Anwar Hossain Badol

আরশি নগরের পড়শি-০২
আনোয়ার হোসেন বাদল

“এমন মানব জনম আর কি হবে
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।”

লালন শাহ কোন প্রেক্ষিতে এমন কথাটি বলেছিলেন কে জানে। কিন্তু এযে শ্বাশত বাণী, চিরন্তন কথা। এইযে পটুয়াখালী থেকে বাসযোগে মাত্র সাতঘণ্টার সড়ক পথ অতিক্রম করে কুষ্টিয়া এলাম, এপথে আসতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো আমি যেন হিমালয় পর্বত অতিক্রম করতে চলেছি। শরীর-মন একদম সায় দিচ্ছিলো না। অথচ ত্রিশ বছর আগে যখন রাজশাহী, দিনাজপুরে চাকরি করেছি, কিংবা বান্দরবান, কক্সবাজারে ছিলাম তখন সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে দু’দিন লেগে যেত। অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে সেই দূরত্বকে তখন দূরত্ব মনেই হয়নি বরং সেই দু’দিন পথে পথে কাটিয়েও এতোটা দুর্বিসহ মনে হয়নি। একদম আমল দেইনি সেই ভ্রমণ কষ্টকে বরং এনজয় করেছি।

সে ছিলো দুর্বার যৌবনের সূর্য সময়ের কথা। আজ বয়সের জীর্ণতা যখন শরীর ও মনকে আছন্ন করে ফেলে আত্মার গভীরে তখন এক করুন হাহাকার। সঙ্গত কারনেই মহাত্মা লালনের ওই কথা প্রাসঙ্গিক হয়ে অাড়াল থেকে কে যেন ডেকে বলে- হুশিয়ার-সাবধান , সন্ধ্যা হতে খুব বেশি বাকী নেই। সামনেই ঘোর অন্ধকার। অতএব হে মানুষ “এমন মানব জনম আর কি হবে…..”। এখানে মোটা দাগে একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, মনতো খারাপ কিছুও চায় তবে তাও কি ত্বরায় করতে হবে? এটি একটি দার্শনিক প্রশ্ন আর এর ব্যাখ্যা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে দেয়া সম্ভবও নয়। মূল কথা হচ্ছে সময়।

সময় এক নিষ্ঠুর যাযাবর। সে তার নিষ্ঠুরতা দিয়ে খেয়ে নেয় রুপ-রস-গন্ধ, ধংস করে দেয় পৃথিবীর তামাম সৌন্দর্য। মানব জীবনে এ এক কেরুন ট্রাজেডি। বিবর্তিত পৃথিবীতে মানুষসহ সমস্ত সৃষ্টির মুখের সৌন্দর্য আর দেহ সৌষ্টবে নিষ্ঠুর থাবা বসিয়ে তাকে নিঃশেষ করে দেয় সময়। বয়স হলে নেমে আসে জরা ব্যধি, কেড়ে নেয় তার প্রাণশক্তি। পুরাতন হারিয়ে যায় কালের অতল গহব্বরে, আসে নতুন মানুষ। নতুনরা গড়ে তোলে নতুন সভ্যতা।

আমিও সময়ের নিষ্ঠুর থাবায় আজ খাদের কিনারে বসে কালের অতলান্ত গহব্বরে হারানোর প্রতীক্ষায় আছি। এই সামান্য পথের ধকলেই পা ফুলে গেছে, চোখের পাতাও ভারী হয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে পা বালিশের উপর রেখে শুয়ে পড়েছিলাম। তূর্য আর তানিশা ভিডিও গেইম খেলছে। সোহেল গেছে সান্ধ্যকালীন বাজারে। সুলতানা আর মারুফা অন্যরুমে গল্পে ব্যস্ত।

বাসের মধ্যে মা-ছেলে বমি করলেও এখন তারা দিব্যি সুস্থ ও সতেজ অথচ আমি অনেকটাই দুর্বল অনুভব করছি। কুষ্টিয়ার এই ভ্রমণের বিষয়ে আমার যে অমত ছিলো এমন নয় তবে সুলতানার আগ্রহ ছিলো অনেক বেশী। আসলে সুলতানা জন্মসূত্রেই প্রগতিমনস্ক একজন আধুনিক মানুষ। শিল্প সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ বা ভালোবাসাও জন্মসূত্রে পাওয়া। তার দাদাজানের নাম ওয়াজেদ আলী বয়াতি যিনি ছিলেন দখিনাঞ্চলের প্রখ্যাত বাউল শিল্পী। নিজে গান বাঁধতেন, নিজেই সুর করতেন। সুলতানার ভেতরটাও তার দাদার মতোই সাংস্কৃতিক গুনে সমৃদ্ধ। এসব কারনেই আমার ব্যক্তি জীবনের দৈন্যতাকে তার কখনও খারাপ লাগেনি বরং একজন সাদা মনের মানুষ হিসেবে সম্পূর্ন নির্মোহ যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তার দেহ-মন। বলা বাহুল্য হবেনা যে আমার সন্তানরাও আমাদের দু’জনের আদর্শে বেড়ে উঠেছে। তারাও আমাদের মতো প্রচণ্ড রকমের ভ্রমণপীপাসু আর পড়ুয়া স্বভাবের হয়েছে।

চোখ বন্ধ করে এসব কথা ভাবছিলাম আর ভাবছিলাম আমার মেয়েদের কথা। দু’জনেই লেখাপড়া করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন ভালো চাকরি ইত্যাদির সন্ধান করবে এমনটাই প্রত্যাশা অথচ দু’জনই হয়েছে সম্পূর্ন নির্মোহ ন্বভাবের। ভ্রমণের এক নেশায় পেয়েছে তাদেরকেও। বড়জনতো ইতোমধ্যে দখিন এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশই ঘুরে এলো। নিজেকে প্রশ্ন করি- তারা বড় হয়েছে কিন্তু নিজেদের ভালোটা বুঝতে পারছেনা কেন? এদের ভবিষ্যৎ কী?

কবি সিদ্দিক প্রামানিকের ফোন পেয়ে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। সিদ্দিক ভাই তাড়া দিয়ে বললেন- কুষ্টিয়া এসেছেন ঘুমুতে? নেমে আসুন-নেমে আসুন। আপনার জন্যে আমরা গণমোড়ে চা নিয়ে বসে আছি।

আসছি বলে রেডি হয়ে গণমোড়ে গিয়ে দেখি সত্যিই কবি সিদ্দিক জনৈক কবি পরিমল ঘোষসহ চার-পাঁচজনকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। অনেকদিন পর সিদ্দিক ভাই’র সাথে দেখা। সিদ্দিক বয়সে অনেকটা নবীন, খুব ভালো কবিতা লিখেন। বললেন-আসুন কবি, আসুন। আমরা আপনারই অপেক্ষায়।

কুমারখালীর সন্তান সিদ্দিক প্রামানিক, প্রাণোচ্ছল, টগবগে এক যুবক। সিদ্দিকের সাথে বছর কয়েক আগে ঢাকার কাটাবনে দেখা হয়েছিলো। কনকর্ড টাওয়ারের সামনে কবি হানিফ মোহাম্মদ, সৈয়দ ওয়ালী, পিডি বিজয়ের সাথে ফুটপাতের এক চা দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন সিদ্দিকও যোগ দিয়েছিলেন সে আড্ডায়।

এক শ্রেনির মানুষ আছে যাদের দেখামাত্র মন ভালো হয়ে যায়, কবি সিদ্দিক সেই শ্রেণির মানুষ। আমাকে দেখেই তার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। তাকে দেখামাত্র আমারও ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। সতেজ হয়ে উঠলাম তাদের ছোঁয়ায়। চা, সিগারেট আর গল্পে গল্পে সময় দ্রুত কেটে যাচ্ছিলো।

সেই সন্ধ্যের আবছা অন্ধকারে আমরা পায়ে হেঁটে গড়াই নদীর দিকে যাচ্ছি। গণমোড় থেকে একটু দখিনে হাতের বাম পাশে কুমারখালী শিল্পকলা একাডেমী ঠিক তার বিপরীত দিকে বহু পুরাতন একটি লাইব্রেবী। সিদ্দিক ভাই জানালেন বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর পরই লাইব্রেরীটি তৎকালীন সুধী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

কথা প্রসঙ্গে আফসোস করে বললেন- এখন আর বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ নেই। মানুষ এখন জ্ঞান চায়না, চায় টাকা। বৈধ অবৈধ পথে অর্থ বিত্তের মালিক হওয়ার এক ইঁদুর দৌড়ে মেতে উঠেছে গোটা বাঙালি জাতি।

হাসলাম, বললাম- সে কারনেই কী কবি সিদ্দিক প্রামাণিক ই-বুক বের করেছেন?

বললেন-ওহ, ওই ‘সতর্ক ছুরির দুপুর ‘ বইটির কথা বলছেন।
বললাম- হ্যাঁ, ই-বুক কেন করলেন? এতে লাভ কী হলো?

হাসলেন কবি সিদ্দিক, বললেন-মলাটবদ্ধ বই আর করতে চাইনা ভাই। বই পড়ার লোক এখন আর নেই, বরং ই-বুকে খরচও কম, দু’চারজন যারাওবা পড়তে চান তারা সহজে পেতেও পারেন।

শরত সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে আমরা গড়াইর তীরে বসে আছি। আমাদের দশ হাক দখিন দিক দিয়ে পশ্চিম থেকে পুবে বয়ে যাচ্ছে গড়াইয়ের স্রোত। তার কুলকুল ধনি মধুর কলরব হয়ে আমাদের আনন্দিত করে যাচ্ছে। সামান্য পূর্ব দিকে বিস্তর আলো আর কোলাহল দেখে বললাম ওদিকটায় কী?

বললেন ওটা তেবাড়িয়া, ওখানে ব্রিজের কাজ চলছে। নদীর ওপারে লালন বাজার।

বললাম- আচ্ছা কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতো এখানেই।

সিদ্দিক ভাই বললেন আপনি যার বাসায় উঠেছেন সেই কুণ্ডু পাড়ায়ই হরিনাথ মজুমদারের প্রেস এবং যাদুঘর। আর আলো ঝলমলে ওই তেবাগিয়ার ওখানে ছিলো হরিনাথ মজুমদারের ছাত্র রায়বাহাদুর জলধর সেনের বাড়ি। সেটা বহু আগেই নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।

কথায় কথায় রাত গভীর হয়ে এলো। সুলতানা ফোন দিয়ে বললো রাত দশটা বাজে বাসায় আসছো না কেন?

সিদ্দিক ভাই বললেন- যান, তবে যেখানেই থাকেন আগামীকাল বিকেল আবার আড্ডা হবে। তিনি আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন।

চলবে……
কুমারখালী
২২/০৯/২০২০

Leave a Reply