আরশি নগরের পড়শি পর্ব-০৩

গতকাল সন্ধ্যায় কবি সিদ্দিক প্রামাণিক ও কবি পরিমল ঘোষের সাথে গড়াই তীরে কিছুক্ষণ বসেই গড়াইয়ের সাথে প্রেম হয়ে গিয়েছিলো। অদ্ভুত সুন্দর এক স্রোতস্বিনী। নদীর কাছে আসলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। নদী তার আপন মনে কুলকুল বয়ে চলে নিরন্তর। কতো মানুষের বসত এই নদীর পাড়ে। কতো প্রেমিক-প্রেমিকা, কতো শিশু-কিশোর, আবালবৃদ্ধবনিতা। নদী সবাইকে প্রেম দেয়, সিক্ত করে। সবার সুখ দুঃখের সাথী হয়। মানুষের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, বিরহ-বিচ্ছেদের সাতকাহন নিজের বুকে বয়ে নিয়ে যায় সাগরে, মিলিয়ে দেয় কালের স্রোতে।
আমিও নদী মাতৃক মানুষ। দখিনের অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত পায়রাসিক্ত জীবন আমার। সুতরাং নদীকে আমার মতো করে কেই বা আর চিনবে! আমি যে নদীর কথা বলছি সেই পায়রা কেড়ে নিয়েছে আমার বসতভিটে, বাপ-দাদার পরিচয়। দিয়েছেও অনেক কিছু। আমার ঘর-বাড়ি ভেঙে পায়রা যেমন আমার গ্রামটি নিশ্চিহ্ন করেছে গড়াইও তেমনি কতজনকে করেছে গৃহহারা। নদীরা হয়তো জানে কোন কোন মানুষের ঘর থাকতে নেই। গোটা পৃথিবীই তাদের ঘর, আকাশ তাদের ছাদ আর জমিন তাদের ভিটি।
পায়রার তুলনায় গড়াই’র প্রশস্থতা, নাব্যতা সবই কম কিন্ত তার স্রোতের তীব্রতা বড় ভয়ংকর। ভারতের গঙ্গার জল রাজশাহীতে পদ্মায় পতিত হলে সেই জল সরাসরি গড়াই দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে গড়াই নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে চলেছে কুমারখালী শহরকে। শহরের এমএন হাই স্কুল থেকে তেবাড়িয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা গ্রাস করেছে গড়াই। সে কারনে সরকার নদী শাসনের ব্যবস্থা নিয়েছে।ভাঙন প্রতিরোধের জন্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের কৌশল কাজে লাগিয়ে ভাঙন রোধে সক্ষম হয়েছে।
এপারে ভেঙেছে ওপারে জেগেছে চর। ওপারের জনপদের নাম যদুবয়রা ইউনিয়ন। কুমারখালীর যদু বয়রা ইউনিয়নের অতুল প্রসাদের মুখে শুনেছি- যদুবয়রা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু’র স্মৃতিবিজরিত গ্রাম। বড় লাটকে মারার জন্যে এই কিশোর বোমা নিয়ে আত্মহুতি দিয়েছিলেন। ক্ষুদিরাম বসুর মামাবাড়ি যদুবয়রা ইউনিয়নে।
তবে অসামান্য সৌন্দর্য নিয়ে বয়ে চলা এই গড়াই বাংলাদেশের একটি ভাগ্যবান নদী। ভাগ্যবান এ কারনে যে, এই নদীতে চলাচল করেছেন মহাত্মা লালন, কাঙাল হরিনাথ আর মহর্ষি রবীন্দ্রনাথের মতো মহৎপ্রাণ মানুষেরা। জলদর সেন, বিপ্লবী যতীন আর ক্ষুদিরাম বসুর ছোঁয়াও পেয়েছে গড়াই।
রবীন্দ্রনাথ গড়াইকে আদর করে ডাকতেন গৌরী বলে। সুতরাং গৌরীর রূপ যৌবন ভোরের আলোয় দেখার জন্যে ফজরের আযানের সময়ই বেরিয়ে পড়লাম।
খু্ব প্রত্যুষে সোহেলকে সাথে নিয়ে হাঁটছি, বললাম নদীর তীর ঘেষে হাঁটবো। বাসা থেকে পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটলেই নদী। চমৎকার রাস্তা, দু’পাশে বহুতল ভবনগুলোর বারান্দায় বারান্দায় নানান ফুলগাছ। বাড়ির আঙিনায়ও বাহারী সব গাছপালা। দু’একজন নামাজী লোকের আনাগোনা বাকী সুনসান নীরবতার মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি দৃষ্টি নন্দন কুমারখালী শহরের মধ্য দিয়ে।
একটু পর পর বহু পুরাতন সব ঘরবাড়ি। বেশির ভাগই পরিত্যক্ত। চওড়া দেয়াল, পুরাতন খিলান আর কারুকাজ দেখলেই বোঝা যায় কম হলেও এক-দেড়শো বছরের পুরানো পরিত্যক্ত সব বাড়িঘর। আমাকে অনুসন্ধিতসু দেখে সোহেল বললো- এগুলো সব হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি এখন সরকারের জিম্মায়। বুঝলাম এ শহরের বুনিয়াদ বহু কাল আগের।
দেখতে দেখতে আমরা নদীরকাছে চলে এসেছি। হাঁটছি উত্তর দিকে। বামে নদী, ডানে এমএন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিশাল মাঠ। এই স্কুলেরই শিক্ষার্থী ছিলেন কুমারখালীর সন্তান রায়বাহাদুর জলধর সেন। যার ভ্রমণ আখ্যান আর উপন্যাসসহ রয়েছে বিশাল এক সাহিত্য ভাণ্ডার। আজ বাংলা সাহিত্যে তিনি এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। জলধর সেন ১৮৬১ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম হলধর সেন।
জানা যায় জলধর সেনের আদি নিবাস ছিলো পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাসাতের নিকট দেগঙ্গা গ্রামে। তাঁর প্রপিতামহ তৎকালীন নদীয়া জেলার কুমারখালির ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশম-কুঠিরে দেওয়ানীর কাজ পেয়ে কুমারখালীতেই স্থায়ী হয়ে যান। জলধর সেন প্রখ্যাত বাউল সাধক ও সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ছাত্র। মাত্র তিন বছর বয়সে পিতৃহারা হলে হরিনাথ মজুমদারই পিতৃস্নেহে দেখতেন জলধরকে। জলধর সেন যে স্কুলে কাঙাল হরিরাথ মজুমদারের ছাত্র হিসেবে পড়াশুনা করেছেন সেই এমএন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি গড়াই নদীর তীরঘেষে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও এখন সেই স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে গড়াই’র জল প্রবাহ দেখছি।
এই স্কুলেরই জনৈক শিক্ষার্থী যিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। নাম অতুল প্রসাদ যার বাড়ি নদীর দখিন পাড়ে তার সাথে পরিচয় হলে জানতে পাই জলধর সেন এবং কাঙাল হরিনাথের আদ্যপান্ত।
২১ বছর বয়সে জলধর সেন তার স্ত্রী, কন্যা এবং মাতাকে হারিয়ে কিছুদিনের জন্যে হিমালয়ে পর্বতে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি তার বিখ্যাত ভ্রমণ আখ্যান ‘হিমালয়’ লিখেন। জলধর সেনের পৈত্রিক ভিটে বাড়ি বহু আগেই গড়াই নদীর ভাঙনে বিলুপ্ত হয়েছে। সরকারও তার স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় পর্যটক, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক জলধর সেনের নাম বাংলাদেশের মানুষরা ভুলতেই বসেছে।
গোয়ালন্দে একটি বিদ্যালয়ে মাসে ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে কলকাতা গিয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি শুরু করেন সাংবাদিকতা। তিনি বহু পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান।
ভারতবর্ষ পত্রিকায় তার ” তিনপুরুষ” নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়, রবীন্দ্রনাথেরও ঐ নামে একটি উপন্যাস লেখা ছিলো পরবর্তীতে তিনি সেই নাম পাল্টে রাখেন “যোগাযোগ”।
জলধর সেন কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্তা, সাপ্তাহিক বসুমতী, হিতবাদী, সুলভ সমাচার প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকাতে সম্পাদক বা সহ-সম্পাদক হিসাবে যুক্ত ছিলেন । পরে ১৩২০ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর তিনি ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তার সাহিত্যকর্মের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেয়।
প্রিয় পাঠকদের জন্যে রায় বাহাদুর জলধর সেনের বিখ্যাত ভ্রমন আখ্যান হিমালয়ের অংশ বিশেষ নিবেদন করা হলো-
“পৃথিবীর সকল সভ্যদেশের সাহিত্যেই ভ্ৰমণ বিষয়ক গ্রন্থের প্রাচুৰ্য্য লক্ষিত হয় ; দেশভ্রমণ শিক্ষার একটি অঙ্গ ; দেশভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা ‘ অনুভব করেন না, এমন লোক বোধ করি আমাদের দেশেও এখন একান্ত বিরল । হয়তাে ইহা মনুষ্য-জীবনের একটি স্বাভাবিক বৃত্তি। র্যাহারা কোন রকমে বি-এ, এম-এ পাশ করিয়া উপাৰ্জনের পন্থায় দশটা হইতে পাচটা পৰ্যন্ত আফিস করেন, এবং অর্থোপাৰ্জন ব্যতীত অন্য চিন্তার অবসর পান না, তঁহাদের তৃষিত হৃদয় ও অনতিদীর্ঘ অবকাশ কালে রথচক্ৰ মুখরিত ইষ্টকাবদ্ধ রাজপথ এবং অট্টালিক, সঙ্কল সহরের দৃষিত বায়ুপ্রবাহ পরিত্যাগ পূর্বক মুক্ত প্ৰকৃতির চিরবৈচিত্ৰ্যময় শ্যামলবক্ষে ঝাপাইয়া পড়িয়া বিশ্ববিধাতার প্রেমধারা পান করিবার জন্য অধীর হইয়া উঠেন। কেহ দারঞ্জিলিং যান, কেহ শিমলাশৈলে আশ্রয় গ্ৰহণ করেন, কেহ বা শস্যশ্যামলা নদীমেখলা পল্লীগ্রামের কুঞ্জ-কুটীরে বসিয়া সুখ অনুভব করেন। ইউরোপের কথা ছাড়িয়া দিই। ; সেখানে মানুষের অর্থ, সুযোগ, শক্তি আমাদের অপেক্ষা অনেক অধিক । লাপলাণ্ডের ছয়মাসব্যাপী দীর্ঘরাত্রি ইউরোপীয় পৰ্য্যটকের চক্ষুর সম্মুখে কেন্দ্রীর উষার বিমল বিভা ব্যক্তি করে; উত্তর মেরুর চিরহিমানীরাশির মধ্যে র্তাহারা সঙ্গীহীন, অবলম্বনশূন্য দীর্ঘ সাধনায় কঠোর ব্ৰত উদযাপন করেন “

আরশি নগরের পড়শি -০৪
ক’দিন আগে পটুয়াখালী থেকে যখন কুষ্টিয়ার পথে রওয়ানা হই তখন বলেছিলাম শিল্প সাহিত্যের তীর্থস্থানে যাচ্ছি। তীর্থস্থান কথাটি যে কতোটা যথার্থ ছিলো তা এ ক’দিন মর্মদিয়ে উপলব্ধি করেছি। এই কুমারখালীর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই লালন ফকিরের আরশিনগর। আর আরশিনগরের পড়শী- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, মীর মোশাররফ, কাঙাল হরিনাথ, জলধর সেন, বিপ্লবী বাঘা যতীন, সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব গগন হরকরার বাড়িও কাছাকাছি। এরা সবাই সমকালীন।
আমরা উঠেছি মারুফা আফ্রিনের বাসায়। সে আমাদের মুরাদিয়ার মেয়ে, স্বামীর বাড়ি বেতাগী। দু’জনই পল্লী বিদ্যুতে চাকরি করে। মারুফার বাসা কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায়। এই কুণ্ডুপাড়ায়ই লেখক, সাংবাদিক, বাউল সাধক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়ি।
কাঙাল হরিনাথের অন্য নাম ফিকির চাঁদ বাউল।
বৃটিশ ভারতে ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই তৎকালীন নদীয়া জেলার এই কুমারখালী মহাকুমার কুণ্ডপাড়ায় মহৎপ্রাণ হরিনাথের জন্ম।
অর্থাভাবে কাঙাল হরিনাথ লেখাপড়ায় বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি। তবে সারাজীবন অবহেলিত গ্রামবাংলায় শিক্ষাবিস্তারের জন্য কাজ করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন ইংরেজ ও জমিদারদের শোষণ পীড়নের বিরুদ্ধে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন তিনি।
আজ গিয়েছিলাম হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতে। তার বাড়ি এখন তারই স্মৃতি বিজরিত যাদুঘর। বিশ্বব্যাপী করোনার জন্যে যাদুঘরটি বন্ধ ছিলো। মারুফার স্বামী পল্লী বিদ্যুতের অফিসার সোহেল তার পরিচয় দেয়ায় যাদুঘরের একজন অফিসার যার বাড়ি সোহেলের উপজেলায় তিনি আমাদের বিশেষ ব্যবস্থায় যাদুঘর দেখতে দিলেন। মারুফা তার অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় আমাদের সাথে আজ আসতে পারেনি। আমরা ঘুরে ফিরে দেখলাম কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি যাদুঘরটি।
“যদি ডাকার মতো তোমায় পারিতাম ডাকতে, তবে কি মা এমন করে তুমি লুকিয়ে থাকতে পারতে? ” জনপ্রিয় গানটির রচায়িতা এই ফকির চাঁদ। ফকির চাঁদ তার ধারণকৃত নাম। বাউল সংগীতের প্রতি হরিনাথ মজুমদার নিবেদিত ছিলেন। তার একটি বাউল দলও ছিলো। গ্রামে গঞ্জে বাউল গান পরিবেশন করতেন এই দল নিয়ে। ছিলেন মহামতি লালনের স্নেহধন্য শিষ্য। লালনের গান করতেন, নিজেও রচনা করেছেন বহু গান।গানের আসরে নিজেকে পরিচয় দিতেন কাঙাল বলে। এতেই নামের সাথে কাঙাল শব্দটি জুড়ে গিয়েছিলো।
ঠাকুর পরিবারের জমিদারী এস্টেটের মধ্যেই কাঙাল হরিনাথের বসবাস। হরিনাথ মজুমদার সাংবাদিকতার মাধ্যমে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতেন ফলে ঠাকুর পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। হরিনাথ সম্পাদিত গ্রামবার্তা পত্রিকায় জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ঠাকুর পরিবার হরিনাথের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হন। এক পর্যায়ে পরিস্খিতি এমন দাঁড়ায় যে, হরিনাথ মজুমদারকে কুঠিবাড়িতে ধরে নেওয়ার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী পাঠানো হয়।
এ সংবাদ পান ছেঁউড়িয়ার সুফি বাউল লালন শাহ। তিনি তার শিষ্যদের দলবল নিয়ে চলে আসেন শিষ্য হরিনাথ মজুমদারকে রক্ষা করার জন্যে। সেই ফকির দরবেশদের দল জমিদার বাহিনীকে প্রতিহত করে দেন। জানা যায় পরবর্তীতে সাঁইজির নির্দেশে দিনের পর দিন পাহাড়া চলে হরিনাথ মজুমদারের বাড়ি ও কুমারখালীর হরিনাথের বিখ্যাত সেই ‘এম এন প্রেস’টিতে।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার একজন বাউল সাধক ও সাংবাদিক হিসেবেই সমধিক পরিচিত। বাবা হরচন্দ্র মজুমদার, মায়ের নাম কমলীনি দেবী। বাবা-মাকে শৈশবে হারিয়ে দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেই বেড়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি দেখেন এলাকাবাসির দুঃখ-দুর্দশা। এসব কিছু তাকে সংগ্রামী করে তোলে। এভাবেই তিনি গ্রামবাসির হাতিয়ার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন।
মূলত হরিনাথ মজুমদার একাধারে বাউল সাধক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৮৬৩ সালে তিনি কুমারখালীতে একটি মেয়েদের স্কুল নির্মাণ করেন। স্বয়ং ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর সে সময় ঐ স্কুলটির উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
১৮৭৩ সালে তার পত্রিকা প্রকাশের জন্যে বাবার সম্পত্তি বিক্রি করে গড়ে তোলেন এম এন প্রেস। এতে তার বন্ধু ও সহযোদ্ধারাও সাহায্য করেছিলেন। অবশ্য ১৮৫৭ সাল থেকে হাতে লিখেই গ্রাম্যবার্তা নামক পত্রিকা দিয়ে কাঙাল হরিনাথের সাংবাদিকতার জীবন শুরু।
গ্রাম্য বার্তার মাধ্যমে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার নীলকরদেরসহ সে সময় জমিদারদের অত্যাচার ও অনাচারের বাস্তবতা তুলে ধরেন। তাছাড়া নিজের সাধনা, দর্শন ও সাহিত্যচর্চাও ছিলো। যার পূর্নাঙ্গ রূপ পায় ১৮৭৩ সালে এমএন প্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
দেড়শ বছর আগের এই প্রেসটি থেকে নিয়মিত পত্রিকা বের হত। মীর মশাররফ হোসেনের অমর সৃষ্টি বিষাদসিন্ধু কাঙাল হরিনাথের এমএন প্রেসেই ছাপা হয়েছিল। সাঁইজি লালন শাহসহ মশাররফ হোসেন ও জলধর সেনের হাতের স্পর্শ পড়েছিল এখানে।
হরিনাথ মজুমদার বা ফিকির চাঁদ বা কাঙাল ফকির চাঁদের গানের কথা ও সুরের সহজ ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয়তা পেতে বেশি সময় লাগেনি। ফিকির চাঁদ নিজেই দলবল নিয়ে তার রচিত গান গেয়ে বেড়াতেন। তার সে গান শুনতে স্বয়ং লালন শাহ কাঙাল কুটিরে আসতেন। কাঙাল হরিনাথের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে-
“হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল
পার কর আমারে !
তুমি পারের কর্তা শুনে বার্তা
ডাকি হে তোমারে ।
হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হল
পার কর আমারে !”
কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের প্রেস ঘরে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বোমা ফেলেছিল। সে সময় প্রেসটি অক্ষত থাকলেও প্রেসঘর বা কাঙাল কুঠিরের বেশ ক্ষতিসাধন হয়।
১৬ই এপ্রিল, ১৮৯৬ সালে এই ক্ষণজন্মা লেখক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে ইন্ডিয়ান পত্র-পত্রিকা মন্তব্য করেছিল যে, “নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো”। তার মৃত্যু পর ১৯০১ সালে হরিনাথ গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বেশিরভাগ লেখাই নীল সাহেব ও জমিদাদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তার কিছু বাউল গান এবং আধ্যাত্মিক রচনাও রয়েছে। জানা যায় হরিনাথ মজুমদারের প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা আঠারো।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -০৫
“রে পথিক! রে পাষাণহৃদয় পথিক! কী লোভে এত ত্রস্তে দৌড়িতেছ? কী আশায় খণ্ডিত শির বর্শার অগ্রভাগে বিদ্ধ করিয়া লইয়া যাইতেছ? এ শিরে-হায়! এ খণ্ডিত শিরে তোমার প্রয়োজন কি? সীমার! এ শিরে তোমার আবশ্যক কি? হোসেন তোমার কী করিয়াছিল? তুমি তো আর জয়নাবের রূপে মোহিত হইয়াছিলে না? জয়নাব ইমাম হাসানের স্ত্রী। হোসেনের শির তোমার বর্শাগ্রে কেন? তুমিই-বা সে শির লইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে এত বেগে দৌড়াইতেছ কেন? যাইতেছই-বা কোথায়? সীমার! একটু দাঁড়াও। আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়া যাও! কার সাধ্য তোমার গমনে বাধা দেয়? কার ক্ষমতা তোমাকে কিছু বলে? একটু দাঁড়াও। এ শিরে তোমার স্বার্থ কি? খণ্ডিত শিরে প্রয়োজন কি?
অর্থ? হায় রে অর্থ! হায় রে পাতকী অর্থ! তুই জগতের সকল অনর্থের মূল। জীবের জীবনের ধ্বংস, সম্পত্তির বিনাশ, পিতা-পুত্রে শত্রুতা, স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, ভ্রাতা-ভগ্নীতে কলহ, রাজা-প্রজায় বৈরীভাব, বন্ধু-বান্ধবে বিচ্ছেদ। বিবাদ, বিসম্বাদ, কলহ, বিরহ, বিসর্জন, বিনাশ, এ সকল তোমার জন্য। সকল অনর্থের মূল ও কারণই তুমি।”
—–বিষাদ সিন্ধু/ উদ্ধার পর্ব/দ্বিতীয় প্রবাহ/১
তামাম বাংলাভাষি শিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঘরে এক সময় এই বিষাদ সিন্ধু বইখানা পাওয়া যেত। বাংলা ভাষায় রচিত অন্য কোন উপন্যাস এতোটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে কীনা আমার জানা নেই। অনেক অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত শ্রেণি বিষাদ সিন্ধুকে ধর্মীয় পুস্তক মনে করতেন। শৈশবে দেখেছি আমার বাপজান এরকম আশ্বিন কার্তিক মাসে যখন কাজের অবসর থাকতো তখন হ্যারিকেনের স্বল্প আলোতে বিষাদ সিন্ধু পড়তেন। গ্রামের বয়স্ক নারী পুরুষরা সমবেত হয়ে বিষাদ সিন্ধুর সেই মর্মান্তিক কাহিনী শুনতেন আর চোখ মুছতেন। সে আসরে অনেক হিন্দু বোদ্ধা মানুষকেও দেখেছি। বাপজানের সংগ্রহে থাকার কারনে মাধ্যমিক অতিক্রমের আগেই বিষাদ সিন্ধু একাধিকবার পড়েছি। সেই অমর গ্রন্থের লেখক মীর সাহেব আমাকে তার বাড়িতে পর্যন্ত টেনে আনবেন তখন কে এমনটা ভেবেছিলো?
আজ এসেছি সেই ‘বিষাদ সিন্ধু’র লেখক মীর মোশাররফ হোসেনের লাহিনীপাড়ার বাস্ত ভিটা দেখতে। কুমারখালি শহর থেকে অটো বাইকে ত্রিশ মিনিটের পথ। গড়াই ব্রিজ পার হয়েই হাতের বামদিকে এ্যারো চিন্হিত ডাইরেকশন বোর্ড। তীর চিন্হিত সেই নির্দেশক বোর্ডে লেখা রয়েছে মীর মোশারফ হোসেনের বাস্তভিটা।
হিজরী ৬১ সনে কারবালার মর্মন্তদ ঘটনা নিয়ে মীর মোশাররফ হোসেন সৃষ্টি করেন বাংলা সাহিত্যের এই কালজয়ী আখ্যান ‘বিষাদ সিন্ধু’। এই অমর কথাশিল্পীর বাড়ি কুমারখালীর লাহিনীপাড়ায়। তিনি ১৮৪৭ সালে লাহিনীপাড়ার পৈত্রিক বাড়িতে জন্ম নেন। পিতার নাম মীর মোয়াজ্জেম হোসেন, তিনি একজন জমিদার ছিলেন। নিজগৃহে মুনশির নিকট আরবি ও ফারসি শেখার মাধ্যমে মশাররফ হোসেন লেখাপড়া শুরু করেন। পরে পাঠশালায় গিয়ে তিনি বাংলা ভাষা শেখেন।
জানা যায় তিনি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন; কিন্তু তারপর লেখাপড়া আর করেননি। সেমতে তাকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ বলেই ধরে নেয়া যায়।
মীরের কর্মজীবনের শুরুতে তিনি পিতার জমিদারি দেখাশুনা করেছেন। পরে তিনি ফরিদপুর নবাব এস্টেটে চাকরি নিয়ে এস্টেটের ম্যানেজার হয়েছিলেন। এক সময় এ চাকরিও ছেড়ে দেন অতঃপর কলকাতায় কিছুদিন অবস্থান করেন।
মশাররফ হোসেন ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’-র মফঃস্বল সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ ছিলেন তাঁর সাহিত্য গুরু। পরে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী বিবি কুলসুমও সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মোশাররফ আজিজননেহার ও হিতকরী নামে দুটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। বঙ্কিমযুগের অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী হিসেবে মনে করা হয় মীরকে। তিনিই উনিশ শতকের প্রথম বাঙালি মুসলমান যিনি গল্পকার ও সফল ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। মূলতঃ মীর মোশারেফ হোসেন বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকদের অগ্রপথিক।
সাহিতিক বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী নামক উপন্যাসটি প্রকাশের ঠিক চার বছর পর মশাররফের প্রথম উপন্যাস রত্নবতী প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি একে একে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন।
বসন্তকুমারী, জমিদার দর্পণ, বিষাদ-সিন্ধু, উদাসীন পথিকের মনের কথা, গাজী মিয়াঁর বস্তানীসহ তিনি ছত্রিশটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর অমর কীর্তি বিষাদ-সিন্ধু বাংলার মুসলিম ধর্মীয় গ্রন্থের মতোই পাঠ করতেন। বাংলার মুসলিম সাহিত্যানুরাগীদের মধ্যে বিষাদ সিন্ধুর মত জনপ্রিয়তা বোধ হয় অন্য কোন উপন্যাস পায়নি।
বরিশালের বিখ্যাত যাত্রা অভিনেতা এবং যাত্রা শিল্পের উজ্জল নখত্র মোজাহের উদ্দিন বিশ্বাস বিষাদ সিন্ধু অবলম্বনে ‘সখিনার বিলাপ’ ও ‘হোসেন শহীদ কারবালা’ নামে দু’টি যাত্রা পালা রচনা করেন যা সমগ্র বাংলায় ব্যপক জনপ্রিয়তা পায়।
মোজাহের বিশ্বাসের শিষ্য সেকান্দার মাষ্টার ছিলেন বাবুল অপেরার অধিকারী। তিনিও শক্তিমান এক যাত্রাভিনেতা। এই সেকান্দার মাষ্টার বিষাদ সিন্ধু অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় যাত্রাপালা ‘এজিদ বধ জয়নাল উদ্ধার’। বাংলার ঘরে ঘরে এক সময় এজিদ বধ জয়নাল উদ্ধারের ডায়লগ শোনা যেত।
মীর মোশাররফ অনেক প্রহসন ও ধর্মীয় পুস্তক রচনা করেন। সে সময় প্রহসন লেখার একটি প্রচলন ছিলো। একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে যথানিয়মে ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করা সত্বেও ‘গো-জীবন’ নামের একটি বিশেষ রচনার জন্যে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে তিনি নাস্তিক ও কাফের খেতাব পেয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে তৎকালীন মুসলিম ধর্মীয় সমাজ আন্দোলন গড়ে তুললে মীর সাহেব বেকায়দায় পড়ে যান এবং কিছুদিন আত্মগোপনেও থাকেন।
মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সফল গল্পকার, নাট্যকার ও কথাকার। অথচ কষ্টের বিষয় হচ্ছে তার প্রতি তার জন্মস্থানের লোকজন আজও যেন ক্ষুব্ধ মনোভাবই পোষণ করে চলেছে।
আমরা হাইওয়ের ডাইরেকশন বোর্ড ধরে যেতে যেতে নানান বয়েসী মানুষের দেখা পেলাম। তাদেরকে মীর সাহেবের বাস্তভিটা সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের উত্তরে মনে হচ্ছিলো বিষয়টিতে তারা বিরক্ত।
তার জন্মস্থান কুমাড়খালীর লাহিনীপাড়া। তবে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে পদমদি গ্রামে। লাহিনীপাড়া তার পৈত্রিক বাস্তভিটায় সরকারের ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্কুল ও অডিটরিয়াম।
তার নামে প্রতিষ্ঠিত তার বাস্তভিটায় যে অডিটরিয়ামি রয়েছে সেখানে আট-দশটি কিশোরের দেখা পেয়েছিলাম। আমাদেরকে তারা যেন উৎপাত মনে করছিলো। ব্যাঙ্গ করে বলছিলো ‘মীর মশা’- মীর মস্কিউটো। বিরক্ত হয়ে বলছিলো এইসব লোক কেন এখানে আসেন? আর কিইবা দেখতে আসেন …?

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -০৬
কুমারখালীতে দেখতে দেখতে চারদিন হয়ে গেলো, সাত-আটদিন থাকার কথা। গত শনিবার বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়ে যখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস করেছিলাম তখনই কবি সিদ্দিক প্রামাণিক বলেছিলেন- ভাই, আপনি যেই শহরে আসছেন সেই কুমারখালীতেই আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।
বললাম- বর্তমান নিবাস কী ওখানেই না অন্য কোথাও?
বললেন-কোথায় আবার? কুমারখালীতেই থাকি। আসুন আনন্দ হবে, আড্ডা হবে। খুশী হয়েছিলাম। পছন্দের আরও একজন মানুষ অন্তত কুমারখালী আছেন।
কবি শাহজাহান পারভেজ রণি, কিরণ আকরামুল হক প্রমুখরাও ফোন দিয়েছিলেন। সবাই আরশী নগরের পড়শি, বলেছিলেন- আসুন প্রিয়জন, আপনার সম্মানে আমরা একটি সাহিত্য আড্ডা করবো। সিদ্দিক ভাই সময় নির্ধারণ করে জানিয়ে দিলেন, বললেন- শুক্রবার বিকেল চারটায়, স্থান একুশের ছাদ বাগান। তারিখ ও সময়টা মনে রাখবেন কুষ্টিয়ার সকল কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা থাকবেন। আপনি যথা সময়ে আসবেন কিন্তু।
তাদের অভ্যর্থনায় সেই গাড়িতে বসেই মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিলো। মনে মনে বলছিলাম- আহা আমারও তাহলে কিছুটা সম্মান আছে! সুলতানাকে বলেছিলাম এবার জমবে মেলা।
সে অবাক হয়ে বলেছিলো- লালন মেলা তো ১৬ অক্টোবর? আমরাতো তার আগেই ফেরৎ আসবো?
বললাম- না না, সাঁইজির মেলা নয়, কুষ্টিয়ার বন্ধু সহযোদ্ধারা মনে করছেন যে, আমারও যেহেতু কিছুটা সম্মান আছে আর সেই সম্মানে তারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চলেছে। সুলতানাও যারপরনাই খুশি হয়েছিলো।
যে আরশি নগরের পবিত্র ধুলি গায়ে মাখবো বলে এসেছি এখন পর্যন্ত সেখানে যাওয়াই হয়নি। অথচ প্রতিদিনই কোথাওনা কোথাও যাচ্ছি, যাচ্ছি আরশি নগরের পড়শিদের বাড়িতে। জানার চেষ্টা করছি তাদের অতীত-বর্তমানের চিত্র। আগামী কাল থেকে মারুফা দু’দিনের ছুটি নিবে, সোহেলের এমনিতেই ছুটি।
সোহেল বললো- চলুন শহরে আমার বন্ধুদের সাথে পরিচিত হয়ে আসবেন।
কুষ্টিয়া জেলায় সোহেলের দীর্ঘ দিনের বসবাস। পল্লীবিদ্যুতের কর্মকর্তা হিসেবে বেশ সুপরিচিত। কুষ্টিয়ার এই কুমারখালীতে পল্লী বিদ্যুতের বেশ কদর। এটি সেই ব্রিটিশ সময় থেকে একটি শিল্প এলাকা হওয়ায় এটি উন্নত একটি জনপদ, খুবই ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা। চিনিকল, তাঁত শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পের জন্যেও কুষ্টিয়া বিখ্যাত। সঙ্গত কারনেই এসব উদ্যোক্তারা পবিসের কর্মকর্তাদের সমীহের চোখে দেখেন। সে কারনে মারুফাও এখানে খুব সম্মানীয়া।
সোহেলের বন্ধুদের একটি সংগঠন আছে নাম ‘ভোরের পাখি’। শহরের অভিজাত সীনিয়র সিটিজেনদের সকালে জিম করার সংগঠন। প্রত্যুষে সবাই হেঁটে এসে বিখ্যাত এম এন হাই স্কুলের সামনে গড়াই’র পাড়ে সমবেত হন, এটা তাদের নিয়মিত ব্যায়াম করার জায়গা। গত তিনদিন তাদের সাথে আমিও হেঁটেছি সমবেত হয়ে ব্যায়াম করেছি।
আল কামাল নামে একজন স্পোর্টসম্যানের কমান্ডে বিশ-পঁচিশ মিনিটের ব্যায়াম। তারা সবাই পদ্ম পুকুরের ঘাটে জমায়েত হয়েছেন। আমার সম্মানে চা চক্রের আয়োজন। শেখপাড়া কলেজের শিক্ষক নাসির ভাই, এসিল্যান্ড অফিসের সাইদুর রহমান ভাই, ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ী শহিদুল ভাই প্রমুখরা আমাকে ঘিরে বসে আছেন। চমৎকার চায়ের আড্ডা। বিশাল পুকুর, এটির পদ্মপুকুর কেন নাম হয়েছিলো জানিনা তবে আমরা যেখানটিতে বসেছি সেই শান বাঁধানো বিশাল কৃষ্ণচূড়ার নীচে সত্যিই এক মনোরম পরিবেশ।
আগেই বলেছি এ শহরের মানুষদের সৌন্দর্যবোধ আছে, আছে সচেতনতাও। এই করোনাকালীন সময়ে আমার নিজ শহর পটুয়াখালীতে শতকরা দশ ভাগ মানুষকেও মাস্ক পড়তে দেখিনি, দেখিনি হ্যান্ড সেনিটাইজার ব্যবহার করতে সেখানে কুমারখালীর দোকান-পাটে, রাস্তা-ঘাটে অন্তত আশি শতাংশ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখেছি। শিল্পে, সংস্কৃতিতে এবং শিক্ষায় এ শহরের মানুষ যে অগ্রগামী তা তাদের সার্বিক আচরণে পরিস্কার ধরা পরে। আর শহরের নাগরিক ব্যবস্থাপনাও গড়াই নদীর সৌন্দর্যের মতোই নান্দনিক।
সোহেলের বন্ধুদের প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত হয় বিকেল আমার সম্মানে গড়াই নদীতে নৌভ্রমণ হবে। নৌভ্রমণের ব্যবস্থা করবেন সাইদুর রহমান ভাই।
মারুফা বিকেল পাঁচটায় ফিরে জানালো- আগামী দু’দিনের জন্যে ছুটি নিয়েছে সে। বললো কাল সকালে শিলাইদহ যাবে আর আমাদের নিয়ে পদ্মায় ঘুরবে। সোহেল সোৎসাহে বললো- কালকেরটা কাল ভেবো, এখন রেডি হয়ে নাও আমরা এখনই গড়াইয়ে নৌভ্রমণে যাচ্ছি।
এম এন স্কুলের ঘাট বরাবর নদীর তীরে বেশ অনেকটা জায়গাজুড়ে নদীর ভাঙন রোধ করার জন্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া তারই উপরে নদীর কূল ঘেষে সুন্দর পার্কের মতো। সুলতানা বললো- এমন সুন্দর একটি পার্ক যেন কোথায় কোন নদীর পাড়ে দেখেছি? মনে করতে পারছিনা।
বললাম- কোলকাতা হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে ওপারে গঙ্গার তীরে।
এখানেও একেবারে একই রকম করে পার্কের মতো সাজানো। দর্শক-পর্যটকদের বসার জন্যে সরকারি উদ্যোগে টাইলস করা বেঞ্চি পাতা রয়েছে। ঘাটে বাঁধা আছে দু’টি বোট। পর্যটকরা সে বোটে করে নৌকা ভ্রমণ করে থাকেন। তারই একটি বোটে করে আমরা চরে বসি। আমাদের নিয়ে মাঝি তার বোট যখন গড়াই নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় তখন শরতের সূর্য গড়াই’র মোহনায় গিয়ে পদ্মার বহু উজানে ডুবে গেছে। নদীর আকাশে তখন রক্তিম আবির। দেখছি গড়াই নদীর সান্ধ্যকালীন সেই অপার্থিব সৌন্দর্য আর মনে মনে ভাবছি আহা আজি হতে শতবর্ষ আগে রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় গৌরি’র বুকে ভাসিয়েছিলেন নাও, মেতে উঠেছিলেন নব নব সৃষ্টির আনন্দে!

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -০৭
ঠাকুর পরিবারের জমিদারী পরগণার মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে গড়াই নদী। রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় এই নদীকে কখনও বলেছেন গোড়াই, কখনও গৌরী। পদ্মার শিলাইদহ ঘাট থেকে তার ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে ঢুকতেন গড়াই নদীতে, আসতেন জমিদারীর কাজে। আর পানসী বা বজরা নিয়ে ঢুকতেন সাহিত্য সৃষ্টির মানসে। রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় এই নদীকে তার সাহিত্যে দুই নামেই উপস্থাপন করেছেন।
আমরা আজ কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত সেই গড়াইয়ের স্রোতে নৌবিহারে আছি। নৌকার বন্দোবস্ত করেছেন সোহেলের বন্ধু সাইদুর ভাই তার সাথে আছেন শেখপাড়া কলেজের শিক্ষক নাসির ভাই। সোহেল এবং আমরা সপরিবারে। শরতের নদী এখন পূর্ন যৌবনা তার স্রোতের তীব্রতায় আমি বিস্মিত হয়ে বললাম-
এতো খঢ়স্রোতা নদী ইদানীং দেখা যায়না, পানি কতফুট হতে পারে-মাঝি ভাই?
মাঝি বললেন-বিশ ফুটের কম নয়। মাঝি তার বোটে রাখা একটি লম্বা বাঁশ পানিতে নামিয়ে মেপে দেখালো।
বিস্মিত হয়ে বললাম- এতো ভয়ংকর নদী।
মাঝি বললেন- এখন ভয়ঙ্কর ঠিকই। ফারাক্কার বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে। এটা বানের জল। কিন্তু দু’তিন মাস পরে যখন শীত নেমে আসবে তখন দেখবেন ধুধু বালুচর। তখন পায়ে হেঁটে পারাপার হবে মানুষ। নদীর এই একমুখী স্রোত পদ্মা থেকে এসে গড়াই হয়ে মধুমতিতে পড়বে। এখানে জোয়ার -ভাটা নেই।
বললেন-তখন পদ্মাও শুকিয়ে যাবে। সবই তাদের দয়া। আমাদের যখন পানি দরকার তখন ভারত তা বন্ধ করে দেয় আর যখন দরকার হয়না তখন বাঁধ খুলে বানে ভাসায়। এই ফারাক্কা এদেশকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলেছে।
ভারতের দীর্ঘতম নদী গঙ্গা যা আমাদের রাজশাহীতে ঢুকে নাম নিয়েছে পদ্মা। এই রাজশাহীর সামান্য উজানে মুর্শিদাবাদে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করে ভারত একচেটিয়াভাবে পানি নিয়ন্ত্রনে রেখেছে যার বিরুপ প্রভাব পড়েছে দেশের সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে।
রাজশাহী দিয়ে ঢুকে গঙ্গা তার নাম পরিবর্তন করে হয়েছে পদ্মা। পদ্মার এক পাশে বাংলাদেশ অন্যপাশে ভারত। কুষ্টিয়ায় এসে এই পদ্মা থেকে গড়াই উৎপন্ন হয়ে কুষ্টিয়ার ভেতর দিয়ে বাঁক নিয়ে কুমারখালি শহরকে বামে রেখে বয়ে গেছে রাজবাড়ীর দিকে। ফলে অপরূপ এক মোহনা সৃষ্টি হয়েছে কুষ্টিয়া শহরের কাছে। যে স্থান দিয়ে গড়াইর উৎপত্তি তার নাম হাটশ হরিপুর। এ নদী কুমারখালি ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
গড়াই নদীর পাশেই কুষ্টিয়া শহরের রেইনউইক এন্ড জজ্ঞেশ্বর কোম্পানী। ১৯১৪ সালে জনৈক স্কটিশ ব্যবসায়ী ডবলিউ বি রেনউইক মেসার্স রেনউইক এন্ড কোম্পানী নামে এখানে দ্বিতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমটি করেছেন ১৮৮১ সালে রাজশাহীতে। চিনি কলের যাবতীয় খুচরা যন্ত্রাংশ, কৃষিযন্ত্র, আখ মাড়াই কল ও তার যন্ত্রাংশ এই কারখানায় তৈরী করা হয়।
এই কারখানা তথা কুষ্টিয়া শহরকে রক্ষা করার জন্যো গড়াইয়ের তীরে ভাঙন রোধকল্প নির্মান করেন বাঁধ। এই বাঁধের নাম রেনউইক বাঁধ। যা গড়াই নদীর সৌন্দর্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। এর একটু দূরেই হরিপুর কুষ্টিয়া সংযোগ সেতু।
রেনউইক বাঁধের পাশে পতিত জমিতে বনায়নের মাধ্যমে এটিকে আরও দৃষ্টি নন্দন করে তোলা হয়েছে। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ে এক মনোরম আবেশ সৃষ্টি হয় এখানে। যে কেহ এই স্থানটিকে কুয়াকাটা সৈকত বলে ভুল করতে পারেন। এখান দিয়েই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা-শিলাইদহ যাতায়াত করতেন। শিলাইদহ থেকে এসে ঢুকতেন গড়াই নদীতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়েছেন গড়াই-পদ্মা নদীর তীরে। তার লেখায় বহুবার এ নদী দুটির প্রসঙ্গ এসেছে। গড়াই নদীকে কবি গৌরী এবং গোড়াই দু’নামেই লিখেছেন।
অপরুপ সৌন্দর্যমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের সেই গৌরীর বুকে আমরাও নৌবিহার করছি, ভাবতেই আনন্দ লাগছে। আমরা যেখানটায় নৌকা ভাসিয়েছি তার উত্তর পাড়ে কুমারখালী শহর আর দক্ষিণ পাড় যদু বয়রা ইউনিয়ন। আমাদের নৌকার পাশ দিয়ে কয়েকজন মানুষ যদু বয়রা থেকে সাঁতরে কুমারখালীর দিকে যাচ্ছেন।
আমি অ্যান্ড্রয়েড হাতে লিখছি-
গড়াই নদীর বুকে
আমরা ক’জন ভাসিয়া চলেছি
আনন্দে ও সুখে
বয়সের দাগ অঙ্গজুড়িয়া
বিরহী ব্যাথার সুর
এই জলে সব যাক বহিয়া
গহীন সমুদ্দুর
শীতের শেষে জাগিবে নদীর
তৃষ্ণার বালুচর
বেভুল মনে সেই বালুচরে
বাঁধবো তাসের ঘর
আবার নামিবে বর্ষা জোয়ার
স্রোতে ভাসিবে সব
হয়তো এমনি হারাবে আমার
জীবনের কলরব।।
আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সোহেল বলল-
কাগজ কলম দেবো? কিছু কী লিখবেন কবি?
বললাম না, লিখতে হবেনা। তারপর মাঝিকে বললাম- মাঝি ভাই, আমাদের ঐদিকে ঐ ইকো পার্কে নামিয়ে দিন। ইকোপার্কে নেমে সন্ধ্যেবেলার আবছা অন্ধকারে বসলে নাসির ভাই জানতে চাইলেন কেমন লাগলো নৌ ভ্রমণ।
বললাম- বেশ লেগেছে।
বললেন- আপনার লেখা একটি কবিতা শোনান।
আমি মারুফার একটি কবিতা পাঠ করলে ভদ্রলোক প্রসংসা করলেন। তার সাথে আলাপচারিতায় বুঝলাম তিনি সাহিত্যের সমঝদার। পড়াশোনাও আছে।
অতঃপর অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সদ্য লেখা ‘গড়াই নদীর বুকে’ কবিতাটি পড়লে আমাদের মধ্যে এক ধরণের নীরবতা নেমে আসে। এ আসরে আমার স্ত্রী সুলতানা, নাসির ভাই এবং মারুফা কবিতাবোদ্ধা। তারা কবিতার লাইন ক’টির গূঢ়ার্থ অনুধাবন করে কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকেন।
অতঃপর সাইদুল ভাই বলেন- চলুন কবি, পদ্মপুকুরে গিয়ে চা খাবো।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-০৮
যাচ্ছি বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। শিলাইদহ যাওয়াই উদ্দেশ্য ছিলো। সোহেল বললো মহাসড়ক থেকে শিলাইদহের পথে প্রথমেই পড়বে আলাউদ্দিন নগর, সে এক দৃষ্টিনন্দন এলাকা। চলুন সেটা দেখতে দেখতে যাই।
কুমারখালী থেকে ইজিবাইকে মিনিট বিশেক চালিয়েই আলাউদ্দিন নগরে পৌঁছে গেলাম। এর পরেই শিলাইদহ। এটি কুমারখালীর নন্দলালপুর ইউনিয়ন। আলাউদ্দিন আহমেদ নামের জনৈক থনাঢ্য ব্যক্তি আলাউদ্দিন নগর শিক্ষাপল্লী নামে একটি এলাকায় গড়ে তুলেছেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনি একজন শিল্পপতি, সমাজ সেবক, শিক্ষানুরাগী ও দানবীর হিসেবে পরিচিত। পুরো নাম আলহাজ্ব ড. আলাউদ্দিন আহমেদ। এই ইউনিয়নের একটি গ্রাম নিভৃত পল্লী এই আলাউদ্দিন নগরে তাঁর জন্ম।
জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি এখানে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ক্যাডেট কলেজ, এতিমখানা, কিন্ডারগার্টেনসহ সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গ্রামটির পূর্ব নাম চকরঘুয়া, এখন আলাউদ্দিন নগর। আলাউদ্দিন সাহের শুধু জ্ঞানের আলোই ছড়াচ্ছেন না বরং মানুষের জন্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেও কাজ করে যাচ্ছেন।
উদ্যোগ নিয়েছেন একটি জৈব সার কারখানা প্রতিষ্ঠার যা বর্তমানে নির্মানাধীন। শুধু নিজ এলাকায়ই নয় দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলে পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে চলেছেন তিনি।
আমরা ইজি বাইকে যেতে যেতে দেখছি দীর্ঘ পথজুড়ে দু’পাশের এইসব প্রতিষ্ঠানসমূহ। ঝকঝকে রাস্তার দু’পাশে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত মনোরম সুরম্য সব অট্টালিকা। সেসব অট্টালিকার অঙ্গনজুড়ে বিচিত্রসব ফুলের বাগান। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি আর ভাবছি টাকা হলেই সবাই অমানুষ হয়ে যায়না। এদেশে অসীম ক্ষমতাধর, টাকাওয়ালা কত মানুষই দেখলাম। তাদেরকে দেখেছি সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারে একেবারে নিরেট পাথর আর পকেট বোঝেই টাকার পেছনে বুকের ভেতরও যে মানবিকতা থাকতে পারে তার উদাহরণ এই আলাউদ্দিন সাহেব।
আজকাল শোনা যায় দেশের অর্থ পাচার করে আমাদের রাজপতি আর সমাজপতিরা কানাডা অস্ট্রেলিয়ায় গড়ে তুলেছে বেগম পল্লী। দেশকে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মতো ব্যবসা বানিজের কলোনী বানিয়েছেন। এখানে রুজি রোজগার করে সে অর্থ পাচার করে সেখানে পাঠাচ্ছে, সেখানে তাদের বেগমরা মৌজ মাস্তি করছেন। আর আলাউদ্দিন সাহেবের মতো মানবিক মানুষরা নিজএলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পপতিষ্ঠান স্থাপন করে দেশের বেকারদের জন্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে চলেছেন।
তিনি শুধু নিজের প্রতিষ্ঠানই স্থাপন করেন নাই, এদেশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতি সংগঠন ও ক্রীড়া অঙ্গনের উন্নয়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে নিজেকে সত্যিকারের দানবীরের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর বাস্তব কর্মকান্ডে “কাল্পনিক কাহিনী আলাউদ্দিনের আচার্য্য প্রদীপ’” যেন পরাস্ত হয়েছে।
আশ্বিন মাস, রোদের তাপ কিছুটা কমে এসেছে। তবু দীর্ঘ ঘুরাফিরায় সবারই তেষ্টা পেয়ে গেছে। আমরা একটি রেষ্টুরেন্টে চা কফি খেয়ে কুঠিবাড়ির প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেলাম।
শিলাইদহে ভীড় এখন নেই বললেই চলে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারনে দীর্ঘদিন কুঠিবাড়ি বন্ধ ছিলো। দু’একদিন আগে খুলেছে। কুঠিবাড়ির দায়িত্বে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অফিসার মোখলেসুর রহমান সোহেলের পরিচিত ।পর্যটকদের টিকেট কেটে ঢোকা বাধ্যতামুলক। সেই অফিসার জনাব মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করে দিলেন।
ঢুকতে যাবো দেখি মারুফাদের পরিচিত এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তিনি কুণ্ডুপাড়ার লোক, নাম- রবিউল শেখ। বেশ পরিপাটি কেতা দুরস্ত। মারুফা আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ইনি কুমারখালীর জনৈক বিত্তশালী মানুষ। কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি মালাই দিয়ে তিনি আমাদের আপ্যায়ন করলেন। আমরা মূল ফটক দিয়ে কুঠিবাড়ি প্রবেশ করলাম।
মূল ফটক থেকে বাড়ির উঠোন। বেশ চওড়া রাস্তা। এই রাস্তায় রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করতেন। সড়কে দু’ধারে সারিসারি ফুলগাছ। নানান জাতের ফুল ফুটে আছে। তানিশা আর তূর্য আনন্দে দৌড়াদৌড়ি করছে, যেন দু’টো প্রজাপতি। বাড়ির নানান জায়গায় ছোট ছোট সাউন্ড বক্সে লো ভলিউমে বেজে চলেছে রবীন্দ্র সঙ্গীত। সম্ভবত শ্রীকান্ত আচার্য গাইছেন-
“মনে রবে কি না রবে আমারে
সে আমার মনে নাই ।
ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে,
অকারণে গান গাই “
আমিও অকারণে গেয়ে উঠি, চিত্ত নেচে ওঠে আনন্দে। ভেতরে এক প্রগাঢ় প্রশান্তি ছুঁয়ে যায়। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ১৪০০ সাল কবিতাটি-
“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে–
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের লেশমাত্র ভাগ–
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ অনুরাগে সিক্ত করি
পারিব না পাঠাইতে তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।”
উচ্চস্বরে আওড়ালাম কবিতাটি। আনন্দে, আবেগে আমার চোখ ভিজে গেলো। সুলতানা, মারুফা আর সোহেল আমার ছেলে মানুষী দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বললো- খুব আনন্দ পাচ্ছেন না?
বললাম- আহ্ রবীন্দ্রনাথ, তুমি কী শুনতে পাচ্ছো তোমার কবিতায় তোমাকে স্মরণ করছি আমি। আবেগে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। সে আবেগ সংক্রমিত হলো সুলতানা ও মারুফার মধ্যেও। কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটিয়ে আমরা কুঠিবাড়িতে ঢুকলাম।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -০৯
শিলাইদহের ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ির উঠোনে গিয়ে যখন দাঁড়াই তখন শরতের সূর্য মাথার উপর অনেকটাই উঠে এসেছে। দ্বিপ্রহরের খুব বেশি বাকী নেই। কুঠিবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছে দিনাজপুর কুঠিবাড়ির কথা। সীমান্ত বাহিনীতে থাকতে দিনাজপুর কুঠিবাড়িতে কয়েক বছর চাকরি করে এসেছি।
দিনাজপুরে ফ্যামিলীসহ থাকতাম। কুঠিবাড়িটি সুরতানাও দেখেছে। বললো- এটা দেখতেতো দিনাজপুরের মতো না?
মারুফা জিজ্ঞেস করলো, দিনাজপুরেও কুঠিবাড়ি আছে নাকি?
সুলতানা বললো আছে তবে সেটা ইংরেজরা তৈরি করেছেন। আর এটা বোধহয় রবীন্দ্রনাথের করা। দু’টোর নির্মান কৌশল ভিন্ন ভিন্ন। বলেই সমর্থণের জন্যে আমার দিকে তাকায়।
আমি বললাম- না না, ঠাকুর পরিবার এটি বানননি। এটি রবীন্দ্রনাথের দাদাঠাকুর ইংরেজদের কাছ থেকে জমিদারীসূত্রে লাভ করেছেন।
মূলতঃ নির্মাণশৈলীর দিক থেকে দু’টি বাড়ি সম্পূর্ণ আলাদা। দিনাজপুর কুঠিবাড়ি যেখানে বিডিআর সেক্টর সদর দপ্তর এবং একটি ব্যাটেলিন সেটি পাশাপাশি দু’টি একতলা ভবন যার মধ্যিখানে খোলা উঠোনের মতো আর চারপাশে ঘোরানো আয়াতাকার অনেকগুলো কক্ষ। আর রবীন্দ্রনাথের এই কুঠিবাড়িটি বাহির থেকে দেখলে অনেকটা আধুনিককালের বাড়ির মতোই মনে হয়।
কুঠিবাড়ির কথা মনে হলে মনে পড়ে যায় বাংলার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও নীলচাষের করুন ইতিহাসের চিত্র। কাপড়ে রঙ দেয়ার জন্য সে আমলে বহুল ব্যবহৃত এই নীল ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের সর্বাধিক লাভজনক পণ্যের তালিকায় অন্যতম ছিল।
আর নীলচাষ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোনো ইংরেজ সাহেবের হাতে চাবুক, অসহায় কৃষকের চোখে জল, নিরুপায় আহাজারি ও ক্ষুধার হিংস্র থাবা। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সময়ের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এইসব নীলকুঠি।
মহর্ষি রবীন্দ্রনাথের কারনেই সেই শিলাইদহ কুঠিবাড়ি আজ বাঙালির অহংকারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্যে বাঙালি জাতিসত্বার পরিচয়ে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির রয়েছে অপরিসীম অবদান। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল বাঙালির কাছে শিলাইদহ হয়ে উঠেছে তীর্থস্বরুপ।
দিনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পন’ নাটকটি আমাদের সময়ে মাধ্যমিকের পাঠ্য ছিলো। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, বাকেরগঞ্জ সেন্ট আলফ্রেড স্কুলে ভর্তির জন্যে গিয়ে স্কুলে মঞ্চস্ত হওয়া নীল দর্পন নাটকটি দেখেছিলাম, যা আমার মনোজগতকে আলোড়িত করেছিলো। পরে দিনাজপুরে কর্মরত থাকাকালীন ইতিহাস খুঁজে জেনে নিয়েছিলাম নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত।
জোর করে নীল চাষ করাতে গিয়ে নীলসাহেবরা ভারত উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলার কৃষকশ্রেণির উপর যে জুলুম নির্যাতন করেছেন ইতিহাসে তা নিষ্ঠুর ও লজ্জাজনক অধ্যায়। জোর করে কৃষি জমিতে নীল চাষ করানো ছাড়াও নীলকরদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিলো। যার মধ্যে নির্বিচারে হত্যা, নারীর অবমাননা, অপহরণ, জুলুম- অত্যাচার ও ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ ছিলো।
জোরপর্বক নীল চাষ করার জন্য কৃষকদের ধরে নিয়ে দিনের পর দিন অনাহারে গুদামে বন্দী করা হতো। তাদের আপনজনরা যাতে কোনো খোঁজখবর না পান সেজন্য তাদের এক কুঠি থেকে অন্য কুঠিতে ঘুরানো হতো। নীলকরেরা বলতো- ‘চৌদ্দ কুঠির জল খাইয়ে ছাড়বে।’’
ডানলপ নামের এক নীলসাহেব প্রকাশ্যে এক কৃষককে হত্যা করে প্রজাদের ভয় দেখান এছাড়া ময়মনসিংহ বাগমারী নীলকুঠির কিং সাহেব নীল বুনতে অস্বীকার করায় একজন প্রজার মাথা মুড়িয়ে তাতে কাদা মেখে নীলের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। এই অত্যাচার জুলুম চলেছিলো শতাব্দীকাল ধরে।
এ সময়ে মোড়েলগঞ্জে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইংরেজ জমিদার রবার্ট মোড়েল বাহিনীর হাতে শহীদ হন রহিম মোল্লা নামের কৃষকপুত্র এক বীর নওযোয়ান। ইংরেজ ছাড়াও স্থানীয়দের মধ্যেও কেউ কেউ নীল চাষ করাতেন। এমনই একজন নেটিভ নীলকর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুর। তবে স্থানীয় জমিদাররা নীল চাষ করালেও ইংরেজদের মতো অত্যাচারী ছিলেন কিনা তা জানা য়ায়না।
ইংরেজ নীলকর জমিদারদের ঐসব অত্যাচারের প্রেক্ষিতে কৃষকশ্রেনির মধ্যেই ১৮৫৯ সালে সারা বাংলায় নীলপ্রধান এলাকায় ব্যাপক বিদ্রোহ শুরু হয় এবং এর প্রেক্ষিতে বন্ধ হয়ে যায় নীল চাষ।
নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীনবন্ধু মিত্র রচনা করেন ‘নীল দর্পণ’ নাটক যা সমগ্র বাংলায় তথা ভারতবর্ষে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘নীল দর্পণ’ নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন পাদ্রি লং নামে একজন ইংরেজ সাহেব। এ অপরাধে ঐ সাহেবের হাজার টাকা জড়িমানা এবং সাজা হয়েছিলো বলে জানা যায়। বর্তমান ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার জন্ম নেয়া নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ১৮৭৩ সালের পয়লা নভেম্বর ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর শিলাইদহে এই নীলককুঠিও সেই নীল চাষের জন্যে ব্যবহৃত একটি স্থাপনা।গ্রামটির পূর্ব নাম ছিলো কসবা। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি লাভ করলে উত্তরাধিকারসূত্রে রবীন্দ্রনাথ এটির মালিক হন। যুবক রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯ সালে এখানে জমিদার হয়ে আসেন এবং ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করেন। এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী। গীতাঞ্জলী কাব্যের অনুবাদের কাজও এখানে বসেই শুরু করেন। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী সহ আরো অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ রবীন্দ্রনাথের সাথে এখানে দেখা করতে এসেছেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকার এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে যান এবং দেশ স্বাধীনের পর কবির বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহপূর্বক একে একটি জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
ভবনের অভ্যন্তরে ঢুকে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি। ভবনের নীচ ও দ্বিতীয় তলায় ১৬টি কক্ষেই কবির নানান বয়সের ছবি। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কৃষক বন্ধু রবীন্দ্রনাথ- বিচিত্র ভঙ্গির রবীন্দ্রনাথের ছবি । বাল্যকাল থেকে মৃতু্শয্যার ছবি পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে । তাছাড়াও রয়েছে শিল্পকর্ম এবং তাঁর ব্যবহার্য আসবাবপত্র দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো।
রয়েছে চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটো স্পিডবোট, পল্টুন, ৮বেহারা পালকি, কাঠের চেয়ার, টি টেবিল, সোফাসেট, আরাম চেয়ার, পালংক ইত্যাদি কবির নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ।
কুঠিবাড়ির দায়িত্বে থাকা প্রত্নতাত্বিক অফিসার জানান এখানে মোট জমির পরিমান ৩৩ বিঘা যার ওপর এই তিনতলা কুঠিবাড়ি। বাড়িটি বানিয়েছিলো নীলকর সাহেবরা যা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ জমিদারিসূত্র পেয়ে যান। মূল বাড়িটি রয়েছে আড়াই বিঘার ওপর। চারদিকে নানান গাছগাছালির ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ পরিবেশ। সামান্য দূরেই আপনমনে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী।
কবির যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়, ঠিক তখনই তিনি বিচরণ করেছেন শিলাইদহে। কখনও একাকী, কখনও স্ত্রী, পুত্র-কন্যা নিয়ে এসেছেন শিলাইদহে, পেতেছেন ক্ষণিকের সংসার; ঘুরে বেড়িয়েছেন বোটে, পালকিতে। পদ্মা আর গড়াই নদী ছিলো কবির সবচেয়ে পছন্দের অবগাহনস্থল।
শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে অবস্থানকালীন সময়ে কবি যে সাহিত্য সৃষ্টি করেন তাই তাকে এনে দেয় বিশ্ব পরিচিতি, লাভ করেন নোবেল পুরস্কার। সে কারনে বাংলাদেশও আজ গর্বিত। শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ যেসব গান-কবিতা লিখেছেন, তার মধ্যে কুঠিবাড়ির পাশে বকুলতলার ঘাটে বসে লেখা “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে” গড়াই নদীতে বোটে বসে লেখা “সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর” “শিলাইদহে বসে লেখা “আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ”, “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি” প্রভৃতি। কবিগুরু শিলাইদহে ছিলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত। এই সুদীর্ঘ ৩০ বছর এখানে অবস্থানকালে তিনি সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -১০
কুঠিবাড়ি মূল ভবনের আঙিনায় রয়েছে এক দৃষ্টিনন্দন সরোবর। রবীন্দ্রনাথ এখানে আসার আগেই এটি খনন করা হয়েছিলো। তিনি এটিকে পুনঃখনন করেছিলেন। চারিদিকে বিশাল বিশাল বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক অপার্থিব দৃশ্যপট। মূল ভবন থেকে সোজা একটি সড়ক এসে নেমে গেছে দীঘীর ঘাটে। শান বাঁধানো এ ঘাটের নাম বকুল তলা ঘাট।
সোহেল আর মারুফা আগেও এখানে এসেছে। মারুফা বললো- গুরু ঘাটে চলুন, ভালো লাগবে। বললাম চলো।
সে বললো-ঘাটে বসলে আপনার অাপনা আপনি লেখা চলে আসবে। হাসলাম, বললাম- আমার লেখার যোগ্যতা কোথায়? আমরা ঘাটে গিয়ে বসতে সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত ছায়াঘেরা নিবির পরিবেশ। শান বাঁধানো ঘাটের দু’ধারে দু’টি বিশাল বৃক্ষ। কুঠিবাড়ির প্রত্যেকটি গাছের পাশে প্লাকার্ডে গাছের নাম, কে কবে লাগিয়েছেন ইত্যাদি বিশদভাবে লেখা রয়েছে। ঘাটের দু’পাশের সেই গাছ দু’টির পাশে লেখা দেখে বুঝলাম রবীন্দ্রনাথ নিজেই গাছগুলো লাগিয়েছিলেন।
গাছদু’টি হয়তো ঝড়ে ভেঙে গিয়েছিলো। তবু জীবন আছে, রবীন্দ্র ভক্তদের উদ্দেশ্যে যেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলতে চাচ্ছে- “কে বলেগো সেই প্রভাতে নেই আমি? “
মনে মনে ভাবলাম আহা মানুষের জীবন কত ছোট! কতো সংক্ষিপ্ত মানুষের সফরের কাল! একটি গাছের সমান আয়ুও যে মানুষ পায়না তার কীসের গর্ব, কীসের অহংকার!
ঘাটের অদূরে কবি যে বজরা বা পানসীতে কলকাতা থেকে শিলাইদহ আসতেন সেই বজরার আদলে কাঠের তৈরী একটি প্রতীকি নৌকা পড়ে আছে। বহু বছরের ব্যবধানে নৌকাটির জরাজীর্ণ দশা। কয়েকজন যুবক সরোবরে গোসল করছেন। তীরে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে ছবি তুলছেন বজরায় চরা এক যুবকের। হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকা হবে।
বকুলতলায় কয়েকজন শিল্পী বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে আছেন তাদের সমুখে ঘাসের উপর শতরিঞ্চি পাতা। চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো প্লাস্টিকের চেয়ার। পরিবেশ দেখে মনে হলো তারা গান পরিবেশনের নিমিত্তে অপেক্ষমান। দর্শক সারিতে কাউকে না দেখে সুলতানা বললো-
এরা বোধহয় এখানের নিয়মিত শিল্পী, চলোনা তাদের গান শুনি?
মারুফার সাথে তার কথোপকথনের প্রেক্ষিতে এগিয়ে গিয়ে শিল্পীদের জিজ্ঞেস করলাম আপনারা গান করবেন নাকি?
বয়স্ক একজন বললেন হ্যাঁ, কেউ শুনতে চাইলে বা ফরমায়েশ করলে আমরা গান করে থাকি।
বললাম তা সে ফরমায়েশ কে করবেন? কখন করবেন?
ভদ্রলোকের নাম রানু বিশ্বাস, বললেন- দর্শক স্রোতাদের যখন মর্জি হবে?
হাসলাম, বললাম- তবে অপেক্ষায় থাকি? কারো মর্জি হলে তখন আমরাও সেই সুযোগে শুনে যাবো? ভদ্রলোক রসিকতা বুঝতে পারলেন। বললেন- বসুন,আপনাদেরকেই শোনাই। করোনার জন্যে পর্যটক খুব একটা নেই, পেট চলেনা ভাই। আপনারাই খুশি হয়ে যা দিবেন তাতেই চলবে।
বললাম, তবে তাই হোক।
আমরা দর্শক সারিতে মাত্র ছয়জন, রানু বিশ্বাস হারমোনিয়াম ধরলেন, বললেন- প্রার্থনা পর্বের একটি গান দিয়ে শুরু করি। তিনি সুর তুললেন-
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।
( মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না।
অন্ধ করে রাখে, তোমারে দেখিতে দেয় না। )
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই হারাই’ সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।
( আশ না মিটিতে হারাইয়া– পলক না পড়িতে হারাইয়া–
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে। )
কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে–
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে।
( আমার সাধ্য কিবা তোমারে–
দয়া না করিলে কে পারে–
তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে। )
আর-কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ–
ওহে তুমি যদি বলো এখনি করিব বিষয় -বাসনা বিসর্জন।
( দিব শ্রীচরণে বিষয়– দিব অকাতরে বিষয়–
দিব তোমার লাগি বিষয় -বাসনা বিসর্জন। )”
সুরের আবেশে, গানের কথায় আমি বিহবল হয়ে পড়েছি, চেয়ার ছেড়ে তার কাছে গিয়ে তন্ময় হয়ে শুনছি। আমার ভেতরে তখন বোবা কান্না গুমড়ে মরছে। আবেগে চোখ সজল হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে পৃথিবীর তামাম মানুষের প্রার্থনা কবি গুরুর কথায় রানু বিশ্বাসের কণ্ঠে ঝরে ঝরে পড়ছে।
রানু বিশ্বাস মানুষটি মিচমিচে কালো, শুরুতে তাকে তেমন পাত্তা দিইনি কিন্তু এ মুহুর্তে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ বলে মনে হচ্ছে। রানু বিশ্বাস শিলাইদহের মানুষ, দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে কুঠিবাড়িতে পর্যটকদের গান গেয়ে শোনান। বললেন- তৃপ্তি পাই, আপনার মতো সমঝদার যখন পাশে বসেন তখন গান আমার কাছে শুধুই আনন্দ। বললেন কোন অনুরোধ থাকলে বলতে পারেন।
তার প্রশংসায় আমি বিব্রত হই তবু সঙ্কোচ কাটিয়ে বলি – ”যখন পড়বে না মোর পায়ের চিন্হ এই বাটে ”, ইদানীং এই গানটি আমাকে খুব টানে। শুনেছি গুরুদেব এই গানটি এখানে বসেই রচনা করেছিলেন।
রানু বিশ্বাস বললেন-হ্যাঁ, বলেই তার দরাজ কণ্ঠে সুরের মুর্ছনা তুললেন। আমি থরে থরে গাঁথা দীঘীর ঘাটের দিকে তাকিয়ে নিবিষ্ট হয়ে শুনছি। তার কণ্ঠে তিনি গেয়ে চলেছেন।
“শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় —
তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে
তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,”
আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমি যেন কবিগুরুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখে আমার অনাগত ভবিষ্যৎ দৃশ্যমান হচ্ছে- একদিন আমিও রবীন্দ্রনাথের মতো তারার দেশে চলে গেছি। মনে মনে বলছি হে রবীন্দ্রনাথ তোমাকে আমি ডাকছি, দেখ তোমার ঘাটে শ্যাওলা জমেনি, তোমার অগণিত ভক্তদের পদচারণায় শ্যাওলা জমার অবসর হয়নি। আমার মতো কোটি মানুষের হৃদয়ে তুমি বেঁচে আছো, থাকবে। আর আমি জানি আমি চলে গেলে আমাকে স্মরণ করার হয়তো কেউ থাকবেনা। হয়তো নতুন কেউ এখানে আসবে তোমার এই ঘাটে বসে তোমার এই গান শুনবে, তোমাকে শ্রদ্ধা জানাবে।
গান থামিয়ে রানু বিশ্বাস বললেন -জানেন স্যার, আপনার মতো শ্রোতা বহুদিন পরে পেলাম। বললেন- আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি।
আপনি যা ভাবছেন ঠিক তাই, গুরুদেব এ গানটি ঠিক এখানে বসেই লিখেছিলেন। হয়তো এই দীঘী, এই ঘাটের কথাই তিনি তার গানে লিখে গেছেন।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -১১
শিলাইদহ কুঠিবাড়ির সামান্য একটু দূরেই গগন হরকরা বা গগন চন্দ্র দাসের বাড়ি। গ্রামের নাম আড়পাড়া। গগনের জন্ম-মৃত্যুর সঠিক সন তারিখ অজানা থাকলেও গবেষকদের মতে জন্মশাল ধারনা করা হয় ১৮৪৫ এবং মৃত্যু ১৯১০ খ্রিঃ।
কুঠিবাড়ির শিল্পী রানু বিশ্বাস এবং স্থানীয় লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে অনেককিছুই জানা গেলো। তদুপরি নানান গুণীজনের গবেষণাপ্রসূত লেখা পড়ে জানার চেষ্টা করলাম গগন হরকরার ইতি বৃত্তান্ত।
গগন হরকরা পেশায় ছিলেন একজন কৃষক পাশাপাশি শিলাইদহ পোস্ট অফিসে তিনি চিঠি বিলির কাজ করতেন। লালনের সমসাময়িক হলেও বয়সে লালনের চেয়ে ছোট ছিলেন। লালনের গানের ভক্ত ছিলেন গগন, লালনও গগন হরকরার গান শুনতেন। তবে লালন দ্বারা প্রভাবিত না হয়েও তিনি নিজে স্বতন্ত্র ধারায় গান রচনা করেছেন। গগনের গানের কথা এবং সুর তার নিজের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে গগন হরকরার ছিলো গভীর ঘনিষ্ঠতা। ছিলো কুঠিবাড়িতে নিবির যোগাযোগ। রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার দুটি গান ভেঙে লিখেছিলেন –
“যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বোনা মা।” এবং লিখেছিলেন
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”।
উপরোক্ত গান দু’টি যে গানের সুর ভেঙে করা হয়েছিলো তা গগন হরকরার। গগনের সেই গানের কথা ছিলো “ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে” এবং “আমি কোথায় পাব তারে”।
গগনের যে গানটি ভেঙে কবি “আমার সোনার বাংলা” লিখেছেন সে গানটির লিরিক পাঠকদের জন্যে পেশ করা হলোঃ
“আমি কোথায় পাব তারে,
আমার মনের মানুষ যেরে।
আমি কোথায় পাব তারে,
আমার মনের মানুষ যেরে॥
হারায়ে সেই মানুষে
তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে,
আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যেরে।।
☆☆☆
লাগি সেই হৃদয়শশী
সদা প্রাণ হয় উদাসী,
পেলে মন হত খুশী,
দিবা-নিশি দেখিতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে,
নিভাই কেমন করে,
মরি হায়, হায় রে-
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে,
নিভাই কেমন করে,
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে,
বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
দেখ না তোরা হৃদয়ে এসে,
দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যেরে।।
☆☆☆
দিব তার তুলনা কি
যার প্রেমে জগৎ সুখী,
হেরিলে জুড়ায় আঁখি,
সামান্যে কি দেখিতে পারে তারে।
তারে যে দেখেছে সেই
মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে,
মরি হায়, হায় রে-
তারে যে দেখেছে সেই
মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে,
ও সে না জানি কি কুহক জানে
না জানি কি কুহক জানে।
অলক্ষে মন চুরি করে,
কটাক্ষে মন চুরি করে।
কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যেরে।।
☆☆☆
কুল মান সব গেল রে
তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে-
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না
জেনে তায় গগন ভেবে মরে,
মরি হায়, হায় রে-
ও তার বসত কোথায় না
জেনে তায় গগন ভেবে মরে।
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস, মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস
কৃপা করি বলে দে রে,
আমার সুহৃদ হয়ে বলে দে রে,
ব্যথার ব্যথিত হয়ে বলে দে রে,
কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যেরে।
হারায়ে সেই মানুষে
তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে,
আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যেরে
আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যেরে।।”
রবীন্দ্র বিদ্বেষী বা নিন্দুকদের অনেকেই অজ্ঞতাহেতু বলতে চেষ্টা করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ জাতীয় সঙ্গীতের সুর গগন হরকরা থেকে চুরি করেছিলেন। কথাটি আদৌ সত্যি নয় বরং যা দেখা যায় তা হচ্ছে পল্লীর এক অখ্যাত বাউল শিল্পির সুর ভেঙে তার গানে সুরারোপ করে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্ব ব্যক্তিত্ব গগনকে বরং সম্মানিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্নভাবে গগন হরকরাকে সাহিত্যের দরবারে সম্মানের সাথে জাহির করেছেন।
‘আরশি নগরের পড়শি’ শিরোনামে আমার এ লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে আমি স্বশরীরে উল্লেখিত স্থানগুলোতে অনেকদিন থেকেছি। সে সময়ে প্রবীন ও প্রাজ্ঞজনদের কাছ থেকে জেনেছি অনেককিছু তেমনি বাল্যকাল থেকে নানান বই পুস্তক পড়ে সর্বোপরি বর্তমান লেখাটি তৈরি করার সময়ে এ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক গবেষণাধর্মী লেখাগুলো পড়ে তথ্য নিয়েছি।
কবিগুরু যে জেনেশুনে গগনের গানের সুর তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিতে বসিয়েছিলেন, তা তার মন্ত্রশিষ্য ও ছায়া সঙ্গী শান্তিদেব ঘোষের লেখায় উল্লেখ আছে বলে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগনের মোট দু’টি গানের সুর তার গানে স্বজ্ঞানেই সুরারোপ করেছেন। বরীন্দ্রনাথ বরং এই গানের মাধ্যমে বাংলার এক প্রান্তিক শিল্পীকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন।
গগন তার সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে কবিগুরুকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করেছেন। তাই ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩২২ বাংলার বৈশাখ সংখ্যায় ‘হারমণি’ বিভাগ চালু হলে ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’-ভাবতত্ত্বের এ গান দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিভাগের সূচনা করেন। এই গানের মধ্যে দিয়ে কবিগুরু বাংলার এই প্রান্তিক শিল্পীকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন প্রবন্ধে এবং দেশ বিদেশের বিভিন্ন বক্তৃতায় বাংলার বাউল ধর্মমতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লালন শাহ ও গগন হরকরার গানের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ১৯৩০ সালে লেখা তার ‘মানবধর্ম’ প্রবন্ধে বাউলের মানবতাবাদী দর্শনের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত An Indian Folk Religion’ শীর্ষক আলোচনা সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগনের ‘কোথায় পাবো তারে’ গানটির কথা উল্লেখ করে বলেছেন,
“এই প্রথম বাউলগান, যা আমি মন দিয়ে শুনেছি এবং যার জন্য আমার মন আন্দোলিত হয়েছে।”
পরবর্তী সময়ে মনসুরউদ্দীন সম্পাদিত হারামণি গ্রন্থের ভূমিকায় লেখা গগনের এই গানটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ভূয়সী প্রশংসা করেন লিখেছেন,
“গানের কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের মূর্চ্ছনায় এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।”
ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করতে ‘বঙ্গভঙ্গ’ অধ্যাদেশ জারি করলে প্রশাসনিকভাবে বাংলাকে যখন বিভক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঢেউ উঠে সারা বাংলায়। ঠাকুর পরিবারের প্রভাবশালী জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ সমর্থন দেন এ আন্দোলনে। প্রতিবাদের জন্য তখন স্বদেশী গানের প্রয়োজন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন,
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।”
ভিবিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সেই ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়।
সময়ের বিবর্তনে আসে ১৯৭১ সাল। সমগ্র পূর্ববঙ্গ তখন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে একজোট। ১ লা মার্চ গঠিত হয় কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ। পরে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার। সেই সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়। এই ছিলো আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি এবং গগন হরকরার আড়পাড়া ঘুরতে ঘুরতে দুপুরের খাবার সময় হয়ে যায় তবু শিলাইদহ পদ্মার ঘাট দেখা এবং পদ্মার বুকে নৌবিহার করার বাসনা ত্যাগ করতে পারলাম না। ভ্যানে চরে শিলাইদহ ঘাটে যেতে যেতে নদীর কাছাকাছি দেখতে পাই একটি পরিত্যক্ত দ্বোতলা বাড়ি। ভ্যানচালকের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নিলাম এটি রবীন্দ্রনাথের কাচারিবাড়ি, এখানে বসে খাজনা আদায় করতেন রবীন্দ্রনাথের কর্মচারীরা।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-১৩
কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে জন্ম নেয়া ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দুর্ধর্ষ বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায বা বাঘা যতীন এবং সাহিত্যিক আকবর হোসেনের বিষয়ে আমার দীর্ঘদিনের আগ্রহ। খুব সকালে তাই সুলতানাকে বললাম কয়া গ্রামে যাবো। বললো- কয়া গ্রাম আবার কোথায়? সেখানে আবার কার মাজার?
বললাম- বাঘা যতীনের নাম শুনেছো? সাহিত্যিক আকবর হোসেনের বাড়িও ওখানে।
আকবর হোসেনকে চিনতে পারলো। তার অবাঞ্ছিত উপন্যাসখানা আমার সংগ্রহে ছিলো, সে সুবাদে সুলতানাও উপন্যাসটি পড়েছেন। কিন্তু বাঘা যতীনের নাম এই প্রথম শুনলো। অবশ্য আমিও বাঘা যতীনকে আগে খুববেশী জানতাম না।
সুলতানার অনাগ্রহ দেখে যাবো কী যাবোনা এমন দোটানায় পড়ে গেলাম। মারুফা অফিসের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। বললো- অফিস না থাকলে আমিই যেতাম। তবে ভাবীকে নিয়ে আমার কিছু কাজও আছে আপনি বরং সোহেলকে নিয়ে যান।
সোহেল এসব বিষয়ে খুব বেশী আগ্রহী নন। বৈষয়িক মানুষ, বিপ্লবী বাঘা যতীন বা সাহিত্যিক আকবর হোসেন কারো নামই কোনদিন শুনেননি। বললাম কলকাতার বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষেরর বাড়িও কয়া গ্রামে। সোহেল বললো- সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়ের বাড়িতে তার আপনজনদের কেউ আছেন নাকি? মানে তার পরিবারের কেউ থাকেন?
বললাম সৌমিত্র চট্রপাধ্যায়ে দাদাঠাকুরই কয়া ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। কথাটি শুনে সোহেলের আগ্রহ হঠাৎ নিভে যায়। তবু আমার সম্মানে না করতে পারেন না অবশ্য ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে তিনি তার এক বন্ধুকেও সাথে নেন। নাস্তাশেষে একটি ইজিবাইকে করে সড়কের দু’ধারের অবারিত সবুজের মধ্য দিয়ে সেই সকালে ছুটে গেলাম আরশি নগরের পড়শি বাঘা যতীনের স্মৃতিস্তম্ভ কয়া কলেজ মাঠে। তখন সকাল দশটা, করোনার জন্যে কলেজ বন্ধ।
কুষ্টিয়া জেলাকে সবাই বলেন সাংস্কৃতিক রাজধানী আর আমি বলি কুষ্টিয়ার কুমারখালী হচ্ছে সাহিত্য-সংস্কৃতির তীর্থস্থান। শুধু শিল্প-সাহিত্যই নয়, আমার ধারণা কুমারখালী হচ্ছে সেই জনপদ যা একদিকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সুতিকাগার। অন্যদিকে বাঙালীর নব জাগরণ এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও এই জনপদের রয়েছে গৌরবময় অবদান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন পৈত্রিক জমিদারী পরিচালনা করতে এসে এখানে বসে দীর্ঘ তিরিশ বছর সাহিত্য চর্চা করেছেন তেমনি উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাউল সম্রাট লালন ফকির জাত-পাত- ধর্মের উর্ধে উঠে ছড়িয়েছেন মানবতার বানী। মীর মোশাররফ হোসেন ছাড়াও কুমারখালীর সূর্য সন্তানদের মধ্যে আছেন কাঙ্গাল হরিণাথ মজুমদার , রায় বাহাদুর জলধর সেন, কবি ড. হরগোপাল, বাউল গগন হরকরা প্রমুখ।
এখানেই জন্মেছেন কবি আজিজুল হক, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, শিশু সাহিত্যিক জোবেদা খানম, বিপ্লবী মিয়াজান, বাঘা যতীন, কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ছড়াকার নাসের মাহমুদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিশু সংগঠক রোকনুজ্জামান দাদাভাই এবং ফুটবলে বাংলার ম্যারাডোনাখ্যাত ওয়ালী সাব্বিরের মত কীর্তিমান কত্তো মানুষ!
সোহেলের বন্ধুর নাম রহমত আলী। তাকেও এসব বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হলো না। তবু তাদের নিয়েই কয়া এসেছি বিপ্লবী বাঘা যতিনের স্মৃতি অবলোকন এবং শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে। আর আছেন প্রিয় কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেন। তার বাড়িও এই কয়া গ্রামে। সেই আশির দশকে তার সাড়া জাগানো উপন্যাস অবাঞ্ছিত পড়ে আকবর হোসেনে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। বাংলা সাহিত্যে কিংবদন্তিতূল্য এই কথাকারের জন্মস্খান কুমারখালীর কয়ায়। ষাট ও সত্তুরের দশকে কথা- সাহিত্যিক আকবর হোসেনের জনপ্রিয়তা সকল সাহিত্যিককে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির ইতিহাসে ঐ সময়ে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে তার নাম উচ্চারিত হতো।
আকবর হোসেনের বাবার নাম হাজী আব্দুল বিশ্বাস ও মাতা ময়জান নেছা। নজিবর রহমান সাহিত্য-রত্ন নামে কুমারখালীতে আরও একজন সাহিত্যিকের গৌরবময় পদচারণা ছিলো। আকবর হোসনের অবাঞ্ছিত উপন্যাসটি পড়ে মনে হয়েছিলো তিনি এ দেশের সেরা সাহিত্যিকদের একজন। প্রকৃতি ও মাটি মানুষের জীবনচিত্র, সমাজ সংসার, চারপাশের চেনা জগৎ আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধরা দিয়েছে তার লেখায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে।
আজ এদেশে উপন্যাস, সাহিত্যে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার শীর্ষে যারা অবস্থান করছেন আকবর হোসেন এদের চেয়ে বেশি নিরেট ও শক্তিশালী ঔপন্যাসিক ছিলেন। কথা সাহিত্যিক আকবর হোসেনেরর মোট বইয়ের সংখ্যা ৩২।
দুঃখজনক বিষয় হলো কয়া কলেজ প্রাঙ্গনে আমরা যখন বিপ্লবী যতীনকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তখন অনেকের কাছেই সাহিত্যিক আকবর হোসেন সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেছি কিন্তু কেউই তার সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে পারলেন না। এমন কী আকবর হোসেনকে তেমন কেউ চিনতেও পারলেন না। কুষ্টিয়ার কবি শাজজাহান পারভেজ রনি ভাইকে ফোন দিয়েছিলাম। তিনিও তেমন কিছু জানাতে পারলেন না। গ্রামের বর্ষীয়ান লোকেরা যা জানালেন তা হচ্ছে আকবর হোসেন নামে এখানে একজন মানুষ মাঝে মধ্যে আসতেন। তবে তিনি সাহিত্যিক ছিলেন কিনা তারা জানেন না।
আকবর হোসেনের বইয়ের পরিচিতি থেকে জানা যায় তিনি ১ অক্টোবর ১৯১৭ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কেয়া গ্রামে জন্ম নেন এবং ২রা জুন ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
কুমারখালীর কবি সিদ্দিক প্রামানিকের কাছে
আকবর হোসেন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আফসোস করে বলেন-তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে অবাঞ্ছিতসহ বেশ কয়েকটি উপন্যাস নিয়ে সিনেমা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, খুব বড় মাপের এই সাহিত্যিক আজও অবমূল্যায়িত রয়ে গেলেন। বাংলার নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছেন এই কৃতি সাহিত্যিকের নাম অথচ কতো আগাছা তেল তোষামদি করে বাগিয়ে নিলেন সরকারি দান অনুদান, পদক শিরোপা।
আকবর হোসেনের লেখা জনপ্রিয় কয়েকটি উপন্যাস হলো— অবাঞ্ছিত, কী পাইনি, মোহমুক্তি, ঢেউ জাগে, আলোছায়া, দু’দিনের খেলাঘরে , মেঘ বিজলী বাদল, নতুন পৃথিবী, দুষ্টক্ষত এবং আভা ও তার প্রথম পুরুষ।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-১৪
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ বা বাঘা যতীনের মৃত্যুর পরে যে পুলিশ বাহিনী তাকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করেছিলো সেই বাহিনীর কমিশনার মিঃ টেগার্ট স্বয়ং যতীনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছিলেন-
“I have met the brevest Indian. I have the greatest regard for him but I had to do my duty.”
আর যতীনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের জাতীয় কবি লিখেছেন-
“বাঙালির রণ দেখে যা তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠী জাত
বালাশোর, বুড়ি বালাম তীর
নবভারতের হলদিঘাট”।
এই দুঃসাহসী, দুধর্ষ বাঘা যতীনের ম্যুরালের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনেই হয়নি যে এর মতো মানুষ প্রবল পরাক্রমশালী ব্রিটিশদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার মতো শক্তি বা সাহস রাখতেন। ডাগর ডাগর দু’টি চোখ, উন্নত টিকালো নাক আর চেহারায় নিতান্ত সহজ সরল অভিব্যক্তির এই মানুষটি নাকি কৈশোরেই প্রবল পরাক্রমের জন্যে বাঘা খেতাব পেয়ে যান।
আমার ভ্রমণসঙ্গীরা যদিও দীর্ঘদিন কুমারখালী থাকেন কিন্তু তারা একেবারেই বৈষয়িক মানুষ আমার এই ভ্রমণের উদ্দেশ্যের সাথে তাদের মানসিকতার কোন মিল নেই। স্থানীয় কারও কাছে যতীন কিংবা আকবর হোসেন সম্পর্কে কোন তথ্যাদি জানতেও পারছিলাম না। অনেকটা বিরস মনে ফিরে আসার সময়ে একটি দোকানে চা খেতে বসি।
কয়া কলেজের অদূরে ছোট্ট চায়ের দোকান। হঠাৎই চায়ের দোকানে পরিচয় হলো বুড়ো বয়েসী এক লালন ভক্তের সাথে। লোকটি বেশ বয়স্ক, আনুমানিক সত্তুরের কম নয় নাম আবদুল খালেক। কিছুটা খ্যাপাটে বলেই মনে হলো। বিড়ি ফুঁকছিলেন আর গুনগুনিয়ে গাইছিলেন-
“দেখ না মন ঝাকমারি এই দুনিয়াদারি।
পরিয়ে কৌপনি ধ্বজা মজা উড়ালো ফকিরী।”
বললাম- গলা ছেড়ে গান না চাচা,আমরাও একটু শুনি।
আমাদের কথা যেন তিনি শুনতেই পাননি। তবে গানের কথা ও সুর পাল্টে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন-
“পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেতো দূরে
সে আর লালন একখানে রয়
লক্ষ যোজন ফাঁক রে
মাঝে লক্ষ যোজন ফাঁক রে ।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।”
হঠাৎ কান্নায় তার গলা যেন ভারী হয়ে এলো। গান থামিয়ে আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।
বললাম- আমি পটুয়াখালীর মানুষ। এসেছিলাম বাঘা যতীনকে দেখবো বলে। বললেন- কী দেখবেন? বাঘা যতীনকে এদেশের মানুষ মনে রাখবে কেন? বীরদের এদেশ মনে রাখে না। তারপর বললেন- তার নাম বাঘা কেন বলতে পারেন?
বললাম না, তাতো জানিনা।
বললেন- সে সময়ে এই গ্রামে বাঘের উৎপাত ছিলো। সবাই গ্রামের তেজী মানুষ ফণিবাবুকে ধরলেন, তার বন্দুক দিয়ে বাঘটিকে তিনি মারবেন। তাঁর পিসতুতো ভাইয়ের নাম যতীন্দ্রনাথ। তিনিও একটা ছোরা হাতে নিয়ে চললেন বাঘ মারা দেখতে। জঙ্গলের পাশে মাঠের মধ্যে সবাই তখন বাঘের জন্য অপেক্ষা করছে, ফণিবাবুর হাতে বন্দুক।
হঠাৎ বাঘ এসে পড়লো যতীনের ঠিক পিছনে। ফণিবাবুও গুলি ছুঁড়লেন কিন্ত তা বাঘের মাথা ঘেঁষে চলে গেলো। উত্তেজিত বাঘ হামলে পড়লো যতীনের ঘারে। যতীনও তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করলো। শুরু হল বাঘে মানুষে তুমুল লড়াই। শেষে বাঘটির মৃত্যু হল, আর যতীন হলেন গুরুতর আহত। বহুদিন সেবা-যত্নের পর যতীন সেরে উঠলেন। ডাক্তার যতীনের অসীম সাহসিকতার জন্যে নাম দিলেন, ‘বাঘা যতীন’।
কৌতহলী হয়ে চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনার বাড়ি কী এই গ্রামে?
শব্দ করে হাসলেন খালেক চাচা। বললেন- পাগলের কী বাড়িঘর থাকে? থাকি পড়ে ঐ সাঁইজির চরণে। বলেই সাঁইজির উদ্দেশ্যে প্রনাম জানালেন।
বললাম- জন্মস্থান কোথায়? সংসার টংসার হয়নি?
বললেন-ওসবের বালাই নাই, সবই সাঁইজির লীলা। জন্মস্থান রাজশাহীর তালাইমারীতে তবে দশ বছর বয়সেই এখানে চলে এসেছি।
বললাম- যতীন যে বাঘ মেরেছিলেন সে ঘটনা কত বছর বয়সের বলতে পারেন?
হাসলেন লোকটি, বললেন তার হিসেব কে রেখেছে। যা বললাম সবই লোকেদের কাছে শুনে শুনে।
আমরা চা খেতে খেতে আলাপ করছিলাম। তাকেও চা দিতে বললাম, অতঃপর সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আচ্চা বাঘা যতীনের বংশের কেউ কী আছেন এখানে?
বললেন-নারে বাবা, সে কবে কারা ছিলো সবতো মরে টরে ভুত হয়ে গেছে।
বললাম- বাঘা যতীনের সম্পর্কে কী জানেন বলবেন?
বললেন- সিগারেট দেন। সিগারেট ধরিয়ে বললেন- এবার বলুন কী জানতে চান?
বললাম- আপনি যা জানেন বলুন।
সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে শুরু করলেন আবদুল খালেক। বললেন- বাঘা যতীন ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, ব্রিটিশ বাংলায় বেঙ্গল গর্ভর্ণরের ব্যক্তিগত সচিব। তার পৈত্রিক বাড়ি ঝিনাইদহ কিন্তু কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে তার মাতুলালয়ে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। সহজ কথায় তিনি খুব আরাম আয়েশেই ছিলেন কিন্তু মাতৃভূমির পরাধীনতা তার সহ্য হয়নি। চাকরিরত অবস্থায়ই তিনি বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের গোপন সংগঠন ‘যুগান্তর’ এ যোগ দেন এবং নিজের যোগ্যতায় দলের নেতৃত্বস্থানীয় হয়ে ওঠেন।
এ পর্যন্ত বলে থামলেন খালেক চাচা। আমি বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিস্মিত হয়েছি এ কারনে যে, নিতান্ত সহজ সরল একজন ভবঘুরে মানুষ বাঘা যতীনের গল্প মনে রেখেছেন অথচ আমাদের মতো ভদ্দরলোকেরা এই বিপ্লবীকে চিনতেও পারছেননা।
খালেক চাচা বললেন- ভারত থেকে লালন সাঁইজি’র দরবারে একজন গবেষক এসেছিলেন। তিনি যতীন সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। তার মুখে শুনেছি- যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলীপুর না কোথাকার ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। তবে তার চাকরি চলে যায়। অতঃপর যতীন ছদ্মবেশে গোপনে বিপ্লবী কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে থাকেন।
তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এবং সে উদ্দেশ্যে দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দলকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
সংগঠনের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে যতীনকে অবিভক্ত বাংলার সর্বাধিনায়ক মনোনীত করা হয়।
আমাদের দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের ফলে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক গুলি বিনিময়ের পর যতীন ধরা পড়েন। যতীনের মাথায় গুলি লেগেছিলো। ব্রিটিশরা তাকে সারিয়ে তুলে ফাঁসি দেয়ার পরিকল্পনা করলে তিনি নিজেই মাথার ক্ষতস্থানে আঙুল ঢুকিয়ে হাসতে হাসতে মুত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুকালীন সময়ে তিনি বলেছিলেন আমাকে সুস্থ করে ইংরেজরা ফাঁসি দিবে তার চেয়ে আমার মৃত্যুর মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তরান্বিত হোক।
গল্প বলা শেষ হলে আমরা আরেক দফা চায়ের অর্ডার করি। মনে মনে ভাবি এ গল্পের সত্যতা যাচাই করা হয়তো সম্ভব নয়। মুখে বললাম- বাঘা যতীনের আত্মত্যাগের পথ ধরেই আমাদের নেতাজী সুভাষ বোস, প্রীতিলতা, মাস্টারদা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম বসুদের জন্ম।
চাচা বললেন- একদম ঠিক বলেছেন। তিনি এদেশকে পথ দেখিয়ে গেছেন।
বাঘা যতীন সম্পর্কে আবদুল খালেক ছাড়াও জেনেছি কুমারখালী কয়া গ্রামের কবি আমার ফেসবুক বন্ধু অশোক বিশ্বাসের কাছ থেকে। অশোক বলেন আমাদের অবহেলার কারনে বাঘা যতীনের নাম নিশানা মুছে যাচ্ছে আজ তিনি অস্মৃতপ্রায়। বাঘা যতীনের বাড়ির প্রায় বাইশ বিঘা সম্পত্তি আজ বেহাত। তার সম্পত্তির উপর নির্মিত কলেজটি তার নামে করতে চেয়ে বহু চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -১৫
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই
মূল হারাবি।
এই মানুষে মানুষ গাথা
গাছে যেমন আলকলতা।
জেনে শুনে মুড়াও মাথা
জাতে ত্বরবি।।”
এক শরৎ বিকেলে আমরা যখন আরশি নগরে পৌঁছাই তখন সূর্য অনেকটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। গাড়িতে বসেই দেখতে পাচ্ছিলাম সাধক লালনের মাজার। মাজার এবং একাডেমিক কমপ্লেক্সের মূল ফটকে এই গানটির প্রথম লাইন লিপিবদ্ধ করা-
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’।
আসলে মহাত্মা লালনের মানবতাবাদী দর্শনের মূল কথাই হচ্ছে মানুষ। মানুষের মাঝেই তিনি দেখেছেন স্রষ্টার রুপ। মুক্তির প্রতিভূ হিসেবে তিনি মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। তাই মানুষের উদ্দেশ্যে তার অমোঘ বানী ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।’
কমপ্লেক্সের ভেতর এবং বহিরে নানান জায়গায় একতারা হাতে লালনের প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে লালনের পূন্যভূমির মাটি স্পর্শ করলাম। সাথে সাথে দেহ-মনে জেগে উঠলো এক অমীয় সুখের শিহরণ। মনে মনে বললাম- আহা্ লালন ফকির তোমাকে যদি দেখতে পেতাম! করোনা মহামারির জন্যে সরকারি নির্দেশে লালন মাজারের মূল ফটক তালাবদ্ধ। অনেকটা হতাশ হয়ে ভাবছি-হায় আরশি নগরে এলাম অথচ লালনকে না দেখেই ফিরে যেতে হবে! সুলতানাও হতাশমনে অসহায়ের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
মারুফা দুঃখিত হয়ে বললো- করোনার জন্যে লালন একাডেমী যে বন্ধ আছে তা জানা ছিলোনা গুরু। বললো- তানিশার বাবা আসুক, তিনি নিশ্চয়ই কোননা কোন ব্যবস্থা করতে পারবেন।
সোহেলের আসতে ঘণ্টাখানেক বিলম্ব হবে। ফোনে জানালো যে, জেলা প্রশাসনের বিশেষ অনুমোদনের চেষ্টা চলছে। সেই অবসরে আমরা আরশিনগর, কালিগঙ্গা ঘাট, ঘুরেফিরে দেখছি।
লালন কমপ্লেক্স থেকে কালিগঙ্গা ঘাটের দিকে যে সড়ক চলে গেছে তার দু’ধারে গড়ে উঠেছে নানান দোকানপাঠ। লালন ভক্তদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে সেসব দোকান পাটে মনোহরি মালামাল উঠানো হয়েছে। দোকানগুলো সারা বছর খোলা থাকে।বছরজুড়ে লালন ভক্তদের নানান অনুষ্ঠান।সেসব দোকানে বিভিন্ন সাইজের একতারা, নানান বাদ্যযন্ত্র, বাচ্চাদের খেলনা সামগ্রী, হস্তশিল্পের তৈরী নানান জিনিসপত্রে ঠাসা।
কালিগঙ্গা নদীর যে ঘাটে লালনকে পাওয়া গিয়েছিলো নদীর সে ঘাটে তৈরী করা হয়েছে বিশাল এক মাঠ। সেই মাঠে লালনের জন্ম-মৃত্যুসহ নানান অনুষ্ঠান করা হয়। বছরজুড়ে সাধু সন্যাসী, লালন ভক্তরা এখানে এসে ঘুরে ফিরে সাধু সঙ্গ করে আবার ফিরে যান। মাঠের এক পাশে বিশাল মঞ্চ তারই সামান্য দূরে কালিগঙ্গা নদীর ঘাট। শানবাঁধানো এ ঘাটের নাম রাজঘাট। সোহেল আসতে আরও বিলম্ব এই সুযোগে আমরা ঘুরেফিরে দেখছি।
এখন এই করোনাকালে পর্যটকদের তেমন ভীড় নেই। লালন অনুসারীদের আনা গোনাও কম। জনা কয়েক সাধুসন্ত গোল হয়ে বসে সাধারণ কথা বার্তা বলছে তাদের একটু দূরে একজন বাউল দ্বোতারা বাজিয়ে আপনমনে গেয়ে চলেছেন। তার কাছে গিয়ে বললাম-লালন গানে একতারা না হলে চলবে কেন বাউল?
আমার কথায় গান থামিয়ে আমার আপাদমস্তক দেখে নিলেন বাউল। বাউলের নাম সোহরাব হোসেন। বয়স চল্লিশের বেশি হবেনা। সাথে চারজন চেলা নিয়ে আসর বসিয়েছেন। কারও বয়সই পঁয়ত্রিশ ছাড়িয়েছে বলে মনে হলোনা। ইশারায় আমাদের বসতে বলে একতারা হাতে নিলেন বাউল।
খোলা মাঠের ঘাসের উপর শতরিঞ্চি বিছানো, সাত আটজনের বসার স্থান। সুলতানা বসলো না, তূর্যকে সাথে নিয়ে মারুফার সাথে অন্যদিকে ঘুরতে গেলো। আমি বসতেই বাউল আপনমনে গান ধরলেন-
“যদি ত্বরিতে বাসনা থাকে
ধর রে মন সাধুর সঙ্গ।।
সাধুর গুণ যায় না বলা
শুদ্ধ চিত্ত অন্তর খোলা।
সাধুর দরশনে যায় মনের ময়লা
পরশে প্রেমতরঙ্গ।”
দর্শক স্রোতা নেই। আমি শুধু একা এক শ্রোতা। থার্ড পারসনে কথা বললেন সাধু। যেমন কোথা থেকে আসা হইছে? ক’দিন থাকা হইবে ইত্যাদি। সাধুর হাতে দু’শো টাকা দিলাম। একেবার না না করে রেখে দিলেন। বললেন- আরও শুনবেন? বললাম- বেঁধেছে এমন ঘর….?
সাধু এবার তার একতারা এক চেলার হাতে দিয়ে বললেন- ধরো।
বছর পঁচিশেক বয়সের এক সাধুর কণ্ঠে যেন সুরের বান ডাকলো। তিনি একতারা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। নাচের তালে তালে গেয়ে চললেন-
“ধন্য ধন্য বলি তারে।
বেঁধেছে এমন ঘর
শূন্যের উপর পোস্তা করে।।
ঘরের সবে মাত্র একটি খুঁটি
খুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটি।
কিসে ঘর রবে খাঁটি
ঝড়ি তুফান এলে পরে।”
তার সুর এবং ভাবের মুর্ছনায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পরিচিত হলাম আকলিমা বাউলের সাথে। তিনি এখানেই থাকেন-জন্মস্থান মাগুরায়। এখানের নিয়মিত একজন ভক্ত এবং লালন গানের শিল্পী এই আকলিমা বাউল। তার সাথেই বসে আছে বছর পনেরো বয়সের একটি মেয়ে। নাম জানালো অ্যানী বৈরাগী। বললেন-এটি তার মেয়ে।
পাশেই কালিগঙ্গা নদী। নদীটি কচুরীপানায় ঠাসা। দেখে মনে হলো কোন জলাশয়। গড়াই নদী থেকে উঠে আসা এ নদীটি ঝিনাইদহের দিকে চলে গেছে। স্থানীয়রা জানালেন এটি এখন নাব্যতাহীন একটি জলাধার। করোনার জন্যে পরিস্কার করার কোন উদ্যোগ নেই। বললেন- এখানেই অসুস্থাবস্থায় লালনকে খুঁজে পেয়েছিলেন মাওলানা মলম শাহ। লালনকে এই মলম শাহ এবং তার স্ত্রী মতিজান সেবা শুশ্রসা করে সুস্থ করে তোলেন এবং লালন এখানেই থেকে যান।
বাউল লালনের জন্ম এবং শৈশব কৈশোর নিয়ে রহস্য রয়ে গেছে। গবেষকরা একেকজন একেক রকম তথ্য উপস্থাপন করলেও তার রহস্য উদঘাটনে সঠিক কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়না।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -১৬
ভাগ্য যে এতোটা সুপ্রসন্ন হবে ভাবতে পারিনি। হতাশ হয়ে আমরা যখন ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক তখনই মিকতাল নামের এক ভদ্রলোক আমাদের খুঁজে বের করলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন- ‘আমি কুষ্টিয়া পল্লী বিদ্যুতের লোক, আপনারা সোহেল স্যারের মেহমান সুতরাং ছেউরিয়ায় আপনারা আমার মেহমান।’
ভদ্রলোকের পুরো নাম হাসান মতিউর রহমান মিকতাল। নড়াইল জেলার মানুষ, থাকেন কুষ্টিয়ায়। পল্লী বিদ্যুতে চাকরির সুবাদে সে সোহেলের খুবই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। পল্লী বিদ্যুতের ছেউরিয়ার দায়িত্বে আছেন। শিল্প-সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ভক্ত, বললেন-
চলুন, চা খেতে খেতে সময় কাটাই, ইতোমধ্যে সোহেল স্যারও এসে পড়বেন। আমাকে বললেন, করোনায় দর্শক-পর্যটক নিষিদ্ধ কিন্তু আপনার সম্মানে জেলা প্রশাসন থেকে বিশেষ অনুমতি নেয়ার চেষ্টা চলছে। গানের আসর যাতে বসানো যায় সে চেষ্টাও হচ্ছে।
মিকতাল সাহেবের মাধ্যমে পরিচিত হলাম লালন একাডেমির শিক্ষক এবং সেই সকল শিল্পীবৃন্দের সাথে যারা আমার সম্মানে গান পরিবেশ করবেন। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন শিল্পী শিরিন আকতার, বাসন্তি রানী, আকলিমা বাউল, এ্যানি বৈরাগী, আলি আহামদ শাহ, এনামুল শাহ প্রমুখ ব্যাক্তিদের সাথে। এরা এখানের নিয়মিত শিল্পী। অবশ্য আকলিমা বাউলের সাথে ইতোমধ্যে পরিচয় হয়ে গেছে। মিকতাল ভাই নিজেও গান শেখেন। তাদের কাছে জানলাম লালন ফকিরের নানান গল্প। সবটাই ভক্তদের মুখে মুখে।
গুরুবাদী দর্শনের প্রবক্তা লালন শাহ ছিলেন মানবতাবাদী একজন মহৎপ্রাণ মানুষ। দিনে দিনে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির গর্ব এবং দিকপালস্বরুপ। লালনের জন্ম, শৈশব এবং কৈশোর অনেকটাই রহস্যাবৃত। তিনি নিজে যেমন সে রহস্য ভেদ করে যাননি। তার শিষ্যরাও সে রহস্যের জাল ভেদ করতে পারেননি। কোন ধর্মমতকে আঘাত না করেও লালন মানবতাবাদী একজন মানুষ হিসেবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভে সক্ষম হয়েছেন।
আমার এই ভ্রমণ আখ্যান লিখতে গিয়ে কুমারখালীতে যেসকল মনিষীদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে গিয়েছি, ঘুরেছি। তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছি এতে নানানভাবে তাদের তথ্যাদি প্রাসংগিক হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক এসব তথ্য বিশ্লেষণ আমার বিষয় না হলেও তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে পারা যায়নি। ফলত আমাকে নির্ভর করতে হয়েছে আমার ব্যত্তিগত পড়াশোনা এবং ভ্রমণকালীন স্থানীয় সূত্রের উপর। তবে এসবের বাইরেও সাঁইজি’র বিষয়ে আমি সহায়তা নিয়েছি “ব্রাত্য লোকায়ত লালন” নামক একটি গবেষণাধর্মী বই এবং গুগলনির্ভর লেখার উপর। ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ বইটির লেখক পশ্চিম বাংলার প্রসিদ্ধ গবেষক সুধীর চক্রবর্তী।
সাঁইজির ধর্মমত সম্পর্কে সে বইয়ের ৩০-৩১ পৃষ্ঠায় ‘ভারতী’ পত্রিকার বরাতে যা লিখেছেন তা থেকে হুবহু তুলে ধরছি-
“লালনের ধর্মমত অতি সরল ও উদার ছিলো। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না, হিন্দু মুসলমানকে সমানভাবেই দেখিতেন ও শিষ্যদিগের মধ্যে হিন্দু মিসলমান সকল জাতিকেই গ্রহন করিতেন। লালন হিন্দু নাম শাহ উপাধি মুসলমান জাতীয়। সুতরাং অনেকেই তাকে জাতির কথা জিজ্ঞেস করিতেন। তিনি কোন উত্তর না দিয়ে নিজের স্বরচিত এই গানটি শুনাইতেন-
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন ভাবে- জাতের কিরুপ
দেখলাম না এ নজরে।”
লালনের সাধন ভজনের ধরন দেখে সমসাময়িক অনেকের মনে লালনের জাতিপরিচয় নিয়ে উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন থাকলেও তাতে লালনের কোন আগ্রহ ছিলোনা। কেননা মানবিক বোধের এমন সুউচ্চ চূড়ায় তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন যেখান থেকে জাতিতত্ত্ব এক নিষ্ফল আচারস্বর্বস্ব শুষ্ক পরিহাস বলে তার মনে হয়েছিলো।
মিকতাল সাহেব দীর্ঘদিন এই লালন আখড়ায় আছেন। আখরার সভাপতি জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে এখানে আগত সাধু সন্নাসী কিংবা বহিরাগত পর্যটক গবেষক প্রায় সকল শ্রেণির মানুষের সাথে তার নিবির সম্পর্ক রয়েছে। মিকতাল খুবই সংস্কৃতি মনস্ক, বন্ধু বৎসল এবং সজ্জন মানুষ। তার কাছে সাঁইজির জীবনবৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করলে বলেন-
লালনের জন্ম, শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে বিশদ কিছু জানা যায়না। নদীর ঘাটের দিকে নির্দেশ করে বললেন- এখানেই মৃতবৎ লালনকে খুঁজে পেয়েছিলেন তার পালক পিতা মাওলানা মরম শাহ।
প্রকৃতপক্ষে লালনে জীবন সম্পর্কে গবেষকরা নানানজনে নানান মত ব্যাক্ত করেছেন যা সর্বৈভ সাংঘর্ষিক। তবে সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসূত্র হচ্ছে তার নিজের রচিত গানের ভাণ্ডার। যদিও সেসব গানে তার জীবন সম্পর্কে পরিস্কার কোনো তথ্য পাওয়া যায়না।
লালনের কোন কোন গানে তিনি নিজেকে “লালন ফকির” হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন নিম্নলিখিত গানের ভণিতায় তিনি বলেন-
“সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন,
কি বলিব আমার আমি না জানি সন্ধান।”
“এই মানুষের আছে রে মন
তারে বলে মানুষ রতন,
ফকির লালন বলে পেয়ে সে ধন
পারলাম না চিনতে রে।”
“অগতির না দিলে গতি,
ওই নামে রবে অখ্যাতি,
ফকির লালন কয় অকুলের পতি,
কে বলবে তোমায়।
লয়ে যাও আমায়,
পারে, লয়ে যাও আমায়।”
লালনের মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকরী পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে যেমন কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাঁহার নিষেধক্রমে অথবা অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না।”
লালনের জন্মস্থান নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কারও কারও মতে ১৭৭৪ খ্রিঃ ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হারিশপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কেউ বলেছেন ছেউরিয়ার অদূরে চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারায় জন্মেছেন।এই মতের সাথেও অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন।
এ মতামতের বিষয়ে বহু গবেষকদের দ্বিমত আছে। জানা যায়, মাসিক মোহম্মদী পত্রিকার ১৩৭৪ আষাঢ় সংখ্যায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে বলে দাবী করা হয়।
হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিবন্ধে বলা হয়েছে, লালন তরুণ বয়সে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়েছিলেন। তীর্থ শেষে ফেরার পথে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার সাথীরা তাকে মৃত ভেবে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। সে অবস্খায় কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ। মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান ফকিরানী তাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন তার কাছে দীক্ষিত হন এবং কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস শুরু করেন। গুটিবসন্ত রোগে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। ছেউড়িয়ায় তিনি দার্শনিক গায়ক সিরাজ সাঁইয়ের সাক্ষাতে আসেন এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হন।
সর্বশেষ সিরাজ সাঁই সম্পর্কেও তার শিষ্যদের কথায় বিতর্ক রয়েছে। বাবুল শাহ, বাউল আকলিমা এবং অন্য আরও অনেকের মতে সিরাজ সাঁই বলে কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই। তারা বলেন সেরাজ সাঁই নামটিকে তারা ভেঙে বলেন (সে+রাজ) সাঁই। বলেন- সেরাজ বলতে সাঁইজি তার নিজের ভেতরের সত্ত্বাকে বুঝিয়েছেন।
তাদের কথার পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেন-লালন মাজারে মোট আঠারোটি কবর রয়েছে যারমধ্যে সেরাজ বা সিরাজ সাঁই’র মাজার নেই। আর ঝিনাইদহে যে সিরাজ সাঁই ছিলেন তিনিই যে লালনের গুরু একথা লালন শিষ্যরা মানতে নারাজ।
আরশি নগরের পড়শি পর্ব-১৭
গুটি বসন্ত রোগে অসুস্থ হয়ে অচেতন অবস্থায় ছেউরিয়ার কালিগঙ্গা ঘাটে ফকির লালনের আগমন। অতঃপর স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস এবং পরবর্তী সাধন ভজনের দিনগুলো সবার কাছে পরিস্কার থাকলেও তার পূর্ব ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানান বিভ্রান্তি। তবু অধিকাংশ গবেষকদের মতানুসারে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর তারিখে লালনের জন্ম এবং ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর তারিখে তার মৃত্যু। মোট আয়ুস্কাল ছিলো ১১৬ বছর। এই ১৭ অক্টোবর মোতাবেক বাংলা ০১ লা কার্তিক এখানে লালনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভারত বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানান দেশের মানুষের আগমনে লালনের সে মেলা মুখরিত হয়ে ওঠে। আমরা এখন লালন মেলার সেই মাঠেই আছি।
লালন সাঁইজি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মহাত্মা গন্ধীর বহু বছর আগে ভারতবাসী লালনকে সর্বপ্রথম মহাত্মা উপাধি দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সূত্রে এটা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নানান কারণে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সাঁইজির যাতায়াত ছিলো। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট হয় এ কারনে যে, লালনের যে ছবিটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সেটি তার জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁকেছিলেন।
মহান সাধক লালন সাঁইজির জীবন দর্শন নিয়ে দেশে বিদেশে এতো গবেষণা হয়েছে যে, আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে তার সম্পর্কে আর নতুন কিছু বলার থাকেনা। তদুপরি লালনের তিরোধানের পর তাকে নিয়ে মিথনির্ভর কাহিনী তৈরি হওয়াও বিচিত্র কিছু নয় এবং তা হয়েছেও।
লালন শিষ্যদের ভাষ্যমতে অলৌকিক আবহের মধ্য দিয়ে লালনের মৃত্যুদিনের ঘটনাবলী ছিলো খুবই মর্মস্পর্শী। শিষ্য পরম্পরায় সেই বর্ণনা শুনলাম। তাদের কথিতমতে- মৃত্যু শয্যায় সাঁইজি তার মুখের চাদর সরিয়ে শিষ্যদের শেষবারের মতো দেখে নেন। তারপর বলেন- আমি তোমাদের জীবনের শেষ গান শোনাবো। একথা বলেই আপনমনে গান ধরেন-
“পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে
ক্ষম হে অপরাধ আমার
এ ভব-কারাগারে।”
অতঃপর ধীরে ধীরে গান থেমে যায়, সাঁইজি তখন ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারণ করেন- ‘আমি চলিলাম।’ এভাবেই গুটিয়ে নেওয়া চাদরের তলে চির নিদ্রায় নিথর হয়ে যান মরমি সাধক লালন শাহ।
লালনের মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিবরণ কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত মীর মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরী পত্রিকায় এভাবে দেয়া হয়েছে-
“মৃত্যুকালে কোন সম্প্রদায়ী মতানুসারে তাহার অন্তিমকার্য সম্পন্ন হওয়া তাহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না। তজ্জন্য মোল্লা বা পুরোহিত কিছুই লাগে নাই। গঙ্গাজল হরে রাম নামও দরকার হয় নাই।…. তাহারই উপদেশ অনুসারে আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাহার সমাধি হইয়াছে। শ্রদ্ধাদি কিছুই হইবে না।”
জাত বিচারে লালনের এ এক নতুন ধারা। সম্ভবত এসব কারনেই তার শিষ্যরাও নির্দিষ্ট কোন ধর্মমতে বিশ্বাসী না হয়ে তাদের গুরু সাধক লালনের নির্দেশিত পথে মুক্তির উপায় খুঁজে ফিরছেন। তবে তারা দার্শনিক লালনের মূল শিক্ষা সেই মানবতাবাদী মনোভাব কতোটুকু ধারণ করে চলেছেন সেটাও এখন গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে চা খাচ্ছিলাম। মিকতাল সাহেবকে বললাম- আচ্ছা, শুনেছি এখানে লালনের ভক্তরা গাঁজা সেবন করে থাকেন। কথা কি সত্য?
বললেন হ্যাঁ, একদম সত্য। এক শ্রেণির ভক্তরা এ কাজটি করে থাকেন। তবে সাঁইজির জীবদ্দশায় এমনটি ছিলো কিনা জানা যায়না। আমাকে বললেন- জিজ্ঞেস করলেন কেন? পরখ করে দেখবেন নাকি? বললাম, না না ওটি সহ্য করার মতো ক্ষমতা শরীরে এখন আর অবশিষ্ট নেই।
সুলতানা কপট রেগে আমার দিকে তাকিয়ে বললো-ওসব বাজে চিন্তা বাদ দাও। ডাক্তারের নির্দেশের বাইরে একদম চলা নিষেধ।
হাসলাম, বললাম- আদেশ নিষেধ করে ডাক্তারের বাবার সাধ্যও কী আছে কাউকে বাঁচিয়ে রাখেন? সবাই ক্ষমা করলেও আজরাইলের কাছে ক্ষমা নাই। সাঁইজি কী বলেছেন, জানো তো?
“এমন মানব জনম আর কি হবে।
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।”
সুলতানা গভীর অনুরাগের চোখে তাকালো। বললো- সাঁইজিতো এটাও বলেছেন-
“অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানব রূপের উত্তম কিছুই নাই ।
দেব-দেবতাগণ,
করে আরাধন
জনম নিতে মানবে।।”
দেব-দেবতারা গাঁজা খাইতে আরাধনা করেছেন? আপনাদের সাঁইজি মন যা করো ত্বরায় করতে বলেছেন, তাতে গাঁজার কথা নিশ্চয়ই বলেননি?
মারুফা বললো- বাদ দেনতো এসব কথা। আপনি গুরু, মেলার সময় আসবেন। দেখবেন খোলা মাঠে জ্বলছে কতো গঞ্জিকার কলকি। তখন গন্ধেই অর্ধেক নেশা হয়ে যাবে। সেবন করতে হবিনানি। তার কথায় আমরা সবাই হাসলাম।
সোহেলে ফোন দিয়ে জানালো তার আসতে এখনও বিলম্ব। এই অবসরে বললাম- তোমরা বসে গল্প করো আমি একটু ঘুরেফিরে দেখি। তাদের ছেড়ে এসে কালীগঙ্গা নদীতে যেখানে শান বাঁধানো ঘাট, সেখানে তাকিয়ে দেখি কয়েকজন সাধু সন্ত গোল হয়ে বসে আছেন। প্রত্যেকের লম্বা চুল, দাড়ি গোফ। পড়নে দবধবে সাদা পোশাক। তাদের ওখানে গিয়ে পরিচিত হলাম বাবুল শাহ নামের একজন সাধুর সাথে। দশ-বারোজন সাধু তবে বাবুলকেই গোদের পাল বলে মনে হলো। পুরো ছ’ফিট উচ্চতার গৌরবর্ণের এক সুপুরুষ এই বাবুল শাহ। জ্যোতির্ময় সৌম্য শান্ত মুখস্রী। লম্বা চুলগুলো মাথার উপর মোড়ানো বাঁধা। পড়নে সাদা লুঙ্গি, সাদা জামা। কাঁচা পাকা দাঁড়িতে বয়স চল্লিশের বেশী মনে হলোনা।
কথা বার্তা বলে খুবই শিক্ষিত বলে মনে হলো।জানলাম বাবুল শাহ তার আসল নাম নয়। তার আসল নাম হাসমত আলী ফরাজী, বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানায়। পেশায় ছিলেন একটি কলেজের ইংরেজী শিক্ষক। বিয়ে থা করেননি। গত তিন বছর ধরে সাঁইজির মাজারে পড়ে আছেন। ভালো গান করেন, সচেতনভাবেই গ্রহণ করেছেন লালনের গুরুবাদী দর্শন। তার গুরুর নাম হাসান শাহ। হাসান শাহের বাড়ি পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলায়।
বাবুল শহ’র গুরু হাসান শাহ’র সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলাম। বাবুল শাহ বললেন- গুরুজীর মা সদ্য গত হয়েছেন। তার শেষকৃত অনুষ্ঠানের জন্যে ভারতে গেছেন।
বললাম-এই করোনাকালে ভিসাতো বন্ধ। তিনি কিভাবে গেলেন?
কিছু বললেন না বাবুল শাহ, মৃদু হাসলেন। বুঝলাম বাউলদের জন্যে বোধকরি পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন পড়ে না।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -১৮
কাজ করেছি নানান পেশায়, বৈধ পথে যা যা করা যায় সবই করেছি তবু অভাব পীছু হটেনি। আজীবনই বিত্ত-বৈভবহীন এক মানুষ। টানাপোড়ন ছিলো জীবনভর, তবু খাওয়া পড়া ঠিকমতো হোক বা নাই হোক দু’পয়সা হাতে জমলে ঘুরতে বেরিয়েছি ঠিকই।
“জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!
বাজারে বিকায় ফল তণ্ডুল
সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা,
হৃদয়-প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল
দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা!”
বোহেমিয়ান জীবনের শুরুতে এই লাইন ক’টি আমার জীবনকে বোধহয় প্রভাবিত করে থাকবে। সে কারনেই ক্ষুধা মেটাবার পরই মূল্যবান মনে হয়েছে ফুল। কেননা শৈশব থেকেই আমার কাছে পেটের ক্ষুধার চেয়ে মনের ক্ষুধা কোন বিবেচনায় কম কিছু ছিলোনা। সুতরাং যখনই সুযোগ পেয়েছি ঘুরেছি আর ঘুরতে গিয়ে পথের ধারে যেসব মনিমুক্তা ছড়ানো ছিটানো পেয়েছি তা কুড়িয়ে এনে গল্প-কবিতা-উপন্যাস আর ভ্রমণ অাখ্যানে রেখে গেছি মানুষের জন্যে। লিখে গেছি সেসব ভ্রমনলব্দ গল্পের আদ্যপান্ত।
আমার লেখা এই ভ্রমণ আখ্যান সাহিত্যের ব্যাকরণসিদ্ধ হচ্ছে কীনা জানিনা। সে বিষয়ে আমার মাথা ব্যথাও নেই আমি শুধু আমার ভ্রমণকালে নিজের চোখে যা দেখেছি, অনুভব করেছি এবং লোকমুখে যা শুনেছি তাই লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। কণ্ঠ যে আমার কাকের মতো, ভাষাজ্ঞান যে খু্বই সীমিত আর পাণ্ডিত্য যে একেবারেই নেই সে আমি জানি। তদুপরি এই ভার্চুয়াল যুগে যেখানে সাহিত্যের কদরই শূনের কোটায় সেখানে আমার এসব কাহিনী খুব কেউ যে পড়বেন তেমনটা আশাও করিনা। তবু ফেসবুকের কল্যানে যারা পড়ছেন মন্তব্য করছেন তাদের কাছে অধীনের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মূলতঃ তাদের জন্যেই লিখে যাচ্ছি মনানন্দে, নেই কাজ তো খই ভাজ এর মতো করে।
এই যে বাবুল শাহ। যার সান্নিধ্যে এসে শুনছি গুরুবাদী দর্শনের তত্বকথা। কী গভীর অর্থপূর্ণ তার বানী। আমাকে বসার জায়গা করে দিয়ে ইশারায় বসতে বলে শিষ্যদের সাথে তার কথায় ফিরে গেলেন তিনি। তাদের উদ্দেশ্যে বললেন-সবচেয়ে বড় গুরু হচ্ছে নিজের বিবেক।
তার কথা বলার ধরণে পুলকিত হলাম। অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম -তাহলে বিবেক বিচারে চললেইতো হলো, কী বলেন?
এবার তিনি গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। চোখে চোখ রেখে স্থির তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তার দৃষ্টিতে আমি আরষ্ঠ হয়ে গেলাম। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো, যেন সম্মোহিত হলাম। তারপর স্মিত হেসে বললেন- আপনারা গুণী মানুষ, আমাদের এসব হেলাফেলা কথায় কান দিয়েন না।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললেন- পিতাগুরু, মাতাগুরু, শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু সব গুরুই বিবেকের কাছে হার মেনে যায় ভাই। মানু্ষকে পরমগুরু যে বিবেক দিয়েছেন সে তার বাইরে কখনও যেতে পারেনা। একথা আমার নয়, স্বয়ং সাঁইজি’র। বলেই জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানালেন বাবুল শাহ।
জিজ্ঞেস করলাম- বেশতো ছিলেন কলেজের অধ্যাপনার কাজ নিয়ে তা এমন সুন্দর জীবন ছেড়ে দিয়ে এখানে এলেন কী উদ্দেশ্য?
বললেন- কারণ ছাড়া কার্য নেই। সতঃ সজ্জায়ত’। অর্থাৎ, সৎ বস্তু থেকে সৎ বস্তু উৎপন্ন হয়।
তারপর বললেন- উদ্দেশ্যের কথা বলছেন? সে তো একটা আছেই।
বললাম- তা যে উদ্দেশ্যে সব ছেড়ে-ছুড়ে এসেছেন তা কী সফল হয়েছে?
কথাটি য়ে ইঙ্গিতবাহী এবং তপর মধ্যে যে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন একটি খোঁচা বিদ্যমান তা তিনি ধরতে পারলেন কিন্তু একদম গায়ে মাখলেন না। বরং শব্দ করে হাসলেন বাউল। বললেন-এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব সহজ নয়। বলেই পাল্টা প্রশ্ন করলেন- আচ্ছা আপনার পেশা কী, মানে কী করেন আপনি?
এবার কথা ফুরিয়ে গেলো আমার। সত্যিইতো আমারইবা পেশা কী? একবার ভাবছি শিক্ষকতার কথা বলি, পরক্ষণেই মনে হলো আমিতো শিক্ষকতা করিনা। বাচ্চাদের একটা ছোট্ট প্রাইভেট শিক্ষালয় পরিচালনা করি কিন্তু আমিতো পড়াইনা। আমাকে মৌন থাকতে দেখে বললেন- বুঝতে পারছি কিছুই করেন না। এ মুহুর্তে জাগতিক পরিচয় দেয়ার মতো তেমন কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না এইতো?
বললাম- একদম ঠিক ধরেছেন। কিন্তু তা বুঝলেন কী করে গুরু?
এবারও হাসলেন বাবুল শাহ। বললেন- আপনার ললাটেই লেখা আছে আপনিও এক বোহেমিয়ান মানুষ। নিজে জীবনকে কিছুই দিতে পারেননি কিন্তু জীবন আপনাকে অনেক কিছু দিয়েছে। জীবন কিন্তু আপনাকে ঠকায়নি, বেশ ভরিয়ে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনি তা কতোটুকু বুঝতে বা গ্রহন করতে পেরেছেন এটাই হচ্ছে আসল বিষয়। আপনি কিন্তু নিরন্তর খোঁজ করে চলেছেন জীবনের মানে। আচ্চা বলুনতো যা খুঁজছেন তা কী পেয়েছেন খুঁজে? তারপর সহসা চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবলেন চোখ খুলে ডানে বামে মাথা নাড়লেন আপনমনে বললেন- না, পাননি। তবু খুঁজে চলেছেন নিজের পরিচয়, জীবনের পরিচয়। এই খুঁজে ফেরাই মানুষের কাজ। খুঁজতে খুঁজতে মানুষ তার অজান্তেই একদিন মানুষ হয়ে ওঠেন।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। কিছু একটা বলতে উদ্যত হতেই হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। এমন সময় বছর ত্রিশের একজন স্ত্রীলোক এসে বাবুল শাহকে সালাম জানিয়ে বসতেই তিনি আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্ত্রীলোকটির নাম খালেদা বেগম। তার পড়নেও শাদা ধবধবে পোশাক। তবে সালোয়ার কামিজের উপরে সাদা চাঁদরের মতো মনে হলো।
বাবুল শাহ’র নির্দেশে অল্প বয়সী এক সাধু আমাদের জন্যে চা আর টোস্ট বিস্কিট নিয়ে এলে বাবুল শাহ এগিয়ে দিয়ে বললেন- নিন।
বললাম- উঁ হু ওটা চলবেনা, সুগার ফ্রি হলে চলতো। তিনি ইশারা করতেই নবীন সাধু ছুটে গিয়ে চিনি ছাড়া চা নিয়ে এলেন।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব -১৯
বাবুল শাহ’র আড্ডায়, কালিগঙ্গার সেই রাজঘাটে ইতোমধ্যে লোকজনের ভীড় জমে গেছে। আমরা চা খেতে খেতে গল্প করছি। খালেদা বাউলের হাতে একটি একতারা সে মাঝে মাঝেই টুং টাং শব্দ করে বাজাচ্ছিলো।
বাউলদের ব্যক্তিগত পরিচয় জানা প্রায় দুরহ বিষয় তবুও আলাপচারিতায় জেনে নিলাম খালেদা বাউলের বৃত্তান্ত। তার বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা থানায়। এখানে মাঝে মাঝে আসেন। বাবুল শাহ তার গুরু। খুব অল্প বয়সে স্বামী নিরুদ্দেশ তারপর থেকে সাঁইজির সহজিয়া বাউল ধর্মের দীক্ষা।
আমি লেখালেখি করি শুনে বাবুল শাহ খুশি হলেন। বললেন- সাঁইজি’র কথা লিখুন। তার বানীকে ধারণ করুন লেখায়। বললাম-সাঁইজির শিষ্য হতে চাইলে কী করতে হয়? মানে নতুনদের জন্যে নিয়ম-নীতি কেমন?
হাসলেন বাউল, বললেন- কোন নিয়ম নাই। শর্ত দিয়ে কি ভালোবাসা হয়? হয় না, প্রেম হয়না। হয় প্রেমের নামে প্রতারনা। এ জন্যেই সাঁইজি বলেছেন-‘সাধু সেজোনা, সাধু হও।’ লালনকে ভালোবাসলে সে তার আদর্শকে ভালোবাসবে। সাঁইজির আলাদা কোন তরিকা নেই। মানুষকে নিয়েই তার বিচরণ। তারপর সহসাই গান ধরলেন বাবুল শাহ-
“(ভবে) মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার
নদী কিংবা বিল-বাঁওড়-খাল
সর্বস্থলে একই এক জল।”
বাদ্যযন্ত্র ছাড়া খোলা কন্ঠে বাবুল শাহ যখন গানটি পরিবেশন করলেন এক অদ্ভুত মোহময়তায় ছেয়ে গেলো আমার মনোজগত। গান থামিয়ে বললেন- মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা। কিন্তু মানুষের কথা সাঁইজি যেভাবে বলেছেন অন্য কেউ এমন করে বলেননি। তবে মধ্যযুগের কবি বরু চণ্ডীদাস বলেছিলেন-
“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
বললাম যথার্থ বলেছেন। যুগে যুগে মনীষীরা এমন করেই মানুষের বন্দনা করেছেন। কবি ফজলুল করিম বলেছেন-
“কোথায় স্বর্গ?
কোথায় নরক?
কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক
মানুষেতে সুরাসুর।”
বাবুল শাহ বললেন- কবি ঠিকই বলেছেন। মানুষই শেষ কথা। তাইতো সাঁইজি বলেছেন-
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।”
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বাউলদের শৃঙ্খলার বিষয়টি খুবই প্রসংশনীয়। আমি যখন বাবুল শাহ’র সাথে কথা বলছিলাম কিংবা তিনি যখন গান গাইছিলেন তখন অন্য সাধুরা কেউ কিন্তু মুখ খুলেননি বরং মনোযোগী হয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা আসন্ন হয়ে উঠলে বাবুল শাহকে বললাম-অনুমতি করলে আপনাদের নিয়ে এই মাত্র একটা লেখা তৈরি করেছি দেখাতাম। বললেন- বলেন কী? কই দেখান তো!
আমি পড়ে শোনালাম এই আসরে বসেই লেখা আমার একটি কবিতা।
সাধু সঙ্গ
সাধুর সঙ্গে কতোনা রঙ্গে
অঙ্গেতে আমার বইছে সুবাতাস
ইচ্ছে হয় সেই বাতাসে
সাধুরে সঙ্গে লয়ে
নিশিদিন রঙ্গে রঙ্গে কাটাই বারোমাস..
ইচ্ছে হয় সাধু সঙ্গে কাটাই বারোমাস…
সাধু যখন চক্ষু মুদেন,
সুখের হাড়ি খুঁজে আনেন
সব সাধুরা সেই হাড়িতে
করেন সুখের চাষ
তারা করেন সুখের চাষ
ইচ্ছে হয় সাধু সঙ্গে কাটাই বারোমাস
আমার দিন পাপে তাপে
পড়িয়া জাগতিক চাপে
অহেতুক করি আমি
সুখেরই তালাশ,
করি সুখের তালাশ
ইচ্ছে হয় সাধু সঙ্গে কাটাই বারোমাস
কেমনে ছাড়ি মোহ মায়া
মিছে এ সংসারের ছায়া
পড়িয়া বিষম কলে
হইলো সর্বনাশ
আমার হইলো সর্বনাশ
ইচ্ছে হয় সাধু সঙ্গে কাটাই বারোমাস।
কবিতাটি শুনে বাবুল শাহ বললেন- সুরারোপ করলে ভালো গান হতে পারে। বলে নিজেই সুর দিয়ে ফেললেন। খালেদা বাউলকে বললেন গানটি আমার দেয়া সুরে তোমার কণ্ঠে গেয়ে শোনাও।
বলামাত্র খালেদা আমার লেখা গানটিতে সুর তুললেন-
ইচ্ছে হয় সাধুর সঙ্গে কাটাই বারো মাস…..
গান শেষ হলে বাবুল শাহ বললেন- আপনার লেখার হাত অসাধারণ। লেখা অব্যাহত রাখুন ভাই। নিয়মিত চর্চা আপনাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিবে।
এসময়ে আসরে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে এসে বসতে বসতে বাবুল শাহকে জয়গুরু বলে প্রণাম জানালেন। আলাপ পরিচয়ে জানলাম এরা গত পনের দিন এখানে আছে এসেছে ঢাকা থেকে। দু’জনই ইউনিভারসিটির শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিলেন। ছেলেটির বাড়ি ঢাকার টঙ্গীতে মেয়েটি রংপুরের।
আমার কেন যেন মনে হলো এরা প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়েছেন। আশ্রয় নিয়েছেন এই আখড়ায়। ছেলেটির নাম ধ্রুব আর মেয়েটি সায়মা। বাবুল শাহ বললেন- এরা নতুন সাধু। মেয়েটিকে কথা-বার্তায় ভীষণ চঞ্চলা-চপলা বলে মনে হলো, ছেলেটি ভীষণ শান্ত। বাবুল শাহ আমাকে দেখিয়ে বললেন- ইনি একজন লেখক। তারপর ধ্রুবকে বললেন- শুরু করো।
ছেলেটি খোলা কণ্ঠেই গেয়ে উঠলো-
“অমৃত মেঘের বারি
মুখের কথায় কি মেলে,
চাতক স্বভাব না হলে।
চাতক পাখির এমনি ধারা
তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা,
অন্য বারি খায় না তারা
মেঘের জল বিনে।”
ছেলেটির কণ্ঠস্বর ভারি মিষ্টি তবে গানটি আমার কাছে একেবারেই নতুন। বললাম তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
ছেলেটি হাসলো, জবাব দিলো না। বাবুল শাহ বললেন- সাঁইজির চরণে যে এসেছে তার আর কোন পরিচয় থাকেনা কবি। বললাম- আর একখানি গান হোক না?
এবারে একতারা হাতে খালেদা বাউল গেয়ে উঠলেন-
“ও যার আপন খবর আপনার হয় না,
একবার আপনারে চিনতে পারলে রে
যাবে অচেনারে চেনা।”
মনে মনে ভাবলাম- এ গানটি সম্ভবত আমার উদ্দেশ্যই নিবেদিত। সত্যিইতো আপন খবর না লয়ে পরের খবর দিয়ে কী করবো?

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২০
নিজের লেখা গান অন্য কারও কণ্ঠে শুনলে তার চেয়ে আনন্দের কী আছে? অতঃপর সে গানের কথার প্রসংশা শুনতে কার না ভালো লাগে? তাই বাবুল শাহ’র মতো প্রাজ্ঞজনের মুখে আমার গানের সেই প্রসংশা শুনে আমারও মন প্রাণ আনন্দে নেচে উঠলো। বললেন- আপনার গানের কথায় আমি মুগ্ধ, আপনি লেখা চালিয়ে যান। মোবাইল নম্বর দিয়ে বললেন- সুর পছন্দ হলে গান লিখে পাঠাবেন। সময় করে মাঝে মধ্যে এখানে আসবেন। কথা হবে আড্ডা হবে।
বললাম- জি আচ্চা, আসতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবানই মনে করবো।
দেখলাম শুধু সিগারেটই নয়, সুগন্ধি মশলাযোগে গুরুজীর পান খাওয়ার অভ্যেসও আছে। খালেদা বাউলের মুখখানাও পানের রসে সিক্ত। পানের মশলাপাতি, সরঞ্জামাদি সাথে সাথেই রাখেন। আমাকেও দিলেন। তার হাত থেকে পান নিতে গিয়েই অসতর্কতাবশত বিপত্তিটা ঘটে গেলো। হঠাৎ নতুন করে আবিস্কার করলাম এক বিরহ কাতর নারীর মুখছবি। হাতে হাতে পান নেয়া দেয়া, একটি মুহুর্ত মাত্র। কিন্তু সেই সামান্য সময়ের স্পর্শে এক গভীর অনুরাগে ছুঁয়ে গেল মন।
চকিতে তার মুখের দিকে তাকাতেই বাউলানী খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো, বললো- বেশ গানইতো লিখেছেন। তারপর দৃষ্টি তীর্যক করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন-
সাধু সঙ্গ করতে চাও নাকি গোসাঁই?
একটি মাত্র শব্দ। আমি হকচকিয়ে গেলাম। এই যে হঠাৎ তুমি সম্মোধন, আর গোসাঁই নামক শব্দযোগে সামান্য একটি প্রশ্ন, এতো প্রশ্নমাত্র নয় এ যে বড় সাংঘাতিক আহবান। এযে ভাবসাগরে ঝাঁপ দেয়ার আমন্ত্রণ। বললাম-
না, বাউলানী। মন চাইলেই কী সব করা যায়?
খালেদা মুখ টিপে হাসলো, চোখে তার গভীর দুষ্টুমি ভাব। সহসা তাকে যেন নতুন রুপে দেখলাম। বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম- কতো হবে? বড়জোর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। কৃষ্ণ কালো চেহারায় উপচেপড়া যৌবন। গভীর কালো চোখে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির কথাই মনে হয়।
বাবুল শাহ অন্য চেলাদের সাথে কথায় ব্যস্ত। খালেদা বললো- না কেন? কেন করা যায়না গোসাঁই? মনতো নিজের, তারপর সুর দিয়ে বললো-
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে…..
বললাম- না গো, বাউলানী। আমি যে সংসারী মানুষ, ছাপোষা জীবন। মন যে আমার মনের মানুষের সিন্ধুকে বন্দী আছে। তারপর বললাম- সবাই যদি বৈরাগ্য সাধনে ব্রতী হন তবে দুনিয়ার জমিন তো বিরান হয়ে যাবে। সমাজ চলবে কী করে? সমাজ, সংসার করেও কী সাধন-ভজন হয়না?
বললেন- তা হবেনা কেন? তারপর প্রশ্নের সুরে আমাকে বললো-
“বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
………… ? “
আমি হেসে বললাম- ঠিক বলেছো। এতো গুরুদেবের বানী।
বাউলানী- চট করে বললেন, তিনি আপনার গুরু হতে পারেন। আমার গুরু সাঁইজি। তিনি অমন কথা কখনও বলেননি। তাছাড়া আপনার গুরুদেব অল্প বয়সে বিপত্নীক হয়েও সংসার কেন করলেন না? বলুন তো!
খালেদা বাউল যে অশিক্ষিত নন। ক্রমে তা স্পষ্ট হতে শুরু করে। আমার বিস্ময়বোধ থেকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই বাবুল শাহ আমাদের দিকে মনযোগী হলেন। বললেন- সবাই যদি সংসার ত্যাগ করে সন্যাস ধারন করেন তবে পৃথিবী চলবে কেন? না ভাই, এ পথ আপনার জন্যে নয়। বরং মানুষের কথা, আমাদের সবার কথা আপনার কলমে উঠে আসুক। কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।
বাবুল শাহ’র আড্ডায় একেবারে মজেই গিয়েছিলাম, আহা কী সাধু বানী! পরানের গহীনে ঝংকার তোলে মরমীয়া সুর, প্রাণ উতালা হয় -ব্যাকুল হয়। চিন্তাশীল মানুষকে নিয়ে যায় ভাবের দেশে, অন্যলোকে। তার কথায়, তার আচরণে আমিও খানিকের জন্যে ডুবে গিয়েছিলাম অন্য ভূবনে।
এ সময়ে সুলতানা ফোন দিয়ে বললো- শীগগির চলে এসো, সোহেল ভাই চলে এসেছেন এখনই ভেতরে ঢুকতে হবে।
এসে দেখি তারাও আকলিমা বাউল আর এ্যানী বৈরাগীকে ঘিরে তারা আড্ডা জমিয়ে ফেলেছে। তাদের আড্ডায় অল্প দূরেই দু’জন বাউল তাদের সংসার গোছাতে ব্যস্ত। মধ্য বয়েসী এ মানুষ দ’টির সাথে একটি ফুটফুটে বাচ্চাও আছে।
সংসার বলতে একটি আম গাছের তলায় পাটি বিছিয়ে তাদের পরিধেয় বস্ত্রাদি, এক পাশে দু’টি একতারা। থালা বাসন বলতে গোটা দুই মাটির বাসন, একটি লোটা আর একটি সিলভারের কলস। তিনটি ইটের উপর ছোট্ট পাতিলে ভাত বসানো। ফ্যান ভাতে রান্না। জিজ্ঞেস করে জানলাম ভাতের মধ্যে আলু সেদ্ধ দেয়া আছ। চলবে রাতের আহার।
নাম জানা গেলোনা। এরা পাবনার আটঘরিয়া থেকে আজই এসেছেন। বিশ দিন বাদে লালন মেলা। থাকবেন মেলা শেষ হওয়া অব্দি। আগামী বিশ দিন হাটে বাজারে গান করবেন রাতে এখানে এসে থাকবেন। বাচ্চাটি তাদের কীনা জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর পেলাম না। মনে মনে ভাবলাম কী বিচিত্র এই জীবন। তবুও তাদের মুখে তৃপ্তির হাসি, যেন সুখের অন্ত নেই।
সন্ধ্যের সামান্য আগে আমরা মাজার প্রাঙ্গনে ঢুকছি। শরতের শেষ বিকেল, মাজার প্রাঙ্গনে সুনসান নীরবতা।
শিশুদের নিয়ে গুনে গুনে আমরা আটজন। আমাদের সাথে আকলিমা বাউল, অ্যানী বৈরাগী আর হাসান মতিউর রহমান মিকতাল। করোনাকালের সেই শরৎবেলা লালন ফকিরের মাজার কমপ্লেক্সে আমরা যখন প্রবেশ করি তখন সন্ধ্যা আসন্ন। মূল ফটক থেকে মাজার পর্যন্ত নানান রঙের ফুল ফুটে আছে। সামনেই বাউল সাধক ফকির লালনের মাজার।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২১
আনোয়ার হোসেন বাদল
বিশ্বব্যাপী করোনা প্যানডেমিকের প্রভাবে আরশি নগরের কর্মকাণ্ডও মুখ থুবরে পড়েছে। লালন একাডেমী, অডিটরিয়ম এবং মাজার কমপ্লেক্স এখন খা খা করছে। জনমানবহীন এক বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে সাঁইজি’র আখড়া। অথচ বছরের বারোমাস এখানে হাজার হাজার বাউল, ভক্ত-পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। হাঁটতে হাঁটতে মারুফা অডিটরিয়মের নিচের ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে বললো-
ওইদিকে তাকিয়ে দেখুন গুরু, করোনার আগে ঐ খালি জায়গায় কিন্তু গাঁজার গন্ধে ঢোকাই যেত না। করোনা গেলে আরেকবার আসবেন, দেখবেন লালন ভক্তদের কাজ কারবার। কতো রঙের মানুষ, কতো রঙের কল্কি!
মিকতাল তার কথায় সায় দিয়ে বললেন- একদম ঠিক বলেছেন, সে এক বিদঘুটে অবস্থা। ভদ্রলোকদের এখানে তিষ্টানো দায়।
মনে মনে ভাবি, যেভাবে নারীপুরুষের অবাধ বিচরণ তাতে অসামাজিক ক্রিয়াকলাপও হয়তো যথেচ্ছ হয়ে থাকে। আচ্চা লালনের জীবদ্দশায়ও কী এমন করেই এসব চলতো? কে জানে? হয়তো গবেষকরাই ভালো বলতে পারবেন।
সেপ্টেম্বরের ২০ থেকে ২৭ এই এক সপ্তাহ কুমারখালীতে থেকে লালন এবং তার সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে এসে লিখতে শুরু করি ভ্রমণ আখ্যান। যাতে ভ্রমণের পাশাপাশি প্রাসংগিক হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বিখ্যাত সব ব্যক্তবর্গের কিছু ঐতিহাসিক তথ্যাবলী। যে তথ্যগুলোর জন্যে আমাকে নির্ভর করতে হয়েছে স্থানীয় সূত্রসহ বিভিন্ন গবেষকদের লেখার উপরে। অতঃপর গত এক মাস যাবৎ কিস্তি করে করে লেখা পোস্ট করে যাচ্ছি ফেসবুকে।
ফেসবুকে পোস্টানোর দু’টি উদ্দেশ্য ছিলো- প্রথমত, লেখাটি ভবিষ্যতে মলাটবদ্ধ করতে না পারলেও সাহিত্যিক-পাঠক বন্ধুরা অন্তত প্রাথমিকভাবে পড়লেন এবং জানলেন। দ্বিতীয়ত, ফেসবুকে প্রকাশের কারণে পড়শিদের সম্পর্কে আমার দেয়া তথ্যে যদি ভুল ত্রুটি থাকে তা কারো নজরে পড়লে নিশ্চয়ই তারা আমাকে সচেতন করবেন।
বলা বাহুল্য যে, আমার দু’টো উদ্দেশ্যই সফল হয়েছে। লেখাটির জন্যে পাঠকদের যেমন ব্যাপক সাড়া পেয়েছি তেমনি পোস্ট দেখেই তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন নর্দার্ণ ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট গবেষক শ্রদ্ধেয় রকিবুল হাসান, কুমারখালীর সন্তান কবি সিদ্দিক প্রামানিক ও সাহিত্যিক অশোক বিশ্বাসসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। সর্বপরি ফেসবুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার সাহিত্যিক বন্ধুরা।
আলোচ্য লেখাটি ইতিহাসের কোন পুনরাবৃত্তি নয়, গবেষণাধর্মীও নয়। নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ভ্রমণের আদ্যপান্ত। লালনকে মহাত্মা, মহান সাধক, বাউল সম্রাট ইত্যাকার বিশেষণগুলো নতুন করে আমার দেয়া নয়। তার দীপ্তিময় ব্যাপ্তি কালের বিচারে সুপ্রতিষ্ঠিত। সর্বজনস্বীকৃত দার্শনিক তিনি। তদুপরি আমি লালন বা সমকালীন মহান ব্যক্তিদেরকে নিয়ে কোন গবেষণাও করছিনা। সে ইচ্ছেও আমার নেই। আমি শুধু লালন এবং তার সময়ের মহান সাহিত্যিকবৃন্দ যারা লালনকে ঘিরে ছিলেন তাদের স্মৃতিগুলো ছুঁয়ে এসে ‘আরশি নগরের পড়শি’ শিরোনামে একটি ভ্রমণ আখ্যানের চেষ্টা করেছি মাত্র।
কিস্তি আকারে আমার এ লেখাটি পোস্ট করার সম্ভবত শুরুর দিকের ঘটনা- ‘নীল কমল’ নামের একজন ব্যক্তি ফোনে লালন সম্পর্কে খুব বাজে তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার তথ্যের সূত্র হিসেবে জানিয়েছিলেন ড. আহমেদ শরীফের বাউল দর্শন নামক একটি বইয়ের কথা। তাকে জানিয়েছিলাম যে, আমার লেখাটি শুধুই ভ্রমণ আখ্যান পরন্তু শুধুমাত্র লালনকেন্দ্রিকও নয়।
শুধু বঙ্গদেশেই নন, বরং পৃথিবীব্যাপী লালন একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। একটি স্বতন্ত্র দর্শন, তার চরিত্র বিশ্লেষণের ধৃষ্টতা আমাকে মানায় না। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, লালন হচ্ছেন সেই মানুষ যাকে মহাত্মা গান্ধীর বহু বহু বছর আগে ভারতবর্ষ ‘মহাত্মা লালন’ খেতাবে ভূষিত করেছেন। শুধু কি তাই? লালনের সময়ে তার স্পর্শে এসে তাকে নিয়ে কাজ করেছেন মহর্ষি রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, মীর মোশাররফ, কাঙাল হরিনাথ, ডি এল রায়সহ, জলধর সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এসব মহান ব্যক্তিদের কষ্টি পাথরে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়েই সাধক লালন।
‘নীল কমল’ নামের সেই আইডি’র প্রকৃত নাম কী তা আমি জানিনা। লালনের চরিত্র নিয়ে কথা বলা এই ব্যক্তি পাবনা বেলকুচি সরকারী কলেজের শিক্ষক বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন, যা তার আইডিতেও লেখা আছে। তবে আইডিতে তার ছদ্মনাম ব্যবহারের কারণটা বোধগম্য ছিলোনা। উপরোন্তু যে ভদ্রলোকের বইয়ের রেফারেন্সে তিনি লালন চরিত্রের পোস্টমার্টেমে এসেছেন সেই ড. শরীফ সাহেবও ব্যক্তিগতভাবে আমার অপছন্দের একজন মানুষ । অবশ্য তার বাউলদর্শন বইটি কতোটা অথেনটিক তা বইটি পড়ার পরেই এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে।
বিষয় যাই হোক। লালন মাজারে মদ-গাঁজা ইত্যাকার বিষগুলো আমাকে খুবই বিদ্ধ এবং বিব্রত করেছে। আমি মিকতাল সাহেবকে বললাম- সমাধিসৌধের এতো নিকটে বসে ভক্তরা যদি এমন অসামাজিক কার্যক্রম চালান তবে মাজারের পবিত্রতা আর রইলো কোথায়? মিকতাল বললেন- কে কী বলবে? এভাবেইতো চলছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।
মাজারের উত্তর দিকে চারতলা লালন একাডেমি আর পূবে অডিটরিয়ম ও কালচারাল সেন্টার। তারই পাশে লালনের মাজার।
আর মাজার ঘিরে আছে তারই সাধনসংগী শিষ্যদের অনেকগুলো কবর। কোথাও কোন লোকজন নেই, এখন খুবই পবিত্র আর ভাব গম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করছে। এই নীরবতার মধ্যে মনে হচ্ছে যেন দিবালোকের কর্ম সম্পাদনশেষে সঙ্গীদের নিয়ে সুখ নিদ্রায় বিভোর হয়েছেন লালন। মনে মনে বললাম- হে মানবতাবাদী দার্শনিক, হে বাউল সাধক, দেখো তোমার ভালোবাসার টানে তোমারই এক ভক্ত তার শেষ জীবনে তোমার কাছে ছুটে এসেছে। তোমার জন্যে দোয়া করছে পরপারে তুমি ভালো থেকো হে মানব দরদী মরমিয়া।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২২
লালনের সমাধি যে ঘরটির মধ্যে সেটি এখন তালাবদ্ধ। করোনাকালীন সময়ে কেউ এদিকে তেমন একটা আসেন না। ঘরের চার পাশের দেয়ালগুলোতে অসংখ্য ঘুলঘুলি। সমুখে বারান্দার মতো আছে কিন্তু সেখানেও আছে একাধিক কবর। ঘরের মধ্যে লালনের পাশের কবরটি তার পালক মা মতিজান ফকিরের। এখানের প্রত্যেকটি কবরের মাথার কাছে মৃত ব্যক্তির নাম পরিচয় এবং জন্ম মৃত্যুর সন তারিখ লেখা আছে।
সাদা পোশাক পরিহিত একজন বাউলকে দেখলাম মাজারের দেখাশোনার দায়িত্বে। হাতে মোমবাতি নিয়ে প্রত্যেক কবরের শিয়রে সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম ঘরের ভেতরে লালনের কবরের কাছে যাওয়া যাবে কি না?
উত্তরে বললেন- করোনা উপলক্ষে মাজারে দর্শক সমাগম নিষিদ্ধ আর চাবি তাদের কাছে নেই। বললেন-জুতা রেখে বারান্দায় উঠে দেখুন। বললেন, আমার সাথে আসুন।
আমি ভেতরে দেখার জন্যে বারান্দায় উঠে গেলাম, মারুফা ছবি তুলতে লাগলো। মিকতাল ভাইকে বললাম ভিডিও করেন। একটু পরে সুলতানাকে নিয়ে মারুফাও উঠে এলো বারান্দায়। আমরা এখন বারান্দার ঘুলঘুলি দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করছি।
লালনের কবরটি হলুদ রঙের মখমলের কাপড়ে আবৃত তার মায়ের কবরে সাদা মখমল। বাহিরের কবরগুলো কালো পাথরে বাঁধাই করা। সমাধিসৌধের প্রাঙ্গনের কবরগুলো যথাক্রমে লালনের শিষ্য-
মাওলানা মলম শাহ
ভোলাই শাহ,
কালু শাহ,
ইয়াছিন শাহ,
দুন্দ শাহ,
আজিফ উদ্দিন শাহ,
মহিন শাহ,
কুসুম ফকিরানী,
ফকির লতিফ শাহ,
মোকসেদ আলী শাহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের।
লালনের জাত-ধর্ম এবং জন্ম বৃত্তান্ত আজও রহস্যাবৃত। তিনি নিজেই স্বজ্ঞানে তার পরিচয় গোপন করে গেছেন। জীবদ্দশায় কোন ধর্ম পালন করতেন না তেমনি তার মরনোত্তর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও কোন নির্দিষ্ট ধর্মাচারে করা হয়নি। তার নিজের নির্দেশানুযায়ী ঘরের মধ্যে সমাহিত করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তার এবং তার শিষ্যদের কবর কিন্তু মুসলিম রীতি অনুসরণ করেই করা হয়েছে। এমন কি লালনের সমাধিসৌধ মুসলমানদের রীতি নীতি মেনেই নির্মাণ করা হয়েছে।
করোনার জন্যে কোন লোক সমাগম না থাকায় সর্বত্র শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। একদিন এখানেই লালন তার অনুচরদের সাথে নিয়ে ভজন সাধন করেছেন। আজ তার সাথীদের নিয়ে তিনি অন্য জগতের বাসিন্দা। লালনের পরিচয় একমাত্র গানেই। জানা যায় তার জীবদ্দশায় তার পরিচয় জানার জন্যে কেউ জোরাজুরি করলে তিনি একটি গান শুনিয়ে দিয়েছেন। যেমন –
“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।”
অথবা
?”সবে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে।”
এমন রহস্যময় গানে তার জাত-ধর্মেরর কথা যেমন স্পষ্ট হয়নি তেমনি কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু জানতেও পারেননি। লালন ফকিরের সাধন ভজনে গানই ছিলো মাধ্যম। জানা যায় তার জীবদ্দশায় তিনি দু’হাজারের অধিক গান রচনা করেছেন। তবে লালন ভক্তদের দাবী সাঁইজির গানের সংখ্যা দশ হাজারের অধিক।
সব গানই বাউল গান কিন্তু প্রচলিত বাউলদের সাথে লালন গানের বৈশিষ্ট ভিন্নতর। প্রচলিত বাউল গানগুলো সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেলেও লালনের গানগুলো হরায়নি। তার গানের গভীর দর্শন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন প্রাজ্ঞ দার্শনিক।
লালন শিষ্যদের একটি অভিযোগ শোনা যিয় এই মর্মে যে, সাঁইজির বহু গানের খাতা ভদ্রলোকদের মাধ্যমে বেহাত হয়েছে বা ভদ্রশ্রেণি লালনের গান প্রচার করার আশা দিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন।
কোলকাতার বিশিষ্ট গবেষক সুধীর চক্রবর্তী তার গবেষণা বই ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’এ তৎকালীন বাউল গান সম্পর্কে লিখেছেন এভাবে-
” লালন ছিলেন নিভৃতচারি সাধক। তার গান তার সমকালে সর্বত্র গাওয়া হতো না। তিনি ছিলেন নিতান্ত আত্মমগ্ন। সাধন জীবনের নির্জন উপলব্ধি থেকে তার গান জেগে উঠতো। যখন গানের বেদনায় তিনি হারিয়ে যেতেন, শিষ্যদের ডেকে বলতেন, ‘ওরে আমার পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে,’ সঙ্গে সঙ্গে তার নতুন গানগুলি লিখে নিতেন। সেসব গান আখড়ার বাইরে গাওয়ার তেমন চল ছিলোনা। কিন্তু লালনের সমকালে পাগলা কানাই গ্রামে গঞ্জে ঘুরে তার স্বরচিত গান গেয়ে বেড়াতেন। তার ছিলো বিপুল চাহিদা আর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা। তার পরেই এলেন বাউল হরিনাথ বা ফিকির চাঁদের গানের প্রবাহ। গগন হরকরাও সমসাময়িক এমন কি মীর মোশাররফ হোসেনও সে সময়ে বাউল গান লেখায় মনযোগী হয়েছিলেন।”
বাউল গানের সে এক বানের জোয়ার কিন্তু সেই জোয়ারেও শেষ পর্যন্ত সবাইকে ছাপিয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়লেন বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ।
চলবে———–
ছেউরিয়া, কুষ্টিয়া
২৬/০৯/২০২০
আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২৩
আরশি নগরের উত্তর পাশের আখড়ায় গানের আসর। আসরের ব্যবস্থা করেছেন হাসান মতিউর রহমান মিকতাল। নড়াইলের মানুষ এই মিকতাল সত্যিই এক অসাধারণ প্রকৃতির লোক। মানুষকে ভালোবাসতে পারলেই তার সুখ। বললেন- করোনার জন্যে শিল্পীদেরও কিছুটা বাধ্যবাধকতা আছে তবু জনা কয়েক শিল্পী পেয়েছি। চলুন রাত বেড়ে যাবার আগেই আসরে বসে যাই।
ভেবেছিলাম আরও দর্শক স্রোতা হয়তো আছেন কিন্তু আসরে গিয়ে দেখলাম মেহমানও আমি আর দর্শকও আমি। সুলতানা, সোহেল আর মারুফাকে নিয়ে আমরা যখন গানের আসরে বসি তখন এশার আযান হয়ে গেছে।
লালনের নানান নাম- ফকির লালন, অসাম্প্রদায়িক লালন, মানবতাবাদী লালন, সাধক লালন, মহাত্মা লালন, দার্শনিক লালন- কোন অভিদায়ই লালনকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। লালন যেমন জাত পাতের হিংসাত্মক মতবাদকে কৌশলে এড়িয়ে একটি সর্বজনগৃহীত মানবতাবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী ছিলেন, তেমনি তার সময়ে তৎকালীন হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার বিপক্ষে ছিলেন আজীবন। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার যখন অত্যাচারী নীলকর সাহেব আর জমিদারদের বিরুদ্ধে তার পত্রিকা গ্রাম্যবার্তায় প্রতিবাদ জানান এবং এতে তার প্রতি জমিদাররা রুষ্ট হয়ে পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে হরিনাথকে ধরে নিয়ে যেতে চায় লালন তখন ফকির সন্নাসীদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এভাবেই আজীবন শোষন বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্ছার ছিলেন লালন।
গানের প্রস্ততি চলছে তখনও শুরু হয়নি, একটি লোক এসে জয়গুরু বলে পাশে বসলেন তাকিয়ে দেখি ক’দিন আগে যখন বাঘা যতীনের কয়া গ্রামে গিয়েছিলাম তখন পরিচিত হওয়া একজন বয়স্ক বাউল, নাম আবদুল খালেক। বললেন- কেমন আছেন ভাই?
জি ভালো। বললাম-দেখা তাহলে আবারও হয়ে গেলো?
হাসলেন খালেক ফকির। বললেন- সবই সাঁইজির খেলা। তার কৃপা হলো তাই আসরে হাজির হয়ে গেলাম!
বললাম- আচ্চা গুরুজী, লালন সম্পর্কে কিছু বলেন তো! তার জীবন, তার দর্শন সম্পর্কে জানতে চাই-
এই মানুষটির সাথে কয়া কলেজ গেটে যেদিন দেখা হয়েছিলো সেদিনই মনে হয়েছিলো লোকটির ভেতরে অগাধ পাণ্ডিত্য আছে। বললেন- “যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে” – এই ছিল সাঁইজির দর্শন। বৈষ্ণব সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া ও মুসলিম সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজন। মানবদেহের ভেতরই আকাশ বাতাস, রবি-শশি, জল-স্থল সব। মানুষই শেষ কথা, দেহ-কেন্দ্রিক সাধনাই লালন ধর্মের মূলমন্ত্র।
সাঁইজি বলেছেন- সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। আত্মসাধনার মাধ্যমে তার সন্ধান করতে হয়। এজন্যেই সাঁইজি বলেন-
“আত্নতত্ত্ব যে জেনেছে
দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে”
নিরহংকার, নির্মোহ প্রকৃতির এক মানুষ এই বৃদ্ধ আবদুল খালেক। তার কথা বলার ধরণ খুবই মোলায়েম আর শ্রুতিমধুরও। বললেন-
মূলতঃ লালনকে বুঝতে হলে তার আর্বিভাবের সময়টা বুঝতে হবে। বাঙালির জীবনে সে ছিলো এক ক্রান্তিকাল। তার জন্ম ১৭৭৪ সাল। তার মাত্র পনের বছর আগে নবাব সিরাজদৌলার পতন। ইংরেজদের অপশাসনে পরাধীন বাংলার গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা তখন নানাভাবে বিভক্ত। ধর্ম জাত-পাত ইত্যাদি নিয়ে সমাজে ছিল হযবরল অবস্থা।
ইংরেজরা তাদের শাসন ব্যবস্থা নিষ্কন্টক রাখতে কৌশলে হিন্দু মুসলিম বিবাদ লাগিয়েই রাখতো। মুসলমানরা সদ্য ক্ষমতাচ্যুত তদস্থলে হিন্দুরা ইংরেজ ঘেষা। জমিদার শ্রেণি সবই প্রায় হিন্দু সম্প্রদায়ের। মুসলমানরা তখন বিপর্যস্ত, কোনঠাসা। সাঁইজি এই জাত-পাত ও ধর্ম বর্ণ-বিভেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি চেয়েছিলেন জাত ধর্ম বর্ণ গোত্রহীন মানব সমাজ গড়ে তুলতে। সবকিছুর ওপরে তিনি স্থান দিয়েছিলেন মানবতাবাদকে।
মুগ্ধ হয়ে বাউল ফবির আবদুল খালেকের কথা শুনছিলাম। তার কথায় দর্শন আর ইতিহাসের মিশেলে যেন অমৃত ঝরে ঝরে পড়ছিলো।
আসলে বাউল ফকিরদের সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই আমার এক ধরণের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল ভাব ছিলো। আজ ফকির আব্দুল খালেকের কথায়, তার ইতিহাস সচেতনতায় যারপরনাই বিস্মিতই হলাম। ইতোমধ্যে গান শুরু হলে আমরা তাতে মনযোগী হই।
আগেই বলেছি দর্শকও আমি, মেহমানও আমি। আমি তাই মঞ্চেই আসন গেড়ে বসলাম। সামনে থাকলো সোহেল, মারুফা সুলতানা আর তূর্যকে নিয়ে তানিশামনি। গান শুরু করলো এ্যানী বৈরাগী-
“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।
লালন কয় জাতের কী রূপ
আমি দেখলাম না দুই নজরে।
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।”
ছোট্ট একটি মেয়ে। বয়স পনেরোর বেশী নয়। তার গানের তাল, লয় আর একতারা হাতে বাউলিয়ানা ঢংএ আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মেয়েটিকে আকলিমা বাউল তার মেয়ে বলে পরিচয় করিয়েছিলো। কিন্তু এ্যানি যখন এই গানটি শেষ করলো আমি বললাম-
তুমিতো লালন কন্যা হে বৈরাগী। ধন্য মায়ের ধন্য মেয়ে তুমি। আজ থেকে আমার কাছে তুমি লালন কন্যাই।
আকলিমা বাউল হেসে বললো- দাদা, সবাই ওকে এই নামেই ডাকে। দোয়া করবেন যেন সাঁইজির কৃপায় তার দেখানো পথে চলতে পারে।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২৪
লালনের আরশী নগরে এক অপার্থিব আনন্দে মেতে উঠলাম শরতের এই সন্ধ্যেবেলা। লালন কন্যা শিরিন আকতার গাইলেন-
“বাড়ির কাছে আরশী নগর
সেথা পড়শী বসত করে-
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।।
গানটি আমার ভেতরে এমন এক অাবহ তৈরি করলো যে, ভেতর থেকে কান্নারা সব দলা পাকিয়ে গেলো। মহাত্মা লালন দর্শনের মূল সুরে আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি করে গাইলেন বাসন্তি রানী, তিনি গাইলেন-
“মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই
মূল হারাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”
অতঃপর একে একে আকলিমা বাউল, এ্যানি বৈরাগী , আলি শাহ, এনামুল শাহ প্রমুখ বাউল শিল্পীগন গানে গানে লালনের মানবতার বাণী আকাশে ছড়িয়ে দিলেন। আকলিমা বাউল একেবারে মাতিয়ে দিলেন আসর। গানের তালে তালে মারুফার ছোট্ট মেয়ে তানিশাও উঠে গিয়ে নাচ আরম্ভ করে দিলো।
সবশেষে মিকতাল ভাইও সমবেত সঙ্গীতে কণ্ঠ দিলেন। সমবেত বিদায়ী সঙ্গীত ছিলো-
“মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে।”
লালনের গানের ব্যাখ্যা দেয়া এই ক্ষুদ্র কলেবরে সম্ভব নয়। আমার এ ভ্রমণ আখ্যানে তা প্রাসঙ্গিকও নয়। তার একেকটি বাণী নিয়ে গোটা বিশ্বে চলছে গবেষণার পর গবেষণা।
লালনের গান এবং তার দর্শন দ্বারা পৃথিবীর বহু কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রভাবিত হয়েছেন। মহর্ষি রবীন্দ্রনাথ নিজে লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ১৫০টি গান রচনা করেছেন বলে জানা যায়। তিনি ইউরোপ, আমেরিকায় তার বিভিন্ন বক্তৃতা ও রচনায় লালনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। মূলতঃ রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম লালনকে আন্তর্জাতিকতা দিয়েছেন।
লালনের মানবতাবাদী দর্শনে প্রভাবিত হয়ে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল বহু সাম্যবাদী কবিতা রচনা করেন। তার গান এবং প্রবন্ধেও লালন দর্শনের সুস্পষ্ট ছাপ দৃশ্যমান।
আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ষাটের দশকে ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন। তার ভারতে সফরকালীন সময়ে বেশিরভাগই কলকাতায় কেটেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং মলয় রায়সহ বহু কবি সাহিত্যিকরা তার বন্ধু ছিলেন। সেই অ্যালেন গিন্সবার্গও লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তার রচনাবলিতেও লালনের রচনা শৈলীর অনুকরণ দেখা গেছে।
লালনের অনুকরণে অ্যালেন গিন্সবার্গের একটি কবিতা এরকম যা ড. বিনায়ক সেন অনুবাদ করেছেন-
“এভাবেই আমি পৃথিবীর পথে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম
সেই-যে তারুণ্য বেলায় উইলিয়াম ব্লেক
আমাকে উস্কে দিলেন, তারপর কত মহামুনির নিষেধঃ
‘ওরে জড়াস নে বিষয়ের আশে,
বরং তৈরী হ মৃত্যুর জন্যে’
সেই যুবা বয়স থেকেই শুনছি এসব
আর এখন তো নিজেই আমি পৌঢ় নাগরিক এক,
বাঁধা পড়ে আছি লক্ষাধিক বইয়ের ভেতরে,
লক্ষাধিক চিন্তার জালে, লক্ষাধিক মুদ্রার স্তূপে,
লক্ষাধিক বাসনায়, তাহলে কবে
এ দেহের মায়া ছেড়ে যাওয়া হবে আমার?
এলেন গিন্সবার্গ বলে, আকন্ঠ ডুবে আছি আমি ক্লেদে।”
লালনের সংগীত এবং তার ধর্ম-দর্শন নিয়ে ইউরোপ আমেরিকাসহ দেশ-বিদেশে গবেষণাে কাজ চলছে। আমার এ ভ্রমণ কাহিনীতে সে প্রসঙ্গ একেবারেই অবান্তর। তবু দেশের অগনিত লালন ভক্ত এবং পাঠক যারা আমার এ লেখাটির শিরোনাম দেখে পড়তে আগ্রহী হয়েছেন তাদের জন্যে এই সামান্য আলোকপাত।
মূলতম লালন আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথা বলা আমার কাছে বোবার বাকদানের মতো আর তাদের নিয়ে লেখাতো হিমালয় অতিক্রমের মতো। তাই লিখতে গিয়ে কেবলই গীতার এই শ্লোকটি মনে পড়েছে
“মূকং করোতি বাচালং
পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্
যৎকৃপা তমঅহং
বন্দে পরমানন্দমঃ।”
,কেননা লালনের আরশি নগরে গিয়েছিলাম সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ, ছিলামএক সপ্তাহ।
অতঃপর ফিরে এসে যখন এ লেখার প্রস্ততি নিয়েছিলাম কলম থেমে গিয়েছিলো। থেমে গিয়েছিলো এ কারনে যে, লালন, রবীন্দ্রনাথসহ সমকালীন মহান ব্যক্তিবর্গের স্মৃতি বিজরিত স্থান ঘুরে এলেই কী লেখা যায়! এইসব ব্যক্তিদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা কতো খ্যাতিমানরা কাজ করেছেন। আমার চলমান লেখাটি ভ্রমণ আলেখ্য হলেও ওইসব মহৎ ব্যক্তিবর্গের ঐতিহাসিক বিষয়াদি কখনও কখনও প্রাসংগিক হয়েছে। সুতরাং সেইসব বিষয় যা, ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে গৃহীত তার পূনঃউল্লেখ তো যথাযথ হওয়া চাই! অতএব গত একমাস আমাকে পড়াশোনাও করতে হয়েছে ব্যাপকভাবে।
লালন এবং তার পড়শিদের নিয়ে দীর্ঘ একমাসের পড়াশোনাশেষে এই ভ্রমণ আখ্যান। এ আখ্যানে তাই আমার দেখা বিষয়গুলোর বাইরেও কিছু বিষয়াদি স্থান পেয়েছে আর এর মধ্য দিয়েই শেষ হচ্ছে “আরশি নগরের পড়শি” ভ্রমণ আখ্যান।
আখড়ার গান শেষ হতে হতে রাত প্রায় দশটা পেরিয়ে গেলে আমাদের ঘরে ফেরার পালা। মিকতাল ভাই শিল্পীদের সাথে আমাদের চা চক্রের আয়োজন করলেন। আমি আমার ভারত ভ্রমণের আখ্যান ‘ভারতে কয়েকদিন’ বইটি তার হাতে তুলে দিয়ে যখন কুমারখালীর উদ্দেশ্য গাড়িতে চরে বসি তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা পেরিয়ে গেছে।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২৫
গতকাল গভীর রাত অব্দি ছেউরিয়ার অনুষ্ঠানে থাকার ফলে ক্লান্ত হয়ে বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবুও সকালে সোহেলের সাথে গড়াই তীরে হাঁটতে বের হয়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। দেখি একটি পুরানো দিনের বিশাল সওদাগরী নৌকা পাল তুলে পশ্চিম থেকে পুবে ভেসে যাচ্ছে।
শৈশবের সেই মহাজনী নাও। বিশাল ছইয়ের উপর দু’জন মানুষ নিবিষ্টমনে বসে আছেন। সোহেলকে বললাম- আহ, বহুদিন পরে মহাজনী নৌকা। আমাদের শৈশবে হাটে বাজারে পাঁচশো মনি সাতশো মনি এমন অনেক নৌকা দেখতাম।
সোহেলও অবাক হলেন, বললেন- কখনো দেখিনিতো! আজ হঠাৎ কোত্থেকে এলো!
হাঁটা শেষ করে আমরা প্রভাতি শরীর চর্চা সংগঠন ‘ভোরের পাখি’ কমান্ডার আল কামাল ভাই’র কমান্ডে ব্যায়াম করছি। আল কামাল ভাই এক মজার মানুষ। পেশায় ব্যবসায়ী, ষাটোর্ধ শক্ত-সমর্থ্য এক সুপুরুষ। কথা বলার সময়ে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি মিলিটারির প্রশিক্ষণ নেয়া মানুষ, তবু ব্যায়াম করার সময়ে কামাল ভাইয়ের কমান্ডের প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে যাই। পেশাদার সৈনিকের মতোই তার চলার ধরণ এবং বাচন ভঙ্গী।
ব্যায়াম শেষ করে সবাই মিলে গল্প করছি। সাথে আছেন মারুফার হাসবেন্ড সোহেল, শেখপাড়া কলেজের শিক্ষক নাসির, ভূমি অফিসের সাইদুর রহমানসহ মোট আট দশজনের একটি দল।
জায়গাটির তারিফ না করে পারা যায়না। মন ভালো হয়ে যাবার মতো একটি লোকেশন। আমাদের সমুখে গড়াই নদীর প্রবাহ, সেই প্রবাহে ভেসে চলেছে পালতোলা নাও। পেছনে দেড়শো বছরের পুরানো এম এন হাই স্কুল। ওপারে ঘন সবুজাভ এলাকাটির নাম যদু বয়রা ইউনিয়ন। আল কামাল ভাই বললেন- কেমন দেখলেন কুমারখালী?
বললাম- বিডিআর এ থাকতে সরকারি আদেশে ঘুরেছি, তারপর ভ্রমণ একটা নেশায় পরিনত হয়ে গিয়েছিলো। আজীবন তাই গ্রামে গঞ্জে, শহর বন্দরে ঘুরে ঘুরে দেখেছি বাংলার রূপ। দেশের প্রায় সবগুলো শহরে গিয়েছি কিন্তু কুমারখালীর মতো এমন সুন্দর শহর আর দেখিনি। বোধ করি আপনাদের উপজেলাতে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাতসব ব্যক্তিবর্গের জন্ম। মনে রাখবো আপনাদের আর মনে রাখবো এই দৃষ্টিনন্দন গড়াই নদীর কথা।
সাইদুর ভাই হেসে বললেন- গড়াইতো আর দু’এক মাস পরে শুকিয়ে যাবে। তখন এই নানন্দনিকতা থাকবেনা। মানুষ তখন পায়ে হেঁটে পারাপার হবে। তখন উৎপত্তিস্থল পদ্মা থেকে এ পর্যন্ত শুধুই মুরুভূমি।
কামাল ভাই জিজ্ঞেস করলেন-কোথায় কোথায় গিয়েছি? ছেউরিয়া, শিলাইদহ, কয়া, লাহিনীপাড়াসহ সবগুলো স্থানের নাম বললাম। বললেন-
ওপাড়ে যে সবুজ বৃক্ষরাজি দেখছেন ওটি যদু বয়রা ইউনিয়ন। ওখানেও রয়েছে এক মহান ব্যক্তির স্মৃতি।
বললাম- কার কথা বলছেন?
বললেন- “একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।”
এই গানটির কথা মনে আছে তো? বললাম- ক্ষুদিরাম বসুর কথা বলছেন? তার বাড়িও কি এই এলাকায়?
কামাল ভাই বললেন- ঠিক ধরেছেন তবে এটি তার মাতুলালয়। তার মামা বাড়ির লাহিড়ি বিল্ডিং যা এখন ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ক্ষুদিরামের মামার নাম পূর্ণ লাহিড়ী, এই লাহিড়ি বাড়িতেই ক্ষুদিরাম ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে, ক্ষুদিরামের মামা ব্রিটিশ পুলিশের দারোগা ছিলেন, সেই মামাই বিসসাঘাতকতা করে ক্ষুদিরামকে ধরিয়ে দিয়েছেন।
নাসির ভাই বললেন- ক্ষুদিরামকে কী দোষে যেন ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো?
কামাল ভাই আমার মুখের দিকে তাকালে আমি বললাম-
গানের মধ্যেইতো সেকথা বলা আছে।
“কলের বোমা তৈরি করে
দাড়িয়ে ছিলাম রাস্তার ধারে মাগো
বড় লাটকে মারতে গিয়ে মারলাম
আর এক ইংলেন্ড বাসি
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।”
বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ব্রিটিশবিরোধী সসস্ত্র আন্দোলনের সর্ব কনিষ্ঠ যোদ্ধা। তিনি যে সংগঠনের সদস্য ছিলো সেই সংগঠন তৎকালীন চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষুদিরাম স্বপ্রনোদিত হয়ে সে দায়িত্ব গ্রহন করেন।
নিরাপত্তাজনিত কারণে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ কিংসফোর্ডকে মোজাফ্ফরপুরে বদলী করলে তার গাড়ি লক্ষ করে ক্ষুদিরাম বোমা হামলা করেন। কিন্তু সে গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। সে হামলায় ভুল করে অন্য দু’জন ইংরেজ মারা যান। এই অপরাধে ক্ষুদিরামকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
আল কামাল ভাই খুবই বিজ্ঞজন। আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন- বললেন, ফাসির সময়ে ক্ষুদিরাম মাত্র আঠারো বছরের যুবক। তাকে মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে তিনি কী বলেছিলেন, জানেন? তারপর নিজেই বললেন-
ক্ষুদিরাম বলেছিলেন- “আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।”
বললাম এটা কোন গল্প নয় ভাই। তিনি কিন্তু সত্যিই এটা বলেছিলেন।
সাইদুর রহমান ভাই অবাক হয়ে সব শুনছিলেন, তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- ধন্য তুমি ক্ষুদিরাম বসু, লাল সালাম হে বীর।
সবার কাছে বিদায় নিয়ে বললাম- আজ সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে কুমারখালী এবাং কুষ্টিয়ার কবি সাহিত্যিকরা একটি সাহিত্য অনুষ্ঠান করবেন। কাল সকালের গাড়িতেই চলে যাবো, এ ক’দিন আপনাদের সাথে ছিলাম ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। মাত্র ছয়দিন, কিন্তু এরই মধ্যে ভালোবাসার বন্ধনটা এতো মজবুত হবে বুঝতে পারিনি। দেখলাম সবার চোখে মুখেই বিরহের স্পষ্ট ছাপ।
মনে মনে বললাম- আমরা বাঙালি, আমাদের অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্য না থাক কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ভালোবাসার মতো যে হৃদয়খানি বাঙালিদের দিয়েছেন তার তুলনা কেবলই বাংলাদেশে। তাইতো ডি এল রায় বলেছেন-
“‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা,
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।”

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২৬
পীর-আউলিয়ার দেশ বাংলাদেশ। বাংলায় ইসলাম প্রচারে মূলত পীর আউলিয়া, দরবেশ, ফকিরদের অবদানই বেশী। একসময় মধ্যপাচ্য থেকে এদেশে ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে বহু পীর মাশায়েখরা আসেন। সুতরাং এ দেশের অলিতে, গলিতে, বনে-জঙ্গলে নিরবে, নিবৃতে শুয়ে আছেন অসংখ্য সাধক পুরুষ।
কুমারখালীর মাটিতে পা রেখেই সোনাবন্ধু নামে তেমনই একজন আধ্যাত্মিক সাধকের নাম শুনেছিলাম, বলেছিলেন কবি সিদ্দিক প্রামাণিক। জীবনে প্রথম শুনেছিলাম নামটি। কিন্তু নামটি আমার কাছে স্ত্রীবাচক মনে হলেও তিনি ছিলেন যুগপৎভাবে একজন সাধক-দরবেশ, কামেল আউলিয়া এবং ব্রিটিশ বিরোধী এক অগ্নি পুরুষ। ভাবলাম আজ একবার ঘুরে না আসলে আর সময় পাবোনা। শহরে এই কামেল দরবেশের একটি মাজার আছে আর শহরের একটি মার্কেটের নামও তার নামানুসারে রাখা হয়েছে। আমরা এই সোনাবন্ধু মার্কেটের পিলু ভাই’র চা দাকানেই রোজ আড্ডায় বসি। এখানে বসেই সিদ্দিক ভাই এই দরবেশের কথা বলেছিলেন।
এ ক’দিন ঘুরে ফিরে পিলু ভাই’র ওখানেই আড্ডা দিতাম। আড্ডা বলতে কবি সিদ্দিক, কিরণ আর পরিমল ঘোষ। পরিমল বাবু রিটায়ার্ড তহশিলদার, কবিতা লেখা এবং পড়া তার একটি নেশা। আজ বিকেলে আমার সম্মানে সাহিত্যানুষ্ঠান হবে। দুপুরে খেয়ে দেয়ে তাড়ড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়েছিলাম, উদ্দেশ্য সোনাবন্ধুর মাজার জিয়ারত। সুলতানা, সোহেল আর মারুফাও সাহিত্য আড্ডায় যাবেন। বললেন-
এতো তাড়াতাড়ি কেন? পাঁচটার আগেতো সাহিত্য অনুষ্ঠান শুরু হবেনা।
বললাম- সোনা বন্ধুর মাজারে যাবো। শুনে তারা একটু হাসলো তবে সোহেলের কিন্তু মাজারের উপর ভক্তি বিশ্বাসটা বেশ মজবুত।তিনি খুশি হলেন। মাজারে যাবার রাস্তাও বলে দিলেন। ঠিক বিকেল চারটায় হযরত সোনাবন্ধু (রহঃ) এর মাজারে উপস্থিত হয়ে আমি কিছুটা হতাশই হই। কেননা বাংলাদেশের অন্যান্য মাজারের মতো হযরত সোনা বন্ধুর মাজারের তেমন কোন আরম্বর নেই।
আসলে এই মানুষটি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বেশীকিছু জানার উপায় নেই। তার কোন বংশধর যেমন নেই তেমনি দেশের অন্যান্য পীর মাশায়েখদের মতো তার প্রতিষ্ঠা করা নিজস্ব কোন মতবাদ বা ধারাও নেই। তার সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায় তা হলো ১৮০০ সালের প্রথম দিকে কোন এক সময় শাহ সোনা বন্ধু নামের এই ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে কুমারখালীতে। তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন তার হদিশ পাওয়া যায়না। প্রকৃত নাম ছিলো সোনাইব- বিন- সোনাহান। তিনি ছিলেন ইসলামের অাধ্যাত্মিক সাধক।
বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা মাওলানা কাজী মিয়াজানের বাড়িও এই কুমারখালীতে। ব্রিটিশ বিরোধী ওহাবী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। তখন কুমারখালী ছিলো হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা তারা মুসলমানদের উপর নানা ভাবে অত্যাচার করতো। তার জের হিসেবে হযরত সোনা বন্ধুর উপর হিন্দুরা চড়াও হয়ে তাকে বাটিকামারা থেকে বিতাড়িত করতে চাইলে কাজী মিয়াজান তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
এ তথ্যগুলো সকালে এম এন হাই স্কুলের সামনে সকালে যাদের সাথে ব্যায়াম করতাম তাদের মধ্যে জনৈক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেছিলেন।
সোনাবন্ধুর সাথে লালন শাহ এবং সাংবাদিকতার পথিকৃত কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের সম্পর্ক ভালো ছিলো। হরিনাথের লেখায়ও সোনাবন্ধুর সংস্পর্শে আসার তথ্য পাওয়া যায়। শাহ সোনাবন্ধুর অনেক অলৌকিক ঘটনার বিবরণ মিথ হিসেবে মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়।
তার কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা যা একুশের ছাদ বাগানে আগত এক সাহিত্যিক বন্ধুর কাছে জানতে পাই, তা ছিলো এরকমঃ
একবার হাসিমপুর গ্রামের এক কৃষক গরুর দুধ বন্ধ হয়ে যাবার কারনে গরুটি কসাইয়ের নিকট বিক্রি করতে গেলে তিনি সেখানে উপস্থিত হন এবং গরুটির জন্যে তিনি দোয়া করেন এবং তাত্ক্ষনিক গরুটি দুধ দান করে।
আর একবার অনাবৃষ্টির কারনে ফসলের দুরবস্থা হলে শাহ সোনাবন্ধু১০০ জন মুসলিম ব্যক্তিদের নিয়ে দুর্গাপুরের আউলিয়া মাঠে উপস্থিত হন এবং দোয়া করেন তার কিছুক্ষনের মধ্য বৃষ্টি নামে।
আর একবার একজন অত্যাচারী জমিদার একজন কৃষককে খাজনার টাকার জন্য ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে নেন। কৃষক কে নির্যাতন করতে থাকলে শাহ সোনা বন্ধু উপস্থিত হন এবং জমিদারের সাথে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে জমিদারের প্রতি দোয়া পড়ে ফুঁক দিলে জমিদার ভীত হয়ে ঐ কৃষক কে ছেড়ে দেয়।
কুমারখালী বড় বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী রহমত উল্লাহর বাড়ি ছাপড়া ইউনিয়নে। তার দোকান থেকে মারুফা আমাদের জন্যে বেশ কিছু উপহার সামগ্রী ক্রয় করলে তার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। রহমত উল্লাহ সাহেব সোনা বন্ধু (রহঃ) এর একজন ভক্ত। তিনি এই সাধক সম্পর্কে অনেক কিছুই জানালেন। বললেন-
এই গড়াই নদীর নাম ছিলো কুমার নদী।
সোনা বন্ধু একবার গভীর রাতে আত্নসুদ্ধির জন্য তার মুখ দিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে নদীতে ধৌত করার সময় কুমির এসে তা খাওয়ার চেষ্টা করে। এতে হুজুর অভিশাপ দেন এই নদীতে কখনও কুমির আসবেনা আসলেও তা ভেসে উঠবে। পরবর্তীতে সেটাই ঘটেছে।
কবি সিদ্দিক প্রামাণিকের কাছে এসব বিষয়ের সত্যতা জানতে চাইলে সিদ্দিক ভাই বলেন-
এগুলো সবই জনশ্রুতি। আর সোনা বন্ধুর মাজারে কতিপয় ভক্তবৃন্দ আসা যাওয়া করেন ঠিকই কিন্তু তার সম্পর্কে স্পষ্ট করে কেউ কিছুই বলতে পারেন না। জানা যায়
গড়াই নদীতে গৌরী নামে এক বাগদীর কন্যা গোসল করছিলো। তাকে ইংরেজরা জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গেলে সোনা বন্ধু বাগদী কে নিয়ে ইংরেজের কুঠিতে যান।
তিনি গৌরীকে ফিরিয়ে দিতে বললে ইংরেজ তা অস্বীকার করে এবং শাহ সোনাবন্ধুর প্রতি রুষ্ট হয়ে গুলি করেন কিন্তু বন্দুক দিয়ে গুলি বের হয়না। এতে ভীত হয়ে ইংরেজ গৌরীকে ফিরিয়ে দেন। অতঃপর এলাকায় গৌরী কুলটা বলে বিবেচিত হলে সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্নহত্যা করে। পরবর্তীতে সোনাবন্ধুর পরামর্শে সরকারের কাছে আবেদন করে কুমারনদীকে গৌরী নদী নামকরন করা হয়।
এসব গল্প শুনতে শুনতে পীলু ভাই’র চা দোকানে চা খাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে একুশে ছাদ বাগানে মাইকের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারি অামার সম্মানে আজকের সাহিত্য সভা শুরু হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি কাটায় কাটায় বিকেল পাঁচটা।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২৭
পটুয়াখালী থেকে কুষ্টিয়ার গাড়িতে উঠেই “আরশি নগরের পড়শি”দের সাক্ষাতে যাচ্ছি মর্মে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস করেছিলাম। সে স্ট্যাটাস দেখেই কুষ্টিয়ার সাহিত্যিক বন্ধুরা আমার সম্মানে একটি সাহিত্য সন্ধ্যা উৎসর্গ করবেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। মূলতঃ এ আয়োজনের মূল হোতা ছিলেন সিদ্দিক প্রামাণিক তবে কুষ্টিয়ার কবি শাহজাহান পারভেজ রনিও এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর নিয়েছেন।
সিদ্দিক প্রামাণিকের বাড়ি কুমারখালী শহরে আর রনির বাড়ি কুষ্টিয়া সদর। আমি যার বাসায় উঠেছি সেই মারুফার কুন্ডুপাড়ার কাছাকাছি কবি সিদ্দিকের বাড়ি। এই মানুষটি সময়ের এক প্রতিশ্রুত শব্দ সৈনিক। সর্বগ্রাসী দুর্বৃত্তায়নের বর্তমান সময়ে শুদ্ধ সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায় সিদ্দিক তেমনই একজন কবি। বলেন-
লিখি নিজের আনন্দ, পদক পুরুস্কারের লোভে নয়। সাহিত্য চর্চায় বরং আনন্দ পাই। প্রচার বিমুখ এই মানুষটির কবিতা আমাকে ভীষণ টানে, আর টানে তার ব্যাক্তিগত আচরণ।
সম্প্রতি ‘সতর্ক ছুরির দুপুর’ নামে গুচ্ছ কবিতা নিয়ে একটি ই-বুক করেছেন। বলেন- মলাটবদ্ধ বই আর করতে চাইনা। তার কাব্য শিরোনামের নিম্নোক্ত কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে-
“দুপুরে যে মেয়েটি নিজের ফ্ল্যাটে খুন হলো
তার টাইলসের ফ্লোরে রক্তমাখা পায়ের ছাপ আর
কনডমের ছেঁড়া প্যাকেট দেখে
সিমটম সিরিয়াসলিই বলল, তারও আগে
এটা ছিল রেপের ব্যাপার
ফালি ফালি তরমুজের ওপর দিয়ে
একটা দুপুর কতো সহজেই
সতর্ক ছুরির মতো পার হয়ে গেল”
কবিতাটি প্রথমবার পড়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। আমার স্ত্রী সুলতানা বলেছিলো অমন করে কী ভাবছো? বলেছিলাম ‘সিদ্দিকের কবিতার কথা ভাবছি। কবিতাটি সুলতানাও বহুবার পড়েছেন।
সিদ্দিকদের আয়োজনে আজ একটু পরেই সেই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান হবে কুমারখালীতে, শহরের গণমোড়ে একুশের ছাদবাগান নামে খ্যাত কবি সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থলে। একুশে সাংস্কৃতিক ও সাহাত্যিক সংগঠন এর কর্ণধারের নাম তুষার আহমেদ। তার শৌখিন কাজ এই ছাদ বাগান। তার সাথে আলোচনা করে কবি সিদ্দিক প্রমাণিক ভেন্যু নির্বাচন ও নির্ধারণ করেছেন। কুমারখালীতে ভ্রমণ আপাতত শেষ হয়ে এসেছে এখন শুধুমাত্র ঐ অনুষ্ঠানটি বাকী। ওইটি শেষ হলেই বাড়ির পথ ধরতে পারি।
নদীয়া জেলার প্রাচীন এই জনপদের স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের মহান ব্যক্তিবর্গের নাম। শুধু কি তাই? বাংলার অর্থনীতি, শিল্প-সংস্কৃতিতে বাঙালির নব জাগরণ এবং ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেও এই উপজেলার কৃতি মানুষদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়।
একুশের ছাদ বাগান নাম করণের সানে নজুলটা কী- তা কারো কাছে জিজ্ঞেস না করেও যা বুঝলাম তা হলো সোনাবন্ধু শাহ মার্কেটের কাঁচা বাজার সংলগ্ন তিন তলা একটি বানিজ্যিক ভবনের ছাদে প্রচুর ফুল ও ফলের নার্সারী জাতীয় বাগান। তার পাশেই একুশে সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফিস।
কুমারখালী সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কৃতি মানুষ তুষার আহমেদ রেজার পরিচালনায় এই ছাদ বাগান এবং তদসংলগ্ন অডিটরিয়ম মূলত কুমারখালীর সাহিত্য-সংস্কৃতির এক মিলনস্থান। গত চার-পাঁচদিন এখানে নিয়মিত এসেছি। এখানেই পরিচিত হয়েছি কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক, লিটন আব্বাস, পরিমল কুমার ঘোষ, মেহেদী হাসান, আবদুল্লা সাঈদ, রেবেকা সুলতানা, কবি ইঞ্জিয়ার রুহুল অাজম, তুষার আহমেদ মানিক প্রমুখ সাহিত্য ব্যক্তিত্বদের সাথে।
কবি শাহজাহান পারভেজ রনি আমার অনেকদিনের পুরানো বন্ধু। কবিতা অঙনে তিনি এক স্বতন্ত্র ধারার কবি। তার সাথে কয়েক বছর আগে পটুয়াখালী চৌরাস্তায় দেখা হয়েছিলো। তিনি তখন কুয়াকাটা থেকে ফিরছিলেন। ফেসবুকের সুবাদে এই কবির কবিতার আদ্যপান্ত আমার চেনা। জীবন ও জবানবন্দী, মায়াবী আফিম নামে তার দু’টি কাব্যগ্রন্থ আমি পড়েছি। শক্তিমান এ কবির একটি কবিতার ক’টি পঙতি এমন-
“এখন ময়দান ফাঁকা, চলো গপ-সপ করি
অথবা পুকুর থেকে তুলে এনে কাদা, রাজার মূর্তি বানাই
যেটা খুব সহজে করেন মলয় হালদার, তিনি শুয়োর আঁকেন
শুয়োরের মূর্তিতে আমি লেজ রাখি না
দুটো পা রাখি, দু পাটি দাঁত রাখি
তাঁকে বলতেই তিনি এঁকে ফেললেন শাসকের মুখ
যে মেধা বোমাতুল্য, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে –
এতোকাল যারা ভেড়া বানিয়ে রাখলো
বীরাসনে আজ তাদের হাতের আঙুলে পাঁচ পাঁচটা গোলাপ
এই তো সেদিন আষাঢ়ের মাঝামাঝি,
অথচ তোমাকে বললাম আমি
– এই নাও ভাই, এইটা পয়লা বৈশাখ।”
অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিলো খোলা আকাশের নিচে ছাদ বাগানে কিন্তু বৃষ্টির জন্যে ভেতরেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দু’দিন ধরেই এই মেঘ এই বৃষ্টি। সবাই ভেবেছিলেন শরতের বৃষ্টি খুব একটা সমস্যা হবেনা। কিন্তু আজ বৃষ্টিটা একটু ঝাঁকিয়েই বসেছে। আয়োজন তাই একুশের অডিটরয়মেই করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ইতোমধ্যে আমন্ত্রিত মেহমানরা চলে এসেছেন। সুলতানা, মারুফা আর সোহেলও এসেছেন। সুলতানা বললো-
এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? বললাম- সোনাবন্ধুর মাজারে গিয়েছিলাম।
আমাকে পেয়ে কবি শাহজাহান পারভেজ রণি, কিরন আকরামুল প্রমুখ সাহিত্যিক বন্ধুরা একেবারে হৈ হৈ করে মাতিয়ে তুললেন। রনি পেশায় একজন সরকারি চাকুরে। কিরণ আকরামুল হক একজন ব্যাঙ্কার। দু’জনই আমার প্রিয় মানুষদের তালিকায়।
একথা মোটেই বাহুল্য নয় যে কুমারখালী সাহিত্যের এক লীলাভূমি। পূর্বসূরীদের যোগ্য সন্তানরা নিরন্তর সাহিত্য সাধনা করে চলেছেন এখানে। যে সকল কবি সাহিত্যিকরা আজ এই সভায় আমার সম্মানে এসেছেন তারা যে একেকজন সুপ্রতিষ্ঠিত, বিদগ্ধ সাহিত্যিক এবং তাদের মাঝে আমি যে একেবারেই ক্ষুদ্র এক আনাড়িমাত্র তাতে আমার কোনই সন্দেহ থাকলো না। তবুও এইসব মানুষ আমাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন সাহিত্য প্রসঙ্গে আমার আলোচনা শুনলেন।
মূলতঃ আমিই মনযোগী শ্রোতার মতো কুমারখালী এবং কুষ্টিয়ার কবি সাহিত্যিকদের অমূল্য সাহিত্যালোচনা শুনছিলাম। তাদের আপ্যায়নে আমার মনে হয়েছিলো কুষ্টিয়ায় না এলে আমার জীবন বুঝি অসম্পূর্ণই থাকতো। এক চরম আনন্দঘন পরিবেশে অনুষ্ঠান শেষে আমরা যখন বেরিয়ে আসি তখন রাতের অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২৮
গাড়ির নাম তুহিন পরিবহন। কুষ্টিয়া বটতৈল থেকে সকাল আটটায় উঠতে হবে সে বাসে। আসার সময়ে এসেছিলাম রাজশাহীগামী আকিব পরিবহনে। সকালে কুণ্ডুপাড়া থেকে ইজি বাইকে চৌড়হাস তারপর ঝিনাইদহ সড়কে একটু এগিয়ে বটতৈল মোড়। সোহেল নিজের পকেটের টাকায় তিনটে টিকেটই কেটে এনেছেন। বহু চেষ্টা করেও তাকে সে টাকাটা দিতে পারলাম না।
বললেন- আপনাকে ভালোবাসি ভাই। এই সামান্য খেদমতটুকু করতে দিন। তার আচরণে মুগ্ধ হলাম। বললাম- গত এক সপ্তাহ তোমাদের এখানে যেভাবে থেকেছি মনেই হয়নি নিজের ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও ছিলাম। অপরিশোধ্য ঋনে আবদ্ধ করলে ভাই। সোহেল জিব কামড়ে বললেন- অমন করে বলতে নেই, কিছুই করতে পারিনি। তার আচরণে আমার ভেতরে অন্যরকম এক অনুভূতি হলো। মনে মনে বললাম- এইতো জীবন, এই ভালোবাসাটুকুর জন্যেই পৃথিবী এতো সুন্দর। বললো- এ লাইনে অনেক গাড়ি চলে কিন্তু তুহিনের সার্ভিস ভালো।
তুহিন পরিবহন ত্রিশ বছর আগেও ছিলো। এ পথে রাজশাহী যেতাম তখনও তুহিন পরিবহন কিন্তু সে ছিলো বরিশাল টু রাজশাহী আর এখন কুয়ায়াটা টু রংপুর পর্যন্ত। রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা গাড়িতে আমাদের সিট। অবাক হয়ে ভাবছি কীভাবে দেখতে দেখতে বাংলাদেশের দৃশ্যপট পাল্টে গেলো! ত্রিশ বছর আগে যখন কক্সবাজারে কিংবা দিনাজপুরে চাকরি করতাম তখন যেতে আসতে সময় লাগতো দু’দিন। এখন বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তে একদিনেই পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশের উন্নয়নটা গত পঁচিশ ত্রিশ বছরেই চোখের সামনেই ঘটে গেলো।
সকাল থেকেই মারুফার মেয়েটার মন খারাপ। তার মা বলেছে আগামী কাল তূর্য ভাইয়ারা চলে যাবে। বয়স মাত্র চার বছর, এরই মধ্যে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। পটুয়াখালীর কথা ভুলে সে এখন কুষ্টিয়ার ভাষায় কথা বলে। আজ সারাদিন আমার কাছাকাছি ঘুর ঘুর করেছে আর বলেছে- তোমাদের যেতে হবিনা। ভয় দেখিয়ে বলেছে, তুমি গেলে তোমাকে ভুতে খেয়ে ফেলবি।
আমি বলি-ভুত ডরাইনা। সে তার মায়ের মোবাইল দিয়ে মিছেমিছি ভুতকে কল দেয়। ভুতকে ডেকে বলে- আয়, আয় ভুত – তুই চলে আয়, বাদল আংকেলকে খেইয়ে যা, তূর্য ভাইয়ার ঘার মইটকে দে।
আমি ভয় পাওয়ার ভান করে বলি- আর তোমার আন্টি? সে বলে তোমাকে ভুতে খেলি পড়ে সে আর বাড়ি যেতে পারবিনানে।
তার বালখিল্যপনায় আমি হাসি। সুলতানা চুপিচুপি বলে- মেয়েটাকে এক সেট জামা কাপড় কিনে দাও।
মারুফারও মন খারাপ। বহুদিন পর বাপের দেশের মানুষ এসে এ ক’দিন থাকলো। সোহেল বারবার বলছে আর একটা সপ্তাহ থেকে গেলো পারতেন। ইচ্ছে যে আমাদেরও ছিলোনা এমন নয়, ইচ্ছে ছিলো আরও কয়েকটাদিন থাকি। করোনা মহামারীর জন্যে স্কুল বন্ধ। এমন দীর্ঘ বন্ধ সুলতানা গোটা চাকরি জীবনে পায়নি। তারও অন্তত পনেরদিন থাকার ইচ্ছে ছিলো। ইচ্ছে ছিলো টাগোর লজে যাবো, প্যারী সুন্দরীর বাড়ি যাবো। মেহেরপুর আম্র কানন দেখবো। মুজিব নগরে যাবো।
বললেই কী থাকা যায়? ঘর-বাড়ি খালি রেখে এসেছি সুতরাং থাকার উপায় নেই। ছোট মেয়েকে বাড়ির পাহাড়ায় রেখে এসেছিলাম তার নতুন চাকরি হয়েছে। অনতিবিলম্বে জয়েন করার নির্দেশ। পাশ করার পর জয়েন করেছিলো ইউনাইটেড হাসপাতালে। করোনা মহামারির কারনে স্বেচ্ছায় রিজেইন দিয়ে গত সাত মাস ঘরে বসে ছিলো। ক’দিন আগে ইউনিসেফের একটি প্রজেক্টে ভার্চুয়াল ইন্টারভ্যিউ দিয়েছিলো। সেখানেই জব কনফর্ম হয়েছে। পোস্টিং কক্সবাজার।
সে নার্সিংএ অনার্স কমপ্লিট করেছে আর্মি- এএফএমআই থেকে। ঢাকা ভার্সিটিতে সান্ধ্যকালীন এমপিএইচ পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ছাত্রী। গত সপ্তাহে একবারে চাকরি হয়েছে দু’টো। প্রথমটি কক্সবাজারে দ্বিতীয়টি টাঙ্গাইলের কুমুদিনী নার্সিং কলেজে। দ্বিতীয়টিতে জয়েন করার পরামর্শ দিয়েছিলাম কিন্তু প্রথমটির স্যালারী স্ট্যাটাস ভালো তাছারা দেশ বিদেশে ঘুরতে পারবে। তার ইচ্ছা সেখানেই জয়েন করবে। মূলতঃ মানসিকতার দিক থেকে সন্তানরা পেয়েছে আমার স্বভাব। কক্সবাজারের দৃষ্টি নন্দন লোকেশনের কারনেই তার এমন সিদ্ধান্ত। সৈকত দেখবে, পাহার, অরণ্য আর সেন্টমার্টিন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তার মা সুলতানা মন খারাপ করেছিলো আমি বললাম, ঠিকাছে যেতে চায় কক্সবাজারেই যাক। বলেছিলো- ওখানে আপনজন কে আছে? বললাম তবে গুরুদেবের ক’টি লাইন শোন-
“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া ॥
এই-যে বিপুল ঢেউ লেগেছে
তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,
সকল পরান দিক-না নাড়া ॥
বোস্-না ভ্রমর,
এই নীলিমায় আসন লয়ে
অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু মাখা হয়ে।
যেখানেতে অগাধ ছুটি
মেল সেথা তোর ডানাদুটি,”
এসব বলছি কিন্ত ভেতরে ভেতরে আমিও চিন্তিত হয়ে পড়েছি। তবে রবীন্দ্রনাথের কথাই ঠিক হলো। সেই কক্সবাজারে খোঁজ খবর নিয়ে পেয়ে গেলাম আপনজনদের। কক্সবাজার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি এ থিন রাখাইন আমার বন্ধু অং থানের বোন। তার হাসবেন্ড কে থিন রাখাইন লেখালেখি করেন, কক্সবাজার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। তাছাড়া কবি, নাট্য ব্যক্তিত্ব রওশন জান্নাত রুশনীর বাড়ি বাশখালী। তার ভাই কক্সবাজারে থাকেন। সেখানের ভন্তে বোদিয়ানাও একজন সাহিত্যিক, তিনিও আমার বন্ধু। কিন্তু এদের কারো কাছেই যেতে হয়নি। আমার বড় মেয়ের এক চাকমা বান্ধবীই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
সুলতানাকে বললাম-এবার বুঝতে পারলে? বললো- কী বুঝবো?
বললাম- ঐ যে “বুকের মাঝে বিশ্ব লোকের পাবি সাড়া? “
বললো- তবু, চারিদিকে কত ভয়ংকর ঘটনাবলীর কথা শুনি। আমার মন মানেনা।
হেসে বললাম- শোন, পৃথিবী নামক এই গ্রহ মানুষেরই জন্যে সৃষ্টি। অসুররা তাণ্ডব চালিয়েছে কিন্তু কখনওই টিকতে পারেনি। পৃথিবীর পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন মানুষ। অসুররা কখনওই মানুষের উপরে উঠতে পারেনা। ভয় পেওনা, ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে। তাদেরকে তাদের মতোই থাকতে দাও। ছোট্ট একটি জীবন যার যার মতো করেই বাঁচুক। কী বলেছি বুঝতে পেরেছো?
বলেলো- কেন পারবোনা? তিন যুগ তোমার সাথে থেকেও তোমাকে বুঝবোনা? তুমি যেমন বাঁধন হারা তোমার সন্তানরাও তাই হচ্ছে। বললাম হোক না। ক’দিনের দুনিয়া, কাটাকনা হেসে খেলে মনানন্দে!
গণমোড় কাপড়ের দোকান থেকে তানিশা, মারুফা আর সোহেলের জন্যে সামান্য কিছু উপহার সামগ্রী কিনে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। ফিরে আমি রীতিমত বিস্ময়ে অভিভূত। দেখি সোহেল আর মারুফা আমাদের সবার জন্যে বিশাল কেনাকাটা করে রীতিমত একটা লাগেজ তৈরি করে ফেলেছে। আমার জন্যে জুতা, লুঙ্গী থেকে শুরু করে সুলতানা তূর্য এমন কী আমার মেয়েদের জন্যেও বিশাল কেনাকাটা। দেখি স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই তৈরি হয়ে বসে আছে। বললো- চলুন পাশের বাসায় আপনার দাওয়াত।
পাশের বাসা বলতে দু’বিল্ডিং পর। কুমারখালীর গুলশান বলে খ্যাত এ কুণ্ডুপাড়া একটি অভিজাত এলাকা। মারুফার বাসার সামনে বিখ্যাত বুলবুল টেক্সটাইলের মালিকের বাড়ি। তার পরের বিল্ডিংএ দাওয়াত। সাথী বেগম নামে খুব মিষ্টি একটা ভাবী। সুন্দর পরিপাটি সংসার। অপু দীপু দু’ছেলে।
তাদের বাবার নাম গোলাম রসুল। তিনিও পল্লী বিদ্যুতের লোক। দু’দিন আগে ভাবী নিজে বাসায় আমাদের নেমন্তন্ন করে গেছেন।
নানান পদের রান্না, খেতে খেতে রাত দুপুরের কাছাকাছি। সুলতানা বললো- ভ্রমণকালীন সময়ে এখানের সবকিছু যেমন সুন্দর ও উপভোগ্য ছিলো। কিউট ভাবীটার এই পরিবারটিও ততোধিক সুন্দর ও পরিপাটি।
বললাম – একদম ঠিক বলেছো, ভাবীর বাবার বাড়িও কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে। মারুফা বললো – শশুরবাড়িও কাছাকাছি। বিদায় নিয়ে বললাম- আগামীকাল চলে যাবো দোয়া করবেন। বললেন- সময় নিয়ে আসুন, মেহেরপুরে আমার বাবার দেশে ঘুরে যাবেন।

আরশি নগরের পড়শি পর্ব-২৯ (শেষ পর্ব)
সুখের ক্ষণগুলো হয় খুবই সংক্ষিপ্ত। সুখ হলো চড়ুই পাখির মতো, ভালো করে দেখার আগেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। দেখতে দেখতে আমাদের সুখের ভ্রমণও শেষ হয়ে এলো, এবার সময় হলো ঘরে ফেরার। চলে যেতে হবে আরশি নগর ছেড়ে। পড়শিদের স্নেহের পরশ, ভালোবাসার ছোঁয়া পেছনে ফেলে কাল চলে যাবো। যে পড়শিরা আজীবন ডেকেছে আমায়, যাদের পদাঙ্ক খুঁজে খুঁজে অতীত করেছি আমার অনিরুদ্ধ যৌবনের কাল। রাত পোহালেই তাদের ছেড়ে যাবো। একথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ভোররাতে একটি স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি তানিশা আর তূর্য আকাশে মেঘের উপর দিয়ে উড়ছে। আমারও উড়তে মন চাচ্ছে কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পারছিনা। তানিশা খিলখিল করে হেসে বলছে- ও আঙ্কেল তুমিতো বড় মানুষ, বড়রা পারবেনা ছোট থাকলে পারতে। তার কথায় আমার খুব কান্না পায়, আমি কেন বড় হয়ে গেলাম? ছোট থাকলে যেমন ইচ্ছা চলা যায়। তূর্য-তানিশার মতো আকাশেও উড়া যায়।
স্বপ্নের মধ্যে আমার কান্না আসে, ঘুম ভেঙে যায়। মসজিদে তখন ফজরের আযান। দেখি ঘরশুদ্ধ সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসি রাস্তায়। গৌরি নদীর প্রেমে পড়েছি তাকে শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখতে চাই। গৌরি’র জলে না ভিজলে তীর্থ ভ্রমণ যে অপূর্ণ থেকে যাবে। সুতরাং বাসা থেকে বেরিয়ে মন্দির পর্যন্ত গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিতেই গড়াইয়ের মুক্ত প্রবাহ। এখানটায় এতোদিন আসিনি। দেখি চার পাঁজন বসতে পারে পৌরসভার ব্যবস্থাপনায় এমন সুন্দর একটি আসন পাতা রয়েছে।
দু’টি কিশোর নদীর জলে এই সকালবেলা মাছ ধরতে এসেছে। তাদের সাহায্য নিয়ে আমিও জলে নেমে পড়ি। দাঁড়িয়ে স্পর্শ নিই গড়াই নদীর। তাদের সাহায্য নিয়েই উঠে আসি। সকালের নির্মল হওয়ায় মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। আর একটু পরই রওয়ানা হতে হবে। মনটা কেমন যেন হু হু করে উঠলো, মনে হলো এমনি করেই অনাদি অনন্তকাল বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে মানুষ। কাজের ডাকে দেশ দেশান্তরে যাচ্ছে কেউ, কেউবা মৃত্যুর ডাকে শেষ বিদায় নিচ্ছে। মারুফার মেয়েটা রাতে মিছেমিছি ভয় দেখিয়ে বলেছে- আঙ্কেল যেওনা, গেলে ভুতে খাবে। সোহেল বলে আর ক’টা দিন থেকে যান, মারুফার চোখে মুখে বিস্বাদের ছায়া। কিন্তু আমাদের যেতে যে হবেই।
মারুফার মেয়েটির মতো রবীন্দ্রনাথের চার বছরের কন্যা শিশুটিও অমন করে বলেছিলো ‘যেতে আমি দিব না তোমায়।’ রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন-
“এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন–“যেতে নাহি দিব’। হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।”
তার পর বলেছিলেন এটাই সংসারের নিয়ম, কেউ কাউকে চিরতরে বেঁধে রাখতে পারেনা। সবাইকে যেতে হয়, অনন্ত-অসীমে সকলেই ধেয়ে চলে-
“চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।
প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
“দিব না দিব না যেতে’ ডাকিতে ডাকিতে
হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
“দিব না দিব না যেতে’– নাহি শুনে কেউ”
এসব ভাবতে ভাবতে বুকের গভীরে আটকে থাকা একটি দীর্ঘশ্বাস নদীর বাতাসে মিশে যায়। গড়াইয়ের তীরে সেই শরত প্রভাতে লিখে ফেলি বিদায় বেলা আমার অনুভবের কথা-
“সবশেষে বেজে ওঠে বিদায় বেহাগ
ফুল পাখি পরে থাকে মাঠির ধুলায়
প্রভাতি সূর্য মাখে অস্তমিত রাগ
বিদায়ের ক্ষণে সব আঁধারে হারায়।
যেপাখি শিখেছে উড়া, দূরে যায় চলে
অঙ্কুর উদ্গম তার সবুজের খেলা
উত্থিত ষোরশী বুক পড়ে যাবে ঢলে
চকিতে তাকায় নারী পরে এলো বেলা।
দখিনা মৌসুমী বায়ু উত্তরে ঘুরিয়া
বয়ে আনে জীর্ণতা দুঃখে ভরা দিন
দিনে দিনে সকলের বাড়ে শুধু ঋণ
শুধিবে কি মোহময়ী চলিছে উড়িয়া!
পরে থাকে ভালোবাসা বেশুমার খা’ব
খেরাজ খাতায় লেখা নিষেধ স্বভাব।।”
সুলতানা ফোন দিয়ে তাড়া দিলো। বললো, শীগগীর চলে এসো গাড়ি ধরতে হবেনা? তার ফোনে সম্বিৎ ফিরে পাই। বাসায় এসে দেখি সবার চোখে-মুখে বিস্বাদের ছায়া। বিদায় বেহাগের করুন সুর। বললাম- মন খারাপ করোনা। শীঘ্রই আবার আসবো। মারুফাকে বললাম-
সবার কাছেই বিদায় নিয়েছি, বাকী থাকলো তোমার অফিসের চায়না আপা ও মাসুমা আপা। সাইদ ভাই’র সাথেও আর দেখা হলোনা। তাদেরকে সালাম বলো। মারুফা বললো- তারা জিজ্ঞেস করেছিলো আপনা কবে যাবেন।
বললাম- তিনজনই অসাধারণ মানুষ। তোমার ভাগ্য ভালো যে, তাদের মতো সুন্দর মনের মানুষরা তোমার সহকর্মী। মারুফা বললো- আসলে কুষ্টিয়ার মানুষগুলো সত্যিই অন্যরকম।
বললাম- তাতো নিজ চোখেই দেখে গেলাম। এখানের মানুষ এতোটা অতিথিপরায়ণ না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। ভুলবোনা কখনও। মারুফার অফিসে একদিন মাত্র গিয়েছি কিন্তু ওই একদিনেই আমার দিল জিতে নিয়েছেন তারা। চায়না, মাসুমা আর সাইদ ভাই একদিন মাত্র দেখা কিন্তু তাদের আচরণে মনে হয়েছিলো আমি তাদের যেন কত জনমের আত্মীয়।
বিদায় নিয়ে আমরা গাড়িতে বসেছি। ওদের দিকে যেন তাকাতে পারছিলাম না। আমাদের নিয়ে থ্রি হুইলার ইজিবাক যখন ছুটতে শুরু করে তখন কাটায় কাটায় সকাল সাতটা।
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ছেড়ে যাচ্ছি লালনের আরশি নগর, পেছনে ফেলে যাচ্ছি পড়শীদের স্মৃতিময় কুমারখালী। মনে মনে বলি বেঁচে থাকলে আবার আসবো। বটতৈল পৌঁছে দেখি গাড়ি আসতে তিরিশ-চল্লিশ মিনিট দেরি হবে। দেখি কবি শাহজাহান পারভেজ রনি হাতে একটি খাবারের ব্যাগ নিয়ে তার মোটর সাইকেলে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন।
বললেন- করোনা মহামারী চলছে আমার বাসায় দু’জনার জ্বর। সে কারনে বাসায় নিতে পারলাম না। ব্যাগটি হাতে দিয়ে বললেন- স্বাস্থ্যবিধি মেনে এগুলো বাজারের দোকান থেকে কেনেছি।
হাতে নিতে নিতে বললাম- মনে রাখবো কমরেড।
আমাদের আলাপচারিতার মধ্যেই গাড়ি চলে এলো। রনি বললেন- আবার দেখা হবে…..
সমাপ্ত।
বটতৈল, কুষ্টিয়া
২৮/০৯/২০২০