Ali Reza

জহির রায়হানের বরফ গলা নদী : মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রাম
আলী রেজা

কথাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের আধুনিক আঙ্গিক। এ আঙ্গিক বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছে সর্বস্তরের পাঠকের কাছে। উপ¯’াপন করেছে সামাজিক নানা প্রপঞ্জ। কথাসাহিত্যের মূল উপাদান সামাজিক মানুষ। ব্যক্তি ও সমাজ নিয়েই মূলত কথাসাহিত্যের কাহিনি নির্মিত হয় এবং প্রবাহমান নদীর মতো বয়ে চলে ঘটনা পরম্পরা। কথাসাহিত্যে যে ব্যক্তিমানুষের উপ¯ি’তি সে ব্যক্তিমানুষ একটি সামাজিক বলয়ে বেড়ে ওঠে। সমাজ কখনো ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার কখনো ব্যক্তি বিশেষই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজকাঠামোয় বিদ্যমান নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ একটি আন্ত:সম্পর্কের জাল বুনে আসছে সমাজব্যব¯’ার সেই আদিপর্ব থেকেই। তবে মানবগোষ্ঠীর আন্ত:সম্পর্ক মানুষকে সাম্যবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ করতে পারে নি। ফলে মানুষ একে অন্যের থেকে ভিন্ন হতে চেয়েছে। এই ভিন্ন হওয়ার আকাক্সক্ষাই মানুষের ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ব মূলত মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনা। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনা মানুষের চিন্তার জগতকে করেছে বহুমুখী, বহুধাবিভক্ত।

এই বহুমুখী চিন্তার আদান-প্রদান প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে চলতে কিছু মানুষের চিন্তা অভিন্ন রূপ লাভ করে। এই অভিন্ন চিন্তাই একটি শ্রেণিচেতনার জন্ম দেয়। শ্রেণিচেতনা এক সময় শ্রেণিসংগ্রামে রূপ নেয়। আর শ্রেণিসংগ্রাম মানেই জীবনসংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম মধ্যবিত্তের জীবনকেই করে তোলে সংকটময়। মধ্যবিত্তের জীবনে সমম্যা ও সম্ভাবনা দুটোই থাকে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি চায় অব¯’ান পরিবর্তন করে উ”চবিত্তের শ্রেণিতে উঠে আসতে। উ”চবিত্তরা সামাজিক অব¯’ান ধরে রাখে আর নি¤œবিত্তরা অপারগ বলে অব¯’ান পরিবর্তনের চিন্তাই করে না। সুতরাং পরিবর্তনবাদী জীবনসংগ্রাম মধ্যবিত্তের জীবনের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রাম কথাসাহিত্যের একটি প্রধান উপাদান। কথাসাহিত্যিক চলমান ঘটনা সম্বলিত যে সমাজচিত্র অঙ্কন করেন তাকে শ্রেণিচরিত্রের রূপায়ণ ঘটে। কথাসাহিত্যে প্রতিফলিত ব্যক্তিচরিত্র মূলত শ্রেণিচরিত্র। শ্রেণিচরিত্র যে সংকটের জন্ম দেয় তা প্রকৃতপক্ষে সামাজিক মানুষের সংকট। এই সংকটে কখনো জড়িয়ে যায় রাষ্ট্র ও ধর্ম। রাষ্ট্র ও ধর্ম মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাকে দলিত করে একক আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। সেখানেও সৃষ্টি হয় আর এক নতুন সংকট। এভাবে সামাজিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকট থেকে শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিচেতনা থেকে শ্রেণিসংগ্রাম কথাসাহিত্যের প্রধান উপজীব্য হয়ে ওঠে।

গল্প, ছোটগল্প ও উপন্যাসের আঙ্গিকে আধুনিককালে নির্মিত হয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের বিশাল ভা-ার। কথাসাহিত্যের এই ভা-ারে কালগত বিবেচনায় প্রথম উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয় হ্যানা ক্যাথারিন ম্যালেন্স’র ফুলমনি ও করুণার বিবরণ গ্রš’টি। তবে উপন্যাসের সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে সার্থক উপন্যাস হিসেবে প্রথম মুকুট লাভ করে প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩ খ্রি.)’র আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮)। কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০ খ্রি.)’র হুতোম প্যাঁচার নকশাও(১৮৬২) উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪) বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম শিল্পমান বিবেচনায় সফল উপন্যাস রচনা করেন। পরবর্তীতে বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ ১৯৪১ খ্রি.) ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮ খ্রি.) কথাসাহিত্যকে সামাজিক কুসংস্কার, সমাজবাস্তবতা ও রাষ্ট্রব্যব¯’ার নানা অলিগলি ঘুরিয়ে আনেন। ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সংকটের সাথে সমাজব্যব¯’ার সাংঘর্ষিক রূপ তুলে ধরেন।
বাংলা কথাসাহিত্যে একদিকে শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব আর অন্যদিকে ব্যক্তিসংকটের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা হলেন ১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১ খ্রি.) ২. বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০ খ্রি.) ও ৩. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬ খ্রি.)। প্রেম-বিরহ, আশা-নিরাশা, ব্যর্থতা-হতাশা, দারিদ্র, ব না ও মনোবিকলনের চিত্র নির্মাণ করেছেন এঁরা। সেলিনা হোসেন সম্পাদিত বাংলা একাডেমী চরিতাভিধানে তারাশঙ্করের উপন্যাসের বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে :

তাঁর উপন্যাসে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্ব- সে দ্বন্দ্বে জমিদার শ্রেণীর পরাভব ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ী শ্রেণীর বিজয়, যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে কৃষিসভ্যতার বিরোধ- সে বিরোধে গ্রামীণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভাঙন ও শিল্পকেন্দ্রিক শহুরে অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা, গ্রামীণ সমাজের শাসন-সংস্কার ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ, জমিদার ও ধনী চাষির সঙ্গে গরিব চাষির বিরোধিতা- সে বিরোধে প্রবলের কাছে গরিবের আত্মসমর্পণ, পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশবিভাগ, অর্থনৈতিক বৈষম্যের নির্লজ্জ বিস্তার, যুব সম্প্রদায়ের ক্রোধ, অ¯ি’রতা, বিদ্রোহÑ সব মিলিয়ে গোটা রাঢ় অ লের গ্রামীণ জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্র্যয় এবং তারই মাঝে গোটা মানুষের অভ্যুদয় নিপুণভাবে উপ¯’াপিত।

এখানে শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব মধ্যবিত্তের জীবনকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে তুলেছে। মধ্যবিত্তের আশা-আকাক্সক্ষা এবং জীবনসংগ্রাম বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ দিক। মধ্যবিত্তের মনস্তাত্ত্বিক সংকট ও যৌনবিকলন আর শ্রেণিচেতনা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য।

বাংলা কথাসাহিত্যে ব¯‘বাদ, অস্তিত্ববাদ আর সামাজিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়ের শব্দচিত্র এঁকেছেন সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১ খ্রি.), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮ খ্রি.), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১ খ্রি.), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩ খ্রি.) প্রমুখ। নগর জীবনের চালচিত্র, নৈতিক অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, জীবিকার সন্ধান বা জীবনযুদ্ধ এঁদের উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, নাগরিক জীবনের নানাবিধ জটিলতা, শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসংগ্রাম ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগ পরবর্তী কথাসাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনায় রচিত হয় বেশকিছু উৎকৃষ্ট কথাসাহিত্য। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কিংবা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত হয় জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধ কথাসাহিত্য। নজিবুর রহমান (১৮৭৮-১৯২৩ খ্রি.), কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬ খ্র্রি.), আবু ইসহাক, আকবর হোসেন (১৯১৫-১৯৮১ খ্রি.), সত্যেন সেন প্রমুখ বাংলা কথাসাহিত্যের যে সমৃদ্ধ ভিত্তি রচনা করেছিলেন সেই ধারার মূল বৈশিষ্ট্য হলো : বিকাশমান বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ, সমাজের প্রতি প্রচ- দায়বোধ, যন্ত্রণাক্লিষ্ট ব্যক্তিজীবন ও তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২ খ্রি.) সেই বিকাশমান সমৃদ্ধ ধারার সুযোগ্য উত্তরসূরী। নজিবুর রহমানের আনোয়ারা (১৯১৪) ও গরীবের মেয়ে (১৯২৩), কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ (১৯২৬), আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী, আকবর হোসেনের অবাঞ্ছিত ও কি পাইনি, সত্যেন সেনের পদচিহ্ন এবং শহীদুল্লাহ কায়সারের সারেং বৌ- এর জহির রায়হানের বরফ গলা নদী (১৯৬৯)একই সামাজিক দায়বোধের প্রতিফলন।

বরফ গলা নদী উপন্যাসের শুরুতেই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সরু রাস্তা, সরু রাস্তার প্রধান বাহন রিকশা আর চারপাশের নোংরা পরিবেশ- এ সবই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাপিত জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। মধ্যবিত্তের বসবাস চাপা গলি বা সরু রাস্তার ধারে, তাদের প্রধান বাহন রিকশা আর তাদের চারপাশের পরিবেশ নোংরা আবর্জনায় ভরা; কারণ সিটি করপোরেশনের গার্বেজ ভ্যান সরু গলিতে কমই যায়। কলার খোসা, মাছের আঁশ, মরা ইঁদুর আর ছেলে-মেয়েদের মলমূত্র- এসব অসুবিধা ঘিরে থাকে মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক জীবন।

উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে ভবন ধসে যে মৃত্যুর ঘটনা সেটাও মধ্যবিত্ত জীবনেরই পরিণতি। কারণ, বিলাসবহুল অভিজাত এলাকার বদলে মধ্যবিত্তের বসবাসের জায়গা হয় জরাজীর্ণ পুরোনো ভবনে। অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার কারণে এ ভবনগুলো বেছে নেয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সুতরাং উপন্যাসের শেষ দৃশ্যেও মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রামের চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে।

মাহমুদ ও মরিয়ম সহোদর ভাইবোন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। হাসিনা, দুলু ও খোকনও ওদের ভাইবোন। মা বাবা আছে। সব মিলে সাতজনের সংসার। সংসারের খরচের সঙ্গে আছে সামাজিকতা, আছে অতিথি আপ্যায়ন। সব মিলিয়ে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা- এ এক কঠিন জীবনসংগ্রাম। অতিথি বেড়াতে এলে আপ্যায়নের জন্য ঘরে কিছু না থাকাটা মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বাভাবিক ঘটনা। মরিয়মের বান্ধবী মিলি বেড়াতে এলে এ প্রসঙ্গে ঘরের কর্ত্রী সালেহা বিবির বিব্রতকর উক্তি :

(কোন কিছু) থাকবার কি উপায় আছে ওই দুলু আর খোকনটার জন্যে। কাল মাহমুদ কিছু বিস্কুট এনেছিলো, সাধ্য কি যে লুকিয়ে রাখবো, আজ সকালে বের করে দুজনে খেয়ে ফেলেছে।

এই আর্থ-সামাজিক অব¯’া মাহমুদের মনে শ্রেণিচেতনার জন্ম দেয়। মাহমুদ শিক্ষিত। একটি পত্রিকায় সাব-এডিটর পদে চাকরি করে। আদর্শ সাংবাদিক হওয়ার বাসনা লালন করে মনে। মরিয়মও শিক্ষিত। স্কুলের চাকরিতে আবেদন করে বসে আছে চাকরিটার অপেক্ষায়। টিউশনি করে নিজে চলে। ছোট ভাইবোনদের আবদার পূরণ করে। সাংবাদিক হিসেবে মাহমুদ উচুতলার আদর্শহীন মানুষদের জানে। তাদের আদর্শহীন জীবনের প্রতি মাহমুদের তীব্র ঘৃণা আছে। মাহমুদের বন্ধু মহলের সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির। উ”চবিত্তের সাথে যৌক্তিক দুরত্ব বজায় রেখে চলে মাহমুদ। মরিয়ম টিউশনি করে বড়লোকের বাসায়। এটা মাহমুদের পছন্দ নয়। তবু মেনে নেয়। কারণ মাস শেষে কিছু টাকা পায় মরিয়ম। নিজে চলে। সংসারে সাপোর্ট দেয়। বড় ভাই হিসেবে মাহমুদ ছোট ভাইবোনদের ছোট-খাট আবদার সব সময় পূরণ করতে পারে না। এজন্য মনে মনে বিব্রতবোধ করে। চাপা গলির জীর্ণ একটি ভবনে বসবাস করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বাসাটাও বদলানো দরকার।

মধ্যবিত্তের আত্মসম্মান প্রবল। সেই আত্মসম্মান বাঁচাতে হলে টাকার প্রয়োজন। কিš‘ শিক্ষা শেষে ভাল চাকরি কোথায়? এ রকম হাজারটা সংকট বয়ে বেড়ায় হাসমত আলীর পরিবারের সদস্যরা। হাসমত আলী পরিবার নিয়ে যে গলিতে থাকে ঔপন্যাসিক সে গলির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :

শহরে সন্ধ্যা নামার অনেক আগে এখানে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বাইরে যখন বিকেল, এ গলিতে তখন রাত। আর বাইরে যখন ভোর হয়, তখনো এ গলিতে তমি¯্রায় ঢাকা থাকা। অনেক বাধা ডিঙিয়ে, অনেক প্রাসাদের চুড়ো পেরিয়ে তবে এখানে প্রবেশের অধিকার পায় সূর্য। এ-পাড়ার বাসিন্দাদের বড় সাধনার ধন সে। তাই বেলা দুপুরে যখন এক চিলতে রোদ এসে পড়ে এই হীন দালানগুলোর ওপর, তখন তার বাসিন্দারা বড় চ ল হয়ে ওঠে। ভিজে কাপড়-চোপড়গুলো রোদে বিছিয়ে দেয় তারা। খানিক পরে ধীরে ধীরে আবার সূর্যটা পশ্চিমে নেমে যায়। কে যেন জোর করে টেনে নিয়ে যায় তাকে। তখন এখানে অন্ধকার। অন্ধকার শুধু।

শুধু হাসমত আলীর পরিবার নয়- এ গলির সবাই মধ্যবিত্ত। আর্থ-সামাজিক সংকটের মতো মধ্যবিত্তের প্রেম-ভালবাসাও সংকটাপন্ন। তাই ভালবেসে প্রতারিতও হতে হয় কখনো কখনো। উ”চবিত্তরা কখনো গ্রহণ করে করুণা করে, কখনো ঠেলে দেয় দূরে। আত্মসম্মানবোধের কারণে নি¤œবিত্তের বিশেষ সম্পর্ক রাখতে চায় না মধ্যবিত্ত। তাই দেখা যায় মধ্যবিত্তের শ্রেণিচেতনা অত্যন্ত প্রবল।
মরিয়মের সাথে একদিন ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জাহেদের। জাহেদকে ভালবেসে ঘর ছেড়েছিল মরিয়ম। কিš‘ আর্থিক সংকটে সে ভালবাসায় বি”েছদ ঘটে। জাহেদ পালিয়ে যায়। মরিয়ম ফিরে আসে ঘরে। তারপর মনসুর ভালবাসে মরিয়মকে। কিš‘ মাহমুদ বিষয়টি মেনে নিতে পারে না। মনসুরের মতো উ”চবিত্তদের মাহমুদ ভয় পায়, ঘৃণা করে। মাহমুদ মনে করে উ”চবিত্তদের কোন নীতি নেই, কোন আদর্শ নেই। ধনতান্ত্রিক সমাজে এরা শুধু ধনের পেছনে ঘোরে। ভালবাসা এদের জীবনে গৌণ বিষয়। মাহমুদের প্রতিবাদে মরিয়ম মনসুরকে ভালবেসেও দূরে থাকে। এটা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সংকট। তবে মধ্যবিত্তের জীবনে প্রতিটি সংকটেই এক ধরনের সম্ভাবনা থাকে। সম্ভাবনাগুলো খুব কাছাকাছি অব¯’ান করে। তাই সংগ্রাম থামে না মধ্যবিত্তের জীবনে। এই বুঝি সংকট কেটে গেল কিংবা এটা হলেই কোন সংকট থাকবে না- এ রকম একটা দোলাচলের মধ্যে মধ্যবিত্তের অব¯’ান। মরিয়মের চাকরি হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়। মাহমুদের ভাল কিছু হতে পারে। এই সম্ভাবনার কারণেই মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রাম থামে না। আশা নামক অনিশ্চয়তা তাড়িত করে মধ্যবিত্তের জীবনকে। এই অন্ধকারে আশার আলো আর আশা ভঙ্গের আশংকা বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক :

চারপাশে তাকালে এই অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। সিগারেটের মাথায় শুধু এক টুকরো আলো। বিড়ালের চোখের মতো জ¦লছে। আশা নামক মানুষের আদিম প্রবৃত্তিটিও বোধ হয় চিরন্তন এমনি করে জ¦লে। পাশ ফিরে শুয়ে মাহমুদ ভাবলো। প্রধান সম্পাদক আজ কথা দিয়েছেন, আসছে মাস থেকে দশ টাকা বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হবে তার। যদি তিনি তার কথা রাখেন তাহলে, সেই বাড়তি দশ টাকা প্রতি মাসে ভাইবোনদের জন্যে খরচ করবে মাহমুদ। আর যদি ছলনার নামান্তর হয় তাহলে?

মধ্যবিত্তকে কেউ দূরে ঠেলে দেয় না। কারণ, এই শ্রেণির মধ্যে আছে অনেক সম্ভাবনা। উপরে ওঠার সম্ভাবনা। কেউ আবার তেমন করে কাছেও নেয় না। কারণ এদের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তাই এক ধরনের দোদুল্যমান অব¯’ান বয়ে বেড়ায় আমাদের মধ্যবিত্ত। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার খোদাবক্স তাই অনি”ছা সত্ত্বেও মাহমুদকে বাকী খাওয়ায়। টাকার জন্য অতটা চাপ দেয় না। মাহমুদের বন্ধু রফিক ও নঈম। ওরাও ভাল কোন চাকরি খুঁজছে। আর এক বন্ধু শাহাদত প্রেসের ব্যবসা করছে। ব্যবসায়ী বলে বিয়েটাও হয়ে গেছে আগেই। মাহমুদ, রফিক ও নঈম বিয়ের পিঁড়িতে বসে নি আজও। মধ্যবিত্তের বিয়ের ক্ষেত্রেও মেলাতে হয় অনেক হিসেব। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার খোদাবক্স ওদের বিয়ের কথাও ভাবে। চাকুরে, ব্যবসায়ী, কেরানি- সব শ্রেণির পরিবারের মেয়েদের খবর রাখে খোদাবক্স। বড়লোকের মেয়েদের সঙ্গে ঝুলে পড়ার পরামর্শ দেয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলেদের বিয়েভাবনার ক্ষেত্রে বড়লোকের মেয়ের কথা বিবেচনা করে অনেকে। বড়লোক মেয়ের বাবাও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ছেলে খোঁজে যাতে জামাইকে নিজের মতো করে চালাতে পারে। এটাও এক ধরনের মানসিক সংকট। এখানেও মধ্যবিত্তের আত্মসম্মান রক্ষা করা একটি বড় ব্যাপার। শ্রেণিচেতনা এখানেও মধ্যবিত্তের জীবনকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে এবং এক মানসিক সংগ্রামে জড়িয়ে যায় মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন। মরিয়ম মনসুরকে ভালবেসেও এই শ্রেণিচেতনার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে না। শ্রেণিচেতনা মানুষের সহজাত বিষয়। এই চেতনা মানুষের সামাজিক ও মানসিক অব¯’ান নির্দেশ করে। মাহমুদ ও মরিয়ম নি¤œপদ¯’ কেরানির সন্তান। আর্থিক সংকটে মানসিকভাবেও দুর্বল ওরা। পরিবারের কর্তা হিসেবে হাসমত আলীকে আরো বেশি দুর্বল থাকতে হয়। হাসমত আলীর দুর্বলতা প্রকাশ পায় এভাবে :

বড় ছেলে মাহমুদ। … বছর তিনেক হলো বি.এ পাশ করেছে। তার এই গ্রাজুয়েট হবার পেছনে, নিজের কোনো অবদান খুঁজে পান না হাসমত আলী। পত্রিকায় চাকরি করে নিজের টাকায় পড়েছে মাহমুদ। মেট্রিক পাশ করার পর বাবার কাছে বেশি কিছু দাবি করেনি। দাবি করলেও দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ।… তাই মাহমুদের নিজের ই”ছার ওপরে কোনোরকম খবরদারি করার সাহস পান না তিনি। জোর করে কিছু নির্দেশ দেবার পিতৃসুলভ ই”েছ থাকলেও তাকে দমন করেন হাসমত আলী। নিজেকে অপরাধী মনে হয় ছেলের কাছে।
মরিয়মের কাছেও অপরাধী হাসমত আলী। মেট্রিক পর্যন্ত ওর পড়ার খরচ জুগিয়েছেন তিনি, তারপর এ-বাড়ি ও-বাড়ি ছাত্রী পড়িয়ে কলেজে পড়েছে মরিয়ম।

মরিয়ম যে চাকরিটার অপেক্ষায় ছিলো সেটি হয় নি। তবে এই সময়ের মধ্যে মনসুরের সাথে মানসিক দুরত্বটা কমেছে। মরিয়ম আর মনসুরের সম্পর্কটা মাহমুদ কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না শুধুমাত্র শ্রেণিচেতনার কারণে। মনসুর উ”চবিত্তের। মাহমুদরা মধ্যবিত্তের। এই শ্রেণিব্যবধানের দেয়াল কখনো ভাঙে না। এটা মাহমুদ জানে বাইরের জগতে হেঁটে। মরিয়মের সাথে মনসুরের সম্পর্ক পরিবারের অন্য সবাই মেনে নিতে চাইলেও মাহমুদ তা পারে না। তাই সালেহা বিবি যখন বলেন ‘সব বড়লোক এক হয় না’ মাহমুদ তখন চিৎকার করে বলে :

কটা বড়লোক তুমি দেখেছো শুনি? কোন বড়লোকের ছেলেকে দেখেছো বি.এ পাশ করে পঁচাত্তর টাকার চাকরির জন্যে মাথা খুঁড়ে মরতে? কই, একটা বড়লোক দেখাও তো আমায়- যার মেয়ে অন্যের বাড়িতে ছাত্রী পড়িয়ে যে- টাকা পায় তা দিয়ে কলেজের বেতন শোধ করে? দুপুরে রোদে এক মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে ক্লাস করতে যায়? ওরা সমান না বললেই হলো? সব শালা বেঈমান, চামার।

অসহায় হাসমত আলীর পরিবার মধ্যবিত্ত বলে ঠাঁট বজায় রেখে চলতে হয়। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে হয়। সম্মান বাঁচাতে সামাজিকতার সবদিক রক্ষা করতে হয়। উ”চবিত্ত কিংবা নি¤œবিত্তের এ সংকট নেই। নেই কোন আদর্শ লালন করার বাধ্যবাধকতা। আর আদর্শিক অব¯’ান ধরে রাখতে গিয়ে মাহমুদ বিক্ষুব্ধ হয়ে মাসিক পঁচাত্তর টাকা বেতনের চাকরিটা ছেড়ে দেয়। কারণ মাহমুদ ব¯‘নিষ্ঠ সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী। বিকৃত খবর পরিবেশন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই আদর্শবাদী চিন্তা মধ্যবিত্তের আর এক সংকট। এ সংকট মধ্যবিত্তকে এক মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রামে ঠেলে দেয়।
বরফ গলা নদী প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। সে হিসেবে উপন্যাসটি রচিত হয় ১৯৬৯ কিংবা তার পূর্বে কোন এক সময়ে। অর্থাৎ বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- এ দুটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যবর্তী কালপর্বের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত হতে পারে উপন্যাসটি। এ কালপর্বে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে মুখরিত। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, আটান্নোর স্বৈরশাসন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয়দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- এ সবই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও তখন স্বাধীন ও ব¯‘নিষ্ঠভাবে সংবাদ পরিবেশন ও মুক্তচিন্তা করতে পারতেন না। এ প্রসঙ্গে মাহমুদের উক্তি :

ধৈর্যের একটা সীমা আছে, বুঝলে।… সাংবাদিক হবার স্বপ্ন ছিলো, সেতো চুরমার হয়ে গেছে। সাংবাদিকতার নামে গণিকাবৃত্তি করেছি এক বছর। মালিকের হুকুম তামিল করেছি বসে বসে। তেলকে ঘি বলতে বলেছে, বলেছি। হাতিকে খরগোশ বানাতে বলেছে, বানিয়েছি।

পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর মাহমুদের নতুন কোন চাকরি হয় নি। আর্থিক সংকটে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হাসমত আলীর পরিবার। এই সংকটময় মুহূর্তে মরিয়ম অসু¯’ হয়ে পড়লে মনসুর এসে পাশে দাঁড়ায়। ঔষধ-পথ্য কিনে দেয়। নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখে। হাসমত আলী ও সালেহা বিবি এই অসময়ে মনসুরের এমন সহযোগিতা পেয়ে এটাকে আল্লার রহমত মনে করে। মানুষের অসহায়ত্বের মাত্রা বেড়ে গেলে সে যেকোন অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে। মনসুর সেই অবলম্বন হয়ে আসে হাসমত আলীর পরিবারে। ছোটদের খেলনা কিনে দেয়, ঘুরিয়ে আনে বিভিন্ন দর্শনীয় ¯’ান। বড়দের শরীর-স্বা¯ে’্যর খোঁজ-খবর নেয়। বিশেষ করে মরিয়মের বিষয়ে মনসুরের আগ্রহ দেখে সালেহা বিবি আর এক চিন্তা করে। মরিয়মকে ভালবাসে মনসুর। সালেহা বিবি এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। তবে আদর্শবাদী মাহমুদ এটাকে টাকার জন্য আত্মবিক্রি মনে করে। মাহমুদ বিশ্বাস করে, মনসুরের যদি টাকা না থাকতে, সে যদি ছোটদের জন্য এটাসেটা কিনে দিতে না পারতো, তাহলে এতো মাথায় নিয়ে থাকতো না। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে এটা মাহমুদের আত্মসম্মানের বিষয়। কিš‘ মাহমুদ তার আত্মসম্মান রক্ষা করবে কিভাবে? তাই ছোটবোন হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে মাহমুদের অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটে এভাবে :

হাঁরে হাসি, ধর আমি যদি একটা বড় চাকরি করতাম, মাসে মাসে যদি শ’পাঁচেক টাকা আয় হতো আমার, আর তোদেরকে যদি রোজ বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতাম, এটা-সেটা কিনে দিতাম- তাহলে তোরা আমাকে খুব ভালবাসতি তাই না?

মাহমুদ একটা প্রেসে প্রুফ রিডারের চাকরি পেয়েছে। মাসে নব্বই টাকা বেতন। মাসে নব্বই টাকা উপার্জন করে পরিবারের কোন সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করা যায় না। তাই মনসুরের সাথে মরিয়মের বিয়েতে মাহমুদ রাজি হতে পারে না। তবে এ বিয়েতে হাসমত আলী ও সালেহা বিবি খুশি হয়। ছোটরাও অনেক খুশি। ছোটরা খুশি হয় না বুঝে। আর হাসমত আলী ও সালেহা বিবি খুশি হয় কন্যাদায়গ্রস্ত অব¯’া থেকে মুক্তি পাবে বলে। কন্যাদায়গ্রস্ত মধ্যবিত্তের এতো আত্মসম্মান থাকলে চলে না। তবে মাহমুদ আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে চায় না। মনসুরকে মাহমুদ আদর্শহীন বলেই জানে। মাহমুদ জানে চরিত্র ঠিক রেখে বড়লোক হওয়া যায় না। অন্যকে ফাঁকি দিয়ে, ধোঁকাবাজি আর লাম্পট্য করে, শোষণ আর দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে টাকা রোজগার করে বড়লোক হয় সব। মাহমুদ ও পরিবারের সকলের এই পরস্পরবিরোধী অব¯’ানের মধ্যেও বিয়েটা হয়ে যায়। মরিয়ম আর মনসুরের সুখের সংসার ভালোই চলছিলো। কিš‘ একদিন মহাবিপর্যয় হয়ে দেখা দেয় মরিয়মের পুরোনো প্রেমিক জাহেদ। স্বশরীরে নয়, মনসুর জানতে পারে জাহেদ নামের একজনকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো মরিয়ম। মরিয়ম বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করলে মনসুর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অবজ্ঞা আর অবহেলার এক পর্যায়ে মরিয়ম বাপের ঘরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

মরিয়মের জীবনের বিপর্যয় যেন আর এক মহাবিপর্যয় ডেকে আনে হাসমত আলীর পরিবারে। দিনভর প্রচ- বৃষ্টিতে হাসমত আলীর জীর্ণ ভাড়া বাসাটি রাতের গভীরে ধসে পরে। পরিবারের সবাই মারা যায়। মাহমুদ প্রেসে থাকার কারণে বেঁচে যায়। এই দুর্ঘটনার জন্য ভাগ্যকে দায়ী করে না মাহমুদ। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার খোদাবক্স ‘খোদার ই”ছা’ বললে মাহমুদ চিৎকার করে ওঠে। মাহমুদ মনে করে দারিদ্রই এ দুর্ঘটনার কারণ। আর্থিক সামর্থ থাকলে হাসমত আলী বাসা বদল করতে পারতো অনেক আগেই। কোন বড়লোকের বাসা এভাবে ধসে যায় না। এমন জীর্ণ বাসায় কোন বড়লোক বসবাসও করে না। হাসমত আলী যদি নি¤œপদ¯’ কেরানি না হতো, মাহমুদের যদি একটা ভাল চাকরি হতো কিংবা মরিয়মের যদি শিক্ষকতার চাকরিটা হয়ে যেতো তাহলে বাসা বদল হয়ে যেতো অনেক আগেই। কারণ হাসমত আলীর পরিবার শিক্ষিত ও রুচিশীল। শুধুমাত্র আর্থিক সংকটের কারণেই পুরোনো জীর্ণ-শীর্ণ, বৃষ্টিতে ফাটল দিয়ে পানি পড়ে এবং সহজেই ইট খসে পড়ে- এমন ভবনে বাস করতো হাসমত আলী। এই আর্থিক সংকট জীবন দিয়ে মোকাবিলা করলো একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। বরফ গলা নদী’র পুরোটাই একটি বিপর্যয়ের কাহিনি। কাহিনিতে স্বপ্ন আছে, আশা আছে; আছে প্রেম-ভালবাসা; আছে আর্থিক সংকটের মধ্যেও পাবিরারিক বন্ধন। আর আছে জীবনসংগ্রাম। মধ্যবিত্তের জীবনে এই জীবনসংগ্রাম কখনো থামে না। মাহমুদ, শাহাদত, নঈম ও আমেনারা বার বার হেরে যায় জীবনসংগ্রামে। তারপরও বেঁচে থাকার স্বপ্ন থাকে। মাহমুদ ও লিলি সংসার সাজায়, মরিয়মকে ভুলে মনসুর ও সেলিনা ঘর বাধে। ঔপন্যাসিক জহির রায়হান তাঁর বরফ গলা নদী উপন্যাসে যে শ্রেণিচেতনা ও আদর্শের প্রতিফলন দেখিয়েছেন তা চিরায়ত বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনেই আদর্শ। মধ্যবিত্তের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামে টিকে থাকার স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। জহির রায়হানের প্রতিটি উপন্যাসই জীবন থেকে নেয়া। মধ্যবিত্তের জীবনচিত্র ও অসহায়ত্বের কাহিনিই এর মূলসুর। এ প্রসঙ্গে নি¤েœর উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য

বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনচিত্র জহির রায়হানের উপন্যাসে এতটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ফুটে উঠেছে যে, বাংলা কথাসাহিত্যেই তা একটি ‘মাইলস্টোন’ হয়ে থাকতে পারে। মধ্যবিত্ত জীবনচিত্র রূপায়ণে জহির রায়হান একেবারেই মোহহীন, মমতাহীন; তাঁর উপন্যাসে জীবন যেমন ছিল ঠিক তেমনিভাবে রূপায়িত হয়েছে, কোনো অকারণ বাড়িয়ে বলা নেই- নেই তেমনি বাহুল্য কোনো উ”ছ¡াসও। জীবনের সংকীর্ণতাকে তিনি তুলে ধরেছেন, দেখিয়েছেন সম্ভাবনাকেও; কিš‘ তার চেয়েও বড় হল মধ্যবিত্ত জীবনের অসহায়ত্বের চিত্র রূপায়ণে জহির রায়হান ছিলেন প্রচ-ভাবে নির্মম এবং সাহসী… [উপন্যাস সমগ্র : জহির রায়হান, ড. মোহাম্মদ হাননান (সম্পাদিত), অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৮]

আর্থিক সংকটে বিপর্যস্ত একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্বের কাহিনি শুধু নয়; বরফ গলা নদী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট, বেকারত্ব, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় মন্দাভাব, সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ, অবকাঠামো, নগর পরিকল্পনা ও বর্জ্য ব্যব¯’াপনাসহ নাগরিক সুবিধাবি ত গণমানুষের এক অনবদ্য জীবনচিত্র।

আলী রেজা
পিএইচডি গবেষক
ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়
রাজশাহী

Leave a Reply