সে। শুধু ম্যাডাম কেন উনার সঙ্গে আসা মেয়েরা সবাই মনোজের চেনা। আজ হতে পাঁচ বছর আগে সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে হাঁটুদুটো কেঁপে ওঠে মনোজের। সেই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তাকেও যেতে হয়েছিল লকআপে।
-“সব ভুলে যান ম্যাডাম। দোষী যেই হোক, ভগবান আছেন,শাস্তি সে পাবেই।” বলল মনোজ।
মাধবী ধীর গলায় বলেন, “বলা খুবই সহজ, কিন্তু বাস্তবে কি সেটা সম্ভব ?”
-“ওই ম্যানেজার বুড়োর সঙ্গে আমারও একটা হিসেব আছে ম্যাডাম, ওর জন্যই আমি বিনাদোষে হাজতে কাটিয়েছি। পাপ করবে ও আর শাস্তি পাব আমি !” ফুঁসে উঠল মনোজ।
ও প্রসঙ্গে আর কিছু বললেন না মাধবী, শুধু বললেন, “পোস্তটা একটু দাও।”
ছোট্ট একটা স্টিলের হাতাতে করে মাধবীর পাতে একহাতা পোস্ত দিয়ে চলে গেল মনোজ। খাওয়ায় মন দিলেন মাধবী। যদিও খেতে ভালো লাগছে না আর। মনের সঙ্গে পেটের একটা সম্মন্ধ আছে। মন খারাপ থাকলে খিদে তৃষ্ণা উড়ে যায়।
দুই
দমাদ্দম দরজা পেটানোর আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল মাধবীর। চান্দ্রেয়ী এখনও অঘোরের ঘুমোচ্ছে। পাশের ঘরে কেকা, জেসমিন আর বিপাশা। চান্দ্রেয়ীকে না জাগিয়েই ঘুমজড়ানো চোখে দরজার দিকে ছুটে গেলেন মাধবী। “এই কনকনে শীতে এত সকালে ওঠা যায়। কে বাপু বে-আক্কেলে…” নিজের মনেই আওড়াতে থাকেন।
দরজা খুলতেই দেখেন বাইরে মনোজ। বেশ ভীত ও সন্ত্রস্ত। থরথর করে কাঁপছে। কথাও বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে বলল, “খুন..”
-“খুন ! কার ? ম্যানেজার বুড়োর ?”
-“হ্যাঁ ।” মাথা নাড়িয়ে বলল মনোজ।
এরপর আর কোনও কথা না বাড়িয়ে মনোজের সঙ্গে চললেন মাধবী। ম্যানেজারের ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল তারা। দরজার সামনে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছেন ম্যানেজার শশীকান্ত । বুকে বিঁধে রয়েছে একটা কিচেন নাইফ। রক্ত গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। চিৎকার করে উঠলেন মাধবী।
মাধবীর চিৎকারে বাকিদের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তারা তড়িঘড়ি এসে হাজির হয়েছে চিৎকার অনুসরণ করে। কেকাই ফোন করল পুলিশে। “হ্যালো…. বড়বাবু বলছেন ? এখানে একটা খুন হয়ে গেছে । সবুজের সন্ধানে। না আমরা কেউ হাত দিইনি।”
পুলিশ এল। ছবিটবি তুলে লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হল মর্গে। ক্রাইমসিন ঘিরে দেওয়া হল। ইন্সপেক্টর পাকড়াশি ডায়েরি নিয়ে বসলেন এজাহার লিখতে।
মাধবী বা তার সঙ্গিনীদের জেরা করে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। লজের কর্মচারীদেরও কোনও মোটিভ নেই। ইন্সপেক্টর হাঁকলেন,”আপনাদের ছাড়া আর কেউ আছেন ?”
-“হ্যাঁ স্যার, একটা বুড়ো চেকইন করেছে কাল।” বললেন মাধবী।
-“কই সেই বুড়ো ?” ইন্সপেক্টর হাঁকলেন।
পর্ব ৩
বুড়ো এল না। ইন্সপেক্টর উঠে গেলেন। বুড়োটা এখনও ওঠেনি ঘুম হতে। দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল সেই বৃদ্ধ। চোখে ঘুমের রেশ। ইন্সপেক্টরের চোখ গেল বুড়োর জামার দিকে। পাঞ্জাবীর উপর রক্তের ছোপ। হলুদের উপর কালচে লাল ছোপ বেশ বোঝা যাচ্ছে।
-“বাইরে আসুন।” গম্ভীর স্বরে বললেন ইন্সপেক্টর।
এরপর গাড়িতে চাপিয়ে সোজা নিয়ে চললেন থানায়। পথে বুড়োর হাজার প্রশ্ন অনুরোধ উপরোধ কিছুতেই কান দিলেন না ইন্সপেক্টর। থানায় এনে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা শুরু হল।
-“আপনার নাম ?”
-“শ্রীযুক্ত অঘোরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ।”
-“বাড়ি.. ”
-“সল্টলেকে, বৈশাখীর কাছে।”
-“ম্যানেজার শশীকান্তবাবুকে মারলেন কেন ?”
মুখ শুকিয়ে গেল অঘোরবাবুর, বললেন, “বিশ্বাস করুন আমি কিচ্ছু জানি না। বিয়ে হচ্ছে না বলে সবাই খোঁটা দিচ্ছিল, তাই এসেছিলাম বাবা ঘটকানন্দের আশ্রমে। সেখান হতে যজ্ঞ করে বেরোতেই বিক্রমের ফোন আসে। ও আসছে। লজে রুমটাও বিক্রমই অনলাইনে বুক করেছে।”
-“বিক্রম মানে বিক্রমাদিত্য মুখোপাধ্যায় ? কবে আসছে ? ”
-“হ্যাঁ । আজই আসছে।”
-“হুম্ ! ” কি যেন ভেবে নিলেন ইন্সপেক্টর, তারপর বললেন,”ঠিক আছে, বিক্রম আসুক, ও যখন আপনার চেনা তখন অ্যারেস্ট করছি না। তবে এখানেই থাকুন। ও এসে নিয়ে যাবে।”
কিছুটা স্বস্তি পেলেও অঘোরবাবু এটা ভালো করেই বুঝলেন যে বাঁচার আশা খুবই কম। একটা জটিল জালে জড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। এখন বিক্রমই একমাত্র ভরসা।
বেলা একটা নাগাদ বিক্রম এল। পরনে নীল রঙের সোয়েটার আর ওই রঙেরই একটা মাফলার। এসেই জড়িয়ে ধরল ইন্সপেক্টর পাকড়াশিকে। ইন্সপেক্টর পাকড়াশিও মহানন্দে জড়িয়ে ধরলেন বিক্রমকে।
ইন্সপেক্টর বললেন “কতদিন পরে দেখা হল বল্ তো ! দীর্ঘ চারবছর। অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তোকে পাইনি। তোর সাসপেন্সনের খবরটা পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম, কিন্তু তুই ততদিনে ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিস। সে যাই হোক তুই যে একজন সফল গোয়েন্দা সে খবর আমি রাখি। সায়ক ভট্টাচার্য্য বলে একজন লেখক আছে না, ওর লেখাতেই তোর সব কেসগুলো আমি পড়েছি। ”
-” তা তো হল ভাই, কিন্তু অঘোরবাবুর কি হবে ?” বলল বিক্রম ।
ইন্সপেক্টর বললেন,”অঘোরবাবুকে তুই নিয়ে যা। ফার্স্ট ইনভেস্টিগেটিং রিপোর্টে উনার উল্লেখ করব না। তবে বিনিময়ে এই কেসটা সলভ করতে হবে তোকে।”
-“ওকে ডান। ”
অঘোরবাবুকে নিয়ে বিক্রম চলল লজে। টোটোয় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন অঘোরবাবু। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিক্রম বলল, “কি এত চিন্তা করছেন অঘোরবাবু ?”
-“কি আর চিন্তা করব ভাই, চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি ফাঁসির দড়ি ঝুলছে। আইবুড়ো হয়েই মরতে হবে দেখছি। ” আর বলতে পারলেন না অঘোরবাবু, তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। কণ্ঠ অবরুদ্ধ।
বিক্রম হো হো করে হেসে উঠল। বলল, “বলিহারি মশাই আপনি, যেখানেই যান সেখানেই সমস্যা তৈরি করে বসেন। আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করে সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না। যার সঙ্গে ঝগড়া সেই সায়কও পালিয়েছে, এখন নাকি প্রফেসর লোমহর্ষণের ফাইফরমাশ খাটছে ।”
-“ওকে আমার স্যরি বোলো। বিয়ে হয়নি সেটা কি আমার দোষ ? বিয়ের ফুল ফোটেনি তাই হয়নি। সায়ক আমাকে আইবুড়ো ধেড়ে টেড়ে অনেককিছু বলেছে। ”
-“সে থাক, এখন আপনি বলুন তো, কাল রাতে ঠিক কি হয়েছিল ?”
-“তুমিও আমাকে সন্দেহ করছ ? আমি খুনি ? কেন ছাড়িয়ে আনলে আমাকে ?” ভটচায মশাই কেঁদে ফেললেন।
ভটচায মশাইকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বিক্রম বলল,”আর যাই হোক খুন যে আপনার দ্বারা সম্ভব নয় তা আমি জানি। কিন্তু গোটা ঘটনাটা না জানলে আমার পক্ষে অপরাধীকে খুঁজে বের করা কঠিন।”
কলকাতা হতে আসা থেকে অ্যারেস্ট হওয়া পর্যন্ত সব কথা খুলে বললেন অঘোরবাবু। সব শুনে বিক্রম বলল, “তাহলে আপনি জানেনই না যে আপনার জামাতে রক্তের ছিটে এল কোথা হতে ?”
-” না। ”
-“কাউকে সন্দেহ হয় আপনার ?
কিছুটা ভেবে নিয়ে অঘোরবাবু বললেন, “একটা কাজের মেয়ে। খাওয়া দাওয়ার পর আমার ঘরে এসেছিল জল নিয়ে। জলের জাগটা দিয়ে বলল, রাতেরবেলা হুটহাট না বেরোতে। ওর কথার মানে বুঝলাম না। আমি মাথা নেড়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।”
-“ঠিক আছে, চলুন, অকুস্থল ঘুরে দেখা যাক। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে।”
লজে এসেই প্রথমে গেল ক্রাইমসিনে। সেখানটা ঘেরা আছে। দু’জন কনস্টেবল পাহারায়। বিক্রমের তদন্ত শেষ হলেই ওরা চলে যাবে।
গোটা ঘরটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল বিক্রম। তেপায়ার উপর জলের জাগটা পাওয়া গেল। একফোঁটাও জল নেই। মনে মনে হাসল সে। এভিডেন্স গায়েবের চেষ্টা হয়েছে। জাগটাকে একটা এভিডেন্স ব্যাগে ভরে নিয়ে বাইরে এল।
বাইরে সবাই জমায়েত হয়েছে। ওদের উদ্দেশ্য করে বিক্রম বলল, “শশীকান্তবাবুর হত্যার তদন্তভার আমাকে দেওয়া হয়েছে। যতক্ষণ না এই কেসের কোনও সমাধান আমি করতে পারি আপনারা এই লজ ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। আমি থানায় বলে রেখেছি, বাইরে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখন আপনাদের এক এক করে ডাকব। আশাকরি আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন।”
অফিসঘরটাতে বসল বিক্রম । প্রথম ডাক পড়ল কাজের মেয়ে বিজয়ার।
-“আপনার নাম-”
-” বিজয়া । বিজয়া লেট।”
পর্ব ৪
-“শশীকান্তবাবুর খুন হওয়ার দিন আপনি এই লজেই ছিলেন ? অন্যান্যদিনও কি থাকেন ?”
বিজয়া মাথা চুলকে বলল,”অন্যদিন থাকি না বাবু, তবে কাল ছিলাম। ম্যানেজারবাবু থাকতে বলেছিল ।” বলেই মাথা নিচু করল বিজয়া।
হাসি দমন করে বিক্রম বলল,”ওই বুড়ো বাবুর ঘরে জল পৌঁছে দিতেও কি তোমার ম্যানেজারবাবুই বলেছিলেন ?”
বিজয়া মাথা নিচু করেই বলল,” না। আমি নিজেই গেইছিলাম । বুড়ো মানুষ তো তাই। ”
-“জগের জলটা কোথায় ফেলেছ ?” একটু সুর চড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল বিক্রম।
বিজয়া কেঁদে উঠল। “আমি কিছু করিনি বাবু।…”
-“ঠিক আছে, তুমি আসতে পার। ও হ্যাঁ, দিদিমণিদের একজনকে পাঠিয়ে দাও।”
মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল বিজয়া। তার চোখের কোণে আর জলের রেখা নেই। যেন স্বস্তি পেল সে।
একটু পরেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন মাধবী। তাকে বসতে বলল বিক্রম।
-“আপনি কাবেরী রায়, ‘অলিভার কলেজ ফর উইমেন’ এর প্রিন্সিপাল ?”
-” হ্যাঁ ।”
-“পুলিশ রিপোর্ট হতে যা দেখছি আজ হতে বছর পাঁচেক আগে আপনি, আপনার এক কলিগ আর পাঁচ ছাত্রী মিলে এই লজেই এসে উঠেছিলেন। আর সেবার দু’দুটো খুন হয়েছিল। ঠিক বলছি তো ?”
-“হ্যাঁ ।”
-“কাল রাতে খাওয়া দাওয়ার পর কি করছিলেন ?”
-“শরীর ক্লান্ত ছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ”
-“আপনার কাউকে সন্দেহ হয় ?”
চিন্তায় পড়ে গেলেন মাধবী। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন,”আমার সঙ্গে আসা মেয়েদের যথেষ্টই মোটিভ আছে। তাছাড়া মনোজও ওই বুড়ো ম্যানেজারটার উপর ক্ষেপে আছে। তবে আপনার বন্ধু যে খুনি নন তা আমি চোখ বন্ধ করেও বলে দিতে পারি। “
-“ঠিক আছে। আপাতত যান। পরেরজনকে পাঠিয়ে দেন।
এরপর এল কেকা। বেশ স্মার্ট ও প্রগলভ। ওর দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল বিক্রম। বলল, “আপনার নাম -”
-“কেকা বোস। আমি কেমিস্ট্রির অধ্যাপিকা।”
-“শশীকান্তবাবুর হত্যার পেছনে তো যথেষ্টই মোটিভ আছে আপনার। এ ব্যাপারে কি বলবেন ?”
-“মোটিভ বলতে ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন তা আমি জানি না, তবে কালকের ঘটনার বিন্দুবিসর্গ আমি জানি না। আর একজন বাপের বয়সী বৃদ্ধকে মারার মতো পাপের কথা আমি ভাবতেও পারি না।”
-“আচ্ছা আপনি আসতে পারেন।”
চান্দ্রেয়ী, বিপাশা আর জেসমিনের বক্তব্য মোটামুটি একইরকম। ওদের পর এল মনোজ। চারজন কাজের লোকের মধ্যে মনোজই হেড। ও বলল,”খামোখা আমি কেন মারতে যাব স্যারকে ? আপনার ওই বুড়োটারই কাজ এটা। আপনার বন্ধু না কি হয় যেন।”
-“পাঁচবছর আগে এই হোটেলে যখন জোড়া খুন হয় তখন তো তুমি এখানেই কাজ করতে।”
-“হ্যাঁ স্যার। সেই খুনগুলো যে কে করল স্যার….. অনেকদিন হাজতে ছিলাম।”
-“এবারেও সেরকমই যোগ দেখতে পাচ্ছি। দিদিমণিদের একজন বলছিলেন যে তুমি নাকি খাওয়ার সময় মাধবী দিদিমণির সঙ্গে চাপা গলায় কিছু আলোচনা করছিলে। কি আলোচনা ? কিছু জানতে পারি ?”
-“তেমন কিছু নয় স্যার, ওই দিদিমণি ম্যানেজারবাবুকে দেখে ভয়ানক রেগে যাচ্ছিলেন, আমি উনাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম।”
হাতের কলমটি থুতনিতে ধরে শান্ত গলায় বিক্রম বলল,”কাকে সন্দেহ হয় ?”
-“দিদিমণিদের সবাইকে স্যার। আমার নিশ্চিত ধারণা, আগের খুনগুলোও ওদেরই কাজ। আর একটা কথা স্যার, ওই মাধবী দিদিমণি সিগারেট খান। হাতে বানানো সিগারেট।”
-“তুমি এখন আসতে পার মনোজ। তবে তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করলাম আর তুমি কি বললে তা যেন বাইরে বোলো না। এতে তোমারই বিপদ হবে।”
সবার এজাহার নিতে নিতে সন্ধ্যা হয়ে এল। বিক্রম বলল,”আপাতত এখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেসনের দায়িত্ব আমার। আমাকে না বলে কেউ বাইরে যাবেন না। আর চেষ্টা করেও সফল হবেন না, কারণ ইতিমধ্যেই দরজার সামনে পুলিশের পাহারা বসে গেছে। অঘোরবাবু আসুন।”
রাতেরবেলা খাবার জায়গায় জড়ো হল সবাই। সবার মুখেই একটা চাপা আতঙ্কের ছাপ। অত হাসিখুশি অঘোরবাবু, তিনিও চুপকরে বসে আছেন। তবে মেয়েরা নিজেদের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে তাদের একটা প্রিয় খেলায় মন দিয়েছে। গল্প। নিজেদের মধ্যে জুড়েছে গল্প। টপিক একটাই, ওই হ্যান্ডসাম গোয়েন্দা।
-“লোকটার মধ্যে একটা চার্ম আছে।” বললেন মাধবী।
জেসমিন ক্ষুন্ন হয়ে বলল, “কাকে লোক বলছেন ম্যাম, ইয়াংম্যান বলুন।”
ডিমের কারি দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে কেকা বলল, “বিয়েটা আর পেন্ডিং রাখলে চলবে না। এই হতচ্ছাড়া কেস হতে মুক্তি পাই, তারপরেই বাবাকে বলব।”
-“মানে ? ওই স্মার্ট হ্যান্ডসাম ডিটেকটিভ তোকে পাত্তা দেবে ?” ঈর্ষান্বিত হল জেসমিন।
পাশের টেবিলে খাচ্ছিল চান্দ্রেয়ী, সে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, হঠাৎ প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল ও। ব্যাপারটা লক্ষ্য করতেই ছুটে এল বিক্রম। এসে ধরল চান্দ্রেয়ীকে। পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল কিচেনের একাধারে থাকা কাঠের তক্তপোশের উপর।
-“কি হয়েছে আপনার ?”
চান্দ্রেয়ী অনেক কষ্টে বলল”….ঘা..”
বিক্রম দেখল চান্দ্রেয়ীর ঘাড়ে একটা রক্তের বিন্দু। পয়েজন ডার্ট ? পকেট হতে মোবাইল বের করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকে সে।
পর্ব ৫
মিনিট দশেকের ভেতরই অ্যাম্বুলেন্স এল। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। আরেকটা মার্ডার। ফোনপেয়ে তড়িঘড়ি ইন্সপেক্টর পাকড়াশিও এসেছেন। তিনি লাসের ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরপর টুপিটা মাথা হতে খুলে বললেন, “নো মোর…”
আতঙ্কে তরে উঠল চারদিক। বাকি মেয়েরা তো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল। লাস পাঠানো হল মর্গে। এদিকে বিক্রম যেন হন্যে হয়ে কি খুঁজে চলেছে। তার মনের মধ্যে শান্তি নেই। কিছু একটা নেই এই ক্রাইমসিনে।
ইতিমধ্যে আরেকটা বিপদ হয়েছে। বিক্রমের মুখোমুখি বসে খাবার খাচ্ছিলেন অঘোরবাবু। সব দেখেশুনে তার প্রেসার ফল করেছে। ইন্সপেক্টর পাকড়াশি অঘোরবাবুকে নিয়ে গেছেন ‘রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজে’। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অঘোরবাবুর জ্ঞান ফেরেনি।
পরদিন সকালে লজে এলেন ইন্সপেক্টর। অফিসঘরে মুখোমুখি বিক্রম আর ইন্সপেক্টর। প্রহ্লাদ চা আর বাটারটোস্ট দিয়ে গেল। কাল সন্ধ্যা হতেই মনোজের শরীর খারাপ। সে নিজের ঘরে শুয়ে আছে। বিক্রম ডাক্তার ডাকতে চেয়েছিল কিন্তু মনোজ বলেছে, ওষুধে তার দরকার নেই, বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
-“তোমার কথাই ঠিক বিক্রম, পয়েজন ডার্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।” বললেন ইন্সপেক্টর ।
বিক্রম বলল, “সেটা তো হল পাকড়াশি, কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন হল যে কাজটা করল কে। অঘোরবাবু আমার কাছাকাছিই ছিলেন। তার যা পজিশন তাতে আমার চোখ এড়িয়ে এসব করা সম্ভব নয়। মনোজ নিজের ঘরে শুয়ে ছিল। শরীর খারাপ ওর। কাজের মাসি রান্নাঘরে। বাকি রইল মেয়েরা, প্রহ্লাদ, সন্তোষ আর ঋজু।”
ইন্সপেক্টর মাথা নামিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন,”তাহলে… নেক্সট স্টেপ ?”
বিক্রম হেসে বলল,”ক্লু যে আমি একেবারে পাইনি তা নয়, তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটা বলা যাবে না। এই কেসটাকে প্রায় সলভ করেই এনেছিলাম, বাধ সাজল ওই পয়েজন ডার্ট। ওটা নতুন করে ভাবাচ্ছে।”
-“পয়েজন ডার্টটা পেলে ?”
-“না। খুব সম্ভবত খুনির অ্যাসিস্ট্যান্ট ওটাকে গায়েব করে দিয়েছে। ”
-“তার মানে খুনি একা নয় !!”
বিক্রম মুচকি হেসে বলল,”হ্যাঁ মাই ডিয়ার ইন্সপেক্টর। একজনকে আমি ইচ্ছা করলেই ধরতে পারি কিন্তু তাহলে ওর পার্টনার ফুকলে যাবে।”
-“ওকে। তাহলে আরও কয়েকটা খুন হোক।” উঠে পড়লেন ইন্সপেক্টর।
বিক্রম বলল,”সেটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। এমনও হতে পারে আজ রাতে আমার পালা।”
মুখটা শুকিয়ে গেল ইন্সপেক্টরের। কথা ঘোরাতে বিক্রম বলল,”আজকাল কি এদিকটায় চোরছ্যাঁচড়ের খুব উৎপাত হচ্ছে ? না মানে তোমার গাড়ি এদিকটাতেই ঘনঘন চড়কিপাক খাচ্ছে তো, তাই বললাম।”
বিক্রমের কথার উত্তর দিলেন না ইন্সপেক্টর। টুপিটা মাথায় দিয়েই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। বাকি টোস্টগুলোতে মন দিল বিক্রম।
ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যেতেই মনোজের ঘরে গেল বিক্রম। মনোজ শুয়ে শুয়ে মোবাইলে গান শনছে। গানে বিভোর থাকায় বিক্রমের উপস্থিতি টের পায়নি সে। মনোজের কপালে হাত রেখে বিক্রম বলল, “শরীর এখন কেমন ? জ্বর টর তো নেই দেখছি।”
তাড়াতাড়ি কান হতে হেডফোন খুলে ফেলে মনোজ বলল, “ওষুধ খেতেই নেমে গেছে।”
বাঁকা হাসি হেসে বিক্রম বলল, “তাও ভালো। কিন্তু আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন তো পেটখারাপ বলেছিলে। জ্বরের কথা তো বলনি। “
অপ্রস্তুত হয় মনোজ। কি বলবে ঠিক করতে পারে না। মাথা নিচু করে বসে থাকে। আর এই সূযোগে ওর ঘরের তাক হতে কি একটা তুলে নিয়ে পকেটে চালান করে বিক্রম। তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে বলে,”কাজে যোগ দাও, মন ভালো থাকবে।”
মনোজের ঘর হতে বেরিয়েই বিক্রম চলল রাস্তার দিকে। অঘোরবাবুকে দেখে আসতে হবে। সম্ভব হলে উনাকে ছুটি করিয়েই নিয়ে আসবে সে। আশাকরাযায় কালকের মধ্যেই সলভ হয়ে যাবে কেসটা, তারপর অঘোরবাবুকে নিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করতে হবে। বেড়াতে এসে বেড়ানোটাই অপশনাল করে দিলে কি হয় !
রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজের একটা বেডে শুয়ে আছেন অঘোরবাবু। নার্স ও ডাক্তারেরা উনাকে নিয়ে নাকাল হয়ে গেছেন। বিক্রম যেতেই একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল, “এই যে, অঘোরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কি আপনার লোক ?”
-“হ্যাঁ, কেন বলুন তো ?”
-“এদিকে আসুন, কথা আছে।”
বিক্রম এগিয়ে গেল নার্সদের বসার জায়গাটার কাছে। একটা চেয়ার টেনে বসল। সামনের চেয়ারে বসে থাকা বেশ সুশ্রী নার্সটা বলল, “উনি খুব জ্বালিয়েছেন আমাদের। ডাক্তারবাবুদের পর্যন্ত বিরক্ত করেছেন উনি। ডঃ মুখার্জিকে তো এমন একটা বানান ধরলেন যে ডাক্তারবাবু এদিকে আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন।”
বিক্রম হেসে বলল, “কি হয়েছে অঘোরবাবুর ?”
নার্সটি বিরক্ত গলায় বলল, “কিচ্ছু না, হঠাৎ প্রচন্ড ঋণ পেয়ে নার্ভ ফেল করেছিল। এখন ঠিকই আছেন।”
অঘোরবাবুকে ছুটি করাতে বেগ পেতে হল না । ডাঃ মুখার্জি আগে হতেই ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে গেছেন। নার্সটি কেবল সময় ও তারিখ বসিয়ে দিল।
পথে অঘোরবাবু বললেন,”এবার আমার পালা। আমার যত টাকাপয়সা আছে সব তোমার নামে নমিনি করে রেখেছি। আমি মরে গেলে ওগুলো দিয়ে তুমি একটা ট্রাস্ট তৈরি করবে। অসহায় কত অবলা প্রাণী খেতে পায় না, থাকার জায়গা নেই, ওদের সেবার কাজে লাগাবে আমার টাকা। আমার তো কেউ নেই, ওদের মাঝেই আমি নিজেকে খুঁজে পাই।” দু’চোখ জলে ভরে উঠল অঘোরবাবুর।
অঘোরবাবুর কাঁধে হাত রাখল বিক্রম। বলল,”সে অবশ্যই হবে অঘোরবাবু, তবে তার জন্য আপনাকে মরতে হবে না। একটা ভালো কাজের জন্য অর্থের চেয়েও যেটা বেশি দরকার সেটা হল মন। সে মন আপনার আছে। তবে এই দু’দিন আমাদের দুজনকেই খুব সাবধানে থাকতে হবে। যে কোনও সময় মৃত্যু আসতে পারে অগোচরে।”
-“আমার কথাই ফলল তাহলে….” আঁতকে উঠলেন অঘোরবাবু।
-“এত সহজেই ভয় পেয়ে গেলে হবে ? আপনি আর আমি কত কত কঠিন রহস্যের সমাধান করেছি বলুন তো। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন, আর বিশ্বাস রাখুন আমার উপর।”
পর্ব ৬
তিন
রাতেরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর ল্যাপটপটা নিয়ে বসল বিক্রম। ছবিগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষন করতে লাগল। সাথে সাথে চলল উপস্থিত সন্দেহভাজনদের বায়োডাটা আর পাস্ট হিস্ট্রি ঘেঁটে দেখা। বহুকষ্টে এগুলো জোগাড় করেছে সে। এগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে খুনির পরিচয়।
রাত প্রায় দেড়টা নাগাদ ল্যাপটপটা শাটডাউন করে অঘোরবাবুর পাশেই শুয়ে পড়ল বিক্রম । চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে আসছে। পাশেই শুয়ে নাক ডাকছেন অঘোরবাবু । বেচারা মিথ্যা কেসে ফেঁসে গিয়ে খুবই কষ্ট পাচ্ছেন। অঘোরবাবুর দিকে তাকিয়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল ওর।
রাত তখন আড়াইটা মতো, একটা খসখস শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল বিক্রমের। বিছানা থেকে না উঠে চোখ খুলে শব্দের উৎপত্তি সম্মন্ধে আন্দাজ করতে লাগল। কারন উঠে পড়লেই শব্দ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিক্রমের আন্দাজই ঠিক, জানালার নিচের পাল্লার কাঁচ খুলে ফেলা হয়েছে। সেখানে একটা মুখ। অন্ধকারে ঠিকমত বোঝা না গেলেও আন্দাজ করা যায়।
হঠাৎই ছায়ামূর্তিটা একটা হাত মুখের কাছে আনল। সিগারেটের মতো কিছু ধরে ফুঁ দিতেই রেগটা এগিয়ে ধরল বিক্রম । আর সঙ্গে সঙ্গেই ছায়ামূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিছানা হতে উঠে আলো জ্বালতেই বিক্রম দেখল রেগের গায়ে লেগে আছে একটা ডার্ট। পয়েজন ডার্ট। রুমাল দিয়ে চেপে ধরে ডার্টটা খুলে আনল বিক্রম। মুখে তার যুদ্ধজয়ের হাসি। ইতিমধ্যেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেছেন অঘোরবাবু। উনাকে লক্ষ্য করে বিক্রম বলল, “হুকুমের গোলামকে পেয়ে গেছি অঘোরবাবু, বাদশাও আমার নজরে আছে, আশাকরি বিবির মুখোশও খুলে দিতে পারব।”
কিছু না বুঝেই হেসে ফেললেন অঘোরবাবু। বিক্রম যখন জাল গুটিয়ে এনেছে তখন নিশ্চিন্ত হওয়াই যায়।
পরদিন সকালে সবাইকে একজায়গায় জড়ো করল বিক্রম। আজ যবনিকা টানা হবে। বেলা দশটার সময় হাজির হল সবাই। লজের বাগানে চেয়ার পাতা হয়েছে। সামনে টেবিল, টেবিলের উপর জলের জাগ গ্লাস ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস। টেবিলের একপাশে বিক্রম, ইন্সপেক্টর পাকড়াশি আর রিটায়ার্ড জেলাজজ পরিমল ব্যানার্জী । পরিমলবাবু বিক্রমের পরিচিত,বিক্রমের অনুরোধে এসেছেন। টেবিলের অপরদিকে বিক্রমদের মুখোমুখি হয়ে সন্দেহভাজনরা।
পরিমলবাবুই শুরু করলেন –
“আপনারা অবগত আছেন যে এই লজের মধ্যে দু’দুজন রহস্যময়ভাবে খুন হয়েছেন। আর এই খুনের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমার পরিচিত স্বনামধন্য গোয়েন্দা শ্রী বিক্রমাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের উপর। উনি সেই দুরূহ কাজ প্রায় সমাধান করে এনেছেন। আজ উনি আততায়ীর মুখের উপর হতে মুখোশ খুলে দেবেন।”
‘ মুখোশ খুলে দেবেন’ কথাটা শোনামাত্রই সন্দেহভাজনদের মধ্যে বিচলিত ভাব দেখা গেল। তারা একে অপরের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। ফিসফাস আলোচনাও শুরু করেদিল অনেকে। পরিমলবাবু বলে চললেন,
“আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে গোটা ঘটনার সাক্ষী থাকার জন্য, যাতে সমস্ত ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপে সহায়তা করতে পারি। এখানকার সমস্ত ঘটনার ভিডিও রেকর্ডও করা হচ্ছে। পরবর্তীতে এই ভিডিওগ্রাফি সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আমি বিক্রমকে অনুরোধ করছি তার কাজ শুরু করতে।”
বিক্রম উঠে দাঁড়াল। শুরু করল তার তদন্তের বিশ্লেষণ।
“আজ আমরা সমবেত হয়েছি স্বর্গীয় শশীকান্ত রায় ও চান্দ্রেয়ী সামন্তর হত্যারহস্য উন্মোচনে । আপনারা সবাই জানেন যে শশীকান্তবাবুর হত্যার পরের দিন এই অঘোরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হয়। কারন অঘোরবাবুর জামাতে শশীকান্তবাবুর রক্তের ছিটে পাওয়া গিয়েছিল। ফরেন্সিক রিপোর্টেও এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
অঘোরবাবুর মুখে অসহায়তা ফুটে উঠল। কারোর দিকে তাকানোর মতো মনের জোর তার নেই। কয়কশ’ উন্মত্ত লোক বুকের মধ্যে মাদল বাজাচ্ছে একনাগাড়ে। এরই মধ্যে বলে চলেছে বিক্রম।
“…. অঘোরবাবুর পরেই যার উপর সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে তিনি হলেন ‘অলিভার কলেজ ফর উইমেন’ এর প্রিন্সিপাল মিস মাধবী রায়। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ইনি। আগেরবছর পাঁচ ছাত্রী ও এক কলিগ নিয়ে এই লজেই উঠেছিলেন। আর খুবই দুঃখজনক ভাবে উনার এক কলিগ ও এক ছাত্রী খুন হন। এখানেই। সন্দেহের বশে শশীকান্তবাবু সমেত অনেককেই গ্রেফতার করা হয় কিন্তু তথ্যপ্রমাণও ও মোটিভের অভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই হতেই শশীকান্তবাবুর উপর রাগ মিস রায়ের। অন্তত সেরকমই জাহির করে তিনি।”
-“কি বলতে চাইছেন আপনি ? আমার কলিগ আমার ছাত্রী এদের জন্য আমার শোক লোকদেখানো ? আসলে মানুষের ইমোশনগুলো বোঝার ক্ষমতাই নেই আপনার।” গর্জে উঠলেন মাধবী।
বিক্রম হাসিমুখে বলল,”সবার সব ক্ষমতা থাকে না। যেমন এলএসডি হজম করার ক্ষমতাও সবার হয় না। যে এলএসডি জলের সাথে সামান্য পরিমাণে মিশিয়ে দিতেই রাতের সব ঘটনা ভুলে গেলেন অঘোরবাবু, আর আপনি ওর চেয়েও বেশি পরিমাণে ওই ড্রাগ প্রতিদিন নেন। ”
-“মিথ্যে কথা….” লাফিয়ে উঠলেন মাধবী।
স্যাম্পল প্যাকেটে ভরা একটা ছোট্ট চৌকোমতো বাক্স বের করে বিক্রম বলল,”আমি যে সত্যি এটা তার প্রমাণ। এই বাক্সটার উপরে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও বাক্সের ভেতরের এলএসডির বোতলের গায়েও যথেষ্ট পরিমাণে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। একডোজ এলএসডির দাম পাঁচশ হতে পাঁচহাজার টাকা। আপনার যা আয় তাতে তো এই ড্রাগের নেশা করা সম্ভব নয়। আয়ের উৎসটা কি ?”
চুপ করে বসে গেলেন মাধবী। তার চিৎকার বন্ধ। মাধবীকে চুপ দেখে বিক্রম বলল,”ড্রাগ পাচার। মোটা কমিশন পেতেন আপনি। আর আপনার এই ছাত্রী কাম কলিগেরা সবাই কোনও না কোনও ভাবে এই সিস্টেমের সাথে যুক্ত। হয় পাচারকারী নয় গ্রাহক।”
কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল কেকা। হেসে ফেলল বিক্রম। বলল, “সব জানি। আর জানি বলেই কাল রাতে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। বরাতজোর বেঁচে গেছি। তবে চান্দ্রেয়ী সামন্তর সে সৌভাগ্য হয়নি, সে সৌভাগ্য হয়নি শশীকান্তবাবু বা পাঁচবছর আগে খুন হওয়া দুই হতভাগ্যের। মুখ খুলতে চাওয়ায় সরিয়ে দেওয়া হল তাদের ।”
আঁতকে উঠলেন ইন্সপেক্টর। চোখদুটো বড় বড় করে বললেন, “বলেন কি বিক্রমবাবু, আপনার উপর হামলা হয়েছে ! তবে খুব উপকার করলেন আমার। এই ড্রাগের চক্রটা বহুদিন ধরেই আমাদের জ্বালাচ্ছিল, ধরতে না পারলে মুখরক্ষাই দায় হয়ে যেত।”
একটু হেসে বিক্রম বলল,”সবার মুখের দায়িত্বই এখন আমার। মুখরক্ষা আর মুখের মুখোশ খোলা, এই দুটোই সত্যান্বেষীর কাজ। এটা আমাকে ঠিকঠাক করে করতেই হবে। সে যাই হোক, চান্দ্রেয়ীদেবীর মতো অনেকেই চান এই চক্র ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। আর সেখানেই মুশকিল। এই দুষ্টচক্রে ঢোকা যায় কিন্তু বেরোনো যায় না। গোপনকথা জানতে পারলেই মৃত্যু নিশ্চিত। কি কেকা দেবী, ঠিক বলছি তো ?”
শেষ পর্ব
উঠে দাঁড়াল কেকা বোস। উষ্মাজড়িত গলায় বলল,”গোয়েন্দাগিরির মানেই যাকে দেখব তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা নয়, আমার মনে হয় আপনি ভুল পথে হাঁটছেন।”
কেকার কথা মন দিয়ে শুনছিল বিক্রম, কথা শেষ হতেই শুরু করল সে। বলল,”আমি সবাইকেই সন্দেহ করছি। এটাই আমার কাজ। তবে আপনাকে একটা জিনিস দেখাই ম্যাম…”
ব্যাগের ভেতর হতে একটা ফাইল বের করল বিক্রম, আর একটা স্যাম্পল ব্যাগে কিছু চুড়ির টুকরো । চুড়ির টুকরোগুলো সামনে ধরে বিক্রম বলল, “এটা সেই চুড়ির টুকরো যেগুলো শশীকান্তবাবুর ঘর হতে পাওয়া গেছে। সবুজাভ চুড়িগুলোকে চিনতে পারেন কিনা দেখুন তো ম্যাম।”
গুম হয়ে বসে রইল কেকা। বিক্রম বলল, “আমার দৃষ্টিশক্তি যদি খুব খারাপ না হয় তবে এরকম চুড়ি আপনার হাতেই যেন দেখতে পাচ্ছি।”
-“কেন, সবুজ রঙের চুড়ি পড়ায় নিষেধ আছে নাকি !!”
-“না তা নেই, তবে চুড়ি বিক্রি হয় ডজনে, আর আপনার দু’হাত মিলিয়ে মোট চুড়ি আছে এগারোটা। একটা হাতে একটা চুড়ি কম। আর সেই চুড়িটাই পাওয়া অকুস্থলে গেছে। ”
-“তার মানে খুনগুলো আমি করেছি ?”
বিক্রম হাসল। বলল,”সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে আপনার বিরুদ্ধে আরও কিছু প্রমাণ আছে মিস বোস, যেগুলো প্রমাণ করে যে খুনের রাতে শশীকান্তবাবুর ঘরে আপনি গিয়েছিলেন। যেমন খাটের গায়ে লিপস্টিকের দাগ। অসাবধানে পড়ে গিয়েছিলেন সম্ভবত। এছাড়াও অজস্র ফিঙ্গারপ্রিন্ট।”
এবার ভেঙ্গে পড়ল কেকা। বলল,”হ্যাঁ আমি গিয়েছিলাম। সবাই শুয়ে পড়ার পর গিয়েছিলাম শশীকান্তবাবুর কাছে। কিছু কথা বলার ছিল উনাকে। আর সেজন্যই গিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি পৌঁছেই দেখি শশীকান্তবাবু দরজার সামনে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। বুকের কাছটায় বিঁধে রয়েছে একটা ছুরি। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই কে যেন দৌড়ে পালিয়ে গেল। খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। লোকটাকে অনুসরণ করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম খাটের উপর। সম্ভবত তখনই চুড়িটা ভেঙ্গে গিয়েছে। “
কেকাকে বসতে বলে বিক্রম শুরু করল আবার।
“এরপরের সন্দেহভাজন হলেন এই লজের পরিচারিকা বিজয়ামাসি। বিজয়ামাসি জেনে বা না জেনে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন । আচ্ছা মাসি, এত লোক থাকতে হঠাৎ অঘোরবাবুর উপর এত দরদ উথলে উঠল কেন আপনার ? সে রাতে জলে কি মিশিয়েছিলেন ?”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠল বিজয়া। বলল, “আমি কিচ্ছুটি জানি না গো সাহেব, ওই জেসমিন না কি যেন নাম, ওই আমাকে জলের জগটা দিয়ে বলেছে, বুড়োটাকে দিয়ে আসতে।”
জেসমিনের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল বিজয়া। জেসমিন উঠে বলল,”কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না আমার। আজ হতে পাঁচ বছর আগে অঘোরবাবুর ঘরেই উঠেছিলাম আমি। আমি আর মোহনা। মোহনাকে নৃশংসভাবে খুন হতে হয়। মরার আগে ও কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছিল। ওই ঘরেই। অঘোরবাবুকে অজ্ঞান করে জিনিসটা খোঁজার ইচ্ছা ছিল আমার।”
-“আর অঘোরবাবুকে অজ্ঞান করতে জলে মেশালেন এলএসডি। ” বিক্রম ব্যঙ্গ করে বলল।
-“কখনোই না। জগের জলে কেবল ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিলাম, এলএসডি নয়।”
-“তার একটাই মানে দাঁড়ায়, মাঝপথে জগের জলটা পাল্টে ফেলা হয়েছে। কি মাসি কিছু মনে পড়ছে ?”
বিক্রমের কথায় ভাবনার অতলে তলিয়ে যায় বিজয়া। অনেক ভেবে বলে,”হ্যাঁ, ওই বুড়োবাবুর ঘরে যাওয়ার সময় চান্দ্রেয়ী দিদিমণি এসে বলল উনার মানিব্যাগটা বাগানে পড়ে গেছে, ভয়ে যেতে পারছেন না। জগটা নামিয়ে রেখে গেলাম। কিন্তু ব্যাগফ্যাগ কিছু পাইনি বাবু।”
-“হুম্.. আর সেই সূযোগেই….. .”
-“কিন্তু চান্দ্রেয়ী যদি ষড়যন্ত্রে জড়িত হয় তাহলে নিজে মরল কেন ?” ইন্সপেক্টরের সহজ প্রশ্ন।
বিক্রম হেসে বলল,”ওই যে বললাম মুখ খুলতে চেয়েছিলেন তিনি। সে যাইহোক চান্দ্রেয়ীদেবীর ড্রাগ মেশানো জল খেয়ে নেশার ঘোরে বিছানা হতেই উঠতে পারলেন না অঘোরবাবু। আর এতেই পণ্ড হতে বসল আততায়ীর পরিকল্পনা। সে চেয়েছিল অঘোরবাবুকে শশীকান্তবাবুর লাশের কাছে এনে ছুরিখানা ধরিয়ে দিয়ে প্ল্যানটাকে ফুলপ্রূফ করা। কিন্তু অঘোরবাবুকে ঘুমোতে দেখেই শশীকান্তবাবুর রক্ত এনে অঘোরবাবুর জামায় ছিটিয়ে কাজ সারল সে।”
-“কিন্তু অঘোরবাবুর ঘর তো ভেতর হতে বন্ধ ছিল। ” বললেন ইন্সপেক্টর ।
বিক্রম বলল,”খুনি পেছনদরজার লোক। সে সচরাচর জানালা দিয়েই যাতায়াত করে। লজের গরাদবিহীন জানালাগুলো তাকে এ ব্যাপারে যথেষ্টই সাহায্য করে । আর এপথে এসেই সে আমার উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ চালিয়েছে। নেহাত আমার কপাল ভালো তাই যমের দুয়োরের কাছ হতে ফিরে এসেছি।”
-“সে তো বুঝলাম মিঃ মুখার্জি, কিন্তু আপনার গালগল্পের ভেতরে খুনি কই ?” বললেন মাধবী।
বিক্রম বলল,”মধ্যরাতের সেই ঘাতক আমাদের সঙ্গেই আছে মিস রায়। কি মনোজ….. “
আর কিছু বলার আগেই লাফিয়ে উঠল মনোজ, তারপর দৌড়দিল দরজার দিকে। ইন্সপেক্টর পাকড়াশি রিভলভার বের করে ট্রিগারে চাপ দিলেন। কিন্তু সেই মূহুর্তেই লাফিয়ে পড়ল বিক্রম। ইন্সপেক্টরের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগল বাগানের বাতিস্তম্ভে লাগান বাতির উপর। টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেটা।
পিস্তলটা ছিনিয়ে নিয়ে বিক্রম বলল, “অত তাড়াহুড়োর কি দরকার পাকড়াশি, বাইরে তো পাহারা আছেই। তাছাড়া ওকে মেরে ফেললে তো কেস শেষ।”
প্রহরারত কনস্টেবলরা ধরে নিয়ে এল মনোজকে। একটু জেরা করতেই সব স্বীকার করল মনোজ। শশীকান্তবাবু আর চান্দ্রেয়ী দেবীকে ওই খুন করেছে। অঘোরবাবুর জামাতে রক্তমাখানো বা বিক্রমকে পয়েজনডার্ট দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা সবই মনোজের কাজ।
-“তাহলে তো কেস ক্লোজ। আমি মনোজকে নিয়ে যাচ্ছি।” উঠে পড়লেন ইন্সপেক্টর।
বাধা দিয়ে বিক্রম বলল, “আরে ভাই এত তাড়াতাড়ি কেন ! কেস এখনও ক্লোজ হয়নি। যে ড্রাগমাফিয়াদের জন্য চার চারটে খুন হল সেই ড্রাগচক্রের মাথাকে ধরতে হবে না।”
-“সবাই তো ধরা পড়ে গেছে। আর এদের জেরা করে মাথাটাকে বের করার দায়িত্ব আমার। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বিক্রম।”
বিক্রম হেসে বলল, “জেরাটেরার দরকার নেই, আসল মাথাটাকে আমি খুঁজে বের করেছি।”
-“কে সে…? ” একযোগে বলে উঠল মাধবী আর কেকা।
ইন্সপেক্টর পাকড়াশির দিকে আঙুল উঠিয়ে বিক্রম বলল,”ইনিই হলেন আপনাদের বস ইন্সপেক্টর অমিয় পাকড়াশি ওরফ ‘কালোহাত’ । এর স্বপক্ষে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ আমি জোগাড় করেছি। মোবাইলের কলরেকর্ড, লোকেশন, সবই আমার দাবিকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। এমনকি ডিলিংয়ে ব্যবহৃত টোকেনের উপরে পাকড়াশির ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলেছে। বড় কাঁচা কাজ করে ফেলেছেন আপনাদের বস। কই এসডিপিও সাহেব ভেতরে আসুন।”
এসডিপিও জগমোহন মেহেতা ভেতরে এলেন। এতক্ষণ বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। হাতে ওয়ারেন্ট। আজ সকালেই সমস্ত তথ্য প্রমাণ মেল করে দিয়েছিল বিক্রম। সব অকাট্য প্রমাণ।
ইন্সপেক্টর পাকড়াশি সহ বাকি অভিযুক্তদের অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়া হল। যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে অঘোরবাবু বললেন, “দুগ্গা দুগ্গা….. ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। চল বিক্রম।”
বিক্রম বলল, “কোথায় ? ঘটকানন্দের কাছে ? “
অঘোরবাবু বেজারমুখে বললেন, “হ্যাঁ। ব্যাটাকে ধরতে হবে। ওর যজ্ঞের জন্যই এতগুলো কনে হাতছাড়া হয়ে গেল।”
হো হো করে হেসে উঠল বিক্রম।